Skip to content Skip to footer

Islamic Tradition

Islamic Tradition 
Dr. Uwaymir Anjum

ইসলামিক “ঐতিহ্য” কি? কেন এবং কিভাবে এটি অবহেলিত হচ্ছে? কেন এখনও আধুনিক বিশ্বে এটি প্রয়োজন? ইসলামে ঐক্য ও বহুত্বের মূল্য কী এবং কীভাবে এগুলোর জারি আর ভারসাম্য বজায় রাখা যায়? এই সিরিজের ছয়টি অংশে আমরা এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেবো।

Tradition Out of Vogue in the Modern World

আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত ঐতিহ্যের বাইরে

আমরা একটি আধুনিক বিশ্বে বসবাস করি, এখানে “আধুনিকতা” হচ্ছে “ঐতিহ্য”-এর বিপরীত। কিন্তু সবাই সমান আধুনিক নয়। অন্যভাবে বললে, যেহেতু ‘আধুনিক’ মানে কেবল “অদ্য হাজির” বা “সাম্প্রতিক”, তাই এছাড়া অস্তিত্ব রাখার অন্য উপায় নেই।  যেমন, গত তিন শতাব্দী ধরে, পশ্চিমারা মনে করেছে যে, তাদের “বর্তমানের” সাথে যদি তুলনা করা হয়, তবে তাদের “অতীত” অনন্য, ভাল এবং মহান ছিল (এবং অন্য সবার অতীত বা বর্তমানের তুলনায়) – এবং বিশ্বের পশ্চিমাকরণের মাধ্যমে এই গালগল্প সবার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

এটি এমন একটি গল্প যেখানে অ-পশ্চিমারা সাগ্রহে ধর্মান্তরিত হয়েছে, সেভাবে জীবনযাপনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখানে আমাদের সময়ের ট্রাজিক দ্বিধা হলো: যারা আধুনিক নয় তারা আধুনিক হতে গিয়ে মরছে ( কখনো কখনো আক্ষরিক অর্থেই আধুনিকদের হাতে), যেখানে আধুনিকরা নিজের জীবনকে খুঁজে ফিরেছে খণ্ডিত, শূন্য, বিভ্রান্ত, অসম্পূর্ণতা আশাহীনতার মাঝে। যেন সুসংগত গ্রহমন্ডল, এক অবিনাশী পাথুরে চোখে আধুনিকদের বলছে, আর উপেক্ষা করা কঠিন, সময় ফুরিয়ে এসেছে, তারা নিজেরাই নিজেদের অপচয় করে দিয়েছে।

যাইহোক, তার থেকে আসুন এই আহজারি করা বন্ধ করি, যে মুসলমানরাই প্রথম জাতি যে আধুনিক হয়ে ওঠেনি আর “প্রগতির” পথে যেতে পারেনি – বরং এর জন্য আমরা আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই। যদি শোকার্ত হবার কিছু থাকে, তবে তা হল আল্লাহর সাথে আমাদের ওয়াদা রক্ষা করতে, তার নেয়া পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করতে, কঠোর মেহনত করতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু এটা বিলাপ করার সময় নয় সময়টি বরং আন্দোলন করার, ফিরে আসার, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ-এ ইসলামকে নিয়ে পূর্ণতার সাথে বাঁচার সময়। এটাই সব ইসলামিক ঐতিহ্যের সারকথা!

এই প্রবন্ধে আমার উদ্দেশ্য হল মুমিন মুসলমানদেরকে, (এবং হ্যাঁ, আমাদের উলামা-দের এটা ইয়াদ রাখা প্রয়োজন!),  তাদের দক্ষতার স্তর পেশা বা আদর্শিক অনুপ্রেরণা যাই হোক না ক্যানো থেকে, ইসলামিক ঐতিহ্যকে গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো। যেখানে ইসলাম হাজির হয়েছে নবুয়াতি সিলসিলা উদ্দীপিত করে, এর মূল শরীয়াহকে, প্রফুল্লদায়ক গাম্ভীর্য এবং আনন্দদায়ক অঙ্গীকারের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করতে ,যা তার প্রাপ্য।

এমনকি, বেশিরভাগ দ্বীনদার এবং ধর্মভীরু মুসলমানরা, এমনকি “পন্ডিত” এবং সেলিব্রেটিরাও আজকের দিনে শরীয়াহ অনুসারে জীবনযাপন করতে ব্যর্থ হয়। কেবল ছোটখাট পাপ বা দোষ নয় ভেবে প্রতিনিয়ত সেই জীবনধারাই বেছে নেয় যা পরিহারযোগ্য-  শরীয়াহর অংশ হিসাবে যা কিছু জেনে এসেছে তার বিপরীত।

অবশ্যই, সত্যিকারের পণ্ডিতও আছেন, তবে তারা খুব খুব বিরল, যাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার আল্লাহর প্রেমময় ভীতি ও উৎকণ্ঠায়  প্রস্ফুটিত হয়েছে।

আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে তারাই তাঁকে ভয় করে যারা জ্ঞানী  [সূরা ফাতির, ৩৫:২৮]

আর যখন “ভাল” মুসলমানে পিছিয়ে পরে, তখন তারা বিভ্রান্ত ও দুর্বল চিত্তের লোকদের ন্যায় ইসলাম ও এর ঐতিহ্য থেকে আরও দূরে সরে যায়।

ইসলামী ঐতিহ্য, আমাদের ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন

 

মুসলমানরা মানব ইতিহাসের সমস্ত প্রচেষ্টার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ একটি মহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী – যার চূড়ান্ত লক্ষ্যে, যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। পাশাপাশি এই ঐতিহ্যের সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য এবং পরিশীলিততায়ও বিস্ময়কর।

খেয়াল করুন,  আমি ইসলামী ঐতিহ্যকে “মানুষের প্রচেষ্টা” হিসাবে উল্লেখ করছি-কারণ ইসলামী ঐতিহ্য বলতে আমরা প্রাথমিকভাবে আজকে কেবল ঐশ্বরিক কালাম-কুরআন এবং নবীর শিক্ষা- ইসলামের শাস্ত্রীয় গ্রন্থ হাদিসকে নয় বরং প্রধানত মুসলিম পণ্ডিতদের শিক্ষা এবং যুগে যুগে তাদের সিলসিলাকে বুঝি।

এই তফাতটি গুরুত্বপূর্ণ ,কারণ কেউ কুরআন এবং নবুয়াতি শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পর মুসলিম থাকতে পারে না-এবং এমন কোনও মুসলিম নেই যে ইসলামিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যগত শিক্ষার মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, অনেকে এই কিতাবি পাঠকে প্রশ্ন করে থাকেন।

বর্তমানে, অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অবশ্য মুখে স্বীকার করেন না যে, ইসলামী ঐতিহ্য তাদের কাছে মূল্যহীন। তাদের কাজে এটা বোঝা যায়। কেউ আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তাদের সন্ধান করতে পারেন। আপাতদৃষ্টিতে তারা চমৎকার নামধারী, ধার্মিক, মসজিদে যাওয়া, মসজিদ পরিচালনা করা মুসলমানদের একজন(কেউ কেউ এমনকি তাদের সন্তানদের কুরআন মুখস্ত করার জন্য জোর দিয়েছেন।) তবে মানব জাতির ভবিষ্যতের সমাধান হিসেবে ইসলামিক ঐতিহ্যের অধ্যয়ন বা বিকাশের জন্য তাদের সন্তানদের মনোযোগি করা, বিনিয়োগ করা, এগিয়ে নেয়াএবং উৎসাহিত করার তৈরির প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তাদের দায়বদ্ধতা শুন্যের কোটায়।

এবার আমার আলোচনাকে গুছিয়ে নিয়ে আসা যাক, প্রায়শই যখন আমি নিজেকে এমন একজন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেই যিনি ইসলাম শিক্ষা দেন এবং ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেন, তখন মুসলমানরা আমাকে আনুষ্ঠানিক সম্মান দেয়া শুরু করেন। কিন্তু নিজেকে হাজির করি এভাবে যে, আমি তো আলাদা কিছু করছিনা ।

যখন আমার সাথে আলাপকারীদের বলি যে, আমি পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা, কম্পিউটার বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং সামাজিক বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী, তখন তাদের চোখ বড় হয়ে যায় এবং আমাকে কখনও কখনও স্পষ্টভাবে বলাও হয়: “ভাই, আপনার আমাদের এটি বলা উচিত ছিল। আমরা তো ভেবেছিলাম ….” হ্যাঁ, আমরা সবাই এভাবেই মনে করি, বেশিরভাগই । এটি দুঃখজনক ব্যাপার।

ঐতিহ্যকে কিভাবে সম্মান করা যায়

 

আমাদের সময়ে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ধর্মীয় বিশৃঙ্খলার অন্তর্নিহিত সমস্যাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা জরুরী। মূল প্রশ্নগুলি হলো: মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থের বাইরে পূর্বপর ইসলামিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে কিনা? এবং যদি আছে মনে করি, তাহলে এই ঐতিহ্য শিক্ষার সঠিক উপায় কী? আমরা কি এটিকে জরুরী উদ্ধৃতি, গল্প এবং ব্যাখ্যার স্তুপ হিসাবে বিবেচনা করব? বা ইসলামিক ঐতিহ্যের মধ্যে থাকা অনেক গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মত, বাকিবের বাদ দিয়ে কেবল নির্দিষ্ট মাযহাবে নিজেদেরকে শামিল করবো? নাকি, অন্য কোন উপায় আছে?

আজকে অধিকাংশ মুসলমানই কুরআন সম্পর্কে জানে-যদিও খুব কম লোকই এটি বুঝতে ও উপলব্ধি করতে ইচ্ছুক। অথবা কেউ কেউ আগ্রহি হলেও-অনেকেই  হাদিস এবং সিরাহ (নবীর জীবন-কাহিনী) সম্পর্কে সামান্যই জানে। এক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী বোঝাপাড়া হতে পারে সঠিক রাহবার খলিফা এবং নবীর সাহাবীদের (আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন) জীবন ও অর্জন সম্পর্কে সচেতন হতে পারা।

মুসলমানদের জীবনযাপন এবং ইসলামকে বোঝাপড়ার জ্ঞানে আমাদের প্রায় ১৪০০ বছরের একটি ফাঁক রয়েছে । বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুমিন মুসলমানরাও যতটা সম্ভব সচেতন যে, দরকারে আমাদের জীবনের মূল্যে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাণ, যেমন, কুরআন ও সুন্নাহকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে ও জারি রাখতে হবে।

কিন্তু আজকে অনেকেই এমনকি সৎকর্মশীল মুসলমানও ভুলে গেছে যে, এই প্রাণকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অবশ্যই তার অঙ্গগুলিকে সংরক্ষণ করতে হবে যেগুলি থেকে প্রাণে রক্ত ​​আসে। অর্থাৎ আমাদের ইতিহাসে ইসলামের চৌদ্দ শতাব্দীর উত্তরাধিকার ইসলামী সিলসিলাকে উন্মোচন করার জন্য অবশ্যই এর সাথে সংরক্ষণ ও গভীরভাবে যুক্ত থাকতে হবে।

কুরআন সুন্নাহর সংরক্ষণকারীদের সংরক্ষণ করা

 

অবশ্যই, ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাথমিক কৃতিত্ব হল সময়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আল্লাহর বাণী, তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা এবং রসূলের সাহাবীদের আদর্শিক অনুশীলনকে হেফাজত  করা। আমি এটাকে ইসলামি ঐতিহ্যের প্রাণ বলছি।

পরবর্তী গুরুত্বপূর্ন দিক হলো, ইসলামকে জিন্দা রাখার প্রচেষ্টায় পরস্পরকে শিক্ষাদান, পথপ্রদর্শন ও সংশোধনের জন্য সর্বোত্তম বিশ্বাসীদের, প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রচেষ্টার নথি- নিদর্শন রাখা। ইসলামিক ঐতিহ্যের এই কিউরেটরদের মধ্যে রয়েছে ইসলামিক বিশ্বের জাতিগত ও ভাষাগত ক্যালিডোস্কোপ জুড়ে চৌদ্দশত বছর ধরে শ্রম দেয়া বিভিন্ন ধর্মীয় বিজ্ঞানের মুমিন মুসলিম মনীষী এবং তাদের সহযোগী এবং পৃষ্ঠপোষকরা ।

আমাদের ঐতিহ্যের হৃদয়কে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থানগুলি, যেমন ভাষা, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, কুরআন দ্বারা অনুমিত সমগ্র চিন্তা-জগত, এই সময়ের মধ্যে সংরক্ষণ এবং বিকাশ করা হয়েছে।

কেউ কেউ আপত্তি করতে পারে যে, আমাদের যা দরকার তা হল কুরআন এবং সুন্নাহ-। এভাবে ভাবা নিছক অজ্ঞতার লক্ষণ। কারণ, ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে সামান্য পরিচিত কেউ (বা জ্ঞান রাখেন এমন কেউ) জানে, আমরা প্রাথমিক পাঠ্যগুলির (কুরআনের/হাদিসের) ভাষাও বুঝতে পারি না।  এর উচ্চতর তাৎপর্য, শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা ব্যাখ্যা, আইনশাস্ত্র, হাদিস-সমালোচনা, ব্যাকরণ ইত্যাদি বিজ্ঞান কথা ছেড়েই দিলাম।

আমাদের ঐতিহ্যের হৃদয় সমুন্নত রাখা

উপরন্তু, পরিপক্কতা এবং অভিজ্ঞতাও সমস্যা আছে। আল্লাহ তার বার্তা দিয়ে যেমন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রথম অনুসারীদেরকে আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে জীবনযাপন করার অর্থ কী তা বোঝানোর জন্য পূর্ববর্তী “মুসলিম” উম্মতের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন, বিশেষ করে বনী ইসরাঈলদের সম্পর্কে।  তাই আমাদেরও শিখতে হবে যে আমাদের উম্মাহ অতীতে কীভাবে অগ্রসর হয়েছিলো, কিভাবে মুসলিমদের বিভিন্ন দল প্রায়শই কী কী উপায়ে ভাল করেছিলো এবং আমাদের কিভাবে সংশোধন করতে হবে।

ঐশ্বরিক বাণীর সঠিক অর্থ এবং তাৎপর্য বোঝা আর তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সমৃদ্ধ এবং কঠোর সংগ্রাম অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাইর ও ভিতরের চ্যালেঞ্জগুলি থেকে একে রক্ষা করাও জরুরী। অতীতে, বিদেশী চ্যালেঞ্জ রুখে দেয়া এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সমাধান করা স্বাভাবিকভাবেই স্থায়ী মতবিরোধের দিকে নিয়ে গিয়েছিলো। যার ফলে ইসলামী ঐতিহ্যের মধ্যে বিভিন্ন স্কুল এবং সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই “ইখতিলাফ” বা বিচ্যুতির প্রতি আমাদের মনোভাব হল, এগুলো নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরীক্ষার অংশ যা আল্লাহ মুমিন হিসেবে আমাদের জন্য রেখেছেন।

বর্তমানের মুসলমানদের দ্বারা ইসলামী ঐতিহ্যের অবহেলাকে চিহ্নিত করা

মোদ্দা কথা হল ইসলামকে আন্তরিকভাবে যাপন করার থেকে বলা অনেক সহজ। তাই আমি আজ মুসলমানদের পক্ষ থেকে ইসলামী ঐতিহ্যকে ব্যাপকভাবে অবহেলার দুটি প্রধান কারণের দিকে মনোযোগ দিতে চাই।

প্রথমত,  প্রাথমিক কারণের মধ্যে রয়েছে যাকে আমি বলি নিশাপুর এবং উমাইয়া সিন্ড্রোম, ইসলামিক ঐতিহ্যের দুটি অভ্যন্তরীণ শত্রু। নিশাপুর সিন্ড্রোম হল ঐতিহ্যের মধ্যে ব্যাপক মতবিরোধ যা প্রায়শই ধর্মান্ধতা সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যায়। উমাইয়া সিনড্রোম হল সঠিক বিশ্বাস, মূলনীতি এবং সীমার প্রতি মনোযোগ না দিয়ে ঐক্য বা সম্প্রীতির জন্য শূন্য আহ্বান।

ইসলামিক ঐতিহ্যের প্রতি মুসলিমদের অবহেলার দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল আধুনিকতা এবং “প্রগতি”র অলীক মুখোশ, যার সাথে কেবল ইসলাম নয়, বিজ্ঞান ও যুক্তির সম্পর্কও বিরোধাত্বক। এই শেষ দুটি, বিজ্ঞান এবং যুক্তি-যখন সঠিকভাবে বোঝা যায়-ইসলাম আমাদেরকে গ্রহণ করার আহ্বান জানায়।

Islamic Tradition (2) | The Nishapur and Ummayyad Syndromes | Dr. Uwaymir Anjum

২য় অংশে আমরা, ইনশাআল্লাহ, কেন ইসলামী ঐতিহ্য উপেক্ষিত হয়েছে সেই কারণগুলো অনুসন্ধান করবো।

Part 2

“আমাদের ঐতিহ্যের হৃদয়” যে সকল সংরক্ষণকারী,পৃষ্ঠপোষক এবং সমর্থক হিসাবে এবং তাদের প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম এবং লেখাগুলি যা কুরআন ও সুন্নাহর প্রেক্ষাপট, অর্থ এবং উপলব্ধিকে সংরক্ষণ করেছে- তাদের অনুসরণ করে আমরা কেনো ইসলামী ঐতিহ্য অবহেলিত হলো তার কারন অনুসন্ধান করবো।

 

প্রথম বাধা: নিশাপুর এবং উমাইয়াদ সিনড্রোম

নিশাপুর

 নিশাপুর- উত্তর-পূর্ব ইরানে কৌশলগত তাতপর্যপূর্ন চীনের পুরানো সিল্ক রুটে অবস্থিত –  প্রকৃতপক্ষে, বিশ্ব – ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ ইসলামী শতাব্দী (১০ থেকে ১২ শতাব্দী) পর্যন্ত  এটি ছিলো ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ মহানগর। পরে যা হানাফীদের এবং শাফিদের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। ( দেখুন- রিচার্ড বুলেটের দ্য প্যাট্রিশিয়ানস অফ নিশাপুর, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭২-এ আল-হাকাম আল-নায়সাবুরিস, তারিক নাইসাবুর দেখুন)।

অবশ্যই,  হানাফী ও শাফেঈদের মধ্যে ফিকহী মতপার্থক্যের চেয়ে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষই অনেক বেশি ছিল।  কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো এই যে, কঠিন মুহুর্তে উম্মাহর ঐক্যের পরিবর্তে, আল্লাহ ও তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীর তাফসীর হয়ে উঠেছিলো সংকীর্ণ স্বার্থবাদি পরিচয় তৈরীর উৎস।

নিশাপুরের এই দুর্দশা, দুর্ভাগ্যবশত, ইসলামের ইতিহাসে ব্যতিক্রম কিছু নয়। নিয়মিতভাবেই এর পুনরাবৃত্ত হয়েছে – যাকে “নিশাপুর সিনড্রোম” নামে আখ্যা দেয়া যায়। তবে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় অংশে আজকের জাহেলী গোষ্ঠিবাদীতা অতীতকেও ছাড়িয়ে গেছে।

এটিকে ‘নিশাপুর সিন্ড্রোম’ বলার উদ্দেশ্য হল, আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া যে সমস্যাটিকে কেবল আধুনিকতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায়না বরং এটি এক কিসিমের গোষ্ঠিবাদীতার পরিণতি, ফিকহি বা ধর্মতাত্ত্বিক গোষ্ঠী যে নামেই হোক না কেন, তা বিপর্যয়কর হতে বাধ্য।

যেহেতু আমি ইসলামী ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার ওকলাতি করছি, তাই আমি ঐতিহ্যের প্রতি সংকীর্ণ মানসিকতা এবং অন্ধ অঙ্গীকারের সবচেয়ে জঘন্য বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরে জোর দিয়ে বলতে চাই যে, এই ধরণের ভুল আখ্যা দেয়া এই ধরনের “ঐতিহ্যবাদ”-এর বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং নির্মূল করা দরকার। কিন্তু, এদিকে আবার, ‘বাচ্চাকে গোসলের নামে গরম পানিতে ঢুবিয়ে দেয়াও’ তো একটি দুঃখজনক ভুল হবে।

উমাইয়াগন

উমাইয়া সিনড্রোম হলো আবার নিশাপুর সিন্ড্রোমের বিপরীত। নিশাপুর সিনড্রোম যদি মেকি তাত্ত্বিকতার মিনারে উম্মাহ এবং তার সম্মিলিত স্বার্থকে জবাই করা হয়, তবে উমাইয়া সিনড্রোম হল ঐক্য, প্রতিরোধ বা অন্যান্য রাজনৈতিক স্বার্থের টেবিলে ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গীকারগুলিকে কতল করা।

খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসন শেষ হওয়ার পর উমাইয়ারা প্রায় এক শতাব্দী, ৪১ থেকে ১৩২ হিজরি পর্যন্ত মুসলিম বিশ্ব শাসন করে। এটি খলিফা মুয়াবিয়ার তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ অথচ আপোষকামী রাজত্বের সাথে শুরু এবং খিলাফা-ব্যাপী গোলাযোগের সময়ের আব্বাসিদের দখলে নেয়ার মধ্যে শেষ হয়েছিলো। তবে এর মধ্যেও, কিছু ন্যায়বান ধার্মিক শাসক ছিলেন, সর্বোপরি, পঞ্চম সৎ-নির্দেশিত খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজিজ (র) এর কথা উল্লেখ করা যায়।

উমাইয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠরা যদিও ধর্মহীন ছিল না, তাদের উদ্বেগ ছিলো “ঐক্য” নিয়ে যা মুসলমানদের রাজনৈতিক উচ্চতায় পৌছানো এবং ইসলামী খেলাফতের চলমান সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু তারা এর জন্য শুরা (পরামর্শ), মুসাওয়া (সমতা), আদল (ন্যায়বিচার), তাকওয়া (তাকওয়া) এবং অন্যান্য মূল্যবোধ (কিয়ম) এর মূল ইসলামী নীতিগুলিকে ত্যাগ করতে রাজি ছিল।

শাসকবংশীয়দের দ্বারাবিরোধী নিপীড়ন

উমাইয়ারা “ধর্মীয়” খলিফা ছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন তাদের সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত আইনবিদ। কিন্তু তাদের খোদাভীতিতে সুস্পষ্ট ঘাটতি ছিল। তাদের শাসনের অধীনে মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্য ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীদের পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্য অনেক ধার্মিক আপত্তিকারী ও সমালোচকদের নিপীড়নের ন্যায্যতা দানের হাতিয়ার।

একটি শক্তিশালী রাজবংশীয় শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য তারা শু’রা ত্যাগ করেছিল। কিন্তু খিলাফতকে রাজত্বে পরিণত করা মুসলমানরা সহজে নেয়নি। উমাইয়া যুগের ইতিহাস বিদ্রোহে ভরাপুর, তাদের ৯০ বছরের শাসনামলে প্রায় এক ডজন প্রধান বিদ্রোহ হয়েছে, যার বেশিরভাগই শু’রার নামে এবং শুরুর খিলাফত ফিরিয়ে আনার দাবিতে। সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আল-জুবায়ের বিদ্রোহ করে খিলাফত দখলে করতে প্রায় সফলই হয়ে গিয়েছিলো।

অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলি থেকে বিভ্রান্ত করার অংশ হিসেবে এবং ইসলামের প্রথম যুগের খলিফাদের গুণাবলী পরিত্যাগ করাকে ন্যায্যতাকে প্রদানের নিমিত্তে উমাইয়ারা ক্রমাগত সম্প্রসারণবাদী জিহাদ চালিয়েছিল । উমর ইবনে আবদুল আজিজ যখন ৩০ মাসের জন্য ক্ষমতায় আসেন, তখন তার প্রথম আদেশের মধ্যে একটি ছিল রক্তাক্ত বাইজেন্টাইন সীমান্ত থেকে মুসলিম সেনাদের প্রত্যাহার করা এবং শুরা (পরামর্শ), মুসাওয়া (সমতা) এবং আদলের (ন্যায়) মত ইসলামী মূল্যবোধের নিকট ফিরে আসা।

সীমানাকে সম্মান করে আমাদের ঐক্যের ভারসাম্য বজায় রাখা

গত শতাব্দীর অনেক মুসলমান, ঐতিহ্যগতভাবে ধর্মীয় গোষ্ঠিবাদীতার উপর হতাশ হয়ে, ঐক্য ও রাজনৈতিক সুবিধার নামে মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে সমস্ত ঐতিহ্যগত বিরোধকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। এটি একটি ন্যায়সঙ্গত অবস্থান বটে। মুসলমানদের ঐক্য নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। কিন্তু অবশ্যই এটি সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বা গুরুত্বপূর্ণ, বিবেচনাকে উপেক্ষা করার অজুহাত হয়ে উঠতে পারে না।

ইসলামে ইমামদের মধ্যে সকলেই ঐক্যের উপর জোর দিয়েছেন (তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট শাইখ আল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, যিনি সমস্ত মুসলমানদের একত্রিত করার জন্য তাঁর বিশেষ উদ্বেগের জন্য সুপরিচিত) তবে তাদের কেউই একটি সারশূন্য ঐক্য জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং আইনগত ভাবনাকে পরিত্যাগ করেননি। ।

একইভাবে, ইমাম আল-গাজালি-যিনি বিভিন্ন ব্যাখ্যার সহনশীলতাকে একটি সীমায় উন্নীত করার জন্য ফয়সাল আল-তাফরিকা রচনা করেছিলেন-সেই ফালাসিফা (দার্শনিক) এবং বাতিনি (গায়েবি) সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যখন এসব গোষ্ঠি সহনশীলতার সমস্ত সীমানা অতিক্রম করেছিল।

শেষ পর্যন্ত, উমাইয়াদের এই ঝোক বিরাট ক্ষতি করেছিল, যার মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে শুরা এবং মুসাওয়া (সমতা) পরিত্যাগ করা এবং আল্লাহর নবীর নাতির শাহাদাত অন্যতম।

একইভাবে,তখন থেকে অদ্যবধি যারা পার্থিব সুবিধার স্বার্থে সত্যের মূল্যকে ক্ষুণ্ন করে এবং ফলস্বরূপ বড় ক্ষতির কারন হয় উমাইয়া সিনড্রোম সুবিধাবাদীদের সংক্রমিত করে চলছে।

চ্যালেঞ্জ হল ইসলামী ঐতিহ্যের একটি মধ্যম পথ খুঁজে বের করা যা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা এবং একতা উভয়কেই এড়িয়ে যায় যা মুসলিমদের তাদের সংজ্ঞায়িত মূল্যবোধ ও নীতির প্রতি সাহসী করে।

Islamic Tradition (3) | Modernity | Dr. Uwaymir AnjumPart 3

আমরা আলোচনা করছি কি কারনে ইসলামী ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করা হয়েছে, বিশেষ করে গত কয়েক শতাব্দীতে। প্রথম বাধা (পর্ব ২) কিছু জায়গায় কাণ্ডজ্ঞানহীন গোষ্ঠিবাদ (“নিশাপুর সিন্ড্রোম”) এবং অন্যান্য জায়গায়, আবার এটি হয়েছে রাজবংশীয় শাসনের স্থিতিশীলতার জন্য ইসলামী মূল্যবোধের বলিদান (“উমাইয়া সিনড্রোম”)। একই সিনড্রোম আজ প্রাসঙ্গিক।

দ্বিতীয় বাধা: আধুনিকতা

দুনিয়ার কেন ইসলামী ঐতিহ্যের প্রয়োজন

অসংখ্য কারনে আমি বিশ্বাস করি-বিশ্বে কেন দুনিয়ার ইসলামী ঐতিহ্যের প্রয়োজন কেনো, তার কারন—বা ন্যায্যতার তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম নয়।

এটি হলো,মানুষকে যুক্তি দিয়ে কেনো শ্বাস নেওয়া চালিয়ে উচিত তা বোঝানোর চেষ্টা করার মতো। কোনও সাধারণ ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম করার চেষ্টা করবে না-এবং প্রচণ্ড গা-জোয়ারি মন মারজি ছাড়া কাউকে শ্বাস নেওয়ার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ইসলাম হল জটিল চিন্তা না করে, মুসলমানরা অতীতে কীভাবে জীবনযাপন করেছে এবং আজ অবধি বাতাসে পাখির মতো বা জলে মাছের মতো জীবনযাপন করে চলছে, তা বোঝা।

অধিকাংশ মুসলমানরা ইসলামের শুরুর দিনগুলোতে ভাবনা চিন্তার থেকে বরং  ইসলামিক ঐতিহ্যের  মধ্যেই চিন্তা এবং কাজ করত

তাহলে এটা নিয়ে কথা বলার দরকার পরলো কেন? কারণ “বায়ু” এবং “জল” এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। চিন্তা না করে শ্বাস নেওয়া, পান করা এবং সেবন করা (আক্ষরিক এবং রূপকভাবে উভয়ই) আমাদের সকলকে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসবে। এটা বিস্তারিত বলছি–

আমরা আজ একটি আলাদা দুনিয়ায় বাস করি। গত দুই শতাব্দী ধরে, মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তনের গতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আমাদের পৃথিবী স্থির “নতুনত্ব”-আধুনিকতার এই সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে—কিছু ক্ষেত্রে আগের পাঁচ হাজার বছরের চেয়েও দ্রত।

নিত্য ধ্রুব পরিবর্তনের সূচনা

এই পরিবর্তনটি পশ্চিমে শুরু হয়েছিল এবং শুধুমাত্র বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত অগ্রগতি, ভৌত আবিষ্কার এবং সৃষ্টির মহান শক্তিগুলির কিছু কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেই নয়,- ত্রিমাত্রিক ঔপনিবেশিকতা, পুঁজিবাদ এবং আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সাথেও এটি সম্পর্কিত।

জানার ও বোঁঝার উন্নত অবস্থার পথে ধারাবাহিক পরিবর্তনের তথা ‘প্রগতি’র ধারণাটি তাতপর্যপূর্ণভাবে কাল্পনিক। যদিও এটা ক্রমাগতভাবে শর্ত এবং কাম্য হয়ে উঠেছে।

মানুষের বেঁচে থাকার (আধুনিক চিকিৎসা) এবং প্রকৃতির শক্তিকে চালিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান, এবং বৃদ্ধিকে অস্বীকার না করেই, মানবতা আজ উপলব্ধি করছে যে আধুনিকতা আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ধ্বংসের জন্ম দিয়েছে শোষণ

পৃথিবীর সম্পদের সম্পূর্ণ উন্মাদ শোষণ এবং আধুনিক, পুঁজিবাদী শক্তির দ্বারা সৃজনশীল ভারসাম্যকে একযোগে ধ্বংসযজ্ঞতা, গত শতাব্দীতে এক ধ্বংসাত্মক জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করেছে, যতদূর বিজ্ঞান আমাদের আভাস দিচ্ছে, যা এখন পরিবর্তনঅযোগ্য।

অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চেয়ে আরও ভয়াবহ , বিশেষভাবে পুঁজিবাদ এবং তার প্রভাব, এগুলো আধুনিকতার সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে এতটাই খোদাই করে দেয়া হয়েছে যে, একে একে নির্মূল না করে আধুনিক রাষ্ট্রর মত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানকেও পূর্বদশায় ফেরত নেয়া সম্ভব না। 

ঘটনাক্রমে, আধুনিকতার এসব সুপারিশ এসেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সর্বাধিক বস্তুগতভাবে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির অগ্রগণ্য বিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদদের থেকে । (উদাহরণস্বরূপ, জেমস স্পেথের দ্য ব্রিজ এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ডের কথা বিবেচনা করুন)।

যদি কেউ বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা- যা তাদের অনিবার্য ফলাফলের দিকে তাকিয়ে এটা বিশ্বাস করে যে দুনিয়াকে বাচানোর একটা উপায় হয়তো আছে। তবে এটি আজকের দিনে অনেক আশাবাদের (আসলে, এটি নিছক বিশ্বাসের ব্যাপার) বিষয় হতে পারে।

ভঙ্গুর বিশ্বকে “আধুনিকীকরণের” চাপ

ইসলামী ঐতিহ্যের কথা বলার সময় আধুনিক সভ্যতার এই করুণ এবং খুব সম্ভবত এর শেষ, স্মরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সত্য হল যে, মুসলিম সংস্কারক, সাধারণ মুসলমানসহ ইসলামী ঐতিহ্য পশ্চিমের মানদণ্ডের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।

আগামী কয়েক দশকে, পৃথিবী অনিবার্যভাবে একটি খুব ভিন্ন স্থান হবে। জলবায়ু, বেদখল এবং দরিদ্ররা, তাদের নিজস্ব অদম্য যুক্তি অনুসারে, পৃথিবীর ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করার জন্য প্রতিশোধ নিতে বা এটিকে আরও খতরনাক জোট বাধবে ।

এখন, বিশেষ করে পশ্চিমা মুসলমানদের জন্য- যারা এই জটিলতার মধ্যে এবং শক্তিশালী অতিথি সংস্কৃতির মানদণ্ডে ক্রমাগত  জাজমেন্টের অধীনে বাস করে- তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য বিচার-বিবেচনা, সংস্কার এবং আধুনিকীকরণে তাদের প্রচেষ্টাও, একইভাবে অবিরাম চলছে, আর অনিবার্যভাবে এর চাপগুলি অনুভব করছে৷

পশ্চিমা মুসলমানরা কদাচিৎ উপলব্ধি, বা উচ্চস্বরে বলার সাহস পায় যে, তারা নিরলসভাবে নিজেদের ধারন করে চলছে এমন একটি সভ্যতার বিপরীতে যা বিভ্রান্তির ফলে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, আর বিশ্বকে একটি করুণ, বিপুল আত্মহুতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

Contentment with Little vs. Catastrophic Reset of the Balance

কিন্তু মানবতার অধঃপতনের, স্রোতের সাথে চলা ভেলার মত জলবায়ু পরিবর্তনের অকাট্য বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিতগুলি, পারমাণবিক বিপর্যয়, যুদ্ধ আর কতৃত্ববাদের ন্যায্য ভয়ের মধ্যেই,  আশা এবং জীবনযাত্রার একটি নতুন উপায় খোজার প্রয়োজন আছে।

তদুপরি, সেই পথ যাই হোক না কেন, এর মূলে থাকতে হবে, সামান্য নিয়ে সুখীভাবে বেঁচে থাকার বিশ্বাস এবং তাই, একটি অপরিহার্য উপলব্ধি: যে এই পৃথিবীর কখনই স্বর্গ হওয়ার কথা ছিল না এবং হবেও না, অনন্ত জীবনও হবে না। অথবা মানুষের বিবর্তন এবং জীবন একটি অতিক্রান্ত শারীরিক-আধ্যাত্মিক অবস্থায় কখনও পার্থিব মানব অবস্থার অংশ ছিলোনা।

জীবনযাপনের এমন একটি নতুন পদ্ধতি, যা  সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল এবং এই দুনিয়াবি জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং চেষ্টা প্রকৃতি বোঝার উপর নির্ভর করে, সর্বক্ষেত্রে এটি আধুনিক জীবনের ঠিক বিপরীত।

The Blessing of Islamic Tradition

তবু আমি বিশ্বাস করি ইসলামী ঐতিহ্যে স্পষ্টতই এই সম্পদ মজুদ রয়েছে ।  দুনিয়ার যা প্রয়োজন এবং মানবতা যার জন্য হাহাকার করছে তার জবাব দিতে বিশেষভাবে নির্মান করা হয়েছে তাকে। এই চিৎকার- হাহাকারের জোর আরও বাড়বে এবং আগামী দশকগুলিতে এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি অনুভূত হবে।

আমি বলছিনা যে ইসলামকেই প্রাথমিকভাবে জাগতিক সংকটের সমাধান হিসেবে মনে করি। ইসলামকে শুধুমাত্র দুনিয়াবি সাফল্যের হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না, করা উচিতও নয়। এটা একটা ধর্ম। এইভাবে আল্লাহ আমাদের যে পার্থিব রহমত দান করেন, তিনি আমাদের যে ভারসাম্য শিক্ষা দেন এবং  আমাদের যে রাহবার দিয়েছেন তা কেবলমাত্র তাঁর প্রতি আন্তরিক ভক্তির মাধ্যমেই পূর্ণতা লাভ করতে পারে।

তবুও মানুষ স্বভাবতই সত্য,সত্যের দ্বারা প্রলুব্ধ হওয়ার জন্য খুব অদূরদর্শী। এ কারণেই আল্লাহ কোনো জাতিকে তার বাণী পাঠানোর আগে নাড়া দেন।

“ এবং এখনও পর্যন্ত আমরা কোন সম্প্রদায়ের কাছে এমন কোন নবী প্রেরণ করিনি যে তার লোকদেরকে দুর্ভাগ্য ও কষ্টের মধ্যে পরীক্ষা করিনি, যাতে তারা নিজেদেরকে বিনয়ী করে। অতঃপর আমরা দুর্দশাকে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যে রূপান্তরিত করেছিলাম, যাতে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং বলেছিল: “দুর্ভাগ্য এবং কষ্ট আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্যও ছিল” – তখন আমরা তাদের অজ্ঞাতসারে, হঠাৎ করে তাদের আটকে নিয়েছিলাম। কি আসছিল]। [সূরা আল আরাফ, ৭:৯৪-৫]”

Crisis As “Blessing in Disguise”

আমেরিকান মুসলমানদের জন্য, এই আয়াতের সত্যতা একটি সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার ফল। এটা নিছক কাকতালীয় নয় যে শতাব্দী ধরে আমাদের কালো ভাই, ক্রীতদাস, অপমানিত হয়ে, এবং লঙহিত হইয়েছে তারাউ আমেরিকাতে প্রথম ইসলামে ছায়াতলে ফিরে এসেছিল।

এ কারণেই, আমার ধারনা আমেরিকার  কারাগারে বন্দী থাকাকালীন লোকেদের ইসলামে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ তাদের জীবন সংকটে পরে, এবং বৈশ্বিক চাহিদার চাপ থেকে তারা এক ধরনের নির্জনতায় পরিণত হয়।

অবশেষে যখন তারা পৃথিবী এবং নিজেদেরকে পরীক্ষা করার সময় পায়, যুক্তি দিয়ে, পুনর্বিবেচনা এবং নিজেদের চিন্তা শোনার সময় পায় – এবং যখন তারা ভারসাম্য, আশার এবং সর্বোপরি চূড়ান্ত করুণা, ন্যায়বিচার এবং বিজয়ের অন্য উপায় সম্পর্কে সচেতন হয় -তারা একটি তৃপ্ত শান্তিতে আশ্রয় নেয় যার নাম “ইসলাম”।

আমার মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আমরা এখন একই অবস্থা ও সুযোগ পেয়েছি। অতএব, বর্তমান সংকট, পরিবেশগত বা অর্থনৈতিক, যদিও গুরুতর এবং দুঃখজনক, তবে এটা ছদ্মবেশে আশীর্বাদও হতে পারে। আধুনিকরা, সাধারণত ঈশ্বর এবং দুর্বলদের বিরুদ্ধে প্রতাপশালী হবার ভান ধরছে, কিন্তু ভেতরে ক্রমবর্ধমান নম্র হচ্ছে, কাঁপছে, বিকল্প খুঁজছে।

Daʿwah in Modern Society

তাহলে, আমরা আর কতদিন, “মানবজাতির সাক্ষী” হয়ে বিভ্রান্ত, ক্ষমাপ্রার্থী এবং নীরব থাকব? আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ে, বিশেষ করে পশ্চিমে আছি, আমাদের সহকর্মী ও প্রতিবেশীদের জন্য এই প্রধান সুযোগে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে বুঝতে হবে। আমাদের দায়িত্ব সেটাই যা নবীদের ছিলো, জাগ্রত ও সতর্ক করা।

Part 4

গত পর্বে আধুনিকতার চাপে সাম্প্রতিক শতাব্দীতে উপেক্ষিত ইসলামিক ঐতিহ্য কীভাবে আমাদের রহমতপূর্ন ইসলামিক চর্চা ফিরিয়ে ক্ষমতা রাখে তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম।

The Second Obstacle: Modernity (continued)

The Dynamism of the Islamic Tradition

প্রথমত, আমাদের স্মরণ করা উচিত যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই উম্মাহকে পথ দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এভাবে ইসলামের উম্মাহ সকল ভ্রান্তি থেকে হেফাজতে থাকবে এটি আহলে সুন্নাহর আকীদগত বিশ্বাস। কিন্তু এই নির্দেশিকাটি আমর বিল-মারুফ এবং নাঈ আনিল-মুনকারের (সঠিক বিষয়ের আদেশ এবং অন্যায়কে নিষেধ করা) দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল।

উম্মাহর এই ক্রমাগত দিক নির্দেশনার জন্য বহুল পরিচিত প্রমাণ হিসাবে, সে যুগের মুসলমানদের সময় থেকে প্রাথমিক প্রজন্মের  সহি রাস্তা সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার জন্য, পঞ্চম খলিফা ‘উমর ইবনে আবদুল আল-আযীয, ইমাম মালিক এবং আল-শাফী এবং অন্যান্যদের দ্বারা, নিম্নলিখিত আয়াত থেকে এই আয়াতকে তুলে দেয়া হয়েছে:

যে কেউ রসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে, তার কাছে সরল পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সব মুসলমানের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ঐ দিকেই ফেরাব যে দিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা কতই না নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান। [সূরা আল-নিসা, ৪:১১৫]

এই মতবাদটি সামগ্রিকভাবে মুসলিম উম্মাহর কাছে ইজম বা ভুলের হেফাজত হিসেবে পরিচিত, এবং এটি মুসলমানদের কাছে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে পরিচিত ইজমার (ঐক্যমত্য) নিষ্ঠার ভিত্তি স্বরূপ।

How Do We Know That We Have Not Gone Astray?

যাইহোক, উম্মাহর বিপথগামী হওয়া থেকে সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থার প্রশংসা খুব কমই করা হয় তা হল। যেহেতু-ইসলামে-নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে আর কেউই নির্দোষ নয়, তাহলে আল্লাহ কীভাবে উম্মতকে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করবেন? এই প্রশ্নে, শাইখ আল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়া- আহলে সুন্নাহর মতবাদের সবচেয়ে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে যে, উম্মাহকে হেফাজতের রাস্তা হল সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করা।

এবার এই প্রক্রিয়াটি বাস্তবয়নের কিছু চিত্র আঁকা যাক। পারস্পরিক সংশোধনের এই প্রক্রিয়া, যা কেবল ব্যক্তিগত স্তরেই ঘটে না, বরং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে সামষ্টিক স্তরেও সংঘটিত হয়। সংশোধনের প্রক্রিয়া এক গোষ্ঠীর মুসলমানদের দ্বারা অন্য অঞ্চলের মুসলমানদের, এক সম্প্রদায়ের চিন্তাধারা অন্য সম্প্রদায়ের এবং এক ধরণের ইসলামের এখতিয়ার দ্বারা  অন্যদের, এবং এভাবে সিলসিলা চলতে থাকে।

নিশ্চিতভাবে ইসলামী ঐতিহ্য হলো,প্রথম যুগের মুসলমানদের (বিশেষ করে কুরআনের তাৎক্ষণিক শ্রোতা) দ্বারা শাস্ত্রীয় গ্রন্থের সঠিক ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগের নথিই নয়,বরং পরবর্তী প্রজন্ম এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ ও ধার্মিক কাজগুলিরও নোকতা রাখা। পাশাপাশি মুসলমানদের দ্বারা শাস্ত্রীয় গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা এবং অপপ্রয়োগের হিসাব এবং আমাদের পূর্বসূরিদের বুদ্ধি ও অনিচ্ছাকৃত ভুল, বিচ্যুতি এবং জটিল ভুল পদক্ষেপের হদিস করা।

যেহেতু – মৌলিক এবং সম্মত বিষয়গুলির বাইরে – আমরা জানি না ঠিক কে সঠিক ছিল, তাই শাস্ত্রীয় পাঠের ভিত্তিতে এবং অন্তঃসার সত্তার সুবিধার ভিত্তিতে আমাদের পুনর্মূল্যায়ন করতে হতে পারে, ঐতিহ্যের কোন অংশটি উন্মুক্ত করা দরকার।

How Do We Understand Reform and Self-Correction?

কিভাবে সংস্কার এবং স্ব-সংশোধন বুঝবো ?

এই মতাদর্শ থেকে শেখা আরেকটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হল যে, ইসলামিক ঐতিহ্য সহজাতভাবেই একটি গতিশীল- চলমান এবং চির-নবীনযোগ্য প্রকল্প। এই কারণেই পুনরুজ্জীবনের ধারণা ইসলামের এত সহজাত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ইসলামকে সংস্কার নয়—যেভাবে আজকাল অনেকেই, বিশেষ করে পশ্চিমা মুসলিমরা এটিকে বুঝতে চায়— এটা হলো ইসলামের মাধ্যমে নিজেদের সংস্কার করা।

অবশ্যই, পুনরুজ্জীবন বা সংস্কারের জন্য তর্ক করার প্রক্রিয়ার জন্য, আমাদের নিজদের অনেক কিছু আমাদের মধ্যের অন্যদের দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে যে, এটা বোঝার জন্য যে ইসলামিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের উপলব্ধির কোন দিকটি ত্রুটিপূর্ণ  এবং সংস্কারের প্রয়োজন, অথবা দ্বীনের কি কি উপাদান উপেক্ষিত হয়েছে যা পুনরুজ্জীবিত করা দরকার।

এই বিষয়টি আমাদের মধ্যে সুপরিচিত হাদিস দিয়ে বোঝা যেতে পারে যে – – – “আল্লাহ প্রতি শতাব্দীর শেষে একজনকে পাঠাবেন (বা তাদেরকে) যারা তার দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবে” (আবু দাউদ), যাকে ভিত্তি করে অনেক কিছু লিখিত হয়েছে।  এর পরিপ্রেক্ষিতে, আমি বিস্তারিতরূপে দেওয়া বাদ দেব আর ঐতিহ্যের সেই দিক মনোযোগ ফেরাবো যেগুলোকে প্রশংসা করা হয়েছে সামান্যই।

Unity vs. Diversity and the Limits of Each

আমরা জানি যে মুসলিম উম্মাহ, বহু, বহু দলে বিভক্ত, ফলে ইসলামী ঐতিহ্যও সেরকমই। এটি সম্পর্কে হতাশ হওয়ার পরিবর্তে, এটিকে আমাদের একে অপরকে ক্রমাগত সংশোধনে উপযোগি করার ঐশ্বরিক উপায় হিসাবে দেখতে হবে। যা  ঐতিহ্যের উপর সম্পূর্ণ এবং আন্তরিক জ্ঞান ছাড়া এটি অর্জন করা অসম্ভব।

মতবিরোধের শ্রেণীবিভাগ ও প্রকৃতি দিকে ফিরে যাওয়ার আগে এবং খারাপ ধরনের মতবিরোধ থেকে ভালোগুলোকেকে আলাদা করার আগে, আমরা সরাসরি সেই প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হই যা সমস্ত চিন্তাশীল মুসলমানদের সামনা করা উচিত।

 

আল্লাহ কেন ইসলামের ব্যাপারে মতভেদ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে দেন? কেন কুরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে এত মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে, সব বিষয়ে? কেন একটি হাদীসকেও মাঝে মাঝে বিভিন্ন আলেম দ্বারা ভিন্নভাবে শ্রেণীভুক্ত করা হয় বা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়? কেন প্রায়শই সুন্নি শিয়াদের মধ্যে এসব বিভেদ শত্রুতা হয়? সুন্নিদের মধ্যে যারা কালাম বা তাওউফ গ্রহণ করে এবং যারা এগুলোকে বিদআত বলে মনে করে তাদের মধ্যে কেন বিভেদ? মুসলিম ফকীহগণ কেন এতগুলো ব্যবহারিক বিষয়কে বিভক্ত করেছেন? শুরুতেই উলামায়ে কেরাম বিভিন্ন ফতোয়া দেন কেন?

How Do Our Disagreements Develop Our Hearts and Minds?

যদি ধর্ম সম্পর্কিত এই প্রশ্নগুলি আপনাকে হতাশ করে, তবে আমি বলব আপনার উদ্বেগ ন্যায্য। কারন যুক্তি-ঐতিহাসিক, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক-অনেকভাবেই হতে, কিন্তু তা হতাশা দূর করতে পারেনা।

সত্য সবসময় স্ফটিক পরিষ্কার হলে সেটাই কি ভাল নয়? এটা সেরকমই মনে হবে, কিন্তু এটা বাস্তবে আমাদের জন্য জরুরী কোন জিনিস? আমি তা মনে করি না। কখনও কখনও হতাশা এবং  একই সময়ে বেদনাদায়ক, মতবিরোধ এবং নারাজি আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ।

জীবন ও বিশ্বাসে আমাদের পরীক্ষার অংশ হল অনিশ্চয়তার মুখে নম্রতা ও অধ্যবসায় জারি রাখা। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি,  যেখানে আবেগ এবং সম্পর্ক থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ঘটনা পর্যন্ত বেশিরভাগ জিনিসই অনিশ্চয়তায় পরিপূর্ণ। তারপরও আমাদের ইনসাফ কায়েম করতে হবে।

ফিকিহ মতামতকে (আইন) একটা অনিশ্চয়তার সাথে মোকাবিলা, হাদিসে পরিবর্তনশীল নির্ভরযোগ্যতা এবং কুরআন ব্যাখ্যা সবগুলোই আমাদের জন্য পরীক্ষা এবং এক ধরণের প্রশিক্ষণ। এটার জন্য আমাদেরকে প্রতিনিয়ত তুষ থেকে গম ছেঁকে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং এবং এটি করতে হবে যদি কেউ ভিন্নভাবে এমনকি ভুলভাবে চালনা করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই।

এটি ইসলামে ধার্মিকতা এবং আদবের প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে, আপাতত এটি কেবল একজনের হৃদয়ের পরীক্ষা নয়, একজনের মস্তিস্কেরও পরীক্ষা। প্রত্যেককে অবশ্যই নম্র হতে হবে, সাথে সেই সীমাগুলি জানার চেষ্টা করুন যার বাইরে একজন বিশ্বাসীকে অবশ্যই একটি অবস্থান নিতে হবে এবং বিরোধিতা করতে হবে যা কিছু বিশ্বাসকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

মানুষকে কালো এবং সাদা দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতে বলা খুব সহজ, নিস্তেজ, আমাদের সৃষ্ট প্রকৃতির বিপরীত হবে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের বিবেককে সেইভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয় যা শুধুমাত্র জটিল নৈতিক পরিস্থিতিরে বিকাশে প্রয়োজন।

Legitimate Differences

মতবিরোধের প্রকৃতি এবং শ্রেণীবিভাগের দিকে ফিরে গেলে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর মধ্যে কিছু ন্যায্য, সম্ভবত সমানভাবে বৈধ (উদাহরণস্বরূপ, সেই ফিকহি বিষয়গুলোকে ধরা যায়-যা মাসায়েল আল-ইজতিহাদ বা স্বাধীন যুক্তির বৈধ সমস্যা নিয়ে করা হয়), বাকিগুলো না. অন্যভাবে বললে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে কিছু পার্থক্য বৈধ এবং যাকে ফকিহরা “বৈচিত্র্যের পার্থক্য” বা ইখতিলাফ আল-তানাউউ’ বলেছেন বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

কঠোরভাবে বললে, বৈচিত্র্য থেকে জন্ম নেওয়া পার্থক্যগুলি নির্দিষ্ট মতামতের সাথে সম্পর্কিত যা জরুরীভাবেই বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং পরিচয় তৈরির দিকে পরিচালিত করে না,। যেমনটি আমরা প্রায়ই দেখি- দিনশেষে সেগুলি হতে পারে এই পথই ধরে। আল্লাহ আমাদের যেভাবে সৃষ্টি করেছেন তার কারণেই এই মতবিরোধ। অর্থাৎ, মানুষ সংস্কৃতি, ভাষা, অভিজ্ঞতা, পছন্দ, মেজাজ ইত্যাদিতে অনিবার্য মানবিক পার্থক্যের বৈচিত্র্যসহ বেড়ে ওঠে।

Illegitimate Differences

অন্য ধরনের মতবিরোধ যাকে বৈধ বলে গণ্য করা যায় না তা হলো ভুল বোঝাবুঝি, অজ্ঞতা, বিদ্বেষ বা সীমালঙ্ঘন থেকে যেগুলো জন্ম নেয়। কুরআনে আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে ঘন ঘন খোদায়ী তিরস্কারের একটি হল তাদের মতবিরোধ একে অপরের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘনের ফলস্বরূপ, অর্থাৎ- বাঘিয়ান বায়নাহুম।

এই ধরনের মতপার্থক্য হৃদয়কে একে অপরের বিরুদ্ধে পরিণত করে এবং এটি সাম্প্রদায়িকতা এবং মতবিরোধ বা তাফরিকার উত্স, যার বিরুদ্ধে কুরআন এবং সুন্নাহ কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছে (দেখুন সূরা ইমরান, ৩:১০৩-৫; সূরা আল-আন’আম , ৬:১৫৩; এবং সূরা আল-শুরা, ৪২:১৩)

তাফরিকা শব্দটি কুরআনের অন্য একটি প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে, যা অসংলগ্ন পার্থক্যের কারণে জীবনসঙ্গীর সাথে বিচ্ছেদকে নির্দেশ করে, যা আমাদেরকে শব্দটির সুনির্দিষ্ট অর্থের আরও ভাল ধারণা দেয় (সূরা আল-নিসা’, ৪:১৩০)। কুরআন আরও জোর দেয়া হয়েছে যে আহলে কিতাবদের মধ্যে তাফরিকার উদ্ভব হয়েছিল একটি ঐশ্বরিক গ্রন্থের মাধ্যমে আল্লাহর জ্ঞান আসার পর (সূরা আল-শুরা, ৪২:১৪ এবং সূরাত আল-বাইয়ীনাহ, ৯৮:৪)।

মনে রাখতে হবে যে, অন্যায্য মতবিরোধ অজ্ঞতা বা ভুল বোঝাবুঝির ফলাফল হতে পারে, এব বিদ্বেষ বা অশ্লীলতা হতেই হবে এমন নয়।

এই মতানৈক্যের উত্সটি যিনি মতামত দোষারোপের দিকে নিয়ে গেছেন  সেই ব্যক্তিকে যথাযথ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে, কারণ আন্তরিকতার পরেও ভুল হতে পারে। ইসলামী জ্ঞানের মেরুদণ্ড গঠনকারী গুরুত্বপূর্ণ হাদীসে এটি ধরা হয়েছে।

The Prophet ﷺ said:

রাসুল (সাঃ) বলছেন-

যখন একজন বিচারক রায় দেন, ইজতিহাদ করেন [আন্তরিকতার সাথে সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা চালান]  এবং সঠিক হন, তখন তিনি দুটি পুরস্কার পান। যখন তিনি এইভাবে বিচার করেন এবং যা সঠিক হয়না, তখন তিনি একটি পুরস্কার পান। (মুসলিম)

মুমিনদের মধ্যে এটা বলা নিরাপদ যে, অন্যায্য মতবিরোধ মূলত এই ধরণেরই। নাসি’আ (আন্তরিক উপদেশ, মতামত, আলোচনা ইত্যাদি) বা আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল-মুনকার (সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ নিষেধ) এর বাধ্যবাধকতা তাই গুরুত্বপূর্ণ , তাফরিকার মতবিরোধের অনুশীলন কমিয়ে আনার জন্য।  কারণ এটি আন্তরিক ত্রুটি এবং বিদ্বেষপূর্ন সীমালঙ্ঘন উভয়ের সম্ভাবনাকে হ্রাস করে।

এই ধরনের মতপার্থক্য জরুরীভাবেই ভিন্নমত পোষণকারী দলকে বঞ্চিত করে না যারা মুমিনদের মর্যাদা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা পোষণ করে, যেমন আল্লাহ বলেছেন:

যদি মুমিনদের মধ্যে থেকে দুটি দল যুদ্ধ করতে আসে, তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করুন… এবং যদি একটি অন্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে, তবে সীমালঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করুন যতক্ষণ না সে আল্লাহর আদেশে আত্মসমর্পণ করে।

যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের উপর চড়াও হয়, তবে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ইনছাফ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ইনছাফকারীদেরকে পছন্দ করেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করবে এবং আল্লাহকে ভয় করবে-যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও। [  সূরা আল-হুজরাত, ৪৯:৯-১০]

কোনো দল যদি তার ত্রুটি স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মুসলমানদের জামাতে (ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়) ফিরে আসতে ব্যর্থ হয় তবেই তারা ঈমানদার হওয়ার মর্যাদা হারাবে। (আহল-আল-বাগী বা বুগাত নামক শাস্ত্রীয় গ্রন্থের ব্যাখ্যার (তা’উইল) ভিত্তিতে যারা মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় তাদের চরম ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিক আইনবিদরা এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন।)

Acceptable and Unacceptable Disagreements

একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা  মতবিরোধের এই প্রাথমিক শ্রেণিবিন্যাসকে জটিল করে তোলে (এবং এর ফলে যে গোষ্ঠীগুলি আবির্ভূত হয়)যাদের বৈচিত্র্যের (অতএব বৈধ) এবং মতবিরোধের (অতএব অবৈধ): বৈচিত্র্যের মতানৈক্য হিসাবে যা শুরু হয় তা সীমালঙ্ঘনের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং বিদ্বেষ, মন্দের পরিসমাপ্তি ঘটায়, যেখানে ভুল ব্যাখ্যা হিসেবে যা শুরু হয়, তা পারস্পরিক পরামর্শ এবং নম্রতার মাধ্যমে গভীর বোঝাপড়ার উৎসে পরিণত হতে পারে।

In Part 5, we elaborate on the first of four possible trajectories of disagreement in Islamic Tradition so as to cull a richer understanding and, Inshâ’Allâh, some wisdom.  

পার্ট 5-, আমরা ইসলামিক ঐতিহ্যে মতানৈক্যের সম্ভাব্য চারটি পথের প্রথমটি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি যাতে একটি সমৃদ্ধ বোঝা এবং, ইনশাআল্লাহ, কিছু প্রজ্ঞা অর্জন করা যায়

 

Part 5

ঐক্য বনাম বৈচিত্র্য এবং প্রতিটির সীমা সম্পর্কে আমাদের অধ্যয়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য, আমরা এখানে প্রথমে ইসলামিক ঐতিহ্যে মতবিরোধের চারটি পথের দিকে তাকাবো।

Trajectory 1:  The great success story of Islamic Tradition: Truth through debate

কিছু মতানৈক্য শুরুতে অন্যায্য বা দ্বিমতের সূচনা হিসাবে মনে হতে পার । কিন্তু যখন সঠিক জ্ঞান এবং  কিতাবাদির আশ্রয় নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয় এবং সব দিক বিবেচনা করে যুক্তির সাথে সঠিকভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তর্ক হাজির করা হয়, তখন এর সাধারণ ভিত্তি স্বীকৃত হয়।

শেষ পর্যন্ত, একাধিক মতামতকেই বৈধ হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। এর একটি উদাহরণ হল ফিকাহ (ইসলামী আইনশাস্ত্রে) বিশ্বাসে (সালাফ) আমাদের প্রাথমিক ধার্মিক পূর্বসূরিদের রা’ঈ (যৌক্তিক মতামত) বনাম নিরঙ্কুশ সাম্প্রদায়িক জ্ঞান (‘আমাল) এর মতো পদ্ধতির অবস্থা সম্পর্কে ইখতেলাফ, যা পরে মিটমাট হয়।

The Emergence of the Traditionalists

সঠিক-নির্দেশিত খিলাফতের পর ইসলামের প্রথম দুই থেকে তিন শতাব্দীতে, কোন ফিকহি মাথহিব (ইসলামী আইনি চিন্তার স্কুল) ছিল না। স্পষ্টতই, ধর্মীয় জ্ঞান ছিলো সাধারণ, এবং শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাহাবায়ে কেরাম ও ছাত্ররা।

(১) মদীনায় নবী ও সাহাবীদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া বুদ্ধিবৃতিক বর্গগুলি আবির্ভূত হয়েছিল এবং তাই তারা আহল আল-আতার (আক্ষরিক অর্থে, ‘ঐতিহ্যবাদী’) নামে পরিচিত। ইসলামিদের দ্বিতীয় শতাব্দীতে, এই প্রবণতা মদীনায় ইমাম মালিক এবং দামেস্কের ইমাম আল-আওজাই-এর স্কুলগুলিতে জমাট বাধে।

(2)

(২) দ্বিতীয় প্রবণতাটি ইরাকের একটি নতুন শহর কুফাতে আবির্ভূত হয়েছিল, যা খলিফা উমর ইবনে আল-খাত্তাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিমান্তে জিহাদে নিয়োজিত অভিবাসী আরব উপজাতিদের এবং সেইসাথে ইসলামে ধর্মান্তরিত পার্সিয়ানদের জন্য। তাই, কুফা প্রায়ই নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় যার হদিস ঐতিহ্যগত কেন্দ্রগুলিতে পাওয়া যায় না। কুফার পণ্ডিত বর্গ, সাহাবী শিক্ষার উপর ভিত্তি করে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং তার ছাত্ররা কুরআনের এবংনবুয়াতি জ্ঞানেরমূল ভিত্তির উপর একটি যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার উপর জোর দিয়ে আসছিলেন। এইভাবে, তারা আহলে-রায়ি (আক্ষরিক অর্থে, মতামত তৈরীর লোক) হিসাবে পরিচিত হয়েছিল, যার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ইমাম আবু হানিফা।

(৩) আহল আল-আতার এবং আহলে আল-রায় উভয়েরই প্রথম দুই শতাব্দীতে নিজেদের মধ্যে যে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল তা অন্যায্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। এই অন্যয্যতা পরবর্তীতে উভয় ঐতিহ্যের একজন মেধাবী এবং আন্তরিক ছাত্র ইমাম আল-শাফি’র দ্বারা মিটমাট করা হয়েছিল, যিনি প্রত্যেকের বৈধ উদ্বেগকে অন্যের বিবেচনায় নিয়ে এসেছিলেন, যার ফলে একটি সংশ্লেষণ হয়েছিল, যা অন্য একটি সিলসিলা (মাথাব) বিকশিত করেছিলো।

তবুও এই তৃতীয় মাযহাবটিও ফিকহের অন্যান্য সুন্নি মাযহাবের দ্বারা কিছুটা ভিন্ন উপায়ে গৃহীত হয়েছিল। আল-শাফি’ই মদীনার আহলে আল-আতারের প্রতিবেদন-ভিত্তিক সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু একই সাথে কঠোর হাদিস পদ্ধতিকে সমর্থন করেছিলেন। এবং ইমাম মালিকের অনবদ্য জ্ঞান এবং ধার্মিকতা গ্রহণ করার পরিবর্তে, আল-শাফি’ই পরিচিত তথ্য প্রদানকারীদের উপর ভিত্তি করে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনের পরিবর্তে, ছড়িয়ে থাকা সম্প্রদায়ের অনুশীলনের (‘আমাল আহল-আল-মদীনা) উপর নির্ভর করার জন্য ইমাম মালিক স্কুলের সমালোচনা করেছিলেন।

আল-শাফীও কুফার পন্ডিত বর্গের দ্বারা যুক্তির বৃহত্তর ব্যবহারকে গ্রহণ করেছিলেন । পাশাপাশি, কুরআন ও সুন্নাহর আদেশের ভিত্তিতে সাদৃশ্যমূলক যুক্তি (কিয়াস) ব্যবহারের মাধ্যমে এটিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করারও মেহনত করেছিলেন। তার সংশ্লেষণ (সিনথিসিস) শেষ পর্যন্ত অন্যান্য সমস্ত জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারকে প্রভাবিত করেছিল, যদিও প্রতিটি ধারাই এটিকে নিজস্ব উপায়ে গ্রহণ করেছিল।

চতুর্থ/দশম শতাব্দীর মধ্যে, ফিকহের বেশিরভাগ সুন্নি মাযহাব হাদিস এবং উপমা উভয়ই গ্রহণ করেছিল। এরকম বহু উদাহরণের একটি  হলো,  এই মতবিরোধ অনেক দৃষ্টান্ত ফলপ্রসূ সংশ্লেষণ দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছে যা সত্যকে স্পষ্ট করেছে এবং প্রারম্ভিক শতাব্দীতে বাহাসের একটি সীমান সীমানা নির্ধারন করেছে।

Mutual Respect and Acceptance

সমস্ত বিষয়ে গ্রহণ না করেই প্রথম তিন শতাব্দীতে প্রাথমিক ইমামরা একে অপরকে যে সম্মান দেখিয়ে সহনশীলতা ও সংলাপের মনোভাব উদাহরণ হয়েছিলেন—এবং ইমামদের দ্বারা আমি শুধু চারজন সুপরিচিত ব্যক্তিকে বোঝাতে চাই না। তাদের শিক্ষক, তাদের শিক্ষকের শিক্ষক এবং তাদের ছাত্রদেরও বোঝাচ্ছি যাদের সংখ্যা হাজার হাজার না হলেও শত শতে।

এটাও উল্লেখ করা উচিত যে, মতবিরোধ, সহনশীল এবং একে অপরকে সম্মান করার ক্ষমতা তাদের ইসলামের মূল বিষয়ে একমত হওয়ার ক্ষমতার দ্বারা সম্ভব হয়েছিল, যা তারা সাহাবী ও তাদের তাবেয়ী কাছ থেকে পেয়েছিলেন।

প্রাথমিক ইমামগণ অবশ্য কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাপক সীমা লঙ্ঘনকারীদেরও সহ্য করেননি। যদিও আমরা এই সীমার উপাদানগুলিকে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করতে আসকারা দিতেপারি না, তবুও ইমাম আল-গাজালি তার বিখ্যাত hyâ’-তে যা বলেছেন তা পুনরায় বলা জরুরী:

ইমাম আল-শাফিঈ যখন কালামের একজন মুতাযিলি বিজয়ী হাফস আল-ফরদের সাথে বিতর্ক করেছিলেন, তখন তিনি উপসংহারে বলেছিলেন: “যে ব্যক্তি শিরক ব্যতীত সমস্ত পাপ নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করে সে তার চেয়ে উত্তম যে কালামের বিজ্ঞানের যে কোনও উপাদান নিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে। আমি হাফসের কাছ থেকে এমন সব কথাই শুনেছি যা আমি পুনরাবৃত্তি করা উচিত না [এমনকি বিবৃত করার জন্যও নয়]।

তাকে [আল-শাফিঈ] একবার কালাম সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি রাগান্বিত হয়ে প্রশ্নকর্তাকে বলছিলেন: “এ সম্পর্কে হাফস আল-ফরদ এবং তার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করুন, আমাকে নয়, আল্লাহ তাদের লানত করুন!”

যখন আল-শাফিয়ী মৃত্যুশয্যায় ছিলেন এবং হাফস আল-ফরদ তাকে দেখতে আসেন, তখন আল-শাফিঈ তাকে বলেছিলেন: “আপনি যে বিষয়ে পতিত হয়েছেন তা থেকে অনুতপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবেন না এবং আপনার জিম্মাদারি করবেন না।” (আই হিয়া’, ভলিউম 1, কিতাব আল-ইলম)

প্রাথমিক ইমামদের কালাম প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে এরকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে।

এই উপাখ্যানগুলিকে সম্পর্কিত করার কারন হল, যে কোনও অর্থপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান, কোনও যুক্তিপূর্ণ আলাপ, মত-দ্বিমত ছাড়া চলতে পারে না। মতবিরোধের সহনশীলতা প্রয়োজনীয়, এবং এটি সমস্ত পক্ষের দ্বারা গৃহীত সাধারণ শর্তগুলির উপর নির্ভর করে। এক্ষেত্রে সালাফের ইমামদের জন্য রেওয়াজ ছিল, একজনকে অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে তর্ক করতে হবে।

Illegitimate Extremes

বর্তমানে, ইসলামিক ঐতিহ্যের ভাষায় তর্ককারী মুসলমানরা প্রায়শই দুটি চরম পর্যায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

  • একদিকে, অনেকে অন্যায়ভাবে অসহিষ্ণু এবং সংকীর্ণ, যাতে শুধুমাত্র একটি কর্তৃপক্ষ, স্কুল বা শায়খেই কেবল তাদের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে
  • অপরদিকে, অনেকেরই ইসলামে গভীর জ্ঞান বা আন্তরিক বিশ্বাসের অভাব রয়েছে। যেমন তারা ঐতিহ্যগত শব্দভাণ্ডারকে শুধুমাত্র পূর্বনির্ধারিত, ফলাফল-ভিত্তিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। অত্যাবশ্যকীয় মূল্যবোধ বা কর্মসূচিগুলোর প্রকল্প ইসলামী ঐতিহ্যের (যা, এই ধরনের লোকেরা জোর দিয়ে বলেন, কোন সারমর্ম মুক্ত এবং “আলোচনাযোগ্য” এর অভাব রয়েছে বলে মনে করে) রূপকে স্থাপন করার ছদ্মবেশ হিসাবে সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের একত্বকে ব্যবহার করা।
  • উভয় ক্ষেত্রেই, নতুন উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে সত্যের কোন উত্থাপন নেই, কারণ পূর্বের ক্ষেত্রে, কোন আবিষ্কার নেই, এবং পরবর্তীতে কোন সত্য নেই।
  •  

এখানে শিক্ষা হল যে সুশৃঙ্খল বিতর্ক সত্যের আবিষ্কার এবং বিভ্রান্তির স্পষ্টীকরণের পাশাপাশি চুক্তির নির্মাণের দিকেও নিয়ে যেতে পারে, যতক্ষণ এতে তিনটি শর্ত মজুদ থাকে:

(1) আমর এবং নাহ ব্যবহার করে ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তরিকতা এবং এর বাস্তবিক প্রকাশ;

(2) পরিস্কার জ্ঞানের ভিত্তির উপরে ভাগ করা; এবং

(3) পর্যাপ্ত একই ভিত্তি (অর্থাৎ, বোঝাপড়া, সাংস্কৃতিক অনুমান, এবং সংবেদনশীলতাকে একইভাবে উপলব্দি করা)

parrT 6

ঐক্য বনাম বৈচিত্র্য এবং প্রতিটির সীমা সম্পর্কে আমাদের অধ্যয়ন চালিয়ে গিয়ে, আমরা এখানে ইসলামিক ঐতিহ্যের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ মতবিরোধের গতিপথ দিকে তাকাই। দ্বিতীয়টি, প্রথমটির মতো, ইতিবাচক, যেখানে তৃতীয় এবং চতুর্থটি নেতিবাচক।

স্মরণ করুন প্রথমটি ছিল “বিতর্কের মাধ্যমে সত্য” তুলে আনা, যার মধ্য থেকে প্রথাগত মাথহিবের (ইসলামী আইনশাস্ত্রের স্কুল) বিকাশ ঘটেছিল। চিন্তার ঘরানা এবং তাদের ইমামদের মধ্যে ঐতিহাসিক আদান-প্রদানে, আইনশাস্ত্রীয় পদ্ধতির ভারসাম্য তৈরি হয়েছিল।

Trajectory 2:  Richness Through Diversity

বৈচিত্র্য (tanawwuʿ) এবং গোষ্ঠিবাদীতার (তাফ্রিকা) জটিল আন্তঃসম্পর্কের আরেকটি সূক্ষ্ম এবং প্রায়শই উপেক্ষিত সত্য হল, যদি ন্যায্য বৈচিত্র্যকে একটি ভুল বা অকাল সমাধানের দিকে ঠেলে দেয়া হয়, তাহলে এটি গোষ্ঠিবাদীতারই দলভারী করতে পারে।

Legitimate Differences Recognized

উল্লিখিত উদাহরণগুলি যেমন বলছে, সালাফ ইমামগণ এমন অন্যায্য দাবিগুলিকে সহ্য করেননি যা স্পষ্টভাবে রেওয়ায়েতের হৃদয়কে লঙ্ঘন করে, তারা একইভাবে বৈধ মতপার্থক্যের সাথে সামঞ্জস্য বাধ্য করতেও নারাজ ছিলেন।

ইমাম মালিকের খলিফা আল-মান সূর এবং তারপরে হারুন আল-রশিদের শাসনামলে তাঁর ফিকহের বই, আল-মুওয়াতাতা’কে, সমগ্র ইসলামী সম্রাজ্যে প্রচারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইমাম মালিকের যুক্তি ছিলো, বিভিন্ন এলাকার লোকেরা সেখানে বসতি স্থাপনকারী সাহাবী ও আলেমদের শিক্ষা অনুসরণ করে।

ভিন্নভাবে বললে, ইমাম মালিক মুসলমানদের উপর অভিন্নতা আরোপের চেষ্টাকে অপছন্দ করতেন, এমনকি যদি সেই চাপিয়ে দেওয়া মানে তার মতামত প্রকাশ করাও হয়। (এটি আবু নুআইম আল-ইসবাহানি, ইবনে আবি হাতিম এবং অন্যান্যদের দ্বারা উল্লেখিত হয়েছে; এছাড়াও দেখুন ইউ.এফ. আবদুল্লাহর পিএইচ.ডি. ডিস., ইউ. শিকাগো, 1978, পৃ. 100এফ.)

একই মালিক, আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন, তিনি যাদেরকে “আকাঙ্ক্ষার পক্ষপাতী” (আহল আল-আহওয়া’) বলে অভিহিত করেছিলেন, তাদের সহ্য করতে অস্বীকার করেছিলেন। যারা এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা ইমাম মালিক নিষিদ্ধ বলে বিশ্বাস করতেন (যেমন আল্লাহ’র আসনে বসার পদ্ধতি), এবং তিনি এই ধরনের লোকদের তার স্টাডি সার্কেল থেকে বাদ দিতেন।

Adequate Consideration Needs Time

গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক নীতিগুলির বৈধ মতপার্থক্যগুলি সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় যখন সময়ের সাথে সাথে তাদের প্রভাবগুলি অন্বেষণ করা হয়। চার বা ততোধিক ফিকহ মাযহাব আমাদের মূলত এই সুবিধাটিই দিয়েছে।

একটি নির্দিষ্ট ইমামের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নীতির অধীনে কাজ করা আলেমদের একটি দল বিভিন্ন কারণে তির্যক, পক্ষপাতদুষ্ট বা একটি নিদৃষ্ট বিষয় বা যে কোনও কারণে অন্ধ অন্ধের মত আচরন করতে পারে। কিন্তু বেশ কয়েকটি চিন্তাধারা একই সমস্যা এবং বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য নিয়ে, বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের অধীনে, ব্যাখ্যামূলক নীতির অধীনে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে একই কাঠামোর মধ্যে স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন তাদের পক্ষপাতের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম।

Examples of How Mutual Correction Can Work

 

সুনির্দিষ্ট (খাস) এর উপর সাধারণ (আম্ম) আদেশকে প্রাধান্য দেওয়ার হানাফী নীতি এবং দুর্বল বা স্বল্প পরিচিত রেওয়ায়েতের উপর যৌক্তিক ব্যাখ্যা (আমি এখানে কারিগরি শব্দভাণ্ডার এড়িয়ে চলব), এবং শাফেয়ী নীতিতে সাধারণ চেয়ে নির্দিষ্টকে প্রাধান্য দেয়া। মৌলিক পরিস্থিতিতে, একটি জরুরী চেক-এন্ড-ব্যালেন্স পদ্ধতি হিসাবে কাজ করে। .

একইভাবে, বিচ্ছুরিত বা নিরব ঐতিহ্য (মদীনার জনগণের আমল) পছন্দ করার মালিকি নীতি এবং নির্দিষ্ট শৃঙ্খল (ইসনাদ) সহ একটি নিদৃষ্ট হাদীসকে অগ্রাধিকার দেওয়ার হাম্বলী ও শাফেয়ী নীতিও একে অপরকে সংশোধন করে।

Avoidance of Dissension is Primary

তত্ত্বগতভাবে, সুন্নি মুসলমানরা সাধারণত স্বীকার করে যে আইনের নীতির (উসুল আল-ফিকহ)  ব্যাখ্যার বিষয়ে প্রাথমিক ইমামদের মতভিন্নতা চার বা তার বেশি পারস্পরিক বৈধ সম্প্রদায়ের উসুলি ব্যাখ্যার দিকে ধাবিত করেছে।

যাইহোক, এই সহনশীলতা সবসময় অনুশীলন করা হয় না। মধ্য যুগে এই বিষয়ে রচিত সবচেয়ে গভীর এবং উদার গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি হল শাইখ আল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার রাফ’আল-মালম ‘আন আল-আইম্মাতি আল-আ’লাম (মহান ইমামদের মুক্তি)।

নীতি হিসাবে, মতের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে বক্তৃতা এবং ব্যাখ্যার সম্প্রদায়ের গঠন বৈধ হতে পারে, যতক্ষণ না এটি বিভেদ, অনৈক্য, পথের বিচ্ছেদ এবং একচেটিয়া গোষ্ঠিবাদীতা বা অনমনীয়তার নজির হিসাবে হাজির না হয়।

Trajectory 3: The Tragedy: Intolerance, Exaggeration, and “Gratuitous Sectarianism”

যেমনটি আগে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলামী ঐতিহ্য হলো আল্লাহর কালামের জন্য মুসলমানদের সংগ্রামের নথি। এতে “ভাল, খারাপ এবং কুৎসিত” সব হাজির রয়েছে—এবং যদি এটি নিজেকে একমাত্র ভাল হিসেবে রোমান্টিসাইজ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে তবে এর বোঝাপড়া সম্পূর্ণ হয় না।

Exploitation of Differences by the Ignorant and Fanatic

সবচেয়ে ঘন ঘন, ঘৃণ্য প্রবণতাগুলির মধ্যে একটি দেখা যায় যখন  ইমাম এবং প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ বৈধ ন্যায্য মতভিন্নতাকে, ধর্মান্ধ এবং অজ্ঞ অনুসারীদের দ্বারা অসহনীয় মতবিরোধ হিসাবে চিত্রিত করা হয় ( হ্যা সকল আলেমরাই নিষ্পাপ নন, কিন্তু, কুরআনে যেমনটি বলা হয়েছে, প্রকৃত জ্ঞানী তারাই যারা আল্লাহকে ভয় করে)।

অন্যের ব্যাখ্যা বা চিন্তা ঘরানাকে অবৈধ বলে দাবি করা প্রায়শই শোষণ, আধিপত্য এবং স্বার্থপর পরিচয়-গঠনের একটি হাতিয়ার ।এবং এটি বিভেদ, ঘৃণা এবং গোষ্ঠিবাদীতার দিকে পরিচালিত করে। এই ধরনের একটি উদাহরণ হতে পারে ফিকহের সুন্নি মাযহাবের মধ্যে মতভেদ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং এক গোষ্ঠীর দ্বারা অন্য গোষ্ঠীকে কোনঠাসা, যেমনটি আমরা “নিশাপুর সিনড্রোম” হিসাবে পার্ট 2-এ উল্লেখ করেছি।

Unnecessary Sectarianism and Unnecessary Mutual Intolerance

আমি এটিকে “বেহুদা গোষ্টিবাদীতা” বলি কারণ এটি অপ্রয়োজনীয়। ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি বড় ট্র্যাজেডি যা অনেক সময় এবং জায়গায় মুসলমানদের পারস্পরিক গ্রহণযোগ্যতা এবং বৈচিত্র্যের মহান সাফল্যের গল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

এক ধরনের গোষ্ঠিবাদীতা রয়েছে যা সত্যিকার অর্থে অমীমাংসিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ মতপার্থক্য থেকে যার শুরু। যেমন সুন্নি, বিভিন্ন ধরনের শিয়া, খারিজিদের মধ্যে যে মত পার্থক্য। নিঃসন্দেহে, আমাদের অবশ্যই এটি মোকাবেলা করার আরও ভাল উপায়গুলি শিখতে হবে, তবে এটি এখানে আমাদের  আয়ত্বের বাইরে রয়েছে।

Trajectory 4:  Between Vacuous Unity and Fanatic Sectarianism

কিছু মতানৈক্য বা মতামত অগ্রহণযোগ্য হতে পারে-যেমন কুরআন এবং সুন্নাহর বর্ণ এবং মূলবানীর স্পষ্ট লঙ্ঘন যা সালাফদের দ্বারা সর্বসম্মতভাবে বোঝা যায়-এবং তাই, অগত্যা এক ধরন অন্যের অন্যায্য ও দুর্নিতির কারণ হবে। কিন্তু এই ধরনের সমস্যা ঠিক কীভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়।

Failure to Oppose Injustice and Corruption

কেউ কেউ নিজের স্বার্থে, আত্মরক্ষার, উদাসীনতা ইত্যাদির জন্য এই ধরনের ত্রুটির বিরোধিতাকে অবহেলা করতে পারে, এইভাবে ঈমানের মর্মকে ম্লান করে দেয় এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অন্যায়ের সৃষ্টি করে।

আল্লাহ আমাদের যে জ্ঞান দিয়েছেন তা লুকিয়ে রাখা (যার দ্বারা সত্য, প্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত জ্ঞান বোঝানো হয়েছে, মতামত নয়) সবচেয়ে বড় পাপের একটি এবং ওহী দ্বারা এর সবচেয়ে জোরালো নিন্দা করা হয়েছে:

নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাযিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীগণের ও। [সুরা বাকারা – ২:১৫৯]

The Dilemma:  Minimizing Harm

তবুও যেসব বিরোধ এবং স্পষ্ট ত্রুটির সমালোচনা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয় বরং সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষতি এবং বিভেদ ঘটাতে পারে তার ক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে?

নবী মুসা, হারুন এবং তাদের সম্প্রদায়ের একটি কাহিনী কুরআনে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত হারুনের অনুরোধ উপেক্ষা করে আল-সামিরি (সামরিটান) দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে ইসরায়েলীরা যখন মুসার প্রস্থানের পর সোনার বাছুরকে পূজা করতে শুরু করে, তখন হারুনের জন্য একটি সংশয় দেখা দেয়। আল্লাহ ঘটনাটিকে এভাবে বর্ণনা করেন:

“হারুন তাদেরকে পুর্বেই বলেছিলেনঃ হে আমার কওম, তোমরা তো এই গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় নিপতিত হয়েছ এবং তোমাদের পালনকর্তা দয়াময়। অতএব, তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল। তারা বললঃ মূসা আমাদের কাছে ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা সদাসর্বদা এর সাথেই সংযুক্ত হয়ে বসে থাকব। মূসা বললেনঃ হে হারুন, তুমি যখন তাদেরকে পথ ভ্রষ্ট হতে দেখলে, তখন তোমাকে কিসে নিবৃত্ত করল ? আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে? তবে তুমি কি আমার আদেশ অমান্য করেছ? তিনি বললেনঃ হে আমার জননী-তনয়, আমার শ্মশ্রু ও মাথার চুল ধরে আকর্ষণ করো না; আমি আশঙ্কা করলাম যে, তুমি বলবেঃ তুমি বনী-ইসরাঈলে র মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং আমার কথা স্মরণে রাখনি।

[সুরা ত্বা-হা – ২০:৯০-৯৪]

অর্থাৎ হারুন (আঃ) লোকদের বাছুর পূজা করতে দেখে নিষেধ করলেন। কিন্তু তারা বিরত হলো না, হযরত হারুন (আঃ) তখন দ্বিধা পরলেন। তিনি হয় বিপুল সংখ্যক গুনাহগারদে বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়ে,  ইস্রায়েলীয়দের বিভক্ত এবং বিভেদ সৃষ্টি করার ঝুঁকি নিতে পারতেন- এটা ঠিক তিনি মূসার মত সেই সিদ্ধান্তমূলক কর্তৃত্বের অধিকারী নন-অথবা, তিনি সাময়িকভাবে,  বহুঈশ্বরবাদী মূর্তি পূজার মত সব থেকে বড় পাপকে সহ্য করতে থাকেন,,যতক্ষণ না মূসা ফিরে আসেন। যাতে এটিকে আরও কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করতে পারেন।

Calculating the Factors in Dealing with Dissension

অতএব, যখন স্পষ্ট ত্রুটি, ধর্মদ্রোহিতা বা বিপথগামীতার সম্মুখীন হয়, তখন একজনকে ঐক্য, সম্প্রীতি এবং মুসলমানদের শক্তির স্বার্থে সহনশীলতা প্রদর্শন করতে হবে এবং নিজেকে মৌখিক প্রতিবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। অথবা, যদি কেউ থেকেও খুব দুর্বল হয়, তবে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে একজনকে তার হৃদয়ে থেকে এসব কাজকে ( শিরক) ঘৃণা করার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

পরিশেষে, এই ধরনের সিদ্ধান্তগুলির জন্য কেবল শুধুমাত্র বিষয়গুলির সম্পূর্ণ উপলব্ধিই বরং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পূর্ন ধারনাই নয়,প্রয়োজন একজনের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সীমা, কার্যকারিতার যুক্তিসঙ্গত বোধ এবং সর্বপরি ধৈর্যের – যেমনটি আমরা হযরত হারুনের কাছ থেকে শিখি।

এটি ক্ষতি এবং উপকারের একটি গণনা যা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য একটি সর্বজনীন সূত্রের পরিবর্তে “ইসলামী রাজনীতির” ভাগে পড়ে। আমাদের সময়ে, একটি অত্যন্ত জটিল বিশ্বে ব্যবস্থায়, এর অর্থ হল প্রেক্ষাপটের ( কনটেক্স) পদ্ধতিগত অধ্যয়ন, যার জন্য শুধুমাত্র ধর্মতাত্ত্বিক বা আইনগত বিষয়গুলিই নয়, যেখানে প্রযোজ্য সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাস এবং  তার অন্তর্দৃষ্টিও জানা প্রয়োজন।

Reclaiming Our Islamic Tradition

ফলস্বরূপ, ইসলামী ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমার দৃষ্টিতে সামাজিক বিজ্ঞানের একটি ইসলামী ঐতিহ্য গড়ে তোলা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী দরকার।

তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। আর আহলে-কিতাবর া যদি ঈমান আনতো, তাহলে তা তাদের জন্য মঙ্গলকর হতো। তাদের মধ্যে কিছু তো রয়েছে ঈমানদার আর অধিকাংশই হলো পাপাচারী। [সুরা ইমরান – ৩:১১০]