Skip to content Skip to footer

আলিয়া ও কওমীদের মাঝে ঐক্যপ্রয়াস – অতীত ও বর্তমান

আলিয়া ও কওমিধারার মাঝে ঐক্যপ্রয়াস : অতীত ও বর্তমান
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন

যুগচাহিদা ও সময়ের প্রয়োজনে দুটি মাদরাসা শিক্ষাধারার উদ্ভব হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। একটি আলিয়া, অপরটি কওমি। আলিয়া পদ্ধতি চালু হয়েছে ১৭৮০ সালে আর কওমি শিক্ষাপদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে ১৮৬৬ সালে। প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো অভিন্ন। আলিয়া পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য ছিলো ধর্মীয় শিক্ষার বিকাশ ও ইসলামী আইনে পারদর্শী বিচারক তৈরি করা যাতে তাঁরা মুসলিম পারিবারিক আইনে সংশ্লিষ্ট মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারেন।

আলিয়াধারার মাদরাসার সূচনায় দখলদার ইংরেজদেরকে চাপ দিয়ে অথবা রাজি করিয়ে অথবা সহযোগিতা নিয়ে ইসলামী শিক্ষা পুনঃপ্রবর্তনের একনিষ্ঠ প্রয়াস লক্ষণীয় অপর দিকে ইংরেজদের কর্তৃত্ববলয় থেকে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করে নিজস্ব অর্থায়নে অধিকারহারা মুসলমানদের সহায়তায় ইসলামী শিক্ষার নবতর যাত্রার পদক্ষেপ ছিল কওমি ধারার স্বতন্ত্রতা। দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পেছনে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি শামিল ছিল সা¤্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাস গ্রন্থে আছে এক সময় আত্মরক্ষার জন্য দেওবন্দের ছাত্রদের আধা সামরিক ট্রেনিং দেয়া হতো। এ ধারার মাদরাসায় অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী মানসিকতার লালন লক্ষ্য করা যায়। দেওবন্দ যে কোন প্রকার সহিংসতা থেকে দুরে থেকে মধ্যমপন্থাকে উৎসাহিত করে। অর্থাৎ বাড়াবাড়িও না আবার ছাড়াছাড়িও না। জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি দেওবন্দ মাদরাসা কখনো এক পয়সা রাষ্ট্রীয় সাহায্য নেয়নি। বিনয়সহকারে ফিরিয়ে দিয়েছে শাসকদের অনুদানের প্রস্তাব।

আলিয়াধারা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিকতার চেতনাকে লালন করে অপর দিকে দেওবন্দধারা ইসলামের প্রাচীন রূপের পৃষ্ঠপোষকতা করে। আলিয়া মাদরাসাসমুহের শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতন, ভাতা ও অবকাঠামোর খরচ আসে সরকারি কোষাগার থেকে। সরকারি নির্দেশনা পরিপালনে আলিয়া মাদরাসাগুলো আইনত বাধ্য। কওমি মাদরাসায় সে বাধ্যবাধকতা নেই। সমাজের দ্বীনদার জনগোষ্ঠীই কওমি মাদরাসাসমূহের অর্থে মূল জোগানদাতা। ফলে তাদের সাথে সমাজের তৃণমূল মানুষের সম্পর্ক গড়ে উঠে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর বিপর্যয়ের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়ে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ’র নামে সুলতানী ও মুঘল আমলে বরাদ্দকৃত অনুদান ও লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেলেন। ইংরেজি স্কুল চালু করার ধুম পড়ে যায়। স্থানীয় মুসলমানদের সহযোগিতায় মসজিদগুলো চালু থাকলেও বহু দ্বীনি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলিম বানানোর পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন ও মাসআলা-মাসায়েল শেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। সে সময় সচেতন মুসলমানরা পরিকল্পনা নিলেন যে কোন প্রকারে দ্বীনি মাদরাসা চালু করতে হবে। ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় প্রথমে সম্মত হননি। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা না থাকলে জনগণ ধীরে ধীরে দ্বীন থেকে দূরে সরে যাবে ও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলবে এমন আশঙ্কা মুসলমানদের মধ্যে ছিল। ইংলিশ স্কুল চালু হওয়ায় পার্থিব সুবিধা প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বহু মুসলমান পরিবার ওইদিকে ধাবিত হচ্ছে। কতিপয় সরকার সমর্থক দ্বীনদরদি মুসলমান বড়লাটের প্রতি আবেদন, নিবেদন ও চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য। এক পর্যায়ে তিনি সম্মত হন এবং বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেন। এর মধ্যে ইংরেজ প্রিন্সিপাল নিয়োগ অন্যতম। কুরআন, হাদিস ও ফিকহের সিলেবাস সংক্ষেপিত করা হয়। সে সময় মুসলমানরা ইংরেজ প্রিন্সিপাল মেনে না নিলে মাদরাসা কায়েমের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হত না। কিতাবুল জিহাদ ও সূরায়ে নূর সিলেবাস থেকে ইংরেজরা বাদ দিলেও মুসলমানরা মনে করলেন পবিত্র কুরআনের বাকি সূরা ও হাদিসের বাকি অধ্যায় শিক্ষার্থীরা অন্তত পড়তে পারবে। আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা না থাকলে ৮৬ বছর প্রায় এক শতাব্দী উপমহাদেশের শিক্ষার্থীরা দ্বীনি তালিম থেকে মাহরুম থেকে যেত। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ১৮৬৬ সালে। এর আগে ছিল সরকারি মাদরাসা।

ধর্মীয় শিক্ষার পুনঃপ্রবর্তন ব্রিটিশ শাসকবৃন্দ ভালো চোখে দেখেন নি। শিয়ালদার নিকটে ভাড়া করা ঘরে ৪০জন ছাত্র নিয়ে মাদরাসা চালু হওয়ার পরও তাঁরা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীর অব্যাহত দাবির মুখে তাঁরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। পরবর্তিতে নিজস্ব জায়গায় গড়ে উঠে Muhammaden College of Calcutta, লোকমুখে যা কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা নামে পরিচিতি লাভ করে। মোল্লা মাজদুদ্দীন নামে আরবি ভাষায় পারদর্শী এক আলিম মাদরাসার তত্ত¡াবধায়ক ছিলেন। ১৮৫০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ২৬ জন ইংরেজ কোলকাতা আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেংগার অন্যতম।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কোলকাতা আলিয়া ঢাকার বকশিবাজারে স্থানান্তরিত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা ইসলামী শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বর্তমানে ১০ হাজার ৪৫০টি আলিয়া মাদরাসা রয়েছে গোটা বাংলাদেশে। এসব মাদরাসায় দাখিল থেকে কামিল পর্যন্ত ২০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করে (Bangladesh Bureau of Educational Information and Statistics, BANBEIS, Dhaka, 2016)

আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা উপমহাদেশে অনেক বিদগ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আলিম, রাজনীতিক ও সমাজসেবকের জন্ম দিয়েছে। দৈনিক আজাদ এর সম্পাদক ও মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা আকরাম খাঁ, শামসুল ওলামা মাওলানা বেলায়েত হোসেন, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, চীফ মিনিস্টার হোসাইন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, চীফ মিনিস্টার আতাউর রহমান খান, বিজ্ঞানী ড. কুদরতে খুদা, আইন বিশেষজ্ঞ ও বিচারপতি ব্যারিস্টার আমির আলী, বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ, মাওলানা আবদুর রহিম, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, অধ্যাপক আখতার ফারুক, এবং বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল বারি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল করিম আলিয়া মাদরাসার ছাত্র ছিলেন (এবিএম সাইফুল ইসলাম সিদ্দিকী, বাংলাপেডিয়া, ইংরেজি ভার্সন, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা) । সমাজে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ, নৈতিকতার উজ্জীবনে তাঁদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় একশ’ বছর যাবত কোলকাতা আলিয়া তথা আলিয়াধারার মাদরাসার প্রভাব ও আধিপত্য ছিল একচ্ছত্র। তখন অন্য ধারার কোন মাদরাসা গড়ে উঠেনি। ১৮৬৬ সালে জন্ম লাভ করে দেওবন্দ মাদরাসা।

আলিয়া মাদরাসার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দায়িত্বশীল পদে যোগ দিয়ে দেশ ও জাতির খিদমত করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া জয়নাল আবেদিন ছিলেন চট্টগ্রামের চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। স্মর্তব্য যে, তৎকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া কোথাও আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা ছিল না। পরবর্তীতে আসাম, বিহার, ওডিশা ও উত্তর প্রদেশে এ পদ্ধতির কিছু মাদরাসা গড়ে উঠে।

১৮৫৭ সালের গণআন্দোলনে (সিপাহি বিদ্রোহ) ইংরেজ দখলদার বাহিনী দিল্লিতে ৩৩ হাজার আলিমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদÐ কার্যকর করে। রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয় ও সম্পত্তি লুঠে নেয়। এমনতর পরিস্থিতিতে আল্লামা কাছেম নানুতুভীর মত আলিমগণ মনে করেন ধর্মীয় শিক্ষার সেক্টরটিও যদি হাতছাড়া হয়ে যায় ভারতে মুসলিম জাতিসত্তা সমূহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এখান থেকে বেসরকারি মাদরাসা কায়েমের পরিকল্পনা।

খাস ওয়ারিসে আম্বিয়া তৈরি, সিলেবাসভূক্ত সব কিতাবের পূর্ণ পাঠদান ও সরকারি কর্তৃত্বের গÐি থেকে বেরিয়ে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় কওমি মাদরাসার যাত্রা শুরু। ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক কসবায় দারুল উলুম নামে প্রথম কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। শায়খুল ইসলাম আল্লামা কাছেম নানুতুভী ও হাজী সাঈদ আবিদ হোসাইন ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। কোন ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা ছাড়া একজন ছাত্র ও একজন শিক্ষক দিয়ে মাদরাসা চালু করা হয় ডালিম গাছের ছায়ায়। এটাই পরবর্তীতে বিশ^খ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ। সরকার থেকে কোন ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুদান, বেতন-ভাতাও অবকাঠামোগত সুবিধা নিতে কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সম্মত হননি। আট নীতিমালা’ (উসুলে হাশতগানা)-এর আলোকে মজলিশে শুরার মাধ্যমে এ মাদরাসা পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে দারুল উলুম দেওবন্দ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এশিয়া, আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াসহ সারা দুনিয়ায় এর শাখা ছড়িয়ে আছে।

মূলত কওমি শিক্ষাধারা একটি আন্দোলন। মিশনারি স্পৃহা নিয়ে কওমি আলিমগণ কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুদান ছাড়া এত বিশাল আয়তনের মাদরাসাগুলো গড়ে উঠেছে যা রীতিমত বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ক্রমান্বয়ে কওমি শিক্ষাধারা শহরে ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃৃতি লাভ করছে। আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল এবং জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত শ্রম ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কওমি মাদরাসা।

দারুল উলুম দেওবন্দ শত বছরের পথপরিক্রমায় লাখ লাখ বিশেষজ্ঞ আলিম, ইমাম, খতিব, লেখক বিতার্কিক তৈরি করেন। পবিত্র কুরআনের প্রামাণ্য তাফসির, হাদিসে রাসুলের (সা) গবেষণাধর্মী ভাষ্য ও ফিকহে ইসলামীর ব্যাখাগ্রন্থ তাঁদের হাতে তৈরি হয়। বিশ্বনন্দিত গবেষক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চীফ মিনিস্টার মুফতি মাহমুদ আহমদ, মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি, আল্লামা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী, হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী, আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী, আল্লামা মানযুর নোমানী, আল্লামা কারী মুহাম্মদ তৈয়ব, মাওলানা হাফিজ জলন্ধরী, আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, ফখরে বাঙলা মাওলানা তাজুল ইসলাম, খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক জালালাবাদী, হযরত মাওলানা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা মুশাহিদ আহমদ বৈয়ামপুরি, শায়খ আল্লামা তকি ওসমানী, মাওলানা আতাহার আলী, খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ, হযরত মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর, মাওলানা নূরুদ্দিন গহরপূরী, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, মুফতি ফজলুল হক আমিনি, আল্লামা আহমদ শফি, পীর সাহেব চরমোনাই মাওলানা ফজলুল করিম, মাওলানা নূর হোসাইন কাছেমী ও আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন দেওবন্দ তথা কওমি মাদরাসার ছাত্র।

ভারতে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে কওমি আলিমদের ত্যাগ ও কুরবানি ইতিহাসে সোনালী অধ্যায়ের সূচনা করে। ভারত মহাসাগরের আন্দামান নিকোবরে স্থাপিত ব্রিটিশ বন্দিশালায় ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সিংহভাগ আলিম দেওবন্দ ঘরানার। ভারত-বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোন ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে কওমি ঘরানার ছাত্র-শিক্ষকদের রাজপথে প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায়। ‘বিশ্বের বহুদেশের মুসলিমগণ ধর্মীয় পথনির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের দিকে’ (শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি বাংলা, দিল্লি)। সরকারি তথ্যানুসারে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৩ হাজার ৯০২ টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি। তবে বেসরকারি হিসেব মতে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি (ইধহমষধফবংয ইঁৎবধঁ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হধষ ওহভড়ৎসধঃরড়হ ধহফ ঝঃধঃরংঃরপং, ইঅঘইঊওঝ, উযধশধ, ২০১৫) ।
বহু বছর ‘দরসে নিজামী’ ছিলো উভয়ধারার মাদরাসার অভিন্ন পাঠ্যক্রম। ফিকহ, আরবি সাহিত্য, মানতিক, হিকমত ও প্রাচীন দর্শন ছিল এ পাঠ্যক্রমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীতে সিহাহ সিত্তাহ বা ষষ্ঠ প্রামাণিক হাদীস গ্রন্থ সংযোজিত হয়। এগুলো হল বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসায়ী এবং ইবনে মাযাহ। সময়ের ব্যবধানে সিলেবাসে পরিবর্তন আসে।
একই সিলেবাসে পাঠদান পদ্ধতি চালু থাকায় আলিয়া ও কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মানসিকতার মেলবন্ধন, চেতনার ঐক্য ও চিন্তার সাজুয্য পরিলক্ষিত হয়। বাতিল শক্তির প্রতিবাদে উভয়ধারার আলিমগণ একে অপরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেওবন্দ, সাহারানপুর, লাহোর, মুলতান, করাচি, লালবাগ, হাটহাজারী, জিরি ও পটিয়া থেকে দাওরায়ে হাদীস ডিগ্রিধারী বহু আলিম আলিয়া পদ্ধতির দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দ্বীনের বিভিন্ন খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন এবং রয়েছেন। অপর দিকে দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল পাস করে আবার কওমি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন এমন আলিমের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

এক যামানায় বিপুল সংখ্যক দেওবন্দী আলিম আলিয়া মাদরাসায় ইলমের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তেমনিভাবে আলিয়া মাদরাসার কামিল ডিগ্রিধারী অনেক আলিমের কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করার রেকর্ডও আছে। হাকীমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর ভাগিনা আল্লামা যফর আহমদ উসমানী ও ঢাকা বায়তুল মোকাররমের জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন ফাযিলে দেওবন্দ। তাঁরা সারা জীবন শিক্ষকতা করেন ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় এবং সদরুল মুদাররিসিন হিসেবে দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। বাংলাদেশের বরেণ্য আলিমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ ছিলেন ফাযিলে সাহারানপুর। সারা জীবন নাযিমে আ’লা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানাধীন চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসায়। বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ইন’আমুল বারী’ এর লেখক মাওলানা মুহাম্মদ আমীন, শিকওয়া ওয়া জওয়াবে শিকওয়া এর ভাষ্যকার মাওলানা আবদুন নুর ও মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রশিদ চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে ফাযিল ডিগ্রি নেওয়ার পর দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়ন করে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। দেওবন্দের ফাযিল মাওলানা আফলাতুন কায়সার লক্ষীপুর জেলার রায়পুর আলিয়া মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে আজীবন কর্মরত ছিলেন।

আল্লামা আশরাফ আলী থানভী এর প্রখ্যাত খলিফা মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী উত্তর প্রদেশের কানপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস ও মুহতামিম ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি কোলকাতা আলিয়া মাদরাসায় হাদিসের উস্তাদ হিসেবে যোগ দেন। ঢাকার লালবাগ থেকে দাওরায়ে হাদিস পাস করার পর মাওলানা সফিউল্লাহ ও মাওলানা হোসাইন আহমদ কাছেমী পাবনা আলিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ দিন যথাক্রমে হেড মুহাদ্দিস ও ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার তামিরুল মিল্লাতে শায়খুল হাদিস হিসেবে শিক্ষকতা করেন বড় কাটরা কওমি মাদরাসার সাবেক মুহতামিম মাওলানা তুরাব আলী,যাত্রাবাড়ী মাদরাসার শাইখুল হাদীস মাওলানা আবুল বারাকাত মুহাম্মদ ইউছুফ মাদানী।

ঢাকা আলিয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস আল্লামা সাইয়েদ মুফতি আমিমুল ইহসান আল মুজাদ্দিদি লিখিত ৩৪৫ পৃষ্ঠার ‘কাওয়ায়েদুল ফিকহ’ দারুল উলূম দেওবন্দে ইফতা বিভাগে পাঠ্যতালিকাভুক্ত। মাওলানা হাফেজ আবদুল মান্নান চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া থেকে কামিল পাস করে চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মাদরাসা পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ার শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম কওমি মাদরাসা দারুল উলুম হাটহাজারীর দু’জন প্রতিষ্ঠাতা যথাক্রমে মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব ও মাওলানা আবদুল হামিদ সাহেব ছিলেন চট্টগ্রাম মুহসিনিয়া আলিয়া মাদরাসার ফাযিল।

নোয়াখালীর চাটখিলে অবস্থিত জামিয়া উসমানিয়ার শায়খুল হাদিস হিসেবে আমৃত্যু খিদমত করেন প্রখ্যাত ওয়ায়েজ মাওলানা মোস্তফা আল হুসাইনি। তিনি ছিলেন আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। নোয়াখালী আলিয়া ইসলামিয়া থেকে কামিল পাস করেন। চৌদ্দগ্রামের নারানকরা কওমি মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা আনোয়ারুল্লাহ সাহেব ছিলেন সরকারী মাদরাসার ফারিগ।

এ জাতীয় ঘটনা ভারত ও বাংলাদেশে ভূরি ভূরি। আলিয়া ও কওমিধারার ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো এবং এখনো রয়েছে। অনেকে ইতিহাস না জেনে একে অপরের প্রতি কঠিন মন্তব্য ও রূঢ় আচরণ করে থাকেন। এতে দ্ব›দ্ব ও দূরত্ব তৈরি হয়। আ’লা হজরত নামে খ্যাত ভারতের মাওলানা আহমদ রেযা খান বেরলভী’র অনুসারীরা আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসার সাথে যুক্ত। দেওবন্দী ও বেরলভী ঘরানার আলিমগণ ফিকহের দিক দিয়ে ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ.) এর অনুসারী হলেও তাঁরা প্রচÐ ধরনের ভ্রাতৃঘাতী বিরোধে লিপ্ত। আ’লা হযরত দেওবন্দীদের রাসুলে কারিম (সা.)-এর দুশমন মনে করেন। দেওবন্দীদের সালাম প্রদান, তাঁদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন, মৃত দেওবন্দীর জানাযার নামাযে অংশ গ্রহণ, দেওবন্দীদের কবর জিয়ারত অবৈধ মর্মে ফতোয়া জারি করেন। অপর দিকে কওমি ঘরানার আলিমগণ বেরলভীদেরকে বিদআতি ও মাজারপুজারী মনে করেন। অতীতে বেরলভী ও দেওবন্দীর মধ্যে বিভিন্ন ইখতিলাফি মাসায়েল নিয়ে অসংখ্য বাহাস ও বিতর্ক হয়েছে।

বাংলাদেশের কিছু জায়গায় দেওবন্দী-বেরলভী বিরোধ এখনো তুঙ্গে থাকলেও সময়ের বিবর্তনে সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। উভয় ঘরানায় উদারপন্থী, সহনশীল ও বৈশ্বিক চিন্তা চেতনার ওলামা মাশায়েখগণ আছেন। কিছু মাসায়েলে ইখতিলাফ ও ভিন্নতা সত্তে¡ও উভয় তরিকার আলিমগণ সহনশীল মানসিকতার চর্চা করতে পারলে সমাজে ওয়াহাদাতে উম্মতের নির্ভুল বার্তা যেতো। আলিয়া ঘরানার বহু ছাত্র-শিক্ষক তাবলিগি জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত ও নিবেদিত। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তাবলিগি জামায়াত পরিচালিত হয় কওমি ঘরানার ওলামা মাশায়খদের তত্ত¡াবধানে।

চট্টগ্রাম দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ আমিন ছিলেন হযরত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিশিষ্ট মুরিদ এবং কওমি মাদরাসায় আলিমদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের চট্টগ্রাম মহানগরীর দায়িত্বশীল। পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়ার প্রধান পরিচালক মাওলানা আব্দুল হালিম বুখারী শিক্ষকতা জীবনের সূচনা করেন সাতকানিয়া আলীয়া ও টাঙ্গাইল আলিয়া মাদরাসার হাদিসের উস্তাদ হিসেবে। বুখারী সাহেবের বাবা লোহাগাড়া থানার রাজঘাটা হোসাইনিয়া কওমি মাদরাসার প্রধান পরিচালক মাওলানা আবদুল গণি (রহ.) ছিলেন আলিয়া মাদরাসার ফারিগ।

বরিশালের চরমোনাইতে একই ক্যাম্পাসে আলিয়া ও কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত। উভয় মাদরাসার পরিচালক ও মুরব্বি হিসেবে রয়েছেন চরমোনাইর পীর শায়েখ মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ রেজাউল করিম সাহেব হাফি.। পারস্পরিক স¤প্রীতির বাতাবরণ বিরাজিত রয়েছে ক্যাম্পাসে। আলিয়া ও কওমি ঘরানার উলামা মাশায়েখদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে এক প্লাটফরমে জমায়েত হয়ে অভিন্ন রূপরেখা প্রণয়ন করার ইতিহাস আছে।

আলিমদের ঐক্য সময়ের অপরিহার্য দাবি
গণকমিশন কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র দেখলে বোঝা যায়, এ দেশের সব ঘরানার ওলামায়ে কেরামকে এতে যুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা, এ দেশে যারা ইসলামকে ফোকাস করেন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার করেন তাদের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। দেওবন্দী, আলিয়া, জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই, বেরলভী, আহলে হাদিস ও জৌনপুরী কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। গণকমিশনের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব মাসলাকের আলিমদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অস্তিত্বের প্রশ্ন বড়। দলীয় বা গোষ্ঠীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে এবং হৃদয়কে করতে হবে বড় ও প্রসারিত। ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ’- মরহুম হজরত কায়েদ সাহেব হুজুরের এই নীতিমালাকে সামনে রেখে একে অপরের কাছে আসতে হবে। ইখতিলাফ ও ভিন্নমত থাকবে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। অপরের মত, পরামর্শ, ধ্যান-ধারণার প্রতি ইসলাম সবসময় শ্রদ্ধাশীল। গঠনমূলক সমালোচনাকে ইসলাম সবসময় স্বাগত জানায়।

ভিন্নমতের প্রতি ইসলামের আচরণ সহানুভ‚তিপূর্ণ। সহিষ্ণুতা নিঃসন্দেহে মানবিক গুণাবলির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এবং সামাজিক মূল্যবোধ নির্মাণের তাৎপর্যপূর্ণ বুনিয়াদ। অপরের কথা, বক্তব্য, মতামত, পরামর্শ ও জীবনাচার যতই বিরক্তিকর ও আপত্তিকর হোক না কেন, তা সহ্য করার মতো ধৈর্য ও স্থৈর্য যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তা হলে সমাজে নৈরাজ্য, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। ইখতিলাফ বা ভিন্নমত নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্য গড়ে তোলা যায়। নিয়মতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনের পথে লড়াই করতে হবে। পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। জোশকে নিয়ন্ত্রণ করে হুঁশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে- ঐক্যই শক্তি, বিভেদে পতন। আগামীতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় আঘাত হানতে পারে।
বিভিন্ন ঘরানার আলিমদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টির পক্ষে কিন্তু তাদের একটি অংশ মারাত্মকভাবে অহংবাদী, হিংসাশ্রয়ী ও কলহপ্রিয়। নিজেদের সম্পর্কে মাত্রাতিরিক্ত উচ্চধারণা, যশোলিপ্সা, পদমোহ ও কাউকে না মানার একটি বেদনাদায়ক প্রবণতা তাদের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। একে অপরের প্রতি উদারতার অভাব এত তীব্র যে, নিজেদের দলীয় বৃত্ত, মাসলাকি চেতনা ও তরিকার বলয়ের বাইরে তারা কাউকে চিন্তা করতে পারেন না। উদারতাহীন এ মানসিকতা বৃহত্তর ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়। এ দেশে আলিম, পীর, মাশায়েখ ও মুরশিদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের গণভিত্তি বেশ মজবুত। সাধারণ জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর। মাদরাসা শিক্ষা ও ওয়ায-নসিহতের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ দ্বীনে ইসলামের আলো পাচ্ছে। ওয়ায ও নসিহত হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। আলিমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ তৈরির জন্য জনগণকে আহŸান করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম মাহফিলে মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, খুন-খারাবি, ব্যভিচারসহ নানা সামাজিক অপরাধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জনগণকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইসলামের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা, ইহজীবনে সমৃদ্ধি, পরকালে মুক্তি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ওয়াযের মূল সূর। ওয়ায়েয ও আলিমদের শেকড় মজবুত। তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। তারা সামাজিক শক্তির প্রতিভ‚। ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত। কিন্তু আফসোস! মাসলাক ও ফিরকাবন্দির সঙ্কীর্ণ গÐি থেকে তারা বের হতে পারেননি। ফলে এর প্রভাব পড়েছে তাদের ছাত্র, শিষ্য ও অনুরক্তদের ওপর।
আলিমদের অপর একটি গ্রæপ মারাত্মক চরমপন্থী ও অসহিষ্ণু, যারা অন্য দল, তরিকা বা মাসলাকের অনুসারীদের মুসলমানই মনে করেন না অথবা গোমরাহ ভাবেন। অন্তর্মুখী মানসিকতা তাদেরকে বহির্মুখী করতে পারেনি। ওয়ায, মিলাদ ও তাফসির মাহফিলে অপরাপর চিন্তাধারার লোকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা, বিষোদগার ও গালমন্দ করা তাদের চিরবৈশিষ্ট্য। ছোটখাটো ইখতিলাফি মাসায়েল নিয়ে এত বেশি পারস্পরিক ঘৃণা ছড়ানো হয় যে, স্থায়ী বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। আলিমদের বিভেদের সুযোগ নিয়ে বৈরী শক্তি ও কায়েমি স্বার্থবাদীরা সবসময় চক্রান্তের জাল বুনেছে এবং আগামীতেও বুনবে। মাওলানা এহসান এলাহি জহির, মাওলানা নওয়াব ছিদ্দিক হাসান ভ‚পালি, মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরি, মাওলানা শামসুল হক আজিমাবাদী ও মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফি আল কুরায়শির মতো উদারমনষ্ক আলিম বাংলাদেশে আহলে হাদিসের মধ্যে এখন আর নেই। আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভি, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা যফর আহমদ উসমানি ও খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের মতো ওয়াহাদাতে উম্মতের চেতনায় বিভোর মানুষ বাংলাদেশী দেওবন্দিদের মধ্যে এখন আর দেখা যায় না। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, কাজী হোসাইন আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম ও সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসানের মতো অ্যাকোমোডেটিভ মানসিকতাসম্পন্ন নেতা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে আর অবশিষ্ট নেই। পাকিস্তানের বেরলভিদের নেতা মুফতি শফি উকাড়ভি, মাওলানা শাহ আহমদ নূরানি, মুফতি মুনিবুর রহমান ও মাওলানা ড. তাহের আল কাদেরির মতো উদার ব্যক্তি বাংলাদেশী বেরলভিদের মধ্যে অনুপস্থিত। এটি নিঃসন্দেহে বহুমুখী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের শূন্যতা।

বিভিন্ন মতাদর্শের আলিমরা এক দিন নিজেদের ভেদাভেদ ও বিভেদ ভুলে গিয়ে একক প্লাটফর্মে আসতে বাধ্য হবেন। তবে এর আগে একটি প্রচÐ ঘূর্ণিবাত্যার তাÐব প্রয়োজন। তীব্র ঝড়ো হাওয়ার আঘাত-অভিঘাতে যখন সব লÐভÐ হয়ে যাবে তখন তারা একে অপরের হাত ধরে বাঁচতে চাইবেন। বুকের সাথে বুক মেলাবেন। তখন হয়তো দেরি হয়ে যাবে। সময়ের ও যুগের চ্যালেঞ্জ ওলামা-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ করেছে, ইতিহাসের পাতায় রয়েছে তার বহু প্রমাণ। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর পাকিস্তানের ওলামা-মাশায়েখরা যখন ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেন তখন শাসকচক্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ‘কোন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করব? দেওবন্দীর ইসলাম? বেরলভির ইসলাম? মওদূদীর ইসলাম? শিয়া’র ইসলাম? আহলে হাদিসের ইসলাম?’ এ চ্যালেঞ্জ পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের বিভিন্ন মত ও পথের আলিমরা ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হন। ১৯৫১ সালে বিভিন্ন মতাদর্শের ৩১ আলিম করাচিতে হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিখ্যাত খলিফা আল্লামা সাইয়েদ সোলায়মান নদভীর সভাপতিত্বে মিলিত হয়ে ঐতিহাসিক ২২ দফা প্রণয়ন করেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, মাওলানা যফর আহমদ ওসমানি, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শফি উকাড়ভি, মাওলানা শামসুল হক আফগানি, মাওলানা আবদুল হামিদ কাদেরি বাদায়ুনি, মাওলানা ইদরিস কান্ধলভি, মাওলানা দাউদ গজনভিসহ দু’জন শিয়া মুজতাহিদ। ফলে রচিত হয় ১৯৫৬ সালের ইসলামী সংবিধান। ভারতে নানা পথ ও মতের আলিমদের মধ্যে ঐক্যের একটি বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক সম্মেলনে তারা একে অপরকে অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেন।

ইসলামী শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির বিরুদ্ধে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃক আহূত সর্বভারতীয় সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে আহলে হাদিস, আহলে সুন্নাত বেরলভি জামায়াত, শিয়া ওয়াকফ বোর্ড, দিল্লি ও আজমিরের দরগাহের মুতাওয়াল্লি বক্তব্য রাখেন। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কর্তৃক দিল্লি, মুম্বাই, আজমির, কলকাতা ও হায়দরাবাদে আয়োজিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী ও জাতীয় সংহতি সম্মেলনে মুসলমানদের বিভিন্ন চিন্তাধারার আলিমদের পাশাপাশি উদারপন্থী হিন্দু সাধু ও সন্তরাও বক্তব্য পেশ করেন। ২০১৮ সালে জমিয়তে আহলে হাদিসের উদ্যোগে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত ‘বিশ^ শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও মানবতা সংরক্ষণ’ শীর্ষক ৩৪তম জাতীয় সম্মেলনে দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম হিন্দের সভাপতি মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি অতিথি হিসেবে অংশ নেন এবং বক্তব্য উপস্থাপন করেন (সুত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া)। ২০২২ সালের ২৮ ও ২৯ মে ভারতের উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে ওসমাননগর ঈদগাহ ময়দানে দেশটির মুসলমানদের সর্ববৃহৎ পুরনো সংগঠন জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের দুই দিনব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন মাওলানা সাইয়েদ আরশাদ মাদানি, দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মুফতি আবুল কাসেম নোমানি, আসাম রাজ্যের লোকসভার সদস্য মাওলানা বদরুদ্দিন আজমল, জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমির সাইয়েদ সাআদাতুল্লাহ হোসাইনি, মাওলানা আহমদ রেজা খান বেরলভির দৌহিত্র বেরলভি নেতা মাওলানা তাওকির রেজা খান। আহলে হাদিসের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, মুসলিম পারসোনাল ল’ বোর্ড, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডসহ ভারতের বৃহৎ বৃহৎ মুসলিম সংগঠনের প্রতিনিধিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সম্মেলনে জ্ঞানবাপি মসজিদ, মথুরা ঈদগাহের শাহী মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনারসহ ভারতে মুসলিমদের বিভিন্ন চলমান সঙ্কট বিষয়ে আলিম, বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম প্রতিনিধিরা মতবিনিময় করেন। ভারতে ‘কোনোভাবেই ইউনিফর্ম সিভিল কোড গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মত দিয়েছেন দেশটির শীর্ষ আলিমরা। তারা বলছেন, এর বাস্তবায়ন ইসলামে হস্তক্ষেপের শামিল। আলিমরা বিজেপি সরকারের নেয়া পরিকল্পনা- ইউনিফর্ম সিভিল কোড তথা ‘অভিন্ন নাগরিক নীতি’র তীব্র বিরোধিতা করেন। মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ মাদানি বলেন, ভারতে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হচ্ছে। যদি এমনটি ঘটে, তা হলে দেশের নিরাপত্তা ও ভ্রাতৃত্ববোধ হুমকির মুখে পড়বে (নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ৩০ মে, ২০২২)।

ভিন্ন মতাদর্শীদের সাথে দেওবন্দী আলিমদের আচরণ উদারনৈতিক। ২০১৬ সালে কংগ্রেস নেতা শ্রী শ্রী রাহুল গান্ধী দারুল উলুম দেওবন্দ পরিদর্শন করেন। মুহতামিম মুফতি আবুল কাছেম নুমানী ও মাওলানা আবদুল খালেক মাদ্রাজী তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ও আপ্যায়ন করেন (সূত্র হিন্দুস্তান টাইমস)। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ২৯ তম বার্ষিক সম্মেলনে প্রখ্যাত হিন্দু সন্ত শ্রী রবি শঙ্কর ও ৩০ তম সভায় ঠাকুর রামদেব অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন।

১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে দ্বীনি শিক্ষা, ইসলামী রাজনীতি ও মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে যখন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তখন পাকিস্তানের সব চিন্তাধারার আলিম জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের আমির মাওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ‘মুত্তাহিদা মজলিসে আমল’ নামক ঐক্যমঞ্চ গড়ে তুলতে বাধ্য হন। জামায়াতে ইসলামীর আমির কাজী হোসাইন আহমদ আলিমদের একতাবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। মাওলানা ফজলুর রহমান ছিলেন তখন পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতা। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে, বাংলাদেশের মাটি, পরিবেশ, জনমানস ইসলামী আন্দোলনের সফলতার অনুক‚লে; কিন্তু আলিমদের দলাদলি, ইসলামী দলগুলোর দুর্বল নেতৃত্ব, সঙ্কীর্ণতা ও অনৈক্য এ উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে দিয়েছে। নেতা ও কর্মীরা ইসলাম, ইসলামী শাসন ও ইকামাতে দ্বীনের কথা বললেও জনগণের ব্যথা-বেদনা, অভাব-অভিযোগ ও হাসি-কান্নার কথা বলেন খুব কম। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় কাকে বসালে রাষ্ট্রের উন্নতি হবে, আইনের শাসন কায়েম হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে ও ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে, সাধারণ মানুষ তা জানে ও বোঝে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির তীব্রতা অনেক সময় ইসলামপন্থীদের মন ও মানসকে এতই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, অন্য প্লাটফর্মের মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে কুণ্ঠিত হন। ভিন্নতার মাঝে ঐক্য (টহরঃু রহ ফরাবৎংরঃু) ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হওয়া অপরিহার্য, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

এ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ এ জেড এম শামসুল আলমের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যও ইসলামী আন্দোলনের বহু নেতা একসাথে এক দলে কাজ করতে পারেন না। নিজের নেতৃত্ব স্বীকৃত না হলে উপদল করবেন বা ক্ষুদ্র সংগঠন করবেন। কিন্তু কোনো পুরনো দলে যোগ দেবেন না। ইসলামী আন্দোলনকারী বহু নেতার মধ্যে নাফসানিয়ত, খাহেশাত, আমিত্ব ও অহঙ্কারবোধ এত বেশি যে, অদূর ভবিষ্যতেও তাদের মধ্যে এ মারাত্মক ব্যাধির চিকিৎসার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। আন্দোলনের উদ্দেশ্য লিল্লাহ (আল্লাহর জন্য) বলা হলেও আন্দোলন তারা করে থাকেন লিন্নাফস (নিজের জন্য) এবং নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। এটি অনেকের মনে সচেতনভাবে থাকে, অনেকের মনে থাকে অবচেতনভাবে। অবচেতন খায়েশ সচেতন খায়েশ অপেক্ষা মারাত্মক; কারণ অবচেতন খায়েশকারীর মনে কোনো এঁরষঃ ঋববষরহম বা অপরাধবোধ থাকে না। কিন্তু ফল একই। ইসলামী সংগঠনগুলো মধ্যে কোনো ঐক্য নেই, অথচ ধর্মবিরোধী শিবিরে ঐক্যের ঐকতান লক্ষণীয়। ধর্মনিরপেক্ষ কোনো বিরাট দল পার্টির স্বার্থে এক থাকতে পারে, অথচ তুলনামূলকভাবে অনেকগুলো ক্ষুদ্র ডানপন্থী দল ইসলামের স্বার্থে এক থাকতে পারে না। এ অবস্থায় তারা কিভাবে জনগণের আস্থা দাবি করতে পারে? ইসলামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধ। চোখের সম্মুখে তারা দেখতে পাচ্ছেন যে, ইসলামবিরোধী হওয়া সত্তে¡ও বামপন্থীদের সভা-সমিতিতে জনগণ জমায়েত হয়। কারণ বামপন্থীরা যুগ-যন্ত্রণার কথা বলে। অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক সমাধান নির্দেশ করে। একই বক্তব্য যদি ইসলামপন্থীরা পেশ করতে পারে তাদের সভায় তো লোক আরো বেশি হওয়ার কথা। কারণ তাদের থেকে জনগণ শুধু যে যুগের সমস্যার সমাধান পাবে তা নয়; বরং জীবনজিজ্ঞাসার জবাবও পাবে। এ সাধারণ সত্য বোঝার জন্য দার্শনিকের দরকার হয় না। ইসলামপন্থীরা কি তা বোঝেন?’ (ইসলামী প্রবন্ধমালা, পৃষ্ঠা : ৪৮৪-৪৯৮)।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্যোগের ঘনঘটা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং অশুভ শক্তির অশনি সঙ্কেত স্পষ্ট হতে চলেছে। বৈশ্বিক পরিমÐলে ইসলামোফোবিয়া বিশেষত উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহ ও ভূরাজনীতির বাস্তবতাকে ভুললে চলবে না। ৫২ বছরেও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি এ দেশে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘর্ষের পথে এগোচ্ছে দেশ। মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর ক্রমোর্ধ্বগতি, নিম্নমুখী রিজার্ভ, শেয়ারবাজার লোপাট, বিদেশে পুঁজিপাচার, দুর্নীতির মহোৎসব, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট সফলতার সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মইনুল ইসলামের মতে, ‘আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে তিন হাজার কোটি ডলার ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। প্রতি বছর ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার লাখ কোটি টাকায়’ (প্রথম আলো, ৩১ মে, ২০২২)। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, একটি ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। এ ঘূর্ণিঝড় আশীর্বাদও হতে পারে। হতে পারে অভিশাপও। এ দেশের আম ইসলামী জনতা ঘূর্ণির প্রলয়-নৃত্য ও ঘূর্ণি-পরবর্তী বেঁচে থাকার সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করার জন্য অপেক্ষমাণ। সেই সংগ্রাম হতে হবে নিশ্চিতভাবে ঐক্যনির্ভর।

সা¤প্রতিক সময়ে কতিপয় বক্তা মাঠে ময়দানে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন তাতে হতাশ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এতে উম্মাহর ঐতিহ্যচেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিহ্নিত বৈরি শক্তি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার সুযোগ পাবে। পরের দোষ চর্চা না করে নিজের দোষ অন্বেষণ করতে পারলে সহনশীল পরিবেশ তৈরি হবে। এটাকে মুজাদ্দিদে আলফে সানি ‘দিদে কাসূর’ নামে অভিহিত করেন। একথা আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে কোন ইসলামী দল যতই সাংগঠনিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হোক, একা এক দলের পক্ষে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা কোন দিন সম্ভব নয়। ক্ষমতার অংশীদারিত্ব ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এক নয়। সব ইসলামী রাজনৈতিক দল যদি বৃহত্তর ইস্যুতে একটি প্লাটফরমে আসতে পারতো তাহলে চমৎকার ফল দিত। দাবী আদায় ও জনমত সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব হতো। রাজনীতির ময়দানে জনস্বার্থে তারা ইধৎমধরহরহম অমবহঃ হতে পারতেন। নিজেদের স্বতন্ত্র অস্থিত্ব দৃঢ়করণ ও চিন্তাধারার বিকাশ হতো অবারিত।
আলিয়া ও কওমি ঘরানার ওলামা মাশায়েখদের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সহমর্মিতার ঐতিহ্য রয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। সংযত বাক ও সংযমি আচরণের মাধ্যমে একে অপরের কাছে আসার সুযোগ আছে। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে যেন ফাটল না ধরে এ ব্যাপারে নানা ঘরানার মুরব্বি আলিমদের সচেতন থাকার প্রয়োজনীয়তা সবচে বেশি। মনে রাখতে হবে ঐক্যই শক্তির উৎস আর শক্তি মানে শান্তি। সংকীর্ণতার বৃত্ত ভেঙ্গে চিত্তকে বিশাল করতে পারলে ইসলামী সমাজবিপ্লবের আলোকিত পথের সন্ধান পাবো। বাতিল ও কুফরি শক্তি সবচে যেটা ভয় পায় তা হলো মুসলমানদের ঐক্য।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম.ই.এস ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।