সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে ঐক্য ধারণা: সম্ভাব্য পদ্ধতি
ড. হাফিজুর রহমান
ভূমিকা:
মুসলিম বিশ্বে ঐক্যের বিষয়টি সমসাময়িক সময়ে বিশেষত খেলাফত পরবর্তী মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। হাজারো সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা এর উপর হয়েছে। বিষয়টি তার গুরুত্বের মতোই জটিলও বটে। এর ধর্মীয় তথা দ্বীনি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকসহ সকল দিকেই নাতিদীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে। একাডেমিয়াতে এর উপর বিস্তর আলোচনা রয়েছে। শতশত প্রবন্ধ, বই ও থিসিসে এর নানাদিকগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এই প্রবন্ধে (আপাতত আলোচনায়) আমরা কিছুটা তাত্ত্বিক দিক আলোচনা করে সমসাময়িক বিশ্বে ঐক্য কিভাবে হতে পারে এ বিষয়ে বাস্তবিক কিছু করণীয় তথা মডেল তুলে ধরতে চাই। বিশেষত ঐক্যের চেষ্টাগুলো নিয়ে পর্যালোচনা এবং ঐক্যের প্রায়োগিক দিক নিয়েই বিশদ আলোচনা করতে চাই। সময় সংক্ষিপ্তার কারনে শুধু পয়েন্টগুলোই এখানে উল্লেখ করা হল।
১. ইসলামে ঐক্য ধারণা
১.১. কুরআনের নির্দেশনা
কুরআনে বারবারই ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর দ্বীনকে আকড়ে ধরে রাখতে বলা হয়েছে (বিশেষত, সূরা আল ইমরান: ১০৩)। মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ সমাজ বুঝাতে দুটো শব্দ কুরআনে বারবার এসেছে: উম্মাহ এবং মিল্লাহ। এই আলোচনায় উম্মাহ শব্দকেই বেশী ফোকাস করতে চাই। উম্মাহ শব্দটি কুরআনে ৬২ বার এসেছে যদিও শুধু মুসলিমদের জন্য নয় বরং পূর্ববর্তীদের কথা উল্লেখ করতে গিয়েও উম্মাহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা বাকারার ১৪৩ নম্বর আয়াত আমাদেরকে এ বিষয়টিতে খুবই স্পষ্ট বার্তা দেয়,
وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَ طًا لِّتَکُوۡنُوۡاشُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ وَ یَکُوۡنَ الرَّسُوۡلُ عَلَیۡکُمۡ شَهِیۡدًا
সূরা আম্বিয়ার ৯২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,
اِنَّ هٰذِهٖۤ اُمَّتُکُمۡ اُمَّۃً وَّاحِدَۃ۫ وَّ اَنَا رَبُّکُمۡ فَاعۡبُدُوۡنِ ﴿۹۲﴾
ইসমাইল আল ফারুকী তার বইতে উল্লেখ করেন, উম্মাহ ছাড়া ইসলাম হতে পারেনা (“No Islam without the ummah.”) (Akram, 2007)
১.২. হাদীসের নির্দেশনা
১. তিনজন সফরের বের হলে একজন নেতা ঠিক করে নিবে সংক্রান্ত হাদীস
২. হযরত (ওমর.): জামায়াত ছাড়া ইসলাম নেই সংক্রান্ত হাদীস। যা আদতে পুরো উম্মাহর ঐক্য বুঝায়।
৩. আমার উম্মত ভূলের উপর একমত হবেনা।
১.৩. উম্মাহ পরিভাষা ও ঐক্য ধারণা
পরিভাষা হিসেবে উম্মাহ একটি বিশাল অর্থবোধক একটি শব্দ যার অর্থ হিসেবে উম্মাহই সবচেয়ে পারফেক্ট। কারন কমিউনিটি, জাতি এগুলোর কোনোটাই উম্মাহর পারফেক্ট অর্থ নয়। উম্মাহ এমন এমটি পরিভাষা যা শুধু একটি জাতি, বর্ণ, ভাষা কিংবা গোত্রকে নয় বরং গোটা মুসলিমদের বুঝানো হয়।
১.৪. ইসলামের ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালে ঐক্য
– রাসূল (সা.) সর্বদা তার সাহাবীদেরকে ঐক্যের বিষয়টিতে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিয়েছেন। খোলাফায়ে রাশেদা এই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। সিফফিনের যুদ্ধের পর একটি বিভক্তি দেখা যায়। উমাইয়্যা, আব্বাসী এবং উসমানীদের সময়ে পুরো মুসলিম বিশ্বে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে একতাবদ্ধ ছিল এবং কোনমতেই মুসলিম উম্মাহর ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে এমন কাজকে সমর্থন দেওয়া হয়নি। কখনো কখনো বিদ্রোহ দেখা গেছে যেমন ইমাম গাজ্জালীর সময়কালে বাতেনীদের উত্থান আমরা দেখি। তখন সালতানাত এবং উলামারা খলিফার পক্ষেই তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। বিদ্রোহ কিংবা গ্রুপিং এর ক্ষেত্রে সালতানাতগুলোর সংবিধান তথা আইনগ্রন্থে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল। মাজাল্লাতেও এ ধরনের বিষয়গুলো দেখা যায়।
২. প্রথম যুগের স্কলারদের লেখায় ঐক্য ধারণা
২.১. আল ফারাবী
ফারাবী প্রথমদিকের মুসলিম স্কলারদের মাঝে অন্যতম স্কলার যিনি সমাজের ইন্টিগ্রেশনের কথা বলেছেন। “পরস্পর সমন্বয়” তার রাষ্ট্র তথা রাজনৈতিক তত্ত্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। তার অনেকগুলো বইতে বিশেষত আল মাদিনাতুল ফাদিলা, এবং তাহসিলুস সাদাতে একে অপরের সমন্বয়ের মাঝেই কেবল সুখ সম্ভব বলে মতামত দিয়েছেন। তাওহীদকে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছোটো, মাঝারী এবং বড় তিন ধরনের রাষ্ট্রের তথা সমাজের কথা বলেছেন। বড় রাষ্ট্র বলতে এখানে উম্মাহ উদ্দেশ্য। রাসূল (সা.) মদীনা সিটি স্টেটকে একটি ইসলামিক উম্মাহতে পরিণত করেছিলেন (আহমেদ, ১৯৮১)।
২.২. আল মাওয়ার্দী
আল মাওয়ার্দী একতাবদ্ধ সালতানাতের (ইসলামী রাষ্ট) কথা বলেছেন এবং একই সময়ে একাধিক খলিফার বিষয়টি নাকচ করেছেন। একতাবদ্ধ এই রাজনৈতিক ঐক্যকে দ্বীনের জন্য জরুরী অবকাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
২.৩. ইমাম গাজ্জালী
বাতেনীদের উদ্ভবের সময় ইমাম গাজ্জালী আব্বাসী খলিফা আল মুজহাজহিরকে একমাত্র বৈধ খলিফা হিসেবে উল্লেখ করে একটি বই লেখেন ফাদায়ি আল বাতিনিয়্যাহ ওয়া ফাদায়িল আল মুজতাজহারিয়্যাহ যা “কিতাবুল মুজতাজহার” নামে পরিচিত।
২.৪. ইবনে খালদুন
আসাবিয়্যাহ তত্ত্ব। খেলাফত ও মুসলিম উম্মাহ।
৩. সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে ঐক্য ধারণা:
৩. ১. জামাল উদ্দিন আফগানী
আল ওয়াহদা আল ইসলামিয়্যাহ।
মাগরিব (আন্দালুস) থেকে মাশরিক (চীনের তানকিন প্রদেশ পর্যন্ত), উত্তরে ফাজান এবং দক্ষিনে নিরক্ষরেখার সারন্দিব পর্যন্ত একটি নিজস্ব সার্বভৌম শক্তি যারা নিজেদের প্রতিরক্ষা নিজেরাই নিশ্চিত করবে। তার মতে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিহত করতে মুসলমানদের এক হতে হবে।
৩. ২. রশিদ রিদা
খেলাফত পরবর্তী সময়ে নতুন করে খেলাফত প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব দিয়েছেন। এর রাজধানী হিসেবে মক্কা নাকি ইস্তান্বুল কোথায় হবে সেটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সর্বশেষ শাম তথা সিরিয়ায় হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন। তরুণ তুর্কি প্রসঙ্গ।
৩.৩. মাওলানা মওদুদী
আন্তর্জাতিক ইসলামী রাষ্ট্র
জাতীয়তাবাদকে নাকচ করেছে একটি সর্বব্যাপী ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপারে মতামত দিয়েছে।
৩.৪. হাসান আল বান্না
একটি সর্বব্যাপী উম্মাহর কথা বলেছেন। আরবিজমকে বর্ণবাদ এবং আগ্রাসন হিসেবে নয় বরং ইতিবাচকভাবে ইসলামী জাগরনের মাধ্যম হিসেবে সমর্থন করেছেন।
৩.৫. মালেক বেননাবী
ইসলামী সভ্যতার পূণবিনির্মানের কথা বলেছেন।
৩.৬. আল্লামা ইকবাল
উম্মাহর চেতনাকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঐক্যের আসল চেতনা (first and foremost a spiritual principle) হিসেবে উল্লেখ করেন। মুসলিম উম্মাহ চেতনা তত্ত্ব ও বাস্তবতা দুদিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এটা ইসলামের সামাজিক-রাজনৈতিক স্তম্ব্ তৈরী করতে কাজ করবে (Akram, 2007).
৪. সমসাময়িক মুসলিম বিশ্বে কতিপয় ঐক্য মডেল
সত্তরের দশক মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টার দিক থেকে বিবেচনা করলে সরচেয়ে সেরা সময় বলতে হবে।
৪.১. ওআইসি
৪.২. ডি–৮
৪.৩. আরবলীগ
৪.৪. তার্কিক স্টেট
৫. সমসাময়িক সময়ে ঐক্যের পথে বাধাসমূহ
৫.১. মাজহাবী ও মানহাজী দ্বদ্ধ
৫.২. পারস্পরিক অবিশ্বাস ও আস্থার অভাব
তুর্কি-আরবী, আরব-অনারব। আর মুসলিম বিশ্ব দিয়ে কী কিছু হবে? ইউরোপ, আমেরিকা ছাড়া চলা সম্ভব? এ ধরনের বিষয়গুলো আসে। আস্থার অভাব দেখা যায়।
৫.৩. আইডেন্টটিটি ক্রাইসিস
মুসলিম ভার্সেস পশ্চিমা, ট্রাডিশনাল ভার্সেস কন্টেমপোরারী, মৌলবাদী- প্রগতিশীল, আনাতলিয়ান-ইউরোপীয়ান। আমি উম্মাহর একজন এটা পরিচয় দিতে কত পারসেন্ট মুসলমান স্বস্থি অনুভব করে?
৬. ঐক্যের জন্য করণীয়সমূহ (মডেল)
৬.১. নেতৃত্ব
যেকোন ধরনের ঐক্যের জন্য নেতা জরুরী। দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া কোনোমতেই ঐক্য হবেনা কিংবা টিকবেনা। এমন একজন নেতা লাগবে যার অধীনে পুরো মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করবে যে এই নেতার অধীনে ঐক্য সম্ভব।
৬.২. রাজনৈতিক চিন্তার ঐক্য: মুসলিম উম্মাহ
এটা জরুরী নয় যে এখনই সকল মুসলিম দেশগুলোকে একসাথে (একই রাষ্ট্র) হয়ে ঐক্য করে ফেলতে হবে। একটা আনডারস্টেন্ডিং ডেভেলপ করা যে, আমরা একসাথে কি কি করতে পারি।
ঐক্যের শুরুটা আন্তরাষ্ট্র দিয়ে শুরু হতে পারে। ধীরে ধীরে একটা এলাকায় রাজনৈতিক ঐক্য হতে পারে (যেমন: উপসাগরীয় এলাকা/ আরব এলাকা) এরপর গোটা উম্মাহ। তবে এখানে এক রাষ্ট্রের অধীনেই চলে আসতে হবে তা জরুরী না। মিউচ্যুয়াল আনডারস্টেন্ডিং ডেভেলপ হলে অনেক বিষয়ে কাজ করা সম্ভব হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং বিশেষত প্রতিরক্ষা। কেউ মুসলমানদের দিকে চোখ বড় করে তাকানোর সুযোগ পাবেনা তখন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন আমাদের সামনে একটা জ্বলন্ত উদারহণ (Smith, 1992)।
যদিও বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভাঙ্গার পথে। হাঙ্গেরী, ইটালীর মতো দেশগুলোতে এক্সট্রিম ন্যাশনালিস্টরা…
৬.৩. সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর ও পাকিস্তান এই চারটি দেশ ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
৬.৪. আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করা
৫. আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কগুলো যতবেশী সম্ভব শক্তিশালী করা
মুসলিম দুটো দেশের মাঝে যত সমন্বয় চুক্তি, যাতায়াত বাড়বে তাতে উম্মাহই উপকৃত হবে।
৬. রাজনৈতিক ঐক্য/ সমন্বয় অনেক সময় কঠিন হলেও শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং দাওয়াহর ক্ষেত্রে সমন্বয় করা যায়।
রাজনৈতিক ঐক্য না থাকলেও এক বিশ্ববিদ্যালয় আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ কাজ করতে পারে। ব্যবসায়ীদের মাঝে সমন্বয় হতে পারে।
শেষ কথা
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বিশ্বায়ন এবং রাষ্ট্র ধারণার যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে সেখানে পরিচয় (Identity) এবং ঐতিহ্য (Tradition) আবার নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হবে (Fukuyama, 2020)। যদি উম্মাহর চেতনা নিয়ে বাস্তবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায় তবেই কেবল একটি ইসলামী সভ্যতার নতুনভাবে গোড়াপত্তন করা সম্ভব।
রেফারেন্স
Ahmed, M. (1981). Integration of the Muslim World: Problems and Prospects. Pakistan Horizon, 34(1), 3-15.
Akram, E. (2007). Muslim ummah and its link with transnational Muslim politics. Islamic Studies, 381-415.
Bakar, O. (2012). The Identity Crisis of the Contemporary Muslim Ummah: The Loss of Tawhidic Epistomoly as its Root Cause. ICR Journal, 3(4), 637-653.
Fukuyama, F. (2020). 30 years of world politics: What has changed?. J. Democracy, 31, 11.
Pramanik, A. H. (2003). Development strategy and its implications for unity in the Muslim World. American Journal of Islam and Society, 20(1), 63-87.
Smith, A. D. (1992). National identity and the idea of European unity. International affairs, 68(1), 55-76.
