উম্মাহর ঐক্যের অতীত দৃষ্টান্ত:
অনৈক্যের পরিণতি
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
উপমহাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন মাসলাক ও চিন্তাধারার ওলামা ও মাশায়েখ ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে জমায়েত হয়ে অভিন্ন কর্মসূচী দেয়ার এক গৌরবদীপ্ত রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন, যা আগামী দিনে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রিসিডেন্স হিসেবে ভূমিকা রাখবে। ১৯৪৭ সালে দেশবিভক্তির পর পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের ক্ষমতার ভার এমন ব্যক্তিদের প্রতি সোপর্দ করা হয় যারা মুখে ইসলামের বুলি কপচালেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে ছিল তাদের মধ্যে অনেকের ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা ছিল অস্পষ্ট এবং ইসলামী জীবনপদ্ধতি অনুশীলনে তারা ছিলেন অনভ্যস্ত। আমলারা ছিলেন কমবেশী সবাই ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। রাজনীতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামের বিপ্লবী ভূমিকার উপর তাদের বিশ্বাসও সুদৃঢ় ছিল না। ক্ষমতার বাগডোর হাতে আসার পর তৎকালীন পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বিশেষতঃ মুসলিম লীগারগণ ইংরেজ কায়দায় সরকার পরিচালনা করেন। দেশের জন্য স্থায়ী সংবিধান রচনা সম্ভব হয়নি। ধন-বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে, গোলামী যুগের শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামী ছাঁচে নতুনভাবে গড়ে তোলা গেল না। স্বাধীনতা আটকে পড়ে রইল একটি ভূখন্ড ও একটি পতাকায়। ক্ষমতাসীন নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রæত ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বারবার ওয়াদা খেলাফি করেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের যিন্দাদিল ওলামায়ে কেরাম নিশ্চুপ বসে রইলেন না। তারা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে স্মরণ করে দেন যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওয়াদা দিয়ে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিল। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ওলামাদের অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগ কাজে লাগান পুরোপুরি। তাদের ধারণা ছিল ওলামারা এক হতে পারবেন না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবনে তৎকালীন পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম ভুল করেননি। বিভিন্ন মাসলাক ও মতাদর্শের ৩১ জন ওলামা সময়ের চাহিদাকে পুরোপুরি বিবেচনায় এনে ঐক্য ও সংহতি গড়ার এক বিপ্লবী পদক্ষেপ হাতে নেন। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ওলামাদের সম্মেলনে ২২ দফা শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি রচিত হয়।
সিদ্ধান্ত হয় যে, সৃষ্টিকর্তা ও আইনদাতা একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। রাষ্ট্রের সব আইন-কানুন কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে রচিত হবে এবং এমন কোন আইন প্রণয়ন করা যাবে না অথবা অর্ডার বা অর্ডিন্যান্স জারী করা যাবে না, যা কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী হয়। যদি দেশে পূর্ব হতে এমন কোন আইন জারী থাকে যা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী, তবে পরিষ্কার ভাষায় একথা স্বীকার ও ঘোষণা দিতে হবে যে, ওই সব শরীয়ত বিরোধী আইন ক্রমশঃ সীমাবদ্ধ সময়ের মধ্যে রহিত করা হবে অথবা শরীয়তসম্মত রূপে পরিবর্তিত ও সংশোধিত আইন রচনা, প্রবর্তন ও জারী করা হবে। রাষ্ট্র ভৌগোলিক সীমা, বর্ণ, বংশ বা অন্য কোন বস্তুবাদ বা জড়বাদের ভিত্তির উপর গঠিত বা পরিচালিত হবে না। বরং রাষ্ট্র হবে আদর্শবাদী এবং আদর্শের ভিত্তি হবে ইসলাম ও ইসলামের জীবন পদ্ধতি ।
১৮ জানুয়ারী সংসদে এটা গৃহীত হয়। ২২ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের ইসলামী সংবিধান রচিত হয়। অবশ্য নানা টালবাহানা করে ক্ষমতাসীন চক্র ইসলামী সংবিধান চালু করতে এগিয়ে আসেনি। স্বার্থান্বেষী মহল সামরিক শাসন জারী করে। সাংবিধানিক কর্মকাÐ স্থগিত করে দেয়। আশির দশকে জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্বৈরাচারী শাসনের নিগড়ে পাকিস্তানের জনগণ যখন বন্দী তখন জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা মুফতী মাহমুদ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের সাথে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭৭ সালে গঠিত হয় পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (পিএনএ) নামক ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম। মাওলানা মুফতি মাহমুদ পিএনএ-র চেয়ারম্যান হিসেবে গণআন্দোলন সৃষ্টি করে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পিএনএ পরবর্তীতে ‘তাহরীকে নিফাযে নিযামে মুস্তাফা’ নামে ইসলামী আন্দোলন জোরদার করেন।
বাংলাদেশের বিবেচনায় ইসলামী শক্তির ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা অতীতের যে কোন পরিস্থিতি ও সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশী। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, দেশীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইসলামীশক্তির একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম একান্ত প্রয়োজন। ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশে ইসলামী শক্তির এক মজবুত ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশে লাখ লাখ আলিম, ইসলামী স্কলার, ওয়ায়েজ, হক্কানী পীর ও মাশায়েখ আছেন যাদের সাথে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সংযোগ রয়েছে। এসব দ্বীনি ব্যক্তিত্বের মেহনতের ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী দ্বীনমুখী হয়েছে। ইসলামের বুনিয়াদী ইলম, জিহাদী জযবা ও আখিরাতের চেতনায় জনগণ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দ্বীনের মুহাব্বত ও ইসলামী আদর্শের চেতনাবোধ জনগণের মাঝে এত প্রবল যে, কোন মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহী ইসলাম, কুরআন বা মহানবী সাঃ সম্পর্কে বিষোদগার করতে রীতিমত ভয় পায়। কদাচিৎ অশালীন মন্তব্য করলেও ঈমানদার জনগণ প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন কিন্তু বাংলাদেশের ইসলামী শক্তিগুলো বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন থাকায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠা স্বপ্নই রয়ে গেল। এ সুযোগে ইসলামের চিহ্নিত শত্রæরা নানামুখী চক্রান্ত, ভ্রান্ত মতবাদ ও অপসংস্কৃতি দ্বারা সমাজকে বিষিয়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। ইসলামী ব্যক্তিত্বদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। সেবার নামে চালু করা হয়েছে মহাজনী প্রথা, নারীর ক্ষমতায়নের নামে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বেলেল্লাপনা। বিভিন্ন মাসলাকের অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে যেভাবে ইখলাসের সাথে দ্বীনের যতটুকু খিদমত আঞ্জাম দিচ্ছেন সবার খিদমতের কদর করা প্রয়োজন। নিজেদের প্রচেষ্টাকে ইসলামের একমাত্র খিদমত মনে করলে এবং অন্যদের খিদমতকে মামুলি ও নগন্য মনে করলে ঐক্যপ্রক্রিয়া হুমকির সম্মুখীন হবে। সবার খিদমত একে অপরের পরিপূরক ও সম্পূরক। সবাই একই লক্ষ্যের অভিসারী, একই মনজিলের অভিযাত্রী। মাদরাসা, মসজিদ, খানাকাহ, ওয়াজ, দারুল ইফতা, হালকায়ে যিকির, তাবলীগ, দ্বীনি সাহিত্য ও সংবাদপত্র ইসলামী রাজনীতির খিদমতের সাথে জড়িত, সে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে জমায়েত করে যদি সংগঠিত করা যায় তাহলে ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত। গলিত সীসার প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ প্রচÐ ইসলামী শক্তির মোকাবেলা করা ইঙ্গ-মার্কিন ইহুদী অপশক্তির এদেশীয় দোসরদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। বাড়াবাড়ি ও অহংবোধের শিকার হয়ে আমরা যেন মহান আল্লাহর রাসূল সাঃ-এর ঐক্যের সে ঐতিহাসিক বাণীগুলো ভুলে না বসি।
‘মুমিনগণ এক দেহের মতোই তার চোখ যখন আক্রান্ত হয় তখন পুরো শরীর ব্যথা অনুভব করে, মাথায় যখন ব্যথা দেখা দেয়, পুরো শরীর তখন যন্ত্রণায় কাতর হয়।
’ ‘এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য প্রাসাদস্বরূপ, প্রতিটি ইট একে অপরকে আকড়ে ধরে আছে।”
স্মর্তব্য যে, যে মুসলিম সমাজ ও উম্মাহর ধ্বংস ও বিপর্যয় বিভেদ ও অনৈক্যের মাঝে নিহিত। হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতন, ফার্র্র্ডিন্যান্ডের হাতে স্পেনের পতন, লর্ড ক্লাইভের হাতে বাংলার পতন ছিল মুসলমানদরে কলহ, বিভেদ ও অনৈক্যের অনিবার্য ফলশ্রæতি। মুসলমানরা যখন ঐক্যবদ্ধ ছিল, তখন তাদের অগ্রযাত্রাকে কেউ রুখতে পারেনি। রোমান ও পারস্য সভ্যতা মুসলমানদের পদচুম্বন করেছে। হজরত আমীরে মুয়াবিয়া রাঃ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করে ৫০০ জাহাজের নৌবহর নিয়ে সাইপ্রাস, রোড্স, লেড, সিসিলি ও এশিয়া মাইনরের উপকূলের নিকটবর্তী অন্যান্য গ্রীক দ্বীপ যখন দখল করে তখন মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেয়ার মতো শক্তি দুনিয়ার কারো ছিল না। ক্রুসেড বিজয়ী বীরযোদ্ধা সালাহ উদ্দীন আয়ুবীর হাত থেকে জেরুশালেম নগরী উদ্ধার করার জন্য জার্মানীর সম্রাট ফ্রেডারিকা বারবারোসা, ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড, ফ্রান্সের রাজা ফিলিপস অগাষ্টাস, কারাকের শাসনকর্তা রেজিন্যান্ড সম্মিলিত যুদ্ধ চালিয়েও মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির হাতে পরাজিত হয়েছেন মুসলমানরা বুকের তাজা খুন দিয়ে খ্রিষ্টান সেনাপতি রিচার্ডের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। উলামাদের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের ফলে ভারতের বুক থেকে ইংরেজ শক্তি বিতাড়িত হয়েছে। সুতরাং ইতিহাস প্রমাণ করে, ঐক্য ও সংহতি ইসলামের বিজয় নিশ্চিত করে আর দলাদলি, অনৈক্য ও কলহ মুসলিম উম্মাহর পতন ত্বরান্বিত করে
