Skip to content Skip to footer

ইসলামী ঐক্য

লেখক: জামালুদ্দিন আফগানি
অনুবাদক: আবদুল্লাহিল বাকি

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ করো না, তা করলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলবে, তোমাদের শক্তি-ক্ষমতা বিলুপ্ত হবে। আর ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’  — সূরা আনফাল, আয়াত: ৪৬

ইসলামের কর্তৃত্ব একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর পাশ্চাত্যের বিন্দু থেকে নিয়ে চীনের মহাপ্রাচীরের সীমান্তে। প্রস্থগত দিক থেকে উত্তরাঞ্চলীয় ফেজান থেকে বিষুবরেখার নীচে সেরেন্দিব পর্যন্ত। দেশগুলো ছিল সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ — পরষ্পর একে অন্যের প্রতিবেশীর মত। সেসব দেশে অজেয় ক্ষমতা ও শক্তি নিয়ে বসবাস করত মুসলমানগণ। তাদের মধ্যে মহান রাজারা হাতে তুলে নিয়েছিল ক্ষমতার রাজদণ্ড। শাসিত হয়েছে তাদের হাতে পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চল। ছিল তারা মান্যবর আদেশকর্তা, যুদ্ধে অপরাজেয় আর জ্ঞানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুর্গগুলো ছিল সংলগ্ন ও অপ্রতিরোধ্য। সমতল প্রশস্ত ভূমিতে বয়ে যেত নদী-নালা আর পাহাড়ি ঢালু ভূমি বেয়ে নেমে আসত জলপ্রপাত ও ঝরনাধারা। বিচিত্র সব উদ্ভিদে ভরে ছিল নগর-গ্রাম। মুসলমানরা পৃথিবীকে দেখিয়েছে বিভিন্ন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন।  তাদের শহর, বসতি প্রতিষ্ঠিত ছিল নগরায়নের সবচে’ মজবুত ভিত্তির উপর। বাসিন্দাদের শিল্প-উদ্ভাবন-বিজ্ঞান, অবদান-নির্দেশনা ছিল পৃথিবীতে মুসলিম সভ্যতার গর্ব। এসব নগরের ক্রোড়ে জন্ম নিয়েছেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, কবিতা-সাহিত্যের পুরোধা নক্ষত্রেরা।

প্রাচ্যে মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ছিলেন ইবনে সিনা (মৃ. ১০৩৭ ই.), আল-ফারাবি (মৃ. ৯৫০ ই.), আবু বকর রাযি (মৃ. ৯২৫ ই.) প্রমুখ। পাশ্চাত্যে ছিলেন ইবনে বাজাহ (মৃ. ১১৩৮ ই.), ইবনে রূশদ (মৃ. ১১৯৮ ই.), ইবনে তোফায়েল (মৃ. ১১৮৫ ই.) প্রমুখ। মুসলমানদের মাঝে দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশলসহ অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানের অনেক মনীষী ছিলেন। ব্যাপকভাবে সকল শ্রেণীর মাঝেই ছিল ধর্মের শাস্ত্রীয় জ্ঞান। আব্বাসী খলিফার একটা ধমকে বশ্যতা স্বীকার করে নিত চীনের বাদশাহ, কেঁপে উঠত ইউরোপের রাজা। মধ্যযুগীয় মুসলিম সুলতানদের মধ্যে ছিলেন মাহমুদ গজনবী (মৃ. ১০৩০ ই.), মালিকশাহ সেলজুকী (মৃ. ১০৯২ ই.), সালাহুদ্দিন আইয়ুবী (মৃ. ১০৯৩ ই.)। প্রাচ্যে ছিলেন তৈমুর লং (মৃ. ১৪০৫ ই.), পশ্চিমে মুহাম্মদ ফাতিহ (মৃ. ১৪৮১ ই.), সুলতান সেলিম (মৃ. ১৫২০ ই.), সুলাইমান উসমানী (মৃ. ১৫৬৬ ই.)। পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছেন তারা, কিন্তু হারিয়ে যাননি কালের বিবর্তনে ইতিহাসের পাতা থেকে। মুছে যায়নি তাদের পদচিহ্ন।

শ্বেত, লোহিত আর ভারত মহাসাগরে দীর্ঘকাল ছিল মুসলিম নৌবহরদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্ব। অন্যরা ছিল তাদের কর্তৃত্বের ছায়াতলে। সকলে স্বীকার করে নিয়েছিল মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব।

পূর্বপুরুষদের পক্ষ থেকে পাওয়া ভূমিগুলোতেই বসবাস করছে আজ মুসলমানগণ; যা ৪০০ মিলিয়নের কম নয়। প্রতিটি দেশেই আছে তাদের অস্তিত্ব। ধর্মের বিশ্বাস তাদের হৃদয়ে জাগিয়েছে অপার সাহস। মৃত্যুর দিকে তারা এগিয়ে যায় হাসতে হাসতে নির্ভীক চিত্তে। পার্থিব জীবনের রূপ-লাবণ্য আর ক্ষণিকের ঐশ্বর্য্য তাদের কাছে অতি তুচ্ছ।

মুসলমানদের কাছে এসেছে সুস্পষ্ট আয়াত ও নিদর্শন-সম্বলিত কুরআন। প্রতিপক্ষকে আপন বিশ্বাসের স্বপক্ষে যুক্তি পেশ করার আহ্বান জানায় এই মহান গ্রন্থ। অনুমান আর বিভ্রমকে আঁকড়ে ধরে রাখার নিন্দা করে। কুরআন মানুষকে ডাকে উত্তম নৈতিক গুণাবলির দিকে। কুরআন মুসলমানদের চিন্তায় বুনে দিয়েছে সত্যের চারা। হৃদয়ে গুঁজে দিয়েছে পুণ্যের সম্ভার। ধর্মের মৌলিক সূত্র ধরে তারা হয়ে উঠেছে বিবেক-মনের দিক থেকে আলোকিত, বুদ্ধির দিক থেকে তীক্ষ্ম-সতর্ক, মানবিক পূর্ণতা অর্জনের উপযোগী আর নৈতিকতার দিক থেকে মার্জিত। তাদের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। কুরআনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তাদেরকে সমগ্র বিশ্বের উপর বিজয়ের; যদিও তা অপছন্দ করে অপরাধীরা।

নিজেদের উপর অন্যদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারে না তারা। অবনত হতে পারে কারও সামনে। শত বেদনা আর কষ্টের মুখোমুখি হলেও এক্ষেত্রে তারা অনড়। কেননা তাদের পরস্পরের মাঝে আছে বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব। আপন জাতির কোনও দলের পতনকে তারা নিজের ব্যর্থতা জ্ঞান করে। এ তার বিবেকের অনুভূতি। এর অন্যথা সে ভাবতে পারে না। তাদের হৃদয়ে রয়েছে ধর্ম-নির্দেশিত জ্ঞানের শিকড়। এই জ্ঞান তারা পেয়েছে রাষ্ট্রের সূচনাকালেই। নিজেদেরকে তারা মনে করে জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠত্বের যোগ্য।

এগুলো ছিল মুসলমানদের অতীত অবস্থার বর্ণনা। এখন তাদের বর্তমান অবস্থার খতিয়ান তুলে ধরছি। এতটা অগ্রগতির পরও তারা নিজেদের পথচলা থামিয়ে দিল। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যে পিছিয়ে পড়ল অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে। অথচ একসময় তারাই ছিল পৃথিবীর শিক্ষক। তাদের রাজ্যগুলো হ্রাস পেতে শুরু করেছে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সীমানা। অথচ তাদের ধর্ম নির্দেশ দিয়েছে, শত্রুর কর্তৃত্ব মেনে না নিতে। ইসলামের অন্যতম বড় একটি স্তম্ভ হল, যদি কোনও প্রতিপক্ষ মুসলমানদের উপর কর্তৃত্ব ওক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে সেটার বিরোধীতা করতে হবে।

মুসলমানরা কি ভুলে গেছে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি? আল্লাহ তো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারাই হবে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী— যদি তারা সৎকর্মশীল হতে পারে। মুসলমানরা কি উদাসীন হয়ে পড়েছে নিজেদের উপর আরোপিত দায়িত্ব থেকে? আল্লাহ তো তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন সকল ধর্ম ও মতবাদের উপর তাদের ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার; যদিও তারা অপরাধীদের নিকট অপছন্দনীয়। তারা কি বিস্মৃত হয়েছে, আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্য, জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নেওয়া হয়েছে তাদের ধন-প্রাণ? না… এমনটা হতে পারে না। ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস, আখলাক-নৈতিকতা মুসলমানদের হৃদয়ের ব্যক্তিগত ইচ্ছারও ঊর্ধ্বে। সাধারণ ও বিশেষ প্রতিটি মুসলিম আপন হৃদয়ে ধারন করে এই বিশ্বাস।

মুসলমানদের এই পশ্চাতপদতা, বিজ্ঞানের বিকাশে ব্যর্থতা, শক্তির দুর্বলতার পেছনেও অনেক কারণ লুকিয়ে আছে। এর মধ্যে অন্যতম, বিভিন্ন নেতার মধ্যকার স্বার্থগত দ্বন্দ্ব। অথচ ইসলামে, মুসলমানদের জন্য ধর্ম ছাড়া অন্য কোনও জাতীয়তা নেই। মুসলমানদের খলিফার বহুত্ব আসলে অভিন্ন একক গোত্রে একাধিক গোত্রপ্রধানের অস্তিত্বের মত, এক জাতিতে একাধিক বাদশাহর উপস্থিতির মত। তাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে। এসব সরকার ও শাসকগণ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে খেপিয়ে নিজের দলে ভেড়াতে চেয়েছে। একে অপরের বিরুদ্ধে হয়ে উঠেছে খড়গহস্ত। লড়াই হয়েছে মুসলমানদের পরস্পরের মাঝে। এগুলো হল অভ্যন্তরীণ বিবাদ। এসব বিবাদে বানের জলের মত ভেসে গেছে বিজ্ঞান ও শিল্পের বিভিন্ন মহৎ অর্জন। এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বে তারা কিছুই পায়নি চরম ব্যর্থতা আর সামষ্টিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া। এভাবেই মুসলমানদের মাঝে ধীরে ধীরে দেখা দেয় দুর্বলতা, দারিদ্র, শৃঙ্খলতার ভারসাম্যহীনতা, সামগ্রিক অনৈক্য। এই হতাশাজনক অবস্থায় তারা বৈদেশিক আগ্রাসনের হাত থেকে নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারেনি।

মুসলিম নেতাদের পারস্পারিক দ্বন্দ্ব-বিরোধের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে যখন তারা ভিন্ন জাতির শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে থাকত, হয়ে উঠত একেকজন বীরত্ব ও সাহসের প্রতীক। কিন্তু সময়ের আবর্তনে ধীরে ধীরে এসকল রাজাদের অন্তরে নীতি-নৈতিকতা হ্রাস পেয়ে ভরে গেছে দুর্নীতি আর অনাচারে। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উপাধি, আড়ম্বরপূর্ণ জীবনে থিতু হয়ে গেছিল তারা। নিজেদের মধ্যকার বন্ধুত্বকে ভেঙে একসময় তারা বন্ধুরূপে গ্রহণ করলো জাতীয় প্রতিপক্ষ ও শত্রুদেরকে। নিজেদের কর্তৃত্ব আর ক্ষণিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য টিকিয়ে রাখতে আপন মুসলিম ভাইদের বিরুদ্ধে সাহায্য-সহযোগিতার হাত পাতল শত্রুদেরকে কাছে।

এই সংকটই পতন ঘনিয়ে এনেছিল মুসলিম আন্দালুসে। নির্মূল হয়ে গেছিল মুসলিম জনগণ। এর কারণেই ভারতে ধ্বংস হয়ে গেছে তৈমুরি সাম্রাজ্য। এর ধ্বংসাবশেষের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল ব্রিটিশরা। এইভাবেই একসময় ইসলামী রাজ্যগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে মূর্খ রাজাদের হস্তক্ষেপের কারণে। অথচ এরা ডুবে ছিল ভোগ-বিলাস আর কামনা-বাসনায়। ধর্মের বিধি-বিধানের দিকে তাদের দৃষ্টি ছিল না। লক্ষ ছিল না প্রজাদের দিকে। তাদের দরুণ মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হয়ে গেছে। অর্থের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে।

দুনিয়ার লোভ আর তুচ্ছ বিষয়ের পেছনে ছোটার দরুণই মুসলিম রাজারা রাজ্যগুলো টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সাধারণ আপামর জনতা। এই রাজারা ভুলে গিয়েছিল আল্লাহ-রাসূলের বাণী। মতভেদে লিপ্ত হয়েছিল পরস্পরের মাঝে। অথচ শত্রু পৌঁছে গিয়েছিল তাদের ঘরের দরজায়। এই মুহূর্তে তাদের দরকার ছিল, সকল পারস্পরিক মতভেদ ভুলে শত্রুর লড়াইয়ে একত্র হওয়া। যেন শত্রুর মোকাবেলা করে নিজেদের ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে পারে। সুরক্ষা দিতে পারে মুসলিম দেশগুলোকে। অতি লোভ আর পার্থিব সুখের তুচ্ছ প্রতিযোগিতা তাদেরকে কী দিতে পেরেছে? দিতে পেরেছে কেবল লাঞ্ছনা আর ব্যর্থতা। যা তাদের তাড়া করে ফিরেছে জীবিত ও মৃত অবস্থায়। ইসলামী ইতিহাসে তারা এক দুঃসহ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়— যাদেরকে কখনোই মোছা যাবে না ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় থেকে।

মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন আনুষাঙ্গিক মতভেদ থাকবে— এটা খুবই স্বাভাবিক। তাদের দিকনির্দেশনা দেবার জন্যে জ্ঞানী আর আলেমগণ তো আছেন। মতামত ও বিশ্বাসের গৌণ পার্থক্যের পরও যদি তারা সহনশীল থাকতো তাহলে তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ঐক্য গড়ে উঠতে পারত। তারা দেখা পেত সত্য ও ন্যায়বিচারের। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, তাদের মধ্যকার বিরোধ জিইয়ে রেখে ফায়দা নিয়েছিল রাজা-বাদশাহরা। তারা যে মুসলমানদের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত ও একসময় জিজ্ঞাসিত হবে— বিষয়টা যেন তাদের চিন্তা ও জীবন থেকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল।

 

ইসলামী রাষ্ট্রকে সুরক্ষা ও শক্তিশালী করার জন্য ঐক্যমত হওয়া নিঃসন্দেহে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটা শেখার জন্য তাদের কোনও বই-পত্র বা শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। বর্তমানে জ্ঞানী ও নেতারা মুসলিমদের পারস্পরিক মতভেদ ও দ্বন্দ্বের দরুণ চোখের পানি ফেলছে। অথচ এটা নিয়ে ভাবার দরকার ছিল আরো আগে। মুসলিম রাজাদের মধ্যে যদি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, পার্থিব লোভ না থাকত, তাহলে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ— সব চলে আসত মুসলিমদের অধিকারে। তাদের প্রতিটি নির্দেশ ও আহ্বানে সাড়া দিতে বাধ্য হত সকলে।

রুশ জাতির দিকে তাকালে এই দাবির বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারি। তারা ইউরোপের জাতি-গোষ্ঠীর চেয়ে শিল্প ও বাণিজ্যে বেশ পিছিয়ে। তাদের দেশে সম্পদের তেমন কোনও উৎস নেই। যদি থাকেও, তা খুব একটা উৎপাদনশীল নয়। তারা অভাবে পীড়িত। কিন্তু আপন দেশ ও জাতির প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে তারা বেশ অগ্রগামী। তাদের পরস্পরের মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতি ও পরমতসহিষ্ণুতা। এভাবেই তারা আপন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। তাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তা ইউরোপেও প্রভাব বিস্তার করছে। রাশিয়ানদের উল্লেখযোগ্য কোনও যুদ্ধাস্ত্র কারখানা ছিল না। কিন্তু তারা প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র অর্জন করতে পেরেছে। তারা তেমন উৎকর্ষ লাভ করতে পারেনি সামরিক শিল্পে। কিন্তু অন্যান্য স্থান থেকে অফিসার এনে সৈন্যদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা তারা করেছে। এভাবেই তারা একটা শক্তিশালী সৈন্যদল গড়ে তুলতে পেরেছে, যাদেরকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পর্যন্ত ভয় পায়।

সমাধান জানা থাকার পরও, কেন আমরা এর বাস্তবায়ন করতে পারছি না? অথচ মুসলিম জাতি তো নিজেদের ইজ্জত, সম্মান, আপন ধর্মের প্রতিষ্ঠায় সবচে’ অগ্রগামী। তাদের মধ্যে আছে আন্দোলন ও ঐক্যের প্রেরণা। এর অন্যতম কারণ হল, মুসলিম নেতারা— যারা রেস্তোরাঁর গন্ধবহ আহার, বিভিন্ন দেশে বিহার আর আপন লোভ-লালসায় জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকার করে দিচ্ছে। তারাই মুসলমানদেরকে ভয় দেখিয়ে তাদের গলায় পড়িয়ে রেখেছে অদৃশ্য গোলামীর শিকল।

হে সাহসী পুরুষ.. বীরদের উত্তরসূরী.. মহান বিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের বংশধর… সময় কি পেরিয়ে গেছে? শেষ হয়ে গিয়েছে কি মুক্তির কালক্ষণ? এখন কি হতাশা ছাড়া আর কোনও পথ নেই? না… অন্তরে যেন কখনোই হতাশা না জাগে। এখনো সময় আছে জাগৃতির। মুসলিম দেশগুলো পরস্পর সংযুক্ত। তাদের মৌলিক বিশ্বাসে রয়েছে ঐক্য। কুরআনের ভিত্তিতে তারা আবার একত্র হতে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তারা বীর ও সাহসী জাতি। এখনই সময় আবার একত্রিত হওয়ার। সকল জাতি-গোষ্ঠীর মোকাবেলায় এক হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও পথ নেই। আমার ঐক্য প্রকাশিত হলে এটাতে অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই। কারণ, মতপার্থক্যের মধ্যেও ঐক্য স্থাপনই ইসলামের মৌলিক শিক্ষা। তাদের অনুভূতি কি অসাড় হয়ে গেল যে, একে অন্যের প্রয়োজন ও ব্যথা অনুধাবন করতে পারছে না? মুসলমানগণ সকলে তো এক দেহের মত। কুরআনের বাণী অনুযায়ী পরস্পর একে অপরের ভাই। প্রতিপক্ষের শত্রুতা ও আধিপত্যের ভয়াল স্রোতের মুখে, কবে তারা ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের ভিত্তিতে স্থাপন করবে এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাঁধ?

আমি এটা বলতে চাই না যে, সকলের রাজা একক ব্যক্তি হতে হবে। এটা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। কিন্তু আমি আশা করি, মুসলমানগণ কুরআনের ভিত্তিতে একত্রিত হবে। তাদের মধ্যকার শাসকের কর্তৃত্ব করবে কুরআন। তাদের ঐক্যের কেবলা হবে ইসলাম। আপন রাষ্ট্রসীমানার মধ্যেও অপরের চিন্তা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে অন্যকে। মুসলমানগণ একে অন্যের জীবন। একের অস্তিত্ব বিদ্যমান অন্যের কারণেই। এই ঐক্যই বর্তমানের সবচে’ বড় প্রয়োজন।

এটাই ঐক্যের সময়। সময় মুসলমানদের উপর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পণ করেছে। এগুলো তাদের গনিমতের মত। সুতরাং এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। কান্নায় মৃত জেগে উঠে না। অনুশোচনায় ফিরে আসে না হারিয়ে যাওয়া কোনও কিছু। দুঃখ ফেরাতে পারে না বিপদ। কর্ম ও স্বক্রিয়তাই সফলতার চাবি। সত্য ও একনিষ্ঠতাই সফলতার সিঁড়ি। ভয় মৃত্যু ঘনিয়ে আনে। হতাশা আর সংকল্পের অভাবে ধ্বংস নিকটে আসে।

“তোমরা কর্ম সম্পাদন করতে থাক। অচিরেই আল্লাহ তোমাদের কর্মের প্রতি লক্ষ রাখবেন এবং তার রাসূল ও মুমিনগণও (লক্ষ রাখবে), আর অচিরেই তোমাদেরকে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতার দিকে ফিরিয়ে আনা হবে, আর তিনি তখন তোমরা যে কর্ম করছিলে তা তোমাদের জানিয়ে দিবেন।” — সূরা তাওবা, আয়াত: ১০৫

মুসলমানরা কখনো ওই সকল লোকদের মত হতে পারে না, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, “তাদের অভিযানে গমনই আল্লাহর পছন্দ নয়, কাজেই তিনি তাদেরকে পশ্চাতে ফেলে রাখেন আর তাদেরকে বলা হয়, ‘যারা (নিস্ক্রিয় হয়ে) বসে থাকে তাদের সাথে বসে থাক’।” — সূরা তাওবা, আয়াত: ৪৬

এমন হওয়াও মুসলমানদের শোভা পায় না, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তারা পেছনে থাকা লোকদের সাথে থাকা বেছে নিয়েছে আর আল্লাহ তাদের অন্তরসমূহের উপর মোহর এঁটে দিয়েছেন, এজন্য (কিসে নিজেদের কল্যাণ আছে আর কিসে অকল্যাণ) তা তারা জানে না।” — সূরা তাওবা, আয়াত: ৯৩

কুরআন জীবন্ত গ্রন্থ; এটি কোনও মৃত পুঁথিগ্রন্থ নয়। কুরআনের দৃষ্টিতে যে প্রশংসনীয়, সেই সফল। আর যে কুরআনের নির্দেশনার আলোকে ধিকৃত, ঘৃণ্য সে প্রকৃতই পথবিচ্যুত। আল্লাহর কিতাব রহিত হয়ে যায়নি। সুতরাং এই গ্রন্থের দিকেই ফিরে আসা উচিত। নিজেদের প্রকৃতি ও অবস্থার ক্ষেত্রে কুরআনকে গ্রহণ করতে হবে চূড়ান্ত বিধান হিসেবে।

মুসলিম নেতারা হয়ত পূর্ববর্তীদের বিভিন্ন কর্মের দোহাইয়ে নিজেদের সাফাই গাওয়ার পথ খুঁজবে। কিন্তু আমরা চাই, তারাও যেন একনিষ্ঠতার সাথে এই ঐক্যের আহ্বান জানান জনগনের প্রতি। আলেমগণ যেন এই ঐক্যের কাজে ছাত্র, ভক্ত ও সাধারণ মানুষকে আগ্রহী করে তুলেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, পথপ্রদর্শন করেন। আগে ও পরে সবসময়ই তার সীদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়।