Skip to content Skip to footer

মুসলমানরা কি এক উম্মাহ!

আরবি উৎসে ‘উম্মাহ’ শব্দের মর্মার্থ (পৃষ্ঠা ৭ থেকে ১১)

ইমাম রাগিব আল আসফাহানি রাহি. (মৃত্যু ৫০২ হিজরি, ১১০৮ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর ‘আল মুফরাদাত ফি গারিবিল কুরআন’ গ্রন্থে ‘উম্মাহ’ শব্দের পরিচয় প্রসঙ্গে বলেন—

“উম্মাহ হচ্ছে প্রত্যেক এমন গোষ্ঠি বা দল, যাদেরকে কোন একত্রকারী কারণ একত্র করে থাকে। এ একত্রকারী কারণ হতে পারে একই ধর্ম কিংবা একই যুগ অথবা একই স্থান। এ একত্রকারী কারণ হতে পারে ইচ্ছাধীন কিংবা আরোপিত। আর উম্মাহ শব্দের বহুবচন হচ্ছে উমাম।”

অতএব উম্মাহ হচ্ছে এমন একটি গোষ্ঠী বা দল, যাদেরকে বিশেষ কোন কারণ একত্রিত করে থাকে। এ একত্রকারী কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক, জন্মগত ও আরোপিত। যেমন— বন্য প্রাণীদেরকে একত্রকারী কারণ। উম্মাহকে একত্রকারী প্রাকৃতিক কারণের একটি উদাহরণ হতে পারে মনুষ্যত্ব বা মানুষ হওয়া। অথবা এ একত্রকারী কারণ হতে পারে ইচ্ছাধীন ও সৃষ্ট। যেমন— ভাষা।

আমাদের পূর্ববর্তী মুসলমানগণ ও আরবরা উম্মাহ শব্দের এ অর্থের উপরই একমত হয়েছেন। কোন একত্রকারী কারণে একত্রিত হয়ে উম্মাহ গঠন করতে সর্বনিম্ন কত সদস্যের দল বা গোষ্ঠী লাগবে, এ ব্যাপারে তারা ইজতিহাদ করেছেন। হাদিস শরিফে উম্মাহ হওয়ার জন্য সর্বনিম্ন কত সংখ্যক সদস্য লাগবে, এর নির্দেশনা পাওয়া যায়। রাসূল সা. বলেছেন—

“এমন কোন মৃত ব্যক্তি নেই যার উপর মুসলমানদের এমন এক উম্মাহ (বা দল) জানাযার নামায আদায় করে, যাদের সংখ্যা একশতে পৌছে যায়; তারা যদি তার ব্যাপারে সুপারিশ করে, তাহলে তাদের সুপারিশ কবুল না হয়ে পারেই না।”

কোন একজন এ সম্পর্কিত একটি রিওয়ায়াত শুনে এর এক রাবি আবুল মালিহকে উম্মাহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। অর্থাৎ সে জিজ্ঞাসা করে, উম্মাহ বলতে সর্বনিম্ন কতজনকে বুঝায়? আবুল মালিহ উত্তর দেন, চল্লিশজন।”

উম্মাহর সর্বনিম্ন সংখ্যা সংখ্যা সম্পর্কে এ বিভিন্ন অবস্থান ইজতিহাদের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। অতএব এটাই যে একবারে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা, বিষয়টি এমন নয়।

উম্মাহ শব্দের উপর্যুক্ত মর্মার্থই আমাদের ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে গৃহীত হয়েছে। উম্মাহ শব্দের এ অর্থই আরবি অভিধানগুলো এবং বিভিন্ন জ্ঞানবিজ্ঞানের পরিভাষা পরিচিতিমূলক গ্রন্থগুলো বর্ণনা করেছে। সর্বাধুনিক আরবি অভিধান ‘আল মুজামুল কাবির’ও কুরআন, সুন্নাহ ও আরবি কবিতা তথা কাব্য সংকলনে বর্ণিত উম্মাহ শব্দকে বিশ্লেষণ করে উপর্যুক্ত অর্থের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন। অতএব উম্মাহ হচ্ছে একটি দল বা গোষ্ঠী। আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“তোমাদের মধ্যে এমন একটি উম্মাহ থাকা উচিত, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হচ্ছে সফলকাম।” সূরা আল ইমরান : ১০৪

উম্মাহ তথা এ দল বা গোষ্ঠী মানুষ ছাড়াও প্রাণীজগতের অন্য যেকোন প্রকার প্রাণী থেকে হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—


“ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রত্যেকটি জীব এবং (বায়ুমন্ডলে) নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রত্যেকটি পাখি তোমাদের মতই এক একটি উম্মাহ।” সূরা আনয়াম : ৩৮

আবার উম্মাহ হচ্ছে এমন একটি দল বা গোষ্ঠী, যাদেরকে কোন যুগ বা প্রজন্ম একত্রিত করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“এইভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক উম্মাহর প্রতি যার পূর্বে বহু উম্মাহ গত হয়েছে।” সূরা রাদ : ৩০

উম্মাহ হচ্ছে প্রত্যেক নবির জাতি, যাদের কাছে তিনি প্রেরিত হয়েছেন। যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ঈমান আনে নি তাদের সবাই উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত। তারা সবাই ‘উম্মাতুদ দাওয়াহ’ অর্থাৎ এমন উম্মাহ যাদের কাছে দাওয়াত পেঁৗছানো হবে। এ দাওয়াত পেঁৗছার কার্যকারণটি তাদের সবাইকে একত্রিত করেছে এবং একই বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। আর যারা রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারা হচ্ছে ‘উম্মাতুল ইজাবাহ’ অর্থাৎ এমন উম্মাহ যারা রাসূলের দাওয়াতে সাড়া দিয়েছে। ঈমান আনয়ন ও রাসূলের ডাকে সাড়া দেওয়াটা তাদের সবাইকে একত্রিত করেছে এবং একই বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।

আবার উম্মাহ একক ব্যক্তি অর্থেও এসেছে। এমন এক ব্যক্তি যিনি তার গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে একাই এক জাতির সমপর্যায় হয়ে যায়; এমন এক ব্যক্তি যার কোন উপমা নেই, যিনি সকল ভালো ও কল্যাণের ধারক। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহিম আ. সম্পর্কে বলেছেন—

“নিশ্চয়ই ইবরাহিম ছিলেন এক উম্মাহ।” সূরা নাহল :১২০

উম্মাহ দ্বারা এমন একক ব্যক্তিকেও বুঝায়, যিনি পথভ্রষ্টতা ও মূর্তিপূজার তুফানের মাঝেও একাই হক দ্বীনের উপর অটল থাকেন। রাসূল সা. বলেছেন—

“কিয়ামতের দিন যাইদ ইবনু আমর ইবনু নুফাইল একাই এক উম্মাহ হিসেবে উত্থিত হবেন।”

দ্বীন ও মিল্লাতের উপরও উম্মাহ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। কারণ দ্বীন ও মিল্লাত মানুষকে একত্রিত করে একটি উম্মাহ গঠন করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“এভাবে তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই তাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক উম্মাহর (অর্থাৎ দ্বীন বা মিল্লাতের) উপর পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।” সূরা যুখরুফ : ২৩

উপর্যুক্ত অর্থে উম্মাহ শব্দটি পথ, পন্থা ও তরিকা ইত্যাদি শব্দের উপরও প্রুযুক্ত হয়।

আবার, উম্মাহ শব্দটি সময় ও যুগ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কারণ সময় এবং যুগও মানুষকে একত্রকারী। আল্লাহ তায়ালা বলেন—

“আর যদি আমি নির্দিষ্ট কিছু উম্মাহর (অর্থাৎ সময়ের) জন্য তাদের শাস্তিকে বিলম্বিত করি; তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, সেই শাস্তিকে কিসে আটক রাখছে?” সূরা হুদ : ০৮

সবশেষ উম্মাহ শব্দটি ‘মুলক’ বা রাজত্বের উপরও প্রয়োগ হয়। কারণ রাজত্ব হচ্ছে একটি রাজনৈতিক কারণ, যা জনগণকে একটি রাষ্ট্রে্রর অধীন একত্রিত করে।

একইভাবে ‘মুজামু আলফাযিল কুরআনিল কারিম’ প্রণেতাও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উম্মাহ শব্দের প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করার পর উম্মাহর পরিচয় সম্পর্কে বলেন—

“উম্মাহ হচ্ছে এমন প্রত্যেক দল বা গোষ্ঠী, যাদেরকে কোন কিছু একত্রিত করে। উম্মাহ (أمة) শব্দের বহুবচন হচ্ছে উমাম (أمم)। অতএব উম্মাহ হচ্ছে দ্বীন, ৃ.. ও সময় ইত্যাদি।”

কারণ কুরআনুল কারিমের ৪৪ স্থানে উম্মাহ শব্দটি মানুষের জামায়াত তথা দল বা গোষ্ঠী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের ২ স্থানে শব্দটি এসেছে যুগ বা কাল অর্থে; ২ স্থানে দ্বীন অর্থে এবং এক স্থানে ভালো ও কল্যাণের আদর্শ বা ধারক অর্থে উম্মাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
মুসা আ. যখন মাদইয়ানের জলাধারের কাছে পেঁৗছালেন,

“তখন তিনি দেখলেন একটি উম্মাহ (অর্থাৎ একদল লোক) তাদের পশুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে।” সূরা কাসাস : ২৩

এখানে পশুকে পানি পান করানো লোকদেরকে একটি উম্মাহ বলা হয়েছে। কারণ পানি পান করানোর বাসনা তাদেরকে একত্রিত করেছে।
আবার আল্লাহ তায়ালা বলেন

“হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত করো এবং আমাদের বংশধর থেকে তোমার অনুগত একটি উম্মাহ সৃষ্টি করো।” সূরা বাকারা : ১২৮

এখানে অনুগত বংশধরদের একটি উম্মাহ বলা হয়েছে। কারণ আল্লাহর অনুগত হওয়াটা তাদেরকে একত্রিত করেছে।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—

“তোমাদের মধ্যে এমন একটি উম্মাহ থাকা উচিত, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকার্যের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কার্য থেকে নিষেধ করবে। আর এ সকল লোকই হচ্ছে সফলকাম।” সূরা আল ইমরান : ১০৪

এখানে কল্যাণের দিকে আহ্বানকারী লোকদেরকে একটি উম্মাহ বলা হয়েছে। কারণ হকের ব্যাপারে পারস্পরিক পরামর্শদান এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করতে গিয়ে পাওয়া বিপদ—মুসিবত তাদেরকে একত্রিত করেছে।

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—
“ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রত্যেকটি জীব এবং (বায়ুমন্ডলে) নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রত্যেকটি পাখি তোমাদের মতই এক একটি উম্মাহ।” সূরা আনয়াম : ৩৮

উপর্যুক্ত আয়াতগুলোর প্রত্যেকটিতেই বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী ও শ্রেণিকে উম্মাহ বলা হয়েছে, কারণ তাদের মাঝে আচার—আচরণ ও জীবনধারণ পদ্ধতির দিক থেকে সামঞ্জস্য বিদ্যমান।
উম্মাহ শব্দের অর্থের ক্ষেত্রে নববি সুন্নাহও কুরআনেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। কুরআন যে যে মর্ম ও অর্থ উম্মাহ শব্দ দ্বারা বুঝিয়েছে, সুন্নাহও উম্মাহ শব্দ দ্বারা সেই একই অর্থ উদ্দেশ্য করেছে। রাসূল সা. বলেছেন—

“আমার উম্মাহর কখনোই পখভ্রষ্টতার উপর একত্রিত হবে না।”

এখানে উম্মাহ বলতে উম্মাতুল ইজাবাহকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলের দাওয়াতে সাড়া দেওয়াটা তাদের সবাইকে একত্রিত করে এক উম্মাহয় পরিণত করেছে।

রাসূল সা. বলেছেন—
“আমার উম্মাহর দুইটি দল আছে, ইসলামে যাদের কোন অংশই নাই। যথা— কাদরিয়া ও জাবরিয়া।” তিরমিযি : ২১৪৯

এ হাদিস থেকে দেখা যাচ্ছে, অবাধ্যতা সত্ত্বেও তাদেরকে উম্মাহ বলা হচ্ছে; উম্মাাহ হিসেবে একত্রকারী কার্যকারণের আওতার বাহিরে তারা যাচ্ছে না।

রাসূল সা. আরও বলেছেন—
“আমার উম্মাহর একটি দল সর্বদা আল্লাহর নির্দেশের উপর স্থির থাকবে। তাদের বিরোধীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না।” ইবনু মাযাহ : ০৭

অনুরূপভাবে এ হাদিসেও দেখা যাচ্ছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এ দলকে উম্মাহ বলা হয়েছে। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়াটা তাদেরকে উম্মাহ হিসেবে একত্রকারী কার্যকারণের আওতার বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে না।
রাসূল সা. আরও বলেছেন—
“পিঁপড়ারাও উম্মাহগুলোর (অর্থাৎ জাতিগুলোর) মাঝে একটি উম্মাহ (অর্থাৎ জাতি)।” ইবনু হিব্বান : ৫৬১৪

রাসূল সা. আরও বলেছেন—
“কুকুররা যদি উম্মাহগুলোর (অর্থাৎ জাতিগুলোর) মাঝে একটি উম্মাহ (অর্থাৎ জাতি) না হতো, তাহলে আমি এগুলোকে হত্যা করার নির্দেশ দিতাম।” নাসায়ি : ৪২৯০, আবু দাউদ : ২৮৪৫, তিরমিযি : ১৪৮৯, ইবনু মাযাহ : ৩২০৫, আহমাদ : ১৬৭৮৮।

অর্থাৎ কুকুররাও একটি উম্মাহ বা জাতি। এ ধরনের আরও বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে।
অতএব, যে কোন কারণ বা বিষয়েই একত্রিত একটি দল বা গোষ্ঠীকে উম্মাহ বলা হয়। উম্মাহ গঠনে একত্রিতকারী বিষয়গুলোকে নির্দিষ্ট কিছু কারণের মাঝে সীমাবদ্ধ করা কিংবা উম্মাহ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ করা; কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। উম্মাহর এ মর্মার্থই আমরা আরবি উৎস থেকে জানতে পারি। উম্মাহর এ মর্মার্থই আমাদের ইসলামী সভ্যতায় প্রচলিত ছিল।
এখন উম্মাহর সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে এই যে ব্যাপকতা, যা সকল প্রকার শর্তারোপ ও সীমাবদ্ধকরণকে নাকোচ করে; দল বা গোষ্ঠীকে একত্রকারী সকল কারণকেই উম্মাহ হওয়ার বিশুদ্ধ কারণ হিসেবে বিবেচনা করে এবং উম্মাহ হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন সংখ্যার শর্তও আরোপ করে না; এর পক্ষে কি কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে? উম্মাহ শব্দের মর্মার্থ নির্ধারণে আমাদের অনুসৃত ও আরবি উৎস থেকে গৃহীত এই রীতির পক্ষে সভ্যতার বৈচিত্র্য ও জাতিসত্ত্বার স্বাতন্তে্র্যর ইতিহাসে কি কোন ঐতিহাসিক দলিল বর্তমান আছে; যা বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার সময় সামনে আনা যাবে? আমাদের আরব ইসলামী সভ্যতায় এমন কোন কিছু আছে কি যা উম্মাহর মর্মার্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে আলোকপাত করবে?

ইসলামী রাষ্ট্রে্র উম্মাহর মর্মার্থ (পৃষ্ঠা ১২ থেকে ১৩.৫)

পাশ্চাত্য সভ্যতায় ‘উম্মাহ’ বা ‘জাতি’ পরিভাষাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে তাদের ইতিহাসের এমন এক লগ্নে যখন তাদের মাঝে জাতীয়তাবাদী ভাবপ্রবণতা তীব্র আকার ধারণ করে এবং তারা তাদেরকে জাতি হিসেবে একত্রকারী খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক বলয় থেকে বের হতে শুরু করে। মূলত স্বাধীনতা ও শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ছিল ইতিহাসের এ পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারপর পুঁজিবাদী স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে উদগত বিরোধ পাশ্চাত্য সভ্যতার জাতিগুলো ও জনগণের মাঝে জাতীয়তাবাদী পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাসের সেই পর্যায়ে পশ্চিমা জাতির চিন্তাকাঠামোর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন জাতির মধ্যকার বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার কারণগুলো তালাশ করা। তাই আমরা দেখতে পাই তারা উম্মাহর সংজ্ঞায় এমন কিছু সংকীর্ণকারী বৈশিষ্ট্য ও শর্ত যোগ করছে, যা তাদের জাতীয়বাদী স্বাতন্তে্র্যর চেতনা উজ্জীবিত করে এবং তাদের জাতিসত্বাকে তীব্র করে; যেন সেই সভ্যতার প্রতিটি জাতিই অর্থসম্পদ ও আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে প্রথমত ইউরোপে তারপর ইউরোপের বাইরে নিরস্ত্র কিংবা সশস্ত্র লড়াইয়ে জড়িত হয়। এ কারণেই বিগত বা বর্তমান দুনিয়ায়ও আমরা পাশ্চাত্যের জাতিগুলোকে দেখতে পাই অর্থসম্পদ ও সস্তা শ্রমের উৎস সন্ধান এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তার করতে পারস্পরিক লড়াই করছে।
এগুলোই ছিল মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতায় উম্মাহ বা জাতি শব্দের মর্মার্থ ও সংজ্ঞা নির্ধারেণে প্রধান অনুঘটক৷

কিন্তু আমাদের আরব ইসলামী সভ্যতায় উম্মাহ পরিভাষার মর্মার্থ ও সংজ্ঞা নির্ধারণের অনুঘটক পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বরং আরও বলা যায়, ‘উম্মাহ’ বা জাতি পরিভাষার আমাদের মর্মার্থ এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

আমাদের সভ্যতার আরব ইসলামী পর্যায়, যা আমাদের ভূখণ্ডগুলোতে প্রকাশিত হয় ইসলাম আবির্ভুত হওয়ার পরপরই, এটা মূলত ইসলাম পূর্ববর্তী সভ্যতাগত ও চিন্তাগত ঐতিহ্যেরই একটি পরিবর্ধিত রূপ। উম্মাহর এ আরব ইসলামী পর্যায় মূলত বৃহৎ কোন কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা কোন বন্ধন থেকে আলাদা হওয়া ছিল না।

ইসলামী সভ্যতায় ‘উম্মাহ’ শব্দের মর্মার্থ (পৃষ্ঠা ২৮ থেকে ৩২)

বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সহযোগে গঠিত সুপ্রাচীন ও সুগভীর ইতিহাসের অধিকারী এ সভ্যতার পর্যায়গুলোর মাঝে আরব ইসলামী পর্যায়টি সর্বপ্রথম ইসলামী সভ্যতার জাতি ও রাষ্ট্রে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয় ইসলাম আবির্ভুত হওয়ার প্রায় দুই শতাব্দী পর।
নতুন আবির্ভুত এ দ্বীন ইসলাম ঘোষণা করে, এর প্রতি ঈমান আনতে হবে অন্তর দ্বারা এমনভাবে সত্যায়ন করার মাধ্যমে; যা একিন বা সুদৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে পেঁৗছে যাবে। ফলে, এ ঈমান জোরজবরদস্তি কিংবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন—
এ দ্বীন তার সাথে পূর্ববর্তী আসমানি রিসালাতের অধিকারী জাতিগুলোর সম্পর্ক বর্ণনা করেছে— একত্বের আওতায় ভিন্নতার প্রতি বিশ্বাস দ্বারা।
আল্লাহর দ্বীন সবসময়ের জন্য একটাই। আর মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে ঘোষিত হচ্ছে—
মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে এটাই এ দ্বীনের আকিদা এবং তাঁর প্রেরণের উদ্দেশ্যও এটাই।
কুরআন সম্পর্কে বলা হচ্ছে—
আকিদার ক্ষেত্রে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা—
“তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন এমন দ্বীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নুহকে, আর যা আমরা ওহি করেছি আপনাকে এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহিম, মুসা ও ঈসাকে এ বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে বিভেদ সৃষ্টি কর না। তুমি মুশরিকদেরকে যার প্রতি আহ্বান করছো তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে তিনি দ্বীনের দিকে পথপ্রদর্শন করেন।” সূরা শুরা : ১৩
“তোমরা বল, ‘আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি এবং যা আমাদের প্রতি এবং ইব্রাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যা মূসা ও ঈসাকে প্রদান করা হয়েছে এবং যা অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রদত্ত হয়েছে, তাতেও (বিশ্বাস করি)। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণকারী।” সূরা বাকারা : ১৩৬

দ্বীনের একতার এ ঘোষণা বহুত্বকে(চষঁৎধষরংস) স্বীকৃতি দানকারী কার্যকারণ সৃষ্টি করেছে এবং এটা পূর্ববর্তী রাসূলদের উম্মাহর দ্বীনি উত্তরাধিকার আত্নীকরণের দিকেও ধাবিত করেছে। এ কার্যকারণ আরও শক্তিশালী হয়, যখন ইসলাম দ্বীনি শরিয়তের বহুত্বের ঘোষণা দেয়। অতএব, দ্বীনি একত্বের আওতায় শরিয়তি বা পদ্ধতিগত বহুত্ব ও ভিন্নতা থেকে আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য এমন এক বিষয়, যা ইসলামকে অনন্যতা দান করেছে। আর অনন্যতার এ দিকটি হচ্ছে অন্যান্য আসমানি কিতাবের অনুসারী (যেমন— ইহুদি, খ্রিস্টান) , আসমানি কিতাবের অনুসারীদের সাথে যাদের মিল আছে (যেমন— অগ্নিপূজক) এবং এর সাথে তুলনা করে মানবরচিত ধর্মগুলোর (যেমন— ভারত ও দূরপ্রাচ্যের ধর্মগুলো) অনুসারীদের সাথেও সহাবস্থানকে ইসলাম কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়া। আর এটা সম্ভব হয়েছে ঈমানদার উম্মাহ বা জাতির উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, মুশরিক বা কাফিরদের উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নয়। ইসলাম তার সূচনাকাল থেকেই এ উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে আসছে। আমাদের ফকিহরাও স্থান ও কাল প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে এ উদার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন করে এসেছে।

এটাই ছিল সর্বপ্রথম বার যখন এমন একটি দ্বীন আসল, যার কিতাব ও রাসূল শরিয়ত তথা আইনকানুনের ক্ষেত্রে বহুত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওতায়ালা বলেন—

“নিশ্চয়ই আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছিলাম, তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবিগণ, রাব্বানিগণ (আল্লাহভক্তরা) এবং পন্ডিতগণও ইহুদিদেরকে তদনুসারে বিধান দিতো, কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল এর (সত্যতার) সাক্ষী। সুতরাং তোমরা মানুষকে ভয় করো না, কেবল আমাকেই ভয় কর এবং আমার আয়াত নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করো না। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই অবিশ্বাসী (কাফির)। আর তাদের জন্য তাতে (তওরাতে) বিধান দিয়েছিলাম যে, প্রাণের বদল প্রাণ, চোখের বদল চোখ, নাকের বদল নাক, কানের বদল কান, দাঁতের বদল দাঁত এবং জখমের বদল অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ তা ক্ষমা করলে, তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম। আমি তাদের (নবিগণের) পরে পরেই মারিয়াম—তনয় ঈসাকে তার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে প্রেরণ করেছিলাম এবং সাবধানীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাকে ইঞ্জিল দিয়েছিলাম, তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। ইঞ্জিলওয়ালাদের উচিত, আল্লাহ তাতে (ইঞ্জিলে) যা নাযিল করেছেন, তদনুসারে বিধান দেওয়া। আর যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুসারে বিধান দেয় না, তারাই পাপাচারী। এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষকরূপে আমি তোমার প্রতিও সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুসারে তুমি তাদের বিচার—নিষ্পত্তি করো এবং যে সত্য তোমার নিকট এসেছে, তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরিয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদের সকলকে এক জাতি করতে পারতেন।” সূরা মায়িদা : ৪৪—৪৮

আমাদের মুফাসসিরগণ যখন এ বাস্তবতার সামনে দাঁড়ালেন, তখন তারা একত্বের আওতায় বহুত্ব বা ভিন্নতার এ অধ্যায় সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেন—

“শরিয়ত হচ্ছে এমন এক বাহ্যিক পথ যার মাধ্যমে নাযাত বা পরাকালীন মুক্তি লাভ করা যায়। অতএব আলোচ্য আয়াতের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা তাওরাতকে তাওরাতের অনুসারীদের জন্য, ইঞ্জিলকে ইঞ্জিলের অনুসারীদের জন্য এবং কুরআনকে কুরআনের অনুসারীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এ ভিন্নতা হচ্ছে আইনকানুন ও ইবাদতের ক্ষেত্রে। কিন্তু সবকিছুর মূল তাওহিদ কিন্তু একই, এটার মাঝে কোন ভিন্নতা বা বহুত্বের অবকাশ নেই। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন— ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদের সকলকে এক জাতি করতে পারতেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা চাইলে তোমাদের সকলের শরিয়তও এক করে দিতে পারতেন।”

অর্থাৎ প্রথমবারের মতো এমন এক শরিয়ত আসলো, যা কেবল নিজের অনুসারীদের জন্যই নাযাতকে সীমাবদ্ধ করে না। বরং এটা একত্বের আওতায় শরিয়তগত— পথ, পন্থা ও পদ্ধতিগত বহুত্ব ও ভিন্নতার স্বীকৃতি দেয়। আর এ বহুত্বের পথ ধরেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির জগতে সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যতা আসে এবং এটা উম্মাহর ধারণা ও এর সীমাকে আরও প্রসারিত করে। বরং আমরা তাফসিরের ইমামদের মাঝে কিছু ইমামকে দেখতে পাই, তারা মানুষের মধ্যকার এ বহুত্বকে ইলাহি হিকমত ও রব্বানি অভিপ্রায়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন—
“তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে তিনি সকল মানুষকে এক উম্মাহ করতে পারতেন। কিন্তু তারা সদা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে যাদের প্রতি তোমার প্রতিপালক দয়া করেন তারা নয়, আর এ জন্যেই তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।” সূরা হুদ : ১১৮—১১৯

সাঈদ ইবনু যুবাইর (৪৫ হিজরি থেকে ৯৫ হিজরি বা ৬৬৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭১৪ হিজরি) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন—

“আয়াতে এক উম্মাহ দ্বারা এক ইসলামী মিল্লাত বা এক ইসলামী শরিয়ত বুঝানো হয়েছে।”

মুজাহিদ ইবনু জাবর আল মাক্কি (২১ হিজরি থেকে ১০৪ হিজরি বা ৬৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭২২ খ্রিস্টাব্দ) এবং কাতাদা ইবনু দিয়ামা আস সাদুসি (৬১ হিজরি থেকে ১১৮ হিজরি থেকে ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ বা ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দ) “কিন্তু তারা সদা মতভেদ করতেই থাকবে” আয়াতাংশের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন—
“এ আয়াত নির্দেশ করছে মানুষ বিভিন্ন দ্বীন বা শরিয়তের নিয়ে বিভক্ত অতি অবশ্যই থাকবে।”
হাসান আল বসরি (২১ হিজরি থেকে ১১০ হিজরি বা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭২৮ খ্রিস্টাব্দ) , মুকাতিল ইবনু সুলাইমান (১৫০ হিজরি, ৭৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবং আতা ইবনু দিনার (১২৬ হিজরি, ৭৪৪ খ্রিস্টাব্দ) “আর এ জন্যেই তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন” আয়াতাংশের তাফসির প্রসঙ্গে বলেন—

“এখানে মানুষের মাঝে বিদ্যমান ভিন্নতা বা বহুত্বের দিকে ইশারা করা হয়েছে। অন্যকথায়, মানুষকে এই ভিন্নতা বা বহুত্বের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।”
আমরা উসুলুল ফিকাহর আলেমদেরকেও পূর্ববর্তী উম্মাহর শরিয়ত সম্পর্কে আলোচনা করতে দেখি। সারাখসি (৪৮৩ হিজরি, ১০৯০ খ্রিস্টাব্দ) তার ‘উসুলুল ফিকাহ’ গ্রন্থে বলেন—

“আমাদের নিকট সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কথা হচ্ছে— পূর্ববর্তী নবিদের শরিয়ত আমাদের নবি সা. এর জন্যও শরিয়ত, যতক্ষণ না তা রহিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।”

শরিয়ত তথা আইনকানুনের ক্ষেত্রে বহুত্বের স্বীকৃতি, ভিন্ন শরিয়তের অনুসারীদের সাথে সহাবস্থানের বৈধতা এবং তাদের শরিয়তের অরহিত বিষয়ের উপর নির্ভর করার ক্ষেত্রে ইসলাম অনুসৃত এ রীতি তার স্বীয় সভ্যতার মাঝে অন্যদের আত্তীকরণে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়াও এর মাধ্যমে আরব ইসলামী সভ্যতার ধারণা ও এর সীমা প্রসারিত হয়েছে। ইসলাম অনুসৃত এ রীতি অমুসলমানদেরকে আরবদের পতাকা ও রাষ্ট্রের অধীন, ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতার অধীন থেকে সভ্যতা বিনির্মানের জন্য কাজ করে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ইসলাম যেমন তার আওতায় প্রবেশ করা জাতিগুলোর সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকারকে পুনর্জীবন দান করেছে, ঠিক তেমন অন্যান্য শরিযতের অনুসারীরাও আরব ইসলামী সভ্যতা বিনির্মাণ ও এর উন্নয়নকল্পে কাজ করে গেছে। আর তাদের গির্জাগুলো, তাদের পাদ্রিরা তাদের সভ্যতার উত্তরাধিকারকে পুনর্জীবন দান করবে দূর, বরং তাদের উপর এমন নীতি চাপিয়ে দিয়েছিল; যার ফলে সেগুলো কেবল মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে গেছে।
যে দ্বীন তাদেরকে শরিয়ত বা আইনকানুনের ক্ষেত্রে বহুত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেই দ্বীনের রাষ্ট্রই তাদেরকে মুসলমানদের সমান অধিকার দান করেছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলমানদের জন্য যে অধিকার স্বীকৃত, তাদের জন্যও একই অধিকার স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুসলমানদের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত, তাদের উপরও একই দায়িত্ব অর্পিত। তাই তাদেরকে সমানভাবে বিবেচনাকারী এ দ্বীন ও রাষ্ট্রের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা উম্মাহর সভ্যতার আরব ইসলামী যুগ বা পর্যায় নির্মাণ করতে মুসলমান জ্ঞানীগুণীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে অংশগ্রহণ করেছে।

অথচ ইসলামী দুনিয়ায় প্রবেশ করার আগে এ উম্মাহর জাতিগুলো ভিন্ন ভিন্ন একাধিক উম্মাহয় বিভক্ত ছিল।