دعاة لا قضاة
আমরা দাঈ বিচারক নই
হাসান আল—হুদাইবি
অনুবাদ
সাআদ হাসান
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূচিপত্র
শায়েখ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল—খতিবের ভূমিকা
লেখকের কথা
প্রথম পরিচ্ছেদ : কালিমায়ে শাহাদাতের অর্থ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : জুহুদ, কুফর, শিরক, রিদ্দাহ ও নিফাকের অর্থ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : শাসন
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : আমাদের আকিদা : বিধান দেওয়ার ক্ষমতা কেবল আল্লাহর
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : আকিদার ক্ষেত্রে ভুল ও অজ্ঞতা
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : আলোচ্য মূলনীতিসমূহের বিরোধিতাকারীর যুক্তি খণ্ডন
সপ্তম পরিচ্ছেদ : আনুগত্য ও অনুসরণ
অষ্টম পরিচ্ছেদ : ইসলামি হুকুমাত, সত্যনিষ্ঠ ইমাম, শ্রবণ, আনুগত্য, শাসন বিচারক নির্ধারণ ও দীনের আবশ্যিক জ্ঞানের অর্থ
নবম পরিচ্ছেদ : তাগুতকে অস্বীকার
দশম পরিচ্ছেদ : কুরআনে কারিমের ওপর সরাসরি আমল
‘আমরা দাঈ বিচারক নই’ গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু প্রশ্নোত্তর
উসতায হাসান আল—হুদাইবি র.
ভূমিকা
الحمد لله رب العالمين، والعاقبة للمتقين، والصلاة والسلام على سيدنا محمد وعلى آله و صحبه أجمعين… أما بعد.
‘আমরা দাঈ বিচারক নই’ (دعاة لا قضاة) গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ আমাদের হাতে। বইটি লিখেছেন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মুর্শেদে আ’ম হাসান আল হুদাইবি র.। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হোন। তিনি সত্যের পথে জিহাদে অকুতোভয় সেনাপতি এবং ইসলামের ঐ সকল দাঈদের একজন যারা নিজেদের জীবন, জিন্দেগী ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় সঁপে দিয়েছেন। তিনি চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এমন কঠিন দুঃখ—কষ্টের মোকবেলা করেছেন যার নজির বিগত চৌদ্দশত বছরের ইসলামী দাওয়াহর ইতিহাসে মেলা ভার।
তিনি সত্যের পথে দৃঢ়তা ও অবিচলতার ক্ষেত্রে ছিলেন সুউচ্চ পাহাড়ের ন্যায়, যার প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও দৃঢ় প্রত্যয়কে কখনও কোনো দুর্বলতা স্পর্শ করেনি। বার্ধক্য ও অসুস্থতা সত্ত্বেও নানা প্রকার দুর্যোগ—দুর্বিপাক তাকে বিন্দুমাত্র নাড়াতে পারেনি। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ (১৪৬) وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ (১৪৭) فَآتَاهُمُ اللَّهُ ثَوَابَ الدُّنْيَا وَحُسْنَ ثَوَابِ الْآخِرَةِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ}
“আর কত নবী ছিলেন, যাদের সাথে থেকে অনেক আল্লাহ ওয়ালা লড়াই করেছে। অতঃপর আল্লাহর পথে তাদের ওপর যা আপতিত হয়েছে তার জন্য তারা হতোদ্যম হয়নি। তারা দুর্বল হয়নি এবং তারা নতও হয়নি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। আর তাদের কথা শুধু এই ছিলো যে, তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ এবং আমাদের কর্মে আমাদের সীমালঙ্ঘনগুলো ক্ষমা করুন, আমাদেরকে দৃঢ়পদ করুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।
আলে ইমরান : ১৪৬—১৪৮
তিনি এবং তাঁর অনুসারীগণ সকল দুঃখ—কষ্ট ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করেছেন এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রতিদানের আশা করেছেন। ধমনীর শেষ স্পন্দন এবং জীবনের শেষ নিঃশ^াস পর্যন্ত তারা এর ওপর অবিচল ছিলেন। তাদের বক্ষে বিরাজমান ছিলো মহান দায়িত্বের অনুভূতি এবং তাদের ওপর অর্পিত আমানতের গুরুভার।
আমাদের ইমাম হাসান আল হুদাইবি র.—এর প্রচেষ্টার স্বীকৃতি দান কিংবা তার অবদান লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন নেই। কারণ, এখন তিনি আল্লাহর নিকট সম্মানজনক স্থানে অবস্থান করছেন। তিনি পৌঁছে গেছেন দয়ালু প্রভুর দরবারে, সেখানে আল্লাহ তাঁকে তাঁর কৃতকর্মের উত্তম প্রতিদান দান করবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :
فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ أَنِّي لَا أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى بَعْضُكُمْ مِنْ بَعْضٍ فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَأُدْخِلَنَّهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ ثَوَابًا مِنْ عِنْدِ اللَّهِ وَاللَّهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الثَّوَابِ.
“অতঃপর তাদের রব তাদের ডাকে সাড়া দিলেন যে, নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্য হতে কোনো আমলকারীর Ñহোক সে পুরুষ অথবা নারীÑ আমল বিনষ্ট হতে দেবো না। তোমরা তো একে অপরের অংশ। সুতরাং যারা হিজরত করেছে এবং যাদেরকে তাদের ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে এবং যাদেরকে আমার রাস্তায় কষ্ট দেওয়া হয়েছে, আর যারা যুদ্ধ করেছে এবং নিহত হয়েছে, আমি অবশ্যই তাদের ত্রুটি—বিচ্যুতিসমূহ মোচন করে দেবো এবং তাদেরকে প্রবেশ করাবো জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ হতে প্রতিদান স্বরূপ। আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম প্রতিদান।
আলে ইমরান : ১৯৫
নাহাওয়ান্দ যুদ্ধে বিজয়ের পর সেনাপতি উমর রা.—এর কাছে মুসলিমদের বিজয় এবং নুমান বিন মুকরিন রা.—এর শাহাদাতের সংবাদ দিয়ে একজন দূত প্রেরণ করলেন। সংবাদ শুনে হযরত উমর রা. কান্না করলেন এবং “ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন” পাঠ করলেন আর জিজ্ঞেস করলেন, আর কে কে শাহাদাৎ বরণ করেছে? দূত বললেন, আমীরুল মুমিনিন! অমুক, অমুক এবং আরও কিছু লোক, আপনি তাদের চিনবেন না। উত্তরে উমর রা. ক্রন্দনরত অবস্থায় বললেন, “উমর তাদেরকে চিনবে না, এতে তাদের কোনো ক্ষতি নেই, আল্লাহ তো তাদের চিনেন।”
তারিখে তাবারি : ৪/১২০
আমরা পূর্বসূরিদের পবিত্রজ্ঞান করার জন্য তাদের আলোচনা করছি না; বরং আমাদের প্রতি তাদের যে বিশাল অবদান রয়েছে, তার কৃতজ্ঞতা ও স্বীকৃতি স্বরূপ করছি। কেননা তারাই তো আমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে গেছেন এবং আমাদেরকে এমন অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন, যেখান থেকে আমরা রিসালাতের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারি। এ আলোচনায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের অনুসরণের সাহস পাবে। তাদের নির্দেশিত পথে চলার এবং আল্লাহর সন্তুুষ্টির আশায় সত্যের পথে অবিচল থাকার হিম্মত পাবে। কুরআনে কারিমে আমাদের জন্য পূর্বসূরি ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকার কথা ঘোষণা করে বলা হয়েছে :
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
“আরা যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের ভাই, যারা ঈমানের সাথে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তদের ক্ষমা করুন। আর যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।” হাশর : ১০
প্রিয় উসতায উমর তিলিমসানী (আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন, সন্তুষ্ট হোন এবং তাকে নিজ দয়ায় সন্তুষ্ট করুন) বলেন, হাসান আল বান্না তাঁর রবের পানে এমন অবস্থায় গমন করেছেন, যখন তার রোপণকৃত অঙ্কুরটি বয়ঃপ্রাপ্ত ও পরিপক্ক হয়েছে। তাঁর পরে হাসান আল হুদাইবিও ছিলেন স্বীয় যুগে সবচেয়ে বড় আলেম ও মশালধারী আলোকবর্তিকা। যেদিন থেকে তিনি ঝাণ্ডা হাতে নিয়েছেন সেদিন থেকে কখনও দায়িত্বে সামান্যতম ত্রুটি করেননি। তিনি ছিলেন বাতিলের বিরুদ্ধে শক্তিমান পুরুষ, যাকে কখনও দুর্বলতা স্পর্শ করেনি; ছিলেন মহানুভব, যিনি কখনও মাথা নত করেননি। তিনি পূর্ণ আমানতদারির সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী।
তিনি স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা ও দর্শন আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ফাঁসির কাষ্ঠের রশি যাকে স্বীয় লক্ষ্য থেকে সামান্যতম বিচ্যুত করেনি এবং জেল—জুলুম কোনো কিছুই তার অন্তরে ভীতি সঞ্চার করতে পারেনি; বরং এসব কিছু তার মধ্যে সত্যের পথে দৃঢ়তা ও অবিচলতাই বৃদ্ধি করেছে। মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ, সংখ্যা : ১, রজব ১৩৯৬
উসতায হাসান আল হুদাইবি বদর দিবসের আলোচনায় বলেন,
“ভাইয়েরা আমার! ইখওয়ানুল মুসলিমিনের দাওয়াত কোনো আঞ্চলিক দাওয়াত নয়, যা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ; বরং এটি আজ একটি আন্তর্জাতিক দাওয়াতে পরিণত হয়েছে, যা বিশ^ব্যাপী মুসলিমদের অন্তরে সম্মান, আত্মমর্যাদা ও তাকওয়ার চেতনা জাগ্রত করে চলেছে। কেননা তা আজ এমন জাগরণের প্রতীক, যার পরে আর কোনো সুখনিদ্রা আসবে না। এটি স্বাধীনতার প্রতীক, যার সাথে দাসত্বের কোনো স্থান হবে না। এটি জ্ঞানের প্রতীক, যার পেছনে অজ্ঞতার কোনো স্থান হবে না। কোনো সীমালঙ্ঘনকারী অপশক্তির পক্ষে সহজ হবে না এ আধ্যাত্মিকতার বিস্তৃতিকে থামিয়ে দেওয়া কিংবা তার গতিরোধ করা। আর তা এ কারণেই যে, এটি হচ্ছে একটি গভীর চেতনার সত্য ভাষণ, যার স্থান সকল মুসলিমের অন্তর জুড়ে, যে অনুভূতি তাদের চিন্তার জগতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আর তা হচ্ছে, আজ ইসলামকে বাদ দিয়ে কোনো জাগরণ সম্ভব নয়। কারণ, মূলত ইসলাম হলো জাতীয়, সামাজিক, ও মানবিক প্রয়োজন।”
মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ : সংখ্যা—৭, গাজা, মুহাররম : ১৩৯৭ হি.
তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে উদ্দেশ্য করে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ বিশেষভাবে তোমাদের দেশের জন্য এবং সামগ্রিকভাবে পুরো বিশে^র জন্য ন্যায়, সম্মান ও মর্যাদার বিষয়ে তোমাদেরকে সৈনিক করেছেন। যেহেতু সৈনিকের দায়িত্ব হলো, স্বীয় দায়িত্ব পালনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকা। তাই তোমাদেরকে তোমাদের জীবনে আল্লাহর সাহায্য লাভের প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অতএব, তোমরা নিজেদের অন্তরকে পবিত্র কর এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পূর্বে তোমাদের রিপুর কামনা বাসনার বিরুদ্ধে লড়াই কর। কেননা যে আত্মশুদ্ধির ময়দানে স্বীয় নফসের কাছে হেরে যায় সে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে আরও দ্রুত হেরে যাবে।” (প্রাগুক্ত)
‘আমরা দাঈ বিচারক নই’ (دعاة لا قضاة) গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : গ্রন্থটির আলোচ্য বিষয়, ইসলামী শরিয়াহর কিছু নীতিমালা এবং সূক্ষ্মতর মানদণ্ড। মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে আমাদের এ নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। আর এসবের দাবি অনুযায়ী কাজ করতে হবে এবং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে দায়িত্ব প্রদান করেছেনÑ তথা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা, তাঁর দ্বীনকে আকড়ে ধরা এবং তাঁর রাসূলের (সা.) অনুসরণ করা ইত্যাদি যথাযথভাবে পালন করতে হবে। বক্তব্য ও লেখনীর মাধ্যমে সংশয় দূরীভূত করে বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা করা, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সা. সুন্নাহকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী সুন্দরতম পন্থায় বিতর্ক করাÑ ইত্যাদি কাজগুলো ঐ সকল নীতিমালার আলোকে পালন করা আমাদের কর্তব্য। আর এটিই সুন্দর ও সঠিক পন্থা। কোরআনে এসেছে —
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِينَ.
তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন, কে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। আর হেদায়েতপ্রাপ্তদের বিষয়ে তিনি খুব ভালো করেই জানেন। নাহল : ১২৫
একদিন হযরত উমর বিন আব্দুল আযিয র. সংবাদ পেলেন যে, খারেজি সম্প্রদায় সা¤্রাজ্যের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং সেখানে বিশৃঙ্খলা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সংবাদ পাওয়া মাত্রই তিনি তাদের কাছে একটি পত্র প্রেরণ করলেন। সে পত্রে তিনি বলেন,
“উমর ইবনে আব্দুল আযিয—এর পক্ষ থেকে অমুক অমুকের প্রতি …. , আমার কাছে এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর দ্বীনের সাহায্যের প্রতি বিদ্বেষ বশত হয়ে বিদ্রোহ করেছ। তবে এক্ষেত্রে তোমরা আমার থেকে উত্তম নও। তাই আস, আমরা সংলাপে বসি। যদি আমরা ন্যায়ের ওপর থাকি তাহলে তোমরা আমাদের আনুগত্য করতে বাধ্য থাকবে। আর যদি তোমরা ন্যায়ের ওপর থাক তাহলে আমরা আমাদের করণীয় বিষয়ে চিন্তা করবো।”
তাদের কাছে এ পত্র পেঁৗছার পর তারা এসে উপস্থিত হলো। তিনি তাদেরকে নিয়ে মসজিদে সংলাপে বসলেন এবং মুক্ত মনে মনোযোগ সহকারে তাদের বক্তব্য শুনলেন। অতঃপর তারাও তাঁর বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করলো। কারণ, তারা ইসলামের কথা শুনছিলো এমন ব্যক্তিত্ব থেকে, যিনি ছিলেন সত্যবাদী ও আমানতদার। ফলে তারা তাঁর রায় সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিল এবং নিজেদের অবস্থান থেকে ফিরে এসে আল্লাহর দরবারে তাওবা করলো।
বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের ক্ষতিসাধানের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকা, চক্রান্ত করা এবং জুলুম—নিপীড়নের মাধ্যমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি করাÑ এটি একটি ব্যর্থ নীতি এবং মানবতাবিরোধী কাজ। তাছাড়া এ নীতি বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে হঠকারিতা ও সীমালঙ্ঘনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, অতীতে এমনটি ঘটতে দেখা গেছে।
মুস্তফা সাদেক রাফেয়ি র. বলেন,
“যদি তুমি তোমার বিরোধী মতের লোককে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাও তাহলে আমি বলবো, তোমার মাথায় রশি নামক একটি আকল রয়েছে। যদি তুমি তোমার বিরোধী মতের লোককে কারাবদ্ধ কর তাহলে আমি বলবো, তোমার মাথায় প্রাচীর নামক একটি আকল রয়েছে। যদি তুমি তোমার বিরোধী মতের লোককে হত্যা কর তাহলে আমি বলবো, তোমার মাথায় ছুড়ি নামক একটি আকল রয়েছে। আর যদি তুমি অন্যের মতামত গ্রহণ কর, নিজেও মতামত প্রদান কর, যদি তুমি বিরোধী মতের লোক থেকে শ্রদ্ধা অর্জন কর এবং নিজেও শ্রদ্ধাশীল হও তাহলে আমি বলবো, তোমার মাথায় ‘আকল’ আছে; আর তা হচ্ছে প্রকৃত আকল ও বুদ্ধিমত্তা।” (ওয়াহয়ুল কলম)
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সংবেদশীল। এগুলো পরিপূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে চাইলে দীর্ঘ অধ্যয়ন, গভীর জ্ঞান ও পূর্বসূরিদের কর্মকৌশল সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। অতএব, কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার কথা যে শুনা গিয়েছে তার কারণ সম্ভবত এটিই হবে যে, ইসলামি ফিকহ ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সম্পর্কে কিছু লোকের জ্ঞান ও অবগতি কম থাকা, কিছু নসকে (শরিয়ার বক্তব্য) বাদ দিয়ে বাকিগুলো গ্রহণ করা। পূর্বসূরিদের মতামত অধ্যয়ন না করা এবং সেগুলোর প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে অবগত না থাকা। এমনিভাবে পূর্বসূরিদের মতামতগুলো সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারা এবং সাহাবা ও তাবেয়িগণের ইজমা (ঐকমত্য)—এর প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা। এ কারণে উসতায র. “কুরআনে কারিমের ওপর সরাসরি আমল” (التعامل المباشر مع القرآن الكريم) শিরোনামের অধীনে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে এসকল নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আমাদের পূর্বসূরিগণ আমাদেরকে নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া কোনো বিধান বর্ণনা করা এবং শর্তাবলি ও নীতিমালার পরিপূর্ণ জ্ঞান ব্যতীত দীনের প্রচার বা তার বিধানাবলির ব্যাখ্যা করতে এবং নতুন বিধান আহরণের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ব্যতীত এসবের প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছেন।
হাসান বসরি র. বলেন,
“ইলমবিহীন আমলকারী উল্টোপথে গমনকারীর ন্যায়। ইলমবিহীন আমলকারী দীনের যতটা না উপকার করে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে। কাজেই তোমরা এমনভাবে ইলম অন্বেষণ কর, যেন তার কারণে ইবাদতে ত্রুটি না হয় এবং এমনভাবে ইবাদত কর, যেন তার কারণে ইলমের ক্ষতি না হয়। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে যে, একটি জাতি ইলম বর্জন করে ইবাদতে মগ্ন হয়েছে। ফলে তারা নবী মুহাম্মাদ সা.—এর উম্মতের বিরুদ্ধে তরবারি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। যদি তারা ইলম অর্জন করতো তাহলে তাদের ইলম কখনও তাদেরকে এমন কর্মের প্রতি নির্দেশ করতো না।”
চূড়ান্ত কথা
আমাদের ইমাম শহিদ হাসান আল বান্না (আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন) রিসালাতুত তাআলিম গ্রন্থে বলেন,
“এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা হলো, আমরা কখনও এমন কোনো মুসলিমকে কাফের সাব্যস্ত করবো না, যে আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করে এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.—কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে। সেই সাথে এ দুটি বিষয়ের দাবির ওপর আমল করে এবং ফরয বিধানসমূহ পালন করে; তা হোক নিজেদের মন মত অথবা কোনো গোনাহের কারণে। কিন্তু যদি সে কুফরি কালিমা উচ্চারণ করে, অথবা দীনের কোনো আবশ্যিক ও অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করে, অথবা কুরআনের স্পষ্ট বিধানকে মিথ্যারোপ করে, অথবা কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করে, আরবি ভাষার নীতিমালা অনুসারে যার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই, কিংবা এমন কাজ করে কুফরি ছাড়া যার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, সেক্ষত্রে আমরা তাকে কাফের সাব্যস্ত করবো।” (রিসালুত তাআলিম)
“ইখওয়ানুল মুসলিমিন” তার সূচনালগ্ন থেকে এ মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত আছে। এটিই হচ্ছে পরিপূর্ণ সত্য, সঠিক ও নিরাপদ পন্থা।
ইমাম বান্নার বক্তব্য “আমরা কখনও এমন কোনো মুসলিমকে কাফের সাব্যস্ত করবো না, যে আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করে এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.—কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে। সেই সাথে এ দুটি বিষয়ের দাবির ওপর আমল করে এবং ফরয বিধানসমূহ পালন করে..” এ কথা থেকে কেউ এমন ধারণা করতে পারে যে, শুধু কালিমার সাক্ষ্য দিলেই কেউ মুসলিম হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না এগুলোর দাবির ওপর আমল করবে এবং ফরয বিধানসমূহ পালন করবে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয় এবং এটা ইমাম বান্নার উদ্দেশ্যও নয়। তার প্রমাণ হলো, এরপরই তিনি বলেছেন, “হোক তা নিজের মন মত অথবা কোনো গোনাহের কারণে।”
অর্থাৎ, কোনো মুসলিমকে নিজেদের মন মতো অথবা কৃত গোনাহের কারণে কাফের সাব্যস্ত করবো না। আর এ কথা সুবিদিত যে, ফরয বিধাান ত্যাগ করা গোনাহের কাজ। আর রিয়া তথা লৌকিকতা মিশ্রিত ইবাদতও একত্ববাদের (তাওহিদ) সাক্ষ্যের বিপরীত এবং এটি গোনাহের কাজও বটে। তাছাড়া আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত প্রত্যেক গোনাহ বা পাপের কারণে কাফের সাব্যস্ত করেন না। অতএব প্রতীয়মান হলো, ইমাম বান্নার উপযুর্ক্ত কথার উদ্দেশ্য হলো, কালিমার সাক্ষ্যদানের বিষয়টি এর দাবির ওপর আমল করাকে আবশ্যক করে। আর এগুলোর অন্যতম দাবি হলো, ফরয বিধানসমূহ পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা।
এরপর ইমাম বান্না র. বলেন, তবে কেউ যদি কুফরি কালিমা উচ্চারণ করে অথবা দীনের কোনো আবশ্যিক ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কে অস্বীকার করে অথবা কুরআনের বিধানকে মিথ্যারোপ করে অথবা এমন ব্যাখ্যা করে আরবি ভাষার নীতিমালা অনুসারে যার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই; কিংবা এমন কাজ করে কুফরি ছাড়া যার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় সেক্ষত্রে আমরা তাকে কাফের সাব্যস্ত করবো।
সুতরাং এখানে সুস্পষ্টরূপে পাঁচটি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আর ইমাম বান্নার বক্তব্যে “কুফরি কালিমা উচ্চারণ করে” এ কথার অর্থ হলো, কোনোরূপ অপারগতা ব্যতীত খুশি মনে কুফরের কথা মুখে স্বীকার করে, অথবা তাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় বটে, তবে সে মানুষের শাস্তিকে আল্লাহর শাস্তির মত মনে করে উদারচিত্তে কুফরের কথা স্বীকার করে।
আর ‘দীনের আবশ্যিক ও অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করে’ এ কথার অর্থ হলো, শরিয়াহর নিশ্চিতরূপে স্বীকৃত বিষয়সমূহকে অস্বীকার করে। যেমনÑ নামায ফরয হওয়া, মদপান হারাম হওয়া। অথবা কুরআনের কোনো আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তা কুরআনের অংশ হওয়াকে অস্বীকার করে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলোÑ [যেমনটি বিভিন্ন কিতাবে উল্লেখ আছে[ তার এ অস্বীকার হতে হবে, এ ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা জানার পর এবং অস্বীকারকারীর কাছে স্পষ্টরূপে দলিল—প্রমাণ উপস্থিত করার পর। তবে কেউ যদি এ কথা না জানে যে, এ বিষয়গুলো দীনের আবশ্যিক বিষয়ের অন্তভুর্ক্ত, তাহলে এক্ষেত্রে তাকে অপারগ ধরা হবে এবং এর গোনাহ ঐ সকল লোকের ওপর বর্তাতে যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল ঐ ব্যক্তির কাছে দীনের জ্ঞান পেঁৗছানো, তা সত্ত্বেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি।
আর ‘কুরআনের স্পষ্ট বিধানকে মিথ্যারোপ করে’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, পবিত্র কুরআনে যেসকল বিষয় সুস্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে সেসকল বিষয়কে মিথ্যারোপ করা। যেমনÑ পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের সংবাদকে প্রত্যাখ্যান করা, অথবা কুরআনে বর্ণিত নবীগণের ঘটনাবলি অস্বীকার করা।
আর ‘কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করে আরবি ভাষার নীতিমালা অনুসারে যার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই’ এ কথার ব্যাখ্যা হচ্ছেÑ পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, ব্যাখ্যাটি নিষ্পাপ সত্তা রাসূলে কারিম সা. থেকে বর্ণিত হতে হবে। নবীজি সা. থেকে কোনো বর্ণনা পাওয়া না গেলে সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রাপ্ত হতে হবে। যদি সাহাবায়ে কেরাম থেকেও পাওয়া না যায় তাহলে আমাদের পূর্বসূরি নির্ভরযোগ্য ইমামগণ থেকে বর্ণিত হতে হবে। তাও যদি পাওয়া না যায় তাহলে ইজতিহাদের যাবতীয় শর্তাবলি ও যোগ্যতা পূরণের শর্তের সাথে ইজতিহাদের অবকাশ রয়েছে। বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের একাদশ পরিচ্ছেদে ‘কুরআনে কারিমের ওপর সরাসরি আমল’ শিরোনামের অধীনে এবিষয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা রয়েছে।
যদি কোনো ব্যক্তি যাবতীয় শর্তকে উপেক্ষা করে নিজের খেয়াল—খুশি মত কুরআনের ব্যাখ্যা করে তাহলে সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা করে নেয়, যেমনটি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। এ কথা তখন প্রযোগ্য হবে যখন কোনো ব্যক্তি নিজের খেয়াল—খুশি মত কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করবে আরবি ভাষার নীতিমালা যার কোনো সম্ভাবনা রাখে। অতএব, যদি কেউ কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করে আরবি ভাষার নীতিমালা যার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা রাখে না, তাহলে তার ব্যাখ্যাটি কুরআনের সুস্পষ্ট মিথ্যারোপ হিসেবে গণ্য হবে।
আর লেখক যে বলেছেন, “কিংবা এমন কাজ করে কুফরি ছাড়া যার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়” তার দৃষ্টান্ত হলো, যেমন কোনো ব্যক্তি মুসলিম দেশ থেকে পালিয়ে কাফের দেশে চলে গেল এবং সেখানে গিয়ে সে কাফেরদের সাথে কাছে মুসলিমদের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ করে দিল, তার মুসলিম ভাইয়ের বিরুদ্ধে তার শ্রম ও শক্তি দ্বারা কাফেরদের সাহায্য জোগাল অথবা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সে কাফের সেনাদের সাথে বেরিয়ে পড়লো, অথচ সে স্বীয় কাজ ও এর পরিণতি সম্পর্কে ভালো করে জানে।
ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ ইমাম হাসান আল বান্না র. যে নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন, তার উত্তরসূরি উসতায মুরশিদ হাসান আল হুদাইবি র. সে নীতিমালা মেনে চলেছেন এবং সেগুলোর যথাযথ হেফাযত করেছেন। হাসান আল হুদাইবি র. ছিলেন ইখওয়ানের যাবতীয় কাজ ও দায়িত্বের ব্যাপারে পূর্ণ আমানতদার। তিনি দাওয়াহর কঠিন সঙ্কটময় মুহূর্তে এর ঝাণ্ডা ধারণ করেছেন এবং তার পূর্বসূরিদের ন্যায় এর নিরাপত্তা বজায় রেখেছেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন এর বায়আত পূর্ণকারী এবং তার দায়িত্বসমূহ যথাযথ পালনকারী। কোনো শক্তি তাকে স্বীয় মিশন থেকে দুর্বল করতে পারেনি এবং তিনি এক আল্লাহ ব্যতিরেকে আর কারও কাছে নতি স্বীকার করেননি। এভাবে তিনি অসীম সাহস, ধৈর্য, দৃঢ় প্রত্যয় ও নিষ্ঠার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মহান আল্লাহর বাণী চিরন্তন সত্য —
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا
মুমিনদের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে, যারা আল্লাহর সাথে কৃত তাদের প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন করেছে। তাদের মধ্য হতে কেউ (যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করে) তার দায়িত্ব পূর্ণ করেছে। আর কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা (কৃত প্রতিশ্রম্নতিতে) কোনো পরিবর্তন করেনি। আহযাব : ২৩
বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটিতে ভূমিকা ও এগারটি পরিচ্ছেদ রয়েছে। ভূমিকায় এমন সব নীতিমালা আলোচিত হয়েছে যেগুলোর অনুসরণ করা আমাদের জীবনে অত্যন্ত জরুরি; যেন আমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে না যাই।
১. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তকে আবশ্যিকরূপে মেনে নেওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,
} فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا}
যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। নিসা : ৫৯
২. শুদ্ধতার ওপর দলিল নেই, এমন কথা মানা আমাদের জন্য আবশ্যক নয় এবং তা আমাদের বিপক্ষে দলিল হবে না। এমন কথা যে বলবে তাকে তার বক্তব্যের বিশুদ্ধতার পক্ষে দলিল হাজির করতে হবে।
৩. তিনি যুক্তির (আকল) ভূমিকা প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করেছেন যে, কোনো আদেশ বা নিষেধের কারণে শরিয়াহর কোনো বিধান আবশ্যক করার ক্ষেত্রে যুক্তির কোনো দখল নেই। বিবেক—বুদ্ধি ও জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তাআলা এর জন্য সম্মান ধার্য করেছেন এবং তাকে জীবন পরিচালনা এবং নিত্যদিনের সমস্যাগুলো সমাধানের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। কিন্তু শরিয়ার নস বা বক্তব্যের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট। আমাদের উসতায র. বলেন,
“নুসুস (শরিয়ার বক্তব্য) এবং আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষেত্রে বিবেক—বুদ্ধির ভূমিকা হলো, নুসুস শ্রবণ করে তা আয়ত্ত ও উপলব্ধির চেষ্টা করবে, অতঃপর সে বিষয়টি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। আর আজ যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে না হয়তো আগামীকালই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।”
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, শরিয়ার নুসুসের ক্ষেত্রে উসতায র. এর দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ ও নিরাপদ।
ভূমিকার মধ্যে তিনি আরেকটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, আর তা হলো, নিষ্পাপ সত্তা হযরত নবী কারিম সা. ছাড়া বাকি সকলের কথা গ্রহণ করা ও প্রত্যাখ্যান করার অবকাশ আছে। অর্থাৎ, যে কথার ওপর দলিল প্রমাণ থাকবে তা গ্রহণ করা যাবে, এদিক বিবেচনায় যে, তা সত্য ও সঠিক। আর যে কথার বিশুদ্ধতার ওপর দলিল—প্রমাণ থাকবে না তা প্রত্যাখ্যান করা হবে।
প্রথম পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি “লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” [আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল] এর সাক্ষ্যদানের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি এ কথার সাক্ষ্য দিবে সে সাথে সাথেই মুসলিম হয়ে যাবে এবং তাকে ইসলামের বাকি ফরয বিধানগুলো পালনের কথা বলা হবে। এরপর তিনি ঐ কথার ভ্রান্তি প্রমাণ করেছেন, যে বলেÑ কোনো ব্যক্তি “লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এ কথার মর্ম না বুঝে শুধু সাক্ষ্য দান করলেই মুসলিম হবে না এবং তিনি দলিল—প্রমাণের মাধ্যমে “ঈমানের জন্য আমল করা শর্ত” এর ভ্রান্তি এবং গোনাহ ও পাপের কারণে কাফের হয়ে যাওয়ার নীতির ভ্রান্তি প্রমাণ করেছেন। এরপর তিনি এক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিভঙ্গির কথাও আলোচনা করেছেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি জুহুদ, কুফর, শিরক, রিদ্দাহ ও নিফাক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি আলোচনা করেছেন, বিধান কেবলই আল্লাহর (إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ) এটিই হলো, আমাদের আকিদা ও বিশ্বাস। আরও আলোচনা করেছেন, শরিয়াহর আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির বিধান কী? এক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তির করণীয় এবং সমাজের করণীয় কী? এছাড়াও আরও আলোচনা করেছেন, আইন—কানুন, নীতিমালা ও সংবিধান প্রণয়নের বিধান, ভ্রান্তি, ব্যাখ্যা ও জবরদস্তির সীমারেখা কী হবে? বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির বিধান ও তার বিভিন্ন প্রকার, বিচারক ও দাওয়াত প্রচারকারীর কাজের মধ্যকার পার্থক্যসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রায়োগিক অনুশীলন ইত্যাদি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি আকিদার ভুল—ত্রুটি ও অজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কারও জন্য ইসলামের বন্ধন একবার সাব্যস্ত হওয়ার পর শরিয়ার স্পষ্ট বক্তব্য অথবা ইজমা (ঐকমত্য) ছাড়া তা আর দূরীভূত হবে না। এ বিষয়টি তিনি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর বিভিন্ন দলিল দ্বারা প্রমাণ করেছেন।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
যারা পূর্বে উল্লেখিত নীতিমালার বিরোধীতা করেছেন, এ পরিচ্ছেদে তাদের আলোচনা করা হয়েছে। এখানে তিনি তাদের দাবীসমূহ প্রত্যাখ্যান করে দলীল—প্রমাণের আলোকে সেগুলো ভুল প্রমানিত করেছেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি আনুগত্য, অনুসরণ ও এ দুটি বিষয়ের অর্থ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং বিশ্বাস ও কাজের মধ্যে পাথর্ক্য বর্ণনা করেছেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এখানে তিনি ইসলামি হুকুমাত, সঠিক ইমামত বা নেতৃত্বের অর্থ, শাসন, বিচারক নিয়োগ, ও দীনের আবশ্যিক বিষয়ের অর্থ, মুসলিম শাসকের শর্তাবলি ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার আবশ্যিকতা, অন্যায় শাসকের বিধান ইত্যাদি বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি তাগুতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ এবং তাগুত অস্বীকারের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
নবম পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি কুরআনে কারিমের ওপর সরাসরি আমলের বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন এবং এ বিষয়ক সংশয়ের অপনোদন করেছেন। অতঃপর এ স্পর্শকাতর বিষয়ের সাথে যে নিজেকে জড়াবে তার শর্তসমূহ উল্লেখ করেছেন। আর তাই হচ্ছে ইজতিহাদের শর্তাবলি।
যেমন, আরবি অভিধানশাস্ত্র, তাফসির, সুন্নাহ ইত্যাদি শাস্ত্র সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান রাখা। এছাড়াও ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ (বৈধ), নিষিদ্ধ, মাকরূহ প্রভৃতি বিষয় জানা। এ রত্মভাণ্ডারের সাথে আরও জানতে হবে, সাহাবা ও তাবেয়িদের ইজমা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্বসূরিদের মতামত কী ছিল?
দশম পরিচ্ছেদ
এ পরিচ্ছেদে তিনি কিছু আপত্তির জবাব দিয়েছেন এবং কিছু লোকের সন্দেহের নিরসন করেছেন। সেই সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এ দলের পরিকল্পপনা ও তার ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
প্রিয় ভাই!
এ কিতাবটি শুরু থেকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত বরাবর পড়া উচিত। এটি অত্যন্ত ধীরস্থিরতা ও পূর্ণ মনোযোগের সাথে পাঠ করতে হবে। কেননা ঈমান ও কুফর হচ্ছে সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে সংবেদনশীল বিষয়। সঠিক জ্ঞান ও দলিল—প্রমাণ ছাড়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হওয়া অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ বিষয় থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকা উচিত। বরং বিষয়টি পরিহার করে ভিন্ন কোনো কাজে ব্যস্ত হওয়া উচিত। যেমনÑ নিজের চিন্তা ও সকল মনোযোগ আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত প্রদান, মানুষের সাথে সদাচরণ, উত্তম আদর্শ স্থাপন এবং নিজের প্রতিবেশী ও আশপাশের লোকদের অন্তরে ভালো কাজের মাধ্যমে প্রভাব সৃষ্টি করা ইত্যাদি।
আর যদি আপনি বিচারক সেজে শুধু আইন জারি করেন এবং মানুষকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেন তাহলে এটি কার্যত সহজ হলেও এ নীতি এক সময় আপনাকে এমন জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন করবে, যা এক সময় আপনি সামাল দিতে ব্যর্থ হবেন। আমাদের রাসূল সা. বলেছেন,
وَمَنْ دَعَا رَجُلًا بِالْكُفْرِ، أَوْ قَالَ: عَدُوُّ اللهِ وَلَيْسَ كَذَلِكَ إِلَّا حَارَ عَلَيْهِ.
যে ব্যক্তি কাউকে কাফের আখ্যা দিল, অথবা আল্লাহর দুশমন বললো, অথচ সে বাস্তবে এমন নয় তাহলে সেই কথা তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করলো। (সহিহ মুসলিম : ১১২)
তাই প্রিয় ভাই! আপনি এ স্পর্শকাতর প্রবণতা পরিহার করুন এবং আপনি বাস্তবেই যদি উম্মাহর প্রতি দরদি ও আন্তরিক হয়ে থাকেন তাহলে অজ্ঞ ব্যক্তিদের শিক্ষাদান, তাদের হাতে ধরে সঠিক পথপ্রদর্শন এবং অসচেতন লোকদের সতর্ক করা এবং তাদের উপদেশ দানে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সঠিক কল্যাণের দিকে হেদায়াত করুন এবং আমাদেরকে হেদায়াতপ্রাপ্ত ও হেদায়াতকারী বানিয়ে দিন।
মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আল—খতিব
১০ জুমাদাল উলা ১৪০৭ হি.
মোতাবেক ১০ জানুয়ারি ১৯৮৭ খ্রি.
লেখকের কথা
সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি এক, পরাক্রমশালী, মহান বিচারক, পরম ইনসাফকারী, সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত। আমরা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, তাওবা করি হেদায়াত কামনা করি এবং ভালো কাজের তাওফিক ও সুপথ কামনা করি আর তাঁর কাছেই সাহায্য কামনা করি। আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া ভালো কাজ সম্পাদন করা এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয়।
দুরূদ ও সালাম পেশ করছি সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সকল আদম সন্তানের সর্দার মুহম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সা.—এর প্রতি, যিনি আল্লাহ তাআলার রাসূল ও সর্বশেষ নবী। বিশ্বজগতের সকল মানুষ ও জিনের প্রতি, তাঁর পক্ষ থেকে সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা।
আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর তাআলার বান্দা এবং তাঁর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। যিনি পূর্ণ আমানতদারির সাথে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দীনের ব্যাপারে যে কথা বলেছেন তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহি ও প্রত্যাদেশের পরই বলেছেন। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (৩) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى.
“তিনি মনগড়া কোনো কথা বলেন না। তিনি যে কথা বলেন তাতো কেবল ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়।” নাজম : ৩—৪
শরিয়াহর প্রতিটি বিধান যা আমাদের জন্য আবশ্যক এবং তাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি নিহিত, তিনি সেই বিধানটি আমাদের জন্য বিশদভাবে স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছেন। এমন কোনো ভালো কাজ নেই যা আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী করতে পারে, আর তিনি আমাদেরকে সেই কাজের আদেশ করেননি। এমনিভাবে তিনি আমাদেরকে সকল প্রকার মন্দ কাজ থেকে সতর্ক ও নিষেধ করেছেন, যা আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি আনয়ন করে। এরপর তিনি আমাদের মধ্যে রেখে গিয়েছেন কিতাবুল্লাহ এবং তাঁর পবিত্র সুন্নাহ, যা একটি সুস্পষ্ট আলোকবর্তিকা, যার রাত্রি তার দিবসের মতই উজ্জ্বল। এমন সুস্পষ্ট পথ থেকে কেবল ঐ ব্যক্তিই বিচ্যুত হয় যার ভাগ্যে ধ্বংস অবধারিত।
এ গ্রন্থে আমি এমন কিছু প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি, যা বিভিন্ন সময় সমস্যা আকােও আমাদের সামনে এসেছ, কিন্তু সেগুলোর যথার্থতার বিষয়ে আমাদের নিকট কোনো দলীল প্রমাণ ছিলো না।
আমরা সঙ্গত মনে করেছিÑ কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের আলোকে সে বিষয়গুলোর যথার্থতা বিশ্লেষণ করবো, যাতে করে সত্য ও সঠিক বিষয় সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়। কোনো ব্যক্তি যেন সংশয় ও সন্দেহের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে না থাকে এবং সত্যান্বেষী ব্যক্তি যেন বুঝতে পারেÑ কোন বিষয়টি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; আর কোনোরূপ সন্দেহ ব্যতীত তাকে বিশুদ্ধ বলে বিশ্বাস করে এবং তাকে আবশ্যিক রূপে গ্রহণ করে, তার ওপর আমল শুরু করে। আর যাতে বুঝতে পারেÑ কোন বিষয়টি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের সাথে সাংঘর্ষিক এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসে তার কোনো সমর্থন ও তার বিশুদ্ধতার কোনো প্রমাণ নেই। তখন সে এমন বিষয়ের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করে তা বর্জন করবে, তা বাতিল বলে বিশ্বাস করবে এবং তাকে পরিবর্তনের চেষ্টা করবে।
অনুসৃত নীতিমালা
এ গ্রন্থের আলোচনায় আমরা একটি নীতিকে আবশ্যিক করে নিয়েছি যা থেকে আমরা কিছুতেই বিচ্যুত হবো না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর আদেশ করেছেন :
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ.
আর যেকোনো বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ কর তার ফয়সালা আল্লাহর কাছে। শুরা : ১০
অপর এক আয়াতে তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا.
হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও তার রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা কতৃর্ত্বের অধিকারী তাদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর। নিসা : ৫৯
এ পবিত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আদেশ করেছেন, যেন আমরা আনুগত্য করি তাঁর, তাঁর রাসূলের, অতঃপর কতৃর্ত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের। যদি আমাদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ হয় Ñহোক তা আমাদের ও কতৃর্ত্বের অধিকারীদের মধ্যে অথবা কেবল আমাদের মধ্যেÑ তাহলে এর মীমাংসার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূরের কাছেই প্রত্যার্পণ করতে হবে। যাতে করে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ আমাদের মধ্যে সত্য ও সঠিক ফয়সালা প্রদান করে, যা পালন করা আমাদের জন্য আবশ্যক।
আল্লাহ তাআলার দিকে সিদ্ধান্তকে প্রত্যার্পণের অর্থ হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা সা.—এর প্রতি যে পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন, যার তিলাওয়াত ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় এবং যা আমাদের পর্যন্ত অসংখ্য হাফিযে কুরআনের মাধ্যমে অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছেÑ তার প্রতি প্রত্যার্পণ করা।
আর তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলের প্রতি যে উপদেশাবলি ওহি হিসেবে প্রেরণ করেছেন Ñযার তিলাওয়াত ইবাদত হিসেবে গণ্য হয় নাÑ তথা নবীজি সা.—এর বিশুদ্ধ হাদিসের প্রতি প্রত্যার্পণ করা।
দ্বিতীয় মূলনীতি
যে সকল কথার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে কোনো দলিল—প্রমাণ নেই তা গ্রহণ করা আমাদের ওপর আবশ্যক নয় এবং তা আমাদের বিপরীতে দলিল হিসেবে গণ্য হবে না। যিনি এধরণের কথা বলবেন তাকে তার বক্তব্যের বিশুদ্ধতার প্রমাণ হাজির করতে হবে। তিনি প্রমাণ হাজির না করলে আমরা তার অশুদ্ধতার ওপর দলিল—প্রমাণ হাজির করতে বাধ্য নই।
কারণ এরকম হলে যেকোনো কথায় সাধারণত বিশুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হবে। যদিও বাহ্যত তা বিশুদ্ধ নয়। এতে পরষ্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক প্রতিটি কথাকেই বিশুদ্ধ মনে করা হবে। যার একটি অন্যটিকে খন্ডন করে।
বরং আমাদের জন্য কোনো কথার অশুদ্ধতার ওপর দলিল—প্রমাণ হাজির করা তখন আবশ্যক হবে যখন এর প্রবক্তা নিজ বক্তব্যের বিশুদ্ধতার ওপর তার ধারণা অনুযায়ী দলিল—প্রমাণ উপস্থিত করবে। আর তার দলীল যদি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়, তখন আমরা তার বিপরীতে যুক্তি/দলীল উপস্থাপন করতে বাধ্য থাকবো। আল্লাহ তাআলার বানী—
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ.
আর যে বিষয় তোমার জানা নেই তার অনুসরণ করো না। বনি ইসরাঈল : ৩৭
যেকোনো বক্তব্যের স্বপক্ষে দলিল না থাকলে সে বিষয়ে আমদের কোনো মতামতও নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
{ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى (১৩) وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا (১৪) هَؤُلَاءِ قَوْمُنَا اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةً لَوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِمْ بِسُلْطَانٍ بَيِّنٍ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ كَذِبًا}
নিশ্চয় তারা কয়েকজন যুবক যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম। যখন তারা উঠে দাঁড়ালো আমি তাদের চিত্ত দৃঢ় করলাম। তখন তারা বললো, আমাদের প্রতিপালক আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক। আমরা কখনও তাকে ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহকে ডাকবো না। যদি ডাকি তাহলে নিশ্চয় আমাদের সেই কথা হবে অত্যন্ত গর্হিত। এরা আমাদের কওম, যারা তাঁকে ছাড়া অন্যান্য উপাস্য গ্রহণ করেছে। কেন তারা তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? অতএব, যে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা রটায় তার চেয়ে বড় জালিম আর কে? কাহ্ফ : ১৩—১৫
উপরিউক্ত আয়াতে ‘সুলতান’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দলিল—প্রমাণ। মহান আল্লাহ ঐ সকল যুবকদের প্রশংসা করেছেন। কারণ, তারা তাদের স্বজাতির কথা প্রত্যাখ্যান করেছে, যেহেতু তারা তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি এবং আল্লাহ তাআলা তাদের এ কথাকে সত্যায়ন করেছেন যে, যে ব্যক্তি দলিল ছাড়া কোনো কথা বললো সে যেন আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে মিথ্যা বললো। অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
بَلِ اتَّبَعَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَهْوَاءَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ.
বরং যারা জালিম তারা সঠিক জ্ঞান ব্যতীত তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে। রূম : ২৯
সুতরাং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, যে ব্যক্তি সঠিক জ্ঞান ব্যতীত কোনো কথার অনুসরণ করলো সে জালিম। আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন,
قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ.
তোমরা তোমাদের দলিল পেশ কর যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। বাকারা : ১১১
এ পবিত্র আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ বিষয় অবধারিত করেছেন, যে ব্যক্তি তার দাবিতে সত্যবাদী, সে যেন তার সত্যতার পক্ষে দলিল পেশ করে। যদি দলিল পেশ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হবে না।
তৃতীয় নীতি
কোনো আদেশ বা নিষেধের কারণে শরিয়াহর কোনো বিধান আবশ্যক করা, নিষেধ করা বা বৈধ করার ক্ষেত্রে মানুষের আকল বা বিবেক—বুদ্ধির কোনো দখল নেই। বরং বিবেক—বুদ্ধির কাজ হচ্ছে, নুসুস (শরিয়ার বক্তব্য) অনুধাবন করা এবং আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা। কিয়াসের বৈধতার প্রবক্তা ও তা অবৈধ হওয়ার প্রবক্তা, এ মূলনীতির ক্ষেত্রে সকলে এক বরারব।
যারা কিয়াসের বৈধতার প্রবক্তা, তারা দলিল হিসেবে বলেন, আমরা শরিয়ার নুসুস গবেষণা করে এ কথা অনুধাবন করেছি যে, শরিয়ার বিধানসমূহের মধ্যে ইল্লাত (কার্যকারণ) থাকে। সুতরাং সেই ইল্লাত (কার্যকারণ) যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেও একই বিধান কার্যকর হবে। আমাদের উক্ত মূলনীতির দলিল হলো, আল্লাহ তাআলা বাণী :
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ.
আর যেকোনো বিষয়ে তোমরা মতবিরোধ কর তার ফয়সালা আল্লাহর নিকটে। (সূরা শুরা : ১০)
অপর এক আয়াতে তিনি বলেন,
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ.
আর তোমাদের জিহ্বা যে মিথ্যা বলে এর ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা আরোপের জন্য। (সূরা নাহল : ১১৬)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ.
বল, আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন অশ্লীল কাজসমূহ, তা প্রকাশ্য হোক বা গোপন, পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহ তাআলার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আর আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলা যা তোমরা জান না। (সূরা আরাফ : ৩৩)
সুতরাং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহির মাধ্যমে নাযিলকৃত শরয়ি দলিল প্রমাণ ছাড়া এমন কথা বলা যে, আল্লাহ তাআলা এমনটি করতে আদেশ করেছেন, নিষেধ করেছেন, হারাম করেছেন বা বৈধ করেছেনÑ এসবই হচ্ছে আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে অজ্ঞতাবশত মিথ্যারোপ।
এমনিভাবে একমাত্র নবী কারিম সা. ব্যতীত যেকোনো ব্যক্তির কথা গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার অবকাশ আছে। অর্থাৎ, ঐ কথা গ্রহণ করা হবে যার সত্যতার ওপর প্রমাণ থাকবে এবং এ কথা প্রত্যাখ্যান করা হবে যার সত্যতার ওপর কোনো প্রমাণ থাকবে না।
আমরা যখন আমাদের পূর্ববর্তী ফিকহ ও অভিধানের ইমামগণের কথা দ্বারা দলিল গ্রহণ করি তখন তার অর্থ এটা নয় যে, তারা যা বলবে তাই আমাদেরকে বিনা দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। বরং আমরা ইমামগণের কথা দ্বারা এজন্য দলিল গ্রহণ করি যে, তাদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অধিক ছিল এবং অভিধান ও ফিকহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোর অনুধাবন ক্ষমতাও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল; যদিও মূল বিষয় অনুধাবনের ক্ষেত্রে আমরা সকলে সমভাবে অংশীদার।
আল্লাহ তাআলার কাছে কামনা করিÑ তিনি যেন আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেন, বিচ্যুতি থেকে হেফাযত করেন, আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত করেন, আমাদের কথা ও কাজসমূহকে একনিষ্ঠভাবে তার জন্য করে নেন এবং তা কবুল করে আমাদেরকে এর প্রতিদান দান করেন এবং আমাদের পক্ষ থেকে ঐ ব্যক্তিকে উত্তম প্রতিদান দান করেন যে ব্যক্তি আমাদের ভুল শনাক্ত করে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল হতে দলিল—প্রমাণ দ্বারা সেই ভুল শুধরে দেয়। আর আমাদেরকে তিনি তার উদ্দেশ্য বুঝে আমল করার তাওফিক দান করেন। আমীন
প্রথম পরিচ্ছেদ
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এ কথার সাক্ষ্যদান
কালিমার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। তার মর্ম হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির সর্বোতভাবে ইসলাম ধর্মে প্রবেশ করা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত চারটি শব্দ “ইলাহ, রব, ইবাদত ও দীন এগুলোর অর্থ ভালোভাবে উপলব্ধি করা।
شهادة (সাক্ষ্যদান)
এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ হাজির হওয়া, পরিদর্শন করা। আর এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞান ও বিশ্বাস অর্জিত হয়।
কোনো বিষয়ের সাক্ষ্যদানের অর্থ হলো, ঐ বিষয়ে নিশ্চিত সংবাদ প্রদান করা। আর সেই সংবাদপ্রদানকারীকে সাক্ষী (شاهد) বলা হয়।
সাক্ষ্য : কোনো ব্যক্তি তার জ্ঞানানুসারে সংবাদ প্রদানের জন্য যে বাক্য উচ্চারণ করে তাকে সাক্ষ্য বলে।
علم (ইলম)
এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ কোনো বিষয়ের স্বরূপ জানা এবং তা সত্য বলে বিশ্বাস করা। অতএব, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এ কথার সাক্ষ্যদানের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা। তিনি এক এবং তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই একথা স্বীকার করা। এ স্বীকারোক্তিকেই সাক্ষ্য বলে। চাই সংবাদদাতা নিজের মনে মনে সত্যবাদী হোক বা মিথ্যাবাদী। কেননা সাক্ষ্য মিথ্যাও হতে পারে। যেমনÑ হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারিম সা. বলেছেন,
أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ، وَشَهَادَةُ الزُّورِ
সাবধান! মিথ্যা কথা ও মিথ্যা সাক্ষ্যদান থেকে বেঁচে থাকবো। (সহিহ বুখারি : ৫৯৭৬)
সুতরাং উল্লেখিত হাদিসে নবী কারিম সা. বাস্তবতার অনুযায়ী নয় এমন সংবাদকেও সাক্ষ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ (الله) শব্দটি মহান সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বজগতের প্রতিপালকের বিশেষ নাম।
হাফেয ইবনে কাছির র. বলেন, (الله) শব্দটি মহান প্রতিপালকের নাম। কারও কারও মতে এটিই হচ্ছে ইসমে আযম। কেননা এ নামটি সকল গুণাবলির ধারক। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন ,
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ (২২) هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ (২৩) هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ.
তিনি আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনিই বাদশাহ, মহা পবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষাকারী, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী, মহিমান্বিত, তারা যা শরিক করে তা হতে তিনি পবিত্র। তিনিই আল্লাহ, ¯্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতি দানকারী, তার রয়েছে সুন্দর নামসমূহ, আসমান ও যমিনে যা কিছু আছে সবই তার মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা হাশর : ২২—২৪)
এভাবে তিনি অন্য সকল নামকে তাঁরই গুণাবলি হিসেবে ধার্য করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا.
আল্লাহর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। তোমরা সে নামসমূহ ধরেই তাকে ডাক। (সূরা আরাফ : ১৮০) আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى.
আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ বলেই ডাক অথবা রাহমান বলেই ডাক, তোমরা যে নামেই ডাক না কেন, তাঁর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১১০)
সহিহ বুখারি ও মুসলিম শরিফে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا، مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الجَنَّةَ.
নিশ্চয় আল্লাহর রয়েছে নিরানব্বইটি নাম, একটি কম একশটি। যে ব্যক্তি এগুলোকে আয়ত্ত করবে সে জান্নাতে প্রবেশে করবে। (সহিহ বুখারি : হা. নং : ২৭৩৬)
হাফেয ইবনে কাছির র. আরও বলেন, আল্লাহ শব্দটি এমন বিশেষ নাম যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত এ নামে আর কেউ নেই। এ কারণে বলা হয়, এটি স্থির নাম, যা কোনো শব্দ থেকে নির্গত হয়নি। ইমাম কুরতুবি একদল আলেম থেকে এ মতটি বর্ণনা করেছেন। যাদের মধ্যে আছে, ইমাম শাফেয়ি, খাত্তাবি, ইমামুল হারামাইন, ইমাম গাযালি প্রমুখ।
আবার কারও কারও মতে “আল্লাহ” শব্দটি নির্গত হয়েছে। তারা দলিল গ্রহণ করেন রুবা ইবনুল আজ্জাজের কথা দ্বারা :
لله درّ الغانيات المده … سبّحن واسترجعن من تألّهي
আল্লাহর জন্যই কল্যাণ প্রশংসিত পরমা সুন্দরী রমণীকুলের
যারা আমার ইবাদত দেখে বলে, সুবহানাল্লাহ, ইন্না লিল্লাহ..।
এখানে কবি সুস্পষ্টরূপে (تألّه) মাসদার তথা ক্রিয়ামূলের শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর তার ধাতুমূল হলো, إله। এর থেকে প্রতীয়মান হয়Ñ আল্লাহ (اللَّه) শব্দটি মূলত إله থেকে নির্গত হয়েছে। যেমনÑ হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, [وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ] এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তারা পরিত্যাগ করবে আপনাকে এবং আপনার উপাসনাকে। অর্থাৎ, তিনি آلِهَةَ এর অর্থ করেছেন, ইবাদত বা উপাসনা। মুজাহিদ প্রমুখ তাবেয়ির মতও তাই।
আবার কেউ কেউ আল্লাহ (اللَّه) শব্দটি নির্গত (مشتق) হওয়ার দলিল গ্রহণ করেছেন নিম্নোক্ত আয়াতটি দ্বারা, যেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
}وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ}
আর আসমানসমূহ ও যমিনে তিনিই আল্লাহ। (সূরা আনআম : ৩)
অপর এক আয়াতে তিনি বলেন,
{وَهُوَ الَّذِي فِي السَّمَاءِ إِلَهٌ وَفِي الْأَرْضِ إِلَهٌ}
আর তিনি আসমানে ইলাহ এবং যমিনে ইলাহ। (সূরা যুখরুফ : ৮৪)
ইমাম সিবাওয়াই তাঁর উসতায খলিল থেকে বর্ণনা করেছেন, اللَّهُ শব্দটি মূলত إِلَهٌ ছিল فِعَالওজনে। তবে কারও কারও মতে এটি মূলত لاهٌ ছিল। এরপর শুরুতে সম্মানসূচক আলিফ ও লাম বর্ণদ্বয় যুক্ত হওয়ার কারণে اللَّهُ হয়েছে। ইমাম সিবাওয়াই এ মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। জনৈক কবি বলেছেন,
لاهِ ابنُ عَمِّكَ لا أَفْضَلْتَ في حَسَبٍ *** يَوْمًا ولا أَنْتَ دَيَّاني فتَخْزُوني!
আল্লাহর শপথ! তোমার চাচাতো ভাই তোমার সমমর্যাদা সম্পন্ন, তার ওপর তোমার একটি দিনের জন্যও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আর না তুমি আমার দায়িত্বশীল যে, আমার ওপর কতৃর্ত্ব করবে।
ইমাম কিসায়ি ও ফাররা বলেন, اللَّهُ শব্দটি الإله ছিল। শুরু থেকে হামযা বর্ণটি বিলুপ্ত করে প্রথম লামকে দ্বিতীয় লামের মধ্যে ইদগাম (যুক্ত) করা হয়েছে। এর নজির রয়েছে অপর এক আয়াতে : {لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي} : কিন্তু তিনি আল্লাহ, আমার রব। (সূরা কাহফ : ৩৮)।
এখানে لَكِنَّا এর মূলরূপ ছিল لكن أنا। যেখানে হামযা বর্ণটি বিলুপ্ত করে নুনকে নুনের মধ্যে ইদগাম করা হয়েছে। হাসান বসরি র. এমনটি পড়েছেন।
আবারা কারও কারা মতে اللَّهُ শব্দটি وله থেকে নির্গত হয়েছে, যার অর্থ হলোÑ দিশেহারা হওয়া, হতবুদ্ধি হওয়া। যেমন বলা হয়Ñ رجل واله (দিশেহারা পুরুষ), امرأة ولهي و مولوهة (দিশেহারা নারী)। এটি তখন বলা হয় যখন কোনো ব্যক্তিকে মরুভূমিতে একাকী ছেড়ে দেওয়া হয়ে।
اللَّهُ শব্দটি وله থেকে নির্গত হওয়ার তাৎপর্য হলো, আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার গুণাবলির স্বরূপের মধ্যে চিন্তামগ্ন ও দিশেহারা করে রাখেন।
আবার কারও কারও মতে اللَّهُ শব্দটি ألهت إلى فلان থেকে নির্গত হয়েছে। যার অর্থ হলো, আমি অমুকের প্রতি আসক্ত হলাম। এই আসক্ত হওয়া ধাতু থেকে নির্গত হওয়ার তাৎপর্য হলো, মানুষের অন্তর কেবল আল্লাহর স্মরণে প্রশান্তি খুঁজে পায় এবং মানুষের আত্মা কেবল তার ¯্রষ্টার পরিচায় লাভে আনন্দ খুঁজে পায়। কারণ, কেবল তিনিই পরিপূর্ণ গুণাবলির অধিকারী। তাঁর মত আর কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন,
أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণ দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। (সূরা রা’দ : ২৮)
কারও কারও মতে اللَّهُ শব্দটি لاه— يلوه থেকে নির্গত হয়েছে। যার অর্থ হলোÑ ঢেকে যাওয়া, আবৃত হওয়া।
আবার কারও মতে, اللَّهُ শব্দটি أله الفصيل থেকে নির্গত। যার অর্থ হলো, শিশুটি তার মায়ের প্রতি অনুরক্ত হলো। আর তখন উদ্দেশ্য হবে, বান্দারা তাদের সকল অবস্থায় আল্লাহ তাআলার দরবারে কাকুতি মিনতির মাধ্যমে তার প্রতি অনুরক্ত।
কারও কারও মতে اللَّهُ শব্দটি (أله الرجل) থেকে নির্গত হয়েছে। এটি তখন বলা হয় যখন কোনো ব্যক্তি তার ওপর আপতিত বিপদের কারণে ঘাবড়ে যায়। আর آلَههُ অর্থ হলো, আশ্রয়দান করা। এ নামকরণের কারণ হলো, যেহেতু আল্লাহ তাআল সকল সৃষ্টিকে সব ধরনের অনিষ্টতা থেকে হেফাযত করেন, আশ্রয় দান করেন। যেমনÑ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ.
তিনি আশ্রয়দান করেন, তার ওপর কোনো আশ্রয়দাতা নেই। (সূরা মুমিনুন : ৮৮)
তিনিই নিয়ামত দানকারী। যেমন তিনি বলেছেন,
وَمَا بِكُمْ مِنْ نِعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ.
আর তোমাদের কাছে যেসব নিয়ামত রয়েছে তাতো আল্লাহর কাছে থেকেই প্রাপ্ত। (সূরা নাহল : ৫৩)
তিনিই আহারদাতা। যেমন তিনি বলেছেন :
وَهُوَ يُطْعِمُ وَلَا يُطْعَمُ.
তিনি আহার দান করেন, তাকে আহার দেওয়া হয় না। (সূরা আনআম : ১৪)
তিনিই সবকিছুর ¯্রষ্টা। যেমন তিনি বলেছেন,
قُلْ كُلٌّ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ.
বলুন, সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। (সূরা নিসা : ৭৮)
ইমাম রাযির মতে اللَّهُ শব্দটি কোনো কিছু হতে নির্গত হয়নি। তিনি বলেন, এটিই নাহবি খলিল ও সিবাওয়াইহ এবং অধিকাংশ উসুলবিদ ও ফকিহগণের মত। এরপর তিনি এ বক্তব্যের স্বপক্ষে দলিল প্রদান শুরু করে। তন্মধ্যে একটি দলিল হলো, اللَّهُ শব্দটি যদি কোনো কিছু থেকে নির্গত হতো তাহলে তার অর্থের মধ্যে আরও অনেকে শরিক হয়ে যেতো। তিনি আরও বলেন, আল্লাহ তাআলার বাকি নামগুলো মূলত গুণবাচক। যেমন আমরা বলি, {الله الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ } “আল্লাহ, যিনি অসীম দয়ালু, পরম করুণামায়, রাজাধিরাজ, মহা পবিত্র।”
এর থেকে প্রতীয়মান হয়Ñ اللَّهُ শব্দটি কোনো কিছু থেকে নির্গত নয়। তবে হাফেয ইবনে কাছির র. এর বিপরীতে বলেন, ইমাম রাযি জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন, اللَّهُ শব্দটি মূলত ইবরানি ভাষা থেকে এসেছে। অবশ্য তিনি এ মতটিকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। খলিল ইবনে আহমাদ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, اللَّهُ শব্দটিকে আল্লাহ বলে নামকরণের কারণ হলো, যেহেতু সৃষ্টিজীব তার প্রতি অনুরক্ত হয়।
আবার কারও কারও মতে اللَّهُ শব্দটি উঁচু (ارتفاع) থেকে নির্গত হয়েছে। কেননা আরবরা প্রত্যেক উঁচু জিনিসকে لاها বলতো। যেমনÑ সূর্যোদয় হলে তারা বলতোÑ لاهت (সূর্য উদিত হলো)।
আবার কারও কারও মতে এটি أله الرجل (লোকটি ধার্মিক হলো) থেকে নির্গত হয়েছে। আবার কারও মতে এটি تأله (ইবাদত করা) থেকে নির্গত হয়েছে।
الإله শব্দের ধাতুমূল সম্পর্কে মতভেদ এবং তার প্রতিক্রিয়া
الإله অথবা اللَّهُ শব্দের ধাতুমূল সম্পর্কে বিজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য অভিধান শাস্ত্রবিদগণের মধ্যে যে মতভেদ হয়েছে এ কথা সুবিদিত এবং তাদের মধ্যে কেউ নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি যে, اللَّهُ শব্দটি কি اسم جامد (স্থির বিশেষ্য), না কোনো ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত হয়েছে? যদি নির্গত ধরা হয় তাহলে কোন ক্রিয়ামূল বা ক্রিয়া থেকে নির্গত হয়েছে? আবার ক্রিয়ামূল বা ক্রিয়ার একাধিক অর্থ রয়েছে। এখানে কি সেগুলো হতে কোনো নির্দিষ্ট একক অর্থ উদ্দেশ্য, নাকি সামষ্টিক অর্থ উদ্দেশ্য? এগুলোর কোনোটির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি।
আসল কথা হচ্ছে, এ মতভিন্নতা বিশেষ কোনো গুরুত্ব বহন করে না এবং আমরা এ বিষয়ে গবেষণাও করতে চাই না। কারণ, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এ বিষয়ে নিশ্চিত ও সত্যনিষ্ঠ কথা এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন যে, জাহেলি যুগের কাফের ও মুশরিকরাও বিশ্ব জগতের সৃষ্টি, মহত্ত্ব, সুমহান ক্ষমতা ও কতৃর্ত্ব, বিশ্বজগতের পরিচালনা, রিযিক প্রদান, অসীম রাজত্ব ও পরিবর্তনের ক্ষমতা ইত্যাদি সবকিছু মহান আল্লাহর জন্যই স্বীকার করতো। যেমন পবিত্র কুরআনে তিনি বলেছেন :
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ.
বলুন, কে তোমাদেরকে আসমান ও যমিন থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করেন? অথবা শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কার কতৃর্ত্বাধীন? জীবিতকে মৃত থেকে কে বের করেন এবং মৃতকে জীবিত হতে কে বের করেন? এবং এসব বিষয়কে কে নিয়ন্ত্রণ করেন? তখন তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। (সূরা ইউনুস : ৩১)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তারা অবশ্যই এ উত্তরই দিবে যে, রিযিকদাতা, শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি মালিক, মৃত থেকে জীবিতকে সৃষ্টিকারী এবং জীবিত থেকে মৃতকে সৃষ্টিকারী এবং সবকিছুর নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন আল্লাহ। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়Ñ তারা এ কথা জানতো যে, এসকল ক্ষমতা আল্লাহ তাআলার গুণাবলির অন্তভুর্ক্ত। অনুরূপ অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,
} قُلْ لِمَنِ الْأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৪) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ (৮৫) قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ (৮৬) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ (৮৭) قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ (৮৮) سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ{
বলুন, পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে, তারা কার? যদি তোমরা জান, তবে বল। এখন তারা বলবে, সবই আল্লাহর। বলুন, তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? বলুন, সপ্তাকাশ ও মহান আরশের মালিক কে? এখন তারা বলবে, আল্লাহ। বলুন, তবুও কি তোমরা ভয় করবে না? বলুন, তোমাদের জানা থাকলে বল, কার হাতে সকল কিছুর কতৃর্ত্ব¡, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না ? এখন তারা বলবে, আল্লাহর। বলুন, তবুও কিভাবে তোমরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছো? (সূরা মুমিন : ৮৪—৮৯)
এ সকল আয়াত থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, সকল মুশরিক কোনো পার্থক্য ব্যতিরেকে এ জাতীয় প্রশ্নের উত্তর ‘আল্লাহ” শব্দ দ্বারা দিতো। যদি এর বিপরীত কোনো আয়াত না থাকতো তাহলে আমরাও সে কথাই বলতাম। কিন্তু আমরা কিছু আয়াতে এমনও দেখতে পাই, সেখানে কাফেররা আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বকে একেবারেই অস্বীকার করে। এ শ্রেণির কাফেররা আল্লাহর তাআলার অস্তিত্ব, তার সুমহান ক্ষমতা ও কতৃর্ত্বকে স্বীকার করে না। যেমন আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন,
}وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ}
তারা বলে, দুনিয়ার জীবনই আমাদের একমাত্র জীবন। আমরা মরি ও বাঁচি এখানেই। আর মহাকালই কেবল আমাদেরকে ধ্বংস করে। (সূরা জাছিয়া : ২৪)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ.
তারা কি ¯্রষ্টা ছাড়া সৃষ্টি হয়েছে, না তারাই ¯্রষ্টা? তারা কি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা দৃঢ় বিশ^াস করে না। (সূরা তুর : ৩৫—৩৬)
এ আয়াতের আলোকে প্রতীয়মান হয়, মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব এবং তার ক্ষমতা ও কতৃর্ত্বের স্বীকৃতির বিষয়টি কতক কাফেরের পক্ষ থেকে ছিল; সকলের পক্ষ থেকে নয়।
কালিমার সাক্ষ্য দিলেই মুসলিম
যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)” এ কথার সাক্ষ্য দিবে আমরা তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো। তার ওপর মুসলিমের বিধান কার্যকর হবে। আমরা তার সাক্ষ্য সত্য কি না তা যাচাই করতে যাবো না। কারণ, এটি তার অন্তরের বিষয়। আর মানুষের অন্তরের বিষয় যাচাই করা এবং তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এটি ঐ সত্তার পক্ষে সম্ভব যিনি গোপন বিষয় ও অন্তরের ভেদ সম্পর্কে জানেন। সুতরাং যে ব্যক্তির বক্তব্য ও তাঁর অন্তরের বিশ^াস এক হবে যে আল্লাহ তাআলার নিকট মুমিন ও মুসলিম বলে গণ্য হবে এবং তার মুখের কথা তার জন্য উপকার বয়ে আনবে।
আমাদের এ বক্তব্যের স্বপক্ষে দলিল হলো, রাসূলুল্লাহ সা.—এর পবিত্র হাদিস। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
أمرت أن أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِهِ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ، عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ، وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّهَا، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ.
আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি এবং আমার আনীত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। যদি তারা এ কাজগুলো করে ফেলে তাহলে তারা আমার থেকে তাদের জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করে নিল। তবে এসবের হকও আদায় করতে হবে। আর তাদের হিসাব আল্লাহর নিকট ন্যস্ত হবে। (সহিহ মুসলিম : ৩৪)
মুসলিমদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা অর্জন করলো সেই মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। তবে জিম্মিরা যে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা লাভ করে তা মূলত অধীনতা স্বীকার করে জিযয়া প্রদানের শর্তে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে। তাই তাদের ক্ষেত্রে কালিমার সাক্ষ্যদানের শর্তটি প্রযোজ্য হবে না।
অনুরূপ অপর এক হাদিসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مِنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ شَعِيرَةً، ثُمَّ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مِنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ بُرَّةً، ثُمَّ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مِنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ ذَرَّةً.
ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা’ বলবে যখন তার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) থাকবে, অতঃপর ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, যখন তার অন্তরে গমের দানা পরিমাণ কল্যাণ থাকবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, যখন তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ কল্যাণ থাকবে।” (সহিহ মুসলিম : ৩২৫)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ.
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা : ৪৮)
অতএব, আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারলাম যে, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, যখন তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকেÑ সে মুশরিক নয়। আর এক্ষেত্রে কাফের ও মুশরিকের বিধান একই।
হযরত মিকদাদ বিন আমর আল—কিন্দি রা. থেকে বর্ণিত, [যিনি ঐ সকল সাহাবিদের অন্তভুর্ক্ত যারা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল] একদিন তিনি প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহ রাসূল! যদি আমি যুদ্ধে কোনো কাফেরের মুখোমুখি হই, অতঃপর সে তরবারি দ্বারা আমর এক হাতে আঘাত করে তা কেটে ফেলে, এরপর একটি গাছের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং বলে, আমি আল্লাহর জন্যই ইসলাম গ্রহণ করলাম তাহলে তার এ কথার পরও কি আমি তাকে হত্যা করতে পারবো? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। তখন মিকদাদ রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে তো আমার একটি হাত কেটে ফেলেছে। হাত কাটার পর সে এমন কথা বলেছে। অতএব, আমি কি তাকে হত্যা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না। কেননা যদি তুমি তাকে হত্যা কর তাহলে তাকে হত্যা করার পূর্বে তোমার যে অবস্থান ছিল (অর্থাৎ, ঈমান) সে ঐ অবস্থান লাভ করবে এবং সে কালিমা পড়ার পূর্বে তার যে অবস্থান ছিল (অর্থাৎ, কুফর) তুমি সেই অবস্থান লাভ করবে। (সহিহ বুখারি : ১৪০১৯; সহিহ মুসলিম : ১৫৫)
হযরত উসামা বিন যায়েদ বিন হারেসা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে জুহায়না বংশের হুরাকা কওমের নিকট প্রেরণ করলেন। আমরা প্রত্যুষেই সেই কওমের কাছে পৌঁছে গেলাম এবং তাদের পরাজিত করলাম। ইত্যবসরে আমি এবং একজন আনসারি সাহাবি ঐ গোত্রের এক ব্যক্তিকে ঘেরাও করে নিলাম। তখন হঠাৎ সে বলে উঠলো, ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’। উসামা রা. বলেন, তখন আনসারি সাহাবি নিবৃত্ত হলেও আমি তাকে বর্শা দ্বারা আঘাত করে হত্যা করলাম। এরপর যখন আমরা মদিনায় ফিরে আসলাম এবং নবী সা.—এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছলো তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, উসামা! ঐ ব্যক্তি ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ বলাও পরও কি তুমি তাকে হত্যা করলে? আমি জবাব দিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! সে তো আত্মরক্ষার জন্য এমন কথা বলেছিল। নবীজি সা. আবার বললেন, ঐ ব্যক্তি ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ বলাও পরও কি তুমি তাকে হত্যা করলে? নবীজি (সা) এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন, এমনকি আমি কামনা করলাম, হায়! আমি যদি সেদিনের পূর্বে মুসলিমই না হতাম।
হযরত আবু যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, এক দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
ذَاكَ جِبْرِيلُ أَتَانِي، فَقَالَ: مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِكَ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الجَنَّةَ، قُلْتُ: وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ؟ قَالَ: وَإِنْ زَنَى، وَإِنْ سَرَقَ .
ঐ ব্যক্তি হলেন জিবরিল আ., যিনি আমার কাছে এসে বলেছেন, আপনার উম্মতের মধ্য হতে যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, সে আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করেনি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? তিনি বললেন, হাঁ, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে।
রাসূলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত এ সকল হাদিস নিশ্চিতরূপে আমাদের বক্তব্যকে সমর্থন করে। আর তা হলো, আল্লাহ তাআলার বিধান হলো, যেকোনো ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্য দিবে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং তার ওপর মুসলিমদের বিধান প্রযোজ্য হবে। আমরা তার সাথে একজন মুসলিম হিসেবে ইসলামি শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী আচরণ করবো এবং তার অন্তরের বিষয়কে ঐ মহান সত্তার প্রতি সমর্পণ করবো যিনি সকলের মনের কথা ও গোপন ভেদ সম্পর্কে জানেন।
রব শব্দের অর্থ
হাফেয ইবনে কাছির র.—এর ভাষ্য অনুযায়ী ‘রব’ শব্দের অর্থ হলো, কতৃর্ত্বের অধিকারী, মালিক। আভিধানিক অর্থে এটি নেতা, সর্দার ও সংস্কারকারীকেও বুঝায়। ইমাম নাসাফির মতও তাই। আবার কারও কারও মতে রব শব্দটি শিক্ষা—দীক্ষা, লালন—পালনসহ যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের দায়িত্বশীল মুরব্বির অর্থেও ব্যবহার হয়। এছাড়াও নেতা ও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী মান্যবর ব্যক্তিকেও বুঝায়, যার নেতৃত্ব ও কতৃর্ত্ব সর্বজন স্বীকৃত।
ইবাদত শব্দের অর্থ
‘ইবাদত’ অর্থ হলো, সামগ্রিকভাবে আনুগত্য করা। এছাড়াও সম্মান ও ভক্তির ইচ্ছায় দীনী বিধান কায়েম করা এবং অধীনতা ও আত্মসমর্পণের ঘোষণা করাকেও ইবাদত বলা হয়।
দীন শব্দের অর্থ
‘দীন’ শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। যেমনÑ
১. আধিপত্য বিস্তার করা এবং বিজয়ী হওয়া।
২. উপাসনা ও আনুগত্য করা।
৩. শরিয়াহ তথা এমন সীমারেখা, নিয়ম—কানুন, পথ ও পদ্ধতি যার অনুসরণ করা হয়।
৪. হিসাব—নিকাশ, শাস্তি ও প্রতিদান ইত্যাদি।
উসতায মওদুদির কিছু নিজস্ব মতামত
উসতায মওদুদি তার “চারটি পরিভাষা” নামক গ্রন্থে বলেন,
কুরআনে কারিম নাযিল হয়েছে আরবে, আরবি ভাষাভাষীদের ওপর, যাদের প্রত্যেকেই ইলাহ ও রব এ দুটি শব্দের অর্থ ও উদ্দেশ্য ভালো করে জানতো। কারণ, ইলাহ ও রব শব্দদ্বয় তাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বহুল প্রচলিত ছিল। ফলে এ দুটি শব্দের সকল অর্থ তাদের আয়ত্ত ছিল। এ কারণে যখন বলা হতো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই, তার উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) ও রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) এর ক্ষেত্রে কোনো শরিক নেই, তখন তারা এ আহ্বানের আদ্যোপান্ত অনুধাবন করতে পারতো। এ কথায় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সংশয় ও অস্পষ্টতা থাকতো না যে, বক্তা তাদেরকে কি বুঝাতে চেয়েছে? কোন বিষয়কে নাকচ করেছে? তারা বুঝতে পারতোÑ আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্যাবলি কেবলই তাঁর সাথে নির্দিষ্ট। তিনি ব্যতীত আর কারও সাথে সেগুলো যুক্ত হতে পারে না। তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার সমীপে আত্মসমর্পণ করতো। আর যারা কুফরি করতো তারা ইলাহ ও রব এর অর্থ ভালো করে বুঝে শুনেই কুফরি করতো এবং গায়রুল্লাহর জন্য উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) ও রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) সাব্যস্ত করতো।
আর যারা ঈমান আনয়ন করতো তারা এ কথা ভালো করে বুঝে শুনেই ঈমান আনতো যে, এ আকিদা ও বিশ্বাস গ্রহণের কারণে তাকে কোন কোন বিষয় গ্রহণ করতে হবে, আর কোন কোন বিষয় তাকে বর্জন করতে হবে। এমনিভাবে ইবাদত ও দীন শব্দটি তাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল। তাদের জানা ছিলÑ আব্দ বা দাস কাকে বলে? উবুদিয়্যাহ বা দাসত্বের দাবি কী? এ শব্দ কোন কোন বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে? এ কারণে যখন তাদেরকে বলা হলো, আল্লাহর ইবাদত কর, তাগুতকে বর্জন কর এবং অন্য সকল দীন ও ধর্মকে বর্জন করে আল্লাহর দীনে প্রবেশ কর তখন তারা কুরআনের এ দাওয়াত অনুধাবনে ভুল করতো না। যখন তাদের কানে এ দাওয়াতের আওয়াজ ভেসে আসতো তারা সহজেই বুঝতে পারতো, এ দাওয়াত তাদের জীবনাচারে কোন ধরনের পরিবর্তন দাবি করে।
কিন্তু সেই সোনালি যুগের পরবর্তী সময়ে এসকল শব্দের সঠিক ও মৌলিক অর্থসমূহের মধ্যে Ñযা কুরআন নাযিলের সময় প্রচলিত ছিলÑ পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে। এমনকি এ শব্দ চতুষ্টয়ের প্রত্যেকটি তার বিস্তৃতি হারিয়ে সংকীর্ণ হতে থাকে। অবশেষে সেগুলো অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য মর্মযুক্ত কিছু নির্দিষ্ট সীমিত ও সংকীর্ণ অর্থে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর পেছনে মূলত দু’টি কারণ রয়েছে :
এক. পরবর্তী যুগে বিশুদ্ধ আরবির রুচি কমে যায় এবং আরবি ভাষার স্বচ্ছ ঝরনাটি শুকিয়ে যায়।
দুই. জাহেলি সমাজে কুরআন নাযিলের সময় আল্লাহ, ইবাদত, রব, দীন ইত্যাদি শব্দগুলোর যে অর্থ প্রচিলত ছিল পরবর্তীকালে মুসলিম সমাজে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা সেই পূর্বের অর্থ পায়নি।
এ দু’টি কারণে পরবর্তীকালের অভিধান শাস্ত্রবিদগণ অভিধান গ্রন্থসমূহে এবং মুফাসসিরগণ তাফসির গ্রন্থসমূহে কুরআনের অধিকাংশ শব্দের ব্যাখ্যা সেগুলোর আসল অর্থের পরিবর্তে ঐ সকল অর্থ দ্বারাই করেছেন, যা তারা পরবর্তীকালের মুসলিমগণ থেকে লাভ করেছেন। এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত হলো :
১. ‘ইলাহ’ শব্দের অর্থ তারা এমন করেছেন যেন তা প্রতিমা ও মূর্তির সমার্থক।
২. ‘রব’ শব্দটিকে তারা লালন—পালনকারী, মুরব্বি এবং প্রতিপালক ও দীক্ষা দানকারীর সমার্থক ধরেছেন।
৩. ‘ইবাদত’ এ শব্দটিকে তারা বন্দেগি, উপাসনা এবং আল্লাহর তাআলার সামনে নত হওয়া ও সালাত আদায় করার অর্থে সীমিত করে ফেলেছেন।
৪. ‘দীন’ শব্দটিকে তারা নিহ্লা (نحلة) বা ধর্ম—বিশ্বাস এর মত ব্যবহার করেছেন।
৫. ‘তাগুত’ এর ব্যাখ্যা করেছেন মূর্তি বা শয়তান শব্দ দ্বারা।
এর ফলশ্রম্নতি এই দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের পক্ষে কুরআনের আহ্বানের প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং মর্ম অনুধাবন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে যখন কুরআন মাজিদ তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছে যে, তারা যেন আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহরূপে গ্রহণ না করে তখন তারা ধারণা করেছে যে, তারা মূর্তিপূজা ও প্রতিমা পরিত্যাগের মাধ্যমেই কুরআনের উদ্দেশ্যকে পূর্ণরূপে অর্জন করেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারা মূর্তি প্রতিমা ব্যতীত ইলাহের আনুষাঙ্গিক অন্যান্য উপকরণের সাথে এখনো জড়িত আছে। অথচ তাদের মধ্যে এ অনুভূতি নেই যে, তারা এ কাজের মাধ্যমে গায়রুল্লাহকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। যখন কুরআন তাদেরকে আহ্বান জানিয়েছে যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র রব, কাজেই তাঁকে ছাড়া আর কাউকে রব হিসেবে গ্রহণ করো না, তখন তারা বললো, হাঁ, আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে প্রতিপালক ও আমাদের কাজের অভিভাবক হিসেবে বিশ্বাস করি না। এর মাধ্যমে আমাদের তাওহিদের বিশ্বাস পরিপূর্ণ হয়েছে। অথচ এখনো তাদের অধিকাংশই রব শব্দটির প্রতিপালক ছাড়া এর অন্যান্য অর্থসমূহের বিবেচনায় গায়রুল্লাহকে রব হিসেবে বিশ্বাস করে আছে।
যখন কুরআন তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছে,
أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ : তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে বর্জন কর। (সূরা নাহল : ৩৬) তখন তারা বললো, আমরা মূর্তিপূজা করি না, শয়তানের প্রতি ঘৃণা পোষণ করি, তার প্রতি অভিসম্পাত করি এবং আল্লাহ ব্যতীত আর কারও সামনে মাথা নত করি না। এভাবে আমরা কুরআনের এ আদেশ পালন করেছি। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তারা পাথর নির্মিত প্রতিমা ছাড়া অন্যান্য তাগুতের অঁাচল ধরে আছে। তারা পরম উপাসনা ব্যতীত ইবাদতের অন্য সকল প্রকারকে গায়রুল্লাহর জন্য সীমিত করে নিয়েছে।
দীন শব্দের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে যে, মানুষ তার দীনকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করার অর্থ কেবল এটাই বুঝে যে, ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী হওয়া এবং হিন্দু, ইহুদি বা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী না হওয়া। এদিকে ইসলামি ধর্ম—বিশ্বাসের অনুসারীদের প্রত্যেকেই মনে করছে যে, সে তার দীনকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করেছে; অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই দীনের বিস্তৃত অর্থে তাদের দীনকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করেনি।”
উসতায মুওদুদির উল্লেখিত মতের ফলাফল : কিছু শরয়ি বিধান
কেউ কেউ উসতায মওদুদির উল্লেখিত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কিছু ফলাফল বের করেছে এবং তার ওপর ভিত্তি করে কিছু বিধান রচনা করেছে। তারা ধারণা করেছে, এটিই বুঝি আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর দাবি! তাদের বক্তব্য হলো,
যেহেতু মানুষ ইলাহ, রব, ইবাদত, দীন এ সকল শব্দের প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারে না, সুতরাং তারা যখন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” বারবার এ কথা সাক্ষ্য দেয় তাহলে তারা যেন এমন কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যার প্রকৃত অর্থ তাদের জানা নেই এবং তারা সেই বিষয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে না, নবী কারিম সা.—এর যুগে আরববাসীরা যে বিষয়ের সাক্ষ্য দিতো। কারণ, তারা তাদের সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তির ব্যাপারে গভীর জ্ঞান রাখতো। এ কারণে রাসূলুল্লাহ সা. সেই সাক্ষ্যকে গ্রহণ করতেন, যার বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য সুবিদিত ছিল এবং এটিকে তিনি তার ইসলামের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করতেন। আর বর্তমানকালে আমরা কেউ মুখে কালিমার সাক্ষ্য দিলেই তার ইসলামের ওপর নির্ভর করতে পারবো না; যতক্ষণ পর্যন্ত সে এর প্রকৃত বিষয় উপলব্ধি না করবে। বর্তমান অবস্থাই এর সাক্ষী। কেননা বর্তমানে বহু মানুষ এমন আছে, যারা মুখে কালিমার সাক্ষ্যদান করলেও সমাজ, রাজনীতি ও অর্থব্যবস্থাসহ জীবনের অন্য সকল অনুসঙ্গগুলোতে দীনের বিধানকে পালন করে না। অথচ তারাও মুখে কালিমার সাক্ষ্যদান করে এবং জোর গলায় নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এমন ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং শুধু তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তার সাথে মুসলিমের ন্যায় আচরণ করা হবে না। যে ব্যক্তি নামাযের প্রতিও যত্নশীল নয়। তবে কেবল ঐ ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো, যার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারবো যে, সে কালিমার সাক্ষ্যদানের প্রকৃত মর্ম ও উদ্দেশ্য অনুধাবন করেছে।
কেউ কেউ উপযুর্ক্ত বিষয়ের সাথে এ কথাও সংযোজন করেছেন যে, কারও ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য তার কালিমার সাক্ষ্যদানের মর্ম উপলব্ধির সাথে আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, তার কাজ তার কথাকে সমর্থন করতে হবে এবং তার কাজের মাধ্যমে তার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে। তবেই কেবল তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে। অতএব, তার কাজ যদি তার বক্তব্যকে সমর্থন না করে তবে আমরা তার ব্যাপারে ইসলামের বিধান আরোপ করবো না এবং তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো না। এ বক্তব্যের স্বপক্ষে তারা রাসূলুল্লাহ সা.—এর দিকে সম্বন্ধিত একটি কথা দ্বারা দলিল গ্রহণ করেন। কথাটি হচ্ছে :
ليس الإيمان بالتمنِّي، ولكن ما وقَر في القلب وصدّقه العمل.
ঈমান শুধু আশা—আকাক্সক্ষার নাম নয়। বরং ঈমান হচ্ছে ঐ বিষয় যা অন্তরে বদ্ধমূল হয় এবং কাজে বাস্তবায়িত হয়।
উসতায মওদুদির সিদ্ধান্তের ওপর কিছু আপত্তি
আমাদের প্রথম আপত্তি একথার ওপর যে, “উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাহ, ইবাদত ও দীন এর অর্থ নবীজি সা.—এর নবুওয়াত লাভের পূর্বে আরবদের মাঝে বহুল প্রচলিত ছিল এবং পরবর্তীকালে এসে এ শব্দগুলোর পূর্বেই সেই বিস্তৃত অর্থ হারিয়ে সেগুলো নির্দিষ্ট ও সংকীর্ণ অর্থে সীমিত হয়ে পড়েছে।”
অতএব, আল্লাহর অপার সাহায্যে আমরা বলবো, এ অনুমানটি বাস্তবতার পরিপন্থী। কেননা জাহেলি যুগে উল্লেখিত শব্দসমূহের যে অর্থই প্রচলিত থাকুক না কেন, কুরআনে কারিম সেগুলোর নির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ, কুরআনে কারিম এসব শব্দের মর্ম ও উদ্দেশ্য চূড়ান্ত রূপে স্পষ্ট করে দিয়েছে, যেখানে কোনো প্রকার অস্পষ্টতা বা সংশয়ের অবকাশ নেই। আর কুরআন মাজিদের এ স্পষ্ট বিবৃতি কুরআন নাযিলের পূর্বে জাহেলি যুগে এসব শব্দের যেসব অর্থ প্রচলিত ছিল তার তথ্য তালাশ থেকে অমুখাপেক্ষী করে দিয়েছে। কাজেই কোনো মুসলিমের অন্তরে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, কুরআনে কারিমের বক্তব্য সুনিশ্চিত, সুস্পষ্ট, সামগ্রিক ও চিরন্তন। বরং কুরআনে কারিমের এ উদ্দেশ্যকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার দাবিকে মেনে নিতে হবেÑ চাই তা কুরআন নাযিলের পূর্বের অর্থের অনুকূল হোক বা না হোক।
কুরআনে কারিমে উলুহিয়্যাত, রুরুবিয়্যাত ইবাদত ও দীন এসব শব্দের অর্থের বর্ণনায় বহু স্পষ্ট আয়াত রয়েছে। কুরআন মাজিদের তিলাওয়াকারীর চোখে সর্বপ্রথম যে পবিত্র আয়াতটি পড়ে তা হলো, بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ : আমি শুরু করছি আল্লাহর নামে, যিনি অসীম দয়ালু, পরম করুণাময়। (সূরা ফাতিহা : ১)
কোনো সন্দেহ নেই যে, এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তাআলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় রয়েছে। তৎক্ষণাৎ, আরও বিস্তারিত পরিচয় দিয়ে বলা হচ্ছে,
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (২) الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ (৩) مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ (৪) إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ (৫) اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (৬) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ.
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক, যিনি অসীম দয়ালু, পরম করণাময়। বিচার দিবসের মালিক। আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার নিকটই সাহায্য কামনা করি। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন। তাদের পথ যাদের ওপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন, তাদের পথ নয় যাদের ওপর আপনার ক্রোধ আপতিত হয়েছে, আর যারা পথভ্রষ্ট। (সূরা ফাতিহা)
সুতরাং আল্লাহ তাআলার জন্যই সকল গুণকীর্তণ ও প্রশংসা। তিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা। তিনিই সকল মাখলুকের ওপর কতৃর্ত্বকারী মালিক। তিনি কিয়ামতের দিন বিচার দিসবের অধিপতি। তিনিই একমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। সাহায্য কামনা কেবল তার নিকটই করা হয়। তার ওপরই একমাত্র ভরসা। কল্যাণ ও সফলতার হেদায়াত কামনা কেবল তার নিকটই করা হয়। এছাড়াও অন্যান্য আয়াতে আল্লাহ তাআলর সত্তার পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে :
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ (২১) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ.
হে মানুষ! তোমরা ইবাদত করা তোমাদের রবের, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকেও, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। যিনি তোমাদের জন্য যমিনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে করেছেন ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তার মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল—ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিকস্বরূপ। অতএব, তোমরা জেনে বুঝে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। (সূরা বাকারা : ২১—২২)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (২৮) هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ.
কীভাবে তোমরা আল্লাহর সাথে কুফরি করছো, অথচ তোমরা ছিলে মৃত? অতঃপর তিনি তোমাদের জীবিত করেছেন। এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু দেবেন, অতঃপর জীবিত করবেন। এরপর তারই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তিনিই যমিনে যা কিছু আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আসমানের দিকে মনোনিবেশ করলেন এবং তাকে সাত আসমানে সুবিন্যস্ত করলেন। আর তিনি সবকিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত। (সূরা বাকারা : ২৯)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (১০৬) أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ .
আমি যে আয়াতই রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তুমি কি জান না যে, আসমানসমূহ ও যমিনের রাজত্ব আল্লাহর? আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই। (সূরা বাকারা : ১০৭)
بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ.
আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ¯্রষ্টা। যখন তিনি কোনো কিছু করার সিদ্ধান্ত করেন তখন তার জন্য শুধু বলেন, হও, আর তা হয়ে যায়। (সূরা বাকারা : ১১৭)
وَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ.
আর তোমাদের উপাস্য এক উপাস্য। তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি মহা করুণাময়, অতিশয় দয়ালু। নিশ্চয়ই আসমান ও যমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং সমুদ্রে মানুষের কল্যাণকর সামগ্রী নিয়ে বিচরণশীল নৌযানসমূহে, আর আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করেছেন, অতঃপর তার দ্বারা যে মৃত যমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সবরকম জীব—জন্তু, আর বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং আসমান ও যমিনের মধ্যে তাঁরই হুকুমের অধীনে বিচরণশীল মেঘমালাতে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। (সূরা বাকারা : ১৬৩—১৬৪)
وَاللَّهُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ.
আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন। (সূরা বাকারা : ২১৩)
{وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ}
আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জান না। (সূরা বাকারা : ২১৬)
{وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ}
আর পরম ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু। (সূরা বাকারা : ২১৮)
{ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ }
নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ২২০)
{وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ}
আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা বাকারা : ২২৪)
{ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ}
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে সম্মত দ্রষ্টা। (সূরা বাকারা : ১১০)
{وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ }
জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে জানেন। (সূরা বাকারা : ২৩১)
{اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ}
আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সবকিছুর ধারক। তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমিনে যা কিছু রয়েছে, সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই তিনি জানেন। তাঁর জ্ঞানের সীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই আয়ত্ত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন (তা ব্যতীত)। তাঁর সিংহাসন (কুরসী) সমস্ত আসমান ও যমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর পক্ষে সামান্যতম কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ, সর্বাপেক্ষা মহান। (সূরা বাকারা : ২৫৫)
{لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ فَيَغْفِرُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ }
আকাশমণ্ডলী ও যমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। তোমাদের মনের কথা প্রকাশ করা বা গোপন কর, আল্লাহ তার হিসাব তোমাদের নিকট থেকে গ্রহণ করবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দিবেন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। (সূরা বাকারা : ২৮৪)
{إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ}
আল্লাহ, নিশ্চয় আসমান ও যমিনের কোনো কিছুই তার নিকটে গোপন থাকে না। (সূরা আলে ইমরান : ৫)
{رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ}
হে আমাদের প্রতিপালক! সরল পথ প্রদর্শনের পর আপনি আমাদের অন্তরকে সত্য লংঘনে প্রবৃত্ত করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা। (সূরা আলে ইমরান : ৮)
{قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَنْ تَشَاءُ وَتَنْزِعُ الْمُلْكَ مِمَّنْ تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَنْ تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَنْ تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (২৬) تُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَنْ تَشَاءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ}
বলুন, হে আল্লাহ! আপনিই সার্বভৌম শক্তির মালিক। আপনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দান করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নেন। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। আপনার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। আপনি রাতকে দিনের ভেতরে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের ভেতরে প্রবেশ করান। আর আপনিই মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। আর যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। (সূরা আলে ইমরান : ২৬—২৭)
{ قَالَتْ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ قَالَ كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ}
মারয়াম বললো, হে আমার রব, কিভাবে আমার সন্তান হবে? অথচ আমাকে তো কোনো মানুষ স্পর্শ করেনি! আল্লাহ বললেন, এভাবেই আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যখন তিনি কোনো কাজ করার জন্য ইচ্ছা করেন তখন শুধু বলেন, ‘হয়ে যাও’। অমনি তা হয়ে যায়। (সূরা আলে ইমরান : ৪৭)
{قُلْ إِنَّ الْفَضْلَ بِيَدِ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ . يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ}
বলে দিন, অনুগ্রহ আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। (সূরা আলে ইমরান : ৭৩—৭৪)
{يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا}
হে মানব! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট চেয়ে থাক এবং সতর্ক থাক রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়তার ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর সদা দৃষ্টি রাখেন। (সূরা নিসা : ১)
{الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ (১) هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ طِينٍ ثُمَّ قَضَى أَجَلًا وَأَجَلٌ مُسَمًّى عِنْدَهُ ثُمَّ أَنْتُمْ تَمْتَرُونَ (২) وَهُوَ اللَّهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُونَ}
সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেছেন অন্ধকার ও আলো। এরপরও কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সমতুল্য স্থির করে। তিনিই তোমাদেরকে মাটির দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর একটি কাল নির্ধারণ করেছেন, আর নির্দিষ্টকাল আল্লাহর কাছে আছে। তারপরও তোমরা সন্দেহ কর। তিনিই আল্লাহ নভোমণ্ডলে এবং ভূমণ্ডলে। তিনি তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা কর সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। (সূরা আনআম : ১—৩)
{ وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (১৭) وَهُوَ الْقَاهِرُ فَوْقَ عِبَادِهِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ }
আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোনো কষ্টে নিপতিত করেন, তবে তিনি ব্যতীত তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনিই স্বীয় বান্দাদের ওপর পরাক্রমশালী। তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা আনআম : ১৭—১৮)
{وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ} {رُدُّوا إِلَى اللَّهِ مَوْلَاهُمُ الْحَقِّ أَلَا لَهُ الْحُكْمُ وَهُوَ أَسْرَعُ الْحَاسِبِينَ (৬২) قُلْ مَنْ يُنَجِّيكُمْ مِنْ ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ تَدْعُونَهُ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً لَئِنْ أَنْجَانَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ (৬৩) قُلِ اللَّهُ يُنَجِّيكُمْ مِنْهَا وَمِنْ كُلِّ كَرْبٍ ثُمَّ أَنْتُمْ تُشْرِكُونَ (৬৪) قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ}
তাঁর কাছেই রয়েছে অদৃশ্যের চাবি, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। স্থলে ও জলে যা কিছু আছে, তা তিনিই জানেন। তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও ঝরে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অংকুরিত হয় না এবং কোনো আর্দ্র কিংবা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই। তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিনের বেলায় তোমরা যা কিছু কর, তিনি সব জানেন। অতঃপর দিবসে তোমাদেরকে পুনর্জাগরিত করেন, যাতে নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ হয়। অতঃপর তাঁরই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অনন্তর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদেরকে অবহিত করবেন। তিনিই স্বীয় বান্দাদের ওপর পরাক্রমশালী এবং তিনি তোমাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রেরণ করেন। অবশেষে যখন তোমাদের কারও মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন আমার প্রেরিত ফেরেশতারা তার মৃত্যু ঘটায় এবং তারা কোনো ত্রুটি করে না। অতঃপর তারা সবাইকে তাদের প্রকৃত প্রতিপালক আল্লাহর দিকে প্রত্যানীত হবে। শুনে রাখ, কতৃর্ত্ব তাঁরই এবং তিনি সর্বাধিক দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী।
আপনি বলুন, কে তোমাদেরকে স্থল ও জলের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেন, যখন তোমরা বিনীতভাবে এবং গোপনে তাঁকে ডাক যে, যদি আপনি আমাদেরকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, তবে আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো। আপনি বলে দিন, আল্লাহই তোমাদেরকে সেই বিপদসহ যাবতীয় দুঃখ—কষ্ট থেকে মুক্তি দান করেন। এরপরও তোমরা তাঁর সাথে শিরক কর। আপনি বলুন, তিনিই তোমাদের ওপর তোমাদের ঊর্ধ্বদেশ থেকে অথবা পাদদেশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করতে সক্ষম অথবা তিনি এ বিষয়ে সক্ষম যে, তোমাদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করবেন এবং এক দলকে অপর দলের আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ, আমি কেমন করে নিদর্শনাবলি নানাভাবে বর্ণনা করি, যাতে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারে। (সূরা আনআম : ৫৯—৬৫)
{وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ وَيَوْمَ يَقُولُ كُنْ فَيَكُونُ قَوْلُهُ الْحَقُّ وَلَهُ الْمُلْكُ يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ}
তিনিই যথার্থভাবে আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। যেদিন তিনি বলেন, হয়ে যাও, তখনই তা হয়ে যায়। তাঁর কথাই সত্য। যেদিন শিঙ্গায় ফুৎকার করা হবে, সেদিনের আধিপত্য কেবল তাঁরই হবে। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্য সর্ববিষয়ে জ্ঞাত, আর তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। (সূরা আনআম : ৭৩)
{إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَى}
নিশ্চয় আল্লাই শস্য—বীজ ও অঁাটি অংকুরিত করেন। (সূরা আনআম : ৯৫)
{فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ}
তিনিই ঊষার উন্মেষ ঘটান, তিনিই বিশ্রামের জন্য রাত্রি এবং গণনার জন্য সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। এটি পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নির্ধারণ। (সূরা আনআম : ৯৬)
{ وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (৯৭) وَهُوَ الَّذِي أَنْشَأَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ فَمُسْتَقَرٌّ وَمُسْتَوْدَعٌ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَفْقَهُونَ (৯৮) وَهُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ نَبَاتَ كُلِّ شَيْءٍ فَأَخْرَجْنَا مِنْهُ خَضِرًا نُخْرِجُ مِنْهُ حَبًّا مُتَرَاكِبًا وَمِنَ النَّخْلِ مِنْ طَلْعِهَا قِنْوَانٌ دَانِيَةٌ وَجَنَّاتٍ مِنْ أَعْنَابٍ وَالزَّيْتُونَ وَالرُّمَّانَ مُشْتَبِهًا وَغَيْرَ مُتَشَابِهٍ انْظُرُوا إِلَى ثَمَرِهِ إِذَا أَثْمَرَ وَيَنْعِهِ إِنَّ فِي ذَلِكُمْ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ }
তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্ররাজি সৃষ্টি করেছেন; যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথ খুঁজে পাও। নিশ্চয় জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্যে আমি নিদর্শনাবলি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি। তিনিই তোমাদের কে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের জন্য রয়েছে আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। নিশ্চয় আমি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেছি ঐ সম্প্রদায়ের জন্য জন্যে, যারা অনুধাবন করে। তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি, অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট দানা উৎপন্ন করি। খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে গুচ্ছ বের করি ঝুলন্ত থোকা এবং আঙ্গুরের বাগান, যায়তুন ও ডালিম। এগুলো পরস্পরে একে অপরের সদৃশ ও বিসদৃশ। লক্ষ্য কর এসবের ফলের প্রতি যখন সেুগুলো ফলবান হয় এবং তার পরিপক্কতার প্রতি। নিশ্চয় এগুলোতে নিদর্শন রয়েছে ঈমানদারদের জন্যে।(সূরা আনআম : ৯৭—৯৯)
{ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ فَاعْبُدُوهُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ وَكِيلٌ (১০২) لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ وَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ وَهُوَ اللَّطِيفُ الْخَبِيرُ }
তিনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। অতএব, তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্তুর তত্ত্বাবধায়ক। দৃষ্টিসমূহ তাঁকে অবধারণ করতে পারে না, অবশ্য তিনি সকল দৃষ্টিকে অবধারণ করেন। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী, সম্মক জ্ঞাত। (সূরা আনআম : ১০২—১০৩)
{قُلْ فَلِلَّهِ الْحُجَّةُ الْبَالِغَةُ فَلَوْ شَاءَ لَهَدَاكُمْ أَجْمَعِينَ}
বলুন, চূড়ান্ত প্রমাণ তো আল্লাহরই। তিনি যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে তোমাদের সকলকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করতেন। (সূরা আনআম : ১৪৯)
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ (১৬২) لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ.
বলুন, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমর জীবন ও মরণ সবকিছু জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্য। (সূরা আনআম : ১৬২—১৬৩)
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ.
আর ভূ—পৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রতিটি প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল সম্পর্কে অবহিত। সবকিছু লিপিবদ্ধ আছে সুস্পষ্ট কিতাবে। (সূরা হুদ : ৬)
اللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثَى وَمَا تَغِيضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ (৮) عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْكَبِيرُ الْمُتَعَالِ (৯) سَوَاءٌ مِنْكُمْ مَنْ أَسَرَّ الْقَوْلَ وَمَنْ جَهَرَ بِهِ وَمَنْ هُوَ مُسْتَخْفٍ بِاللَّيْلِ وَسَارِبٌ بِالنَّهَارِ (১০) لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ (১১) هُوَ الَّذِي يُرِيكُمُ الْبَرْقَ خَوْفًا وَطَمَعًا وَيُنْشِئُ السَّحَابَ الثِّقَالَ (১২) وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلَائِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَنْ يَشَاءُ وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ (১৩) {لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ (১৪) وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآصَالِ}
আল্লাহ জানেন, প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং গর্ভাশয়ে যা কমে ও বাড়ে এবং তাঁর বিধানে প্রত্যেক বস্তুরই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্য সম্পর্কে অবগত। তিনি মহান, সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।
তোমাদের মধ্যে কেউ কথা গোপন রাখুক বা প্রকাশ করুক, রাতে লুকিয়ে করুক বা দিনে প্রকাশ্যে করুক সবই তাঁর নিকট সমান।
মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে। তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। কোনো সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তা প্রতিহত করা যায় না এবং তাদের জন্য তিনি ছাড়া আর কোনো অভিাভাবক নেই। তিনিই আশা ও ভয় সঞ্চার করার জন্য তোমাদেরকে বিজলী দেখান এবং তিনি ভারি মেঘামালা সৃষ্টি করেন।
আর বজ্র তাঁর সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে এবং ফেরেশতারাও করে তাঁর ভয়ে। তিনি বজ্রপাত ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা তা দ্বারা আঘাত করেন। তারা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে, অথচ তিনি মহাশক্তিশালী।
সত্যের আহ্বান তাঁরই। আর যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে তারা তাদের ডাকে সামান্যও সাড়া দিতে পারে না। বরং তাদের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মত যে পানির দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দেয়, যেন তা তার মুখে পেঁৗছে, অথচ তা তার কাছে পেঁৗছবার নয়। আর কাফেরদের আহ্বান শুধুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
আর আসমানসমূহ ও যমিনে যাকিছু আছে সব আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় ইচ্ছায়া বা অনিচ্ছায় এবং সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের ছায়াগুলোও। (সূরা রা’দ : ৮—১৫)
{اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ}
আল্লাহ মভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি। (সূরা নূর : ৩৫)
{وَمَا بَيْنَ ذَلِكَ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا}
আপনার প্রতিপালক বিস্মৃত হওয়ার নন। (সূরা মারয়াম : ৬৪)
{ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ }
তিনিই আদি, তিনিই অনন্ত, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গোপন এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্মক অবহিত। (সূরা হাদিদ : ৩)
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ (২২) هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ (২৩) هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ }
তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা। তিনি অসীম দয়ালু ও পরম করুণাময়। তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনিই অধিপতি, পবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, প্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত। তারা যা শরিক করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র মহান। তিনিই আল্লাহ, ¯্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদানকারী, তাঁর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে সবই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি প্ররাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা হাশর : ২২—২৪)
{اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (১) خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ (২) اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ (৩) الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ (৪) عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ}
পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলাক (জমাটবদ্ধ রক্ত) থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানতো না। (সূরা আলাক : ১—৫)
{قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (১) اللَّهُ الصَّمَدُ (২) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (৩) وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ}
বল, তিনি আল্লাহ, এক—অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারও মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি। তাকেও জন্ম দেওয়া হয়নি। আর তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই। (সূরা ইখলাস : ১—৪)
{قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ (১) مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ (২) وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ (৩) وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ (৪) وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ.
বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছিল ঊষার রবের কাছে। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে। রাতের অন্ধকারের অনিষ্ট থেকে যখন তা গভীর হয়। আর গ্রন্থিতে ফুঁ—দানকারী নারীদের অনিষ্ট থেকে। আর হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে। (সূরা ফালাক : ১—৫)
{قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ (১) مَلِكِ النَّاسِ (২) إِلَهِ النَّاسِ (৩) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ (৪) الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ (৫) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ}
বল, আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের কাছে, যিনি মানুষের অধিপতি, মানুষের ইলাহÑ আত্মগোপনকারী, কুমন্থণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিন ও মানুষ থেকে। (সূরা নাস : ১—৬)
পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত থেকে এখানে অল্প কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো, যেখানে উলুহিয়্যাতের অর্থকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার বৈশিষ্ট্য, পরিধি, কতৃর্ত্ব ও ক্ষমতার বিবরণ রয়েছে।
আমরা উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে উলুহিয়্যাতের যে অর্থ ও তাৎপর্য বর্ণনা করেছি, জাহেলি যুগে প্রচলিত অর্থ কি তার পর্যন্ত পেঁৗছতে পারে অথবা এর দূরবর্তী সীমানার কাছাকাছিও কি যেতে পারে?
কুরআন মাজিদের উপর্যুক্ত বর্ণনার পরেও কি কোনো মুফাসসির ও প্রয়োজন মনে করবে যে, অভিধানে ইলাহ শব্দের মূল অর্থ কী? এটি কিসের থেকে নির্গত হয়েছে? কুরআন নাযিলের পূর্বে জাহেলি যুগে এ মর্ম কী ছিল…? !
উপযুর্ক্ত আলোচনার পর এ কথা বলা কী করে সঙ্গত হবে যে, উলুহিয়্যাতের অর্থ পরিবর্তন হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং সেই প্রচলি অর্থ আর ফিরে আসেনি! আর ইসলামের আগমনের পর যাদের জন্ম হয়েছে, যাদের রত্ম—ভাণ্ডারে কিতাবুল্লাহর আয়াতসমূহ সঞ্চিত আছে, তাদের কাছে ইলাহ, ইবাদত, রব, ও দীনÑ এসব শব্দের সেই সকল অর্থ বাকি নেই, কুরআন নাযিলের পূর্বে জাহেলি যুগে যা প্রচলিত ছিল! বাস্তবেই কি এ ধারণা সঠিক হবে? অথচ আরব গোত্রগুলো ছিল শতধা বিভক্ত, যাদের প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র বচনরীতি ও ভাষাশৈলী ছিল। তাদের ছিল না কোনো একক নেতৃত্ব, অভিন্ন সংস্কৃতি বা আকিদা—বিশ্বাস। যারা ছিল নিরক্ষর জাতি। যাদের মধ্যে শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়াই ছিল দুষ্কর। যাদেরকে ঘিরে ছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার। যারা অধঃপতনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত ছিল, যাদের কাছে ছিল না কোনো আসমানি কিতাব এবং অক্ষর জ্ঞান বা শাস্ত্রীয় জ্ঞান। এই যখন তাদের অবস্থা, তখন “ইলাহ, রব, ইবাদত, দীন” এ শব্দগুলোর অর্থ ও মর্ম তাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত ছিল এবং নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের সাথে তাদের মধ্য হতে প্রত্যেকের সমানভাবে জানা ছিল, অতঃপর যখন আল্লাহ তাআলা পবিত্র ও সংরক্ষিত কুরআন নাযিল করলেন, যাকে অগ্র—পশ্চাৎ থেকে কোনো বাতিল স্পর্শ করতে পারে না, যাতে রয়েছে সুস্পষ্ট বর্ণনা, বান্দারা রাত্রি ও দিবস জুড়ে যার তিলাওয়াতের মাধ্যমে ইবাদতে রত থাকে, মসজিদে কিংবা মসজিদের বাইরে জামাআতের নামাযে স্বশব্দে যার তিলাওয়াত করে, সেই কুরআনের অর্থাবলি নষ্ট ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং জাহেলি যুগে তার যে প্রচলন ছিল মানুষের মধ্যে সেই প্রচলন আর ফিরে আসেনি? এ কথা কী করে সঠিক হতে পারে, যখন কিতাবুল্লাহ মুসলিমদের অন্তরে সদা সংরক্ষিত আছে! আর যখন তাদের মধ্য হতে কেউ সূরা ফাতিহা, সূরা ইখলাস এবং সূরা ফালাক ও নাস তিলাওয়াত করবে অথবা শুনবে তখন সে এমন অর্থ অনুধাবন ও উপলব্ধি করবে, জাহেলি যুগের অনুধাবন ও উপলব্ধির সাথে যার কোনো মিল নেই..? এটি কি করে সম্ভব…?
অতএব, এ কথা যে, ইসলামি সমাজে যাদের জন্ম হয়েছে এবং তাতে বেড়ে ওঠেছে তাদের কাছে “ইলাহ, রব, ইবাদত ও দীন”—এর ঐ সকল অর্থ বাকি থাকেনি কুরআন নাযিলের পূর্বে জাহেলি যুগে যার প্রচলন ছিল, যেহেতু এ কথার সত্যতা ও বিশুদ্ধতার ওপর কোনো দলিল—প্রমাণ নেই, অতএব, আমরা বলবো, এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। এ কারণে তার অনুসরণ করা জায়েয নেই এবং তার ওপর ভিত্তি করে কোনো বিধান নির্ণয় করাও সঠিক নয়।
ইতঃপূর্বে আমরা পবিত্র কুরআনে বহু আয়াত বর্ণনা করেছি, যা উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতের অর্থ বর্ণনা জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া মুফাসসিরগণ যে ‘রব’ শব্দের ব্যাখ্যায় তার যেসকল অর্থ হতে পারে সেগুলো হতে শুধু একটি অর্থ বর্ণনা করে ক্ষান্ত হয়েছেন বিষয়টি এমন নয়, বরং তারা প্রতিটি জায়গায় ‘রব’ শব্দের ব্যাখ্যা তার পূর্বাপর আলোচনার নির্দেশনা অনুসারে করেছেন।
কুরআনে কারিমের আয়াতসমূহ রব শব্দের অর্থ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দিয়েছে, হোক তা মালিকানা ও কতৃর্ত্ব সম্পর্কিত অথবা সংশোধন, লালন—পালন, অভিভাবকত্ব, তত্ত্বাবধান, নেতৃর্ত্ব অথবা মহত্ত্ব সম্পর্কিত। যেমন পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে :
رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ.
হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা যদি ভুলে যাই অথবা ভুল করি তাহলে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ওপর এমন গুরুদায়িত্ব অর্পণ করবেন না যেমন আমাদের পূর্ববর্তীগণের ওপর অর্পণ করেছিলেন। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ওপর এমন ভার অর্পণ করবেন না যা বহন করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের ওপর দয়া করুন। আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব, আপনি কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। (সূরা বাকারা : ২৮৬)
رَبُّكُمُ الَّذِي يُزْجِي لَكُمُ الْفُلْكَ فِي الْبَحْرِ لِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا (৬৬) وَإِذَا مَسَّكُمُ الضُّرُّ فِي الْبَحْرِ ضَلَّ مَنْ تَدْعُونَ إِلَّا إِيَّاهُ فَلَمَّا نَجَّاكُمْ إِلَى الْبَرِّ أَعْرَضْتُمْ وَكَانَ الْإِنْسَانُ كَفُورًا (৬৭) أَفَأَمِنْتُمْ أَنْ يَخْسِفَ بِكُمْ جَانِبَ الْبَرِّ أَوْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا ثُمَّ لَا تَجِدُوا لَكُمْ وَكِيلًا.
তোমাদের প্রতিপালক তিনি, যিনি তোমাদের জন্য সমুদ্রে নৌযান চালিত করেন, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পার। নিশ্চয় তিনি তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যখন তোমাদেরকে বিপর্যয় স্পর্শ করে তখন তিনি ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা হারিয়ে যায়। অতঃপর যখন তিনি তোমাদেরকে রক্ষা করে স্থলভাগে আনেন তখন তোমরা বিমুখ হয়ে যাও। মানুষ তো অতিশয় অকৃতজ্ঞ। (সূরা বনি ইসরাঈল : ৬৬—৬৮)
{قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ}
বল, আসমানসমূহ ও যমিনের রব কে? বল, আল্লাহ। তুমি বল, তাহলে তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করছো, যারা তাদের নিজেদের কোনো লাভ—ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়?বল, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? অথবা অন্ধকার ও আলো কি এক? (সূরা রা’দ : ১৬)
{قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ (৩১) فَذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمُ الْحَقُّ فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ فَأَنَّى تُصْرَفُونَ .
বল, কে তোমাদেরকে আসমান ও যমিন থেকে জীবনোপকরণ দান করেন? অথবা তোমাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কার কতৃর্ত্বাধীন? আর কে মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন, আর জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন? আর সকল বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন? তখন তারা বলবে, আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে না? (সূরা ইউনুস : ৩১—৩২)
رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ وَمَا يَخْفَى عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ .
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি জানেনÑ যা আমরা গোপন করি এবং যা প্রকাশ করি। আসমান ও যমিনের কোনো কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন থাকে না। (সূরা ইবরাহিম : ৩৮)
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ (৩৯) رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ (৪০) رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ.
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বার্ধক্যে আমাকে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক প্রার্থনা শ্রবণ করেন। (সূরা ইবরাহীম : ৩৯—৪১)
{ فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ (৩) الَّذِي أَطْعَمَهُمْ مِنْ جُوعٍ وَآمَنَهُمْ مِنْ خَوْفٍ.
অতএব, তারা যেন এ গৃহের রবের ইবাদত করে, যিনি ক্ষুধায় তাদেরকে আহার দিয়েছেন এবং ভয়—ভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন। (সূরা কুরাইশ : ৩—৪)
এখানে কুরআনে কারিমের অল্প কিছু আয়াত পেশ করা হলো, যেখানে উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতের অর্থকে স্পষ্ট করা হয়েছে। তবে বাস্তব কথা হচ্ছে, পাঠক আমরা এখানে যেসকল আয়াত পেশ করেছি এগুলো ছাড়াও কুরআনে কারিমের অন্য সকল আয়াত সম্পর্কে চিন্তা করলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, অধিকাংশ আয়াতে ‘ইলাহ’ ও ‘রব’ শব্দ দুটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে । যেমন ফেরআউনের উক্তি :
مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي.
আমি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমার জানা নেই। (সূরা কাসাস : ৩৮)
أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى.
আমি তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব। (সূরা নাযিআত : ২৪)
অনুরূপ ‘ইবাদত’ ও ‘দীন’ শব্দের বেলায়ও এমনটি দেখা যায়। কুরআনে কারিমের এ বিষয়ে যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এসেছে।
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ.
বিচার দিবসের মালিক। (সূরা ফাতিহা : ৪)
তবে আমরা মনে করি না যে, এ কথার ওপর কোনো দলিল—প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে যে, মুসলিমদের মধ্যে যে অর্থ প্রচলিত আছে, কিয়ামতের দিন এ অর্থের ওপরই হিসাব—কিতাব, প্রতিদান ও শাস্তি প্রদান করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ .
নিশ্চয় ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন। (সূরা আলে ইমরান : ১৯)
এ আয়াত থেকে একজন নিরক্ষর ব্যক্তি এ কথা বুঝতে পারবে যে, এখানে দীন দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাসূল সা.—এর আনীত পুরো জীবন এবং গোটা ইসলামি শরিয়াহ। নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ থেকেও একথাই বোঝা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ.
এটাই শাশ্বত দীন। (সূরা ইউসুফ : ৪)
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা : ৩)
قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي شَكٍّ مِنْ دِينِي فَلَا أَعْبُدُ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ أَعْبُدُ اللَّهَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ (১০৪) وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ .
বল, হে মানুষ! তোমরা যদি আমার দীনের ব্যাপারে সংশয়যুক্ত হও তবে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর আমি তাদের ইবাদত করি না। বরং আমি ইবাদত করি আল্লাহর, যিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন, আমি মুমিনদের অন্তভুর্ক্ত হই। আরও এ বিষয়ে যে, তুমি একনিষ্ঠভাবে দীনে প্রতিষ্ঠিত হও এবং কখনওই মুশরিকদের অন্তভুর্ক্ত হয়ো না। (সূরা ইউনুস : ১০৪—১০৫)
পূর্বে যেসকল আয়াত উল্লেখ করেছি তাতে ইবাদতের অর্থ সন্নিবেশিত আছে। আর তা হচ্ছে, দীনের প্রতীকী বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মকর্ম পালন করা। এছাড়াও অনুগত ও বিনয়ী হওয়া এবং দ্ব্যর্থহীন অনুসরণ ও আনুগত্য স্বীকার করা।
কুরআনে কারিমে বহু আয়াত রয়েছে যেখানে সুস্পষ্টরূপে এ কথা উল্লেখ আছে যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র বিচারক, আদেশদাতা ও নিষেধকারী। এবং দ্ব্যর্থহীন আনুগত্য ও অনুসরণ কেবল তার জন্যই ওয়াজিব। তিনি ব্যতীত আর করো জন্য ওয়াজিব নয়। এ সম্পর্কিত আয়াতগুলো এতটাই সুস্পষ্ট যে, তার জন্য রব শব্দের মর্ম দ্বারা দলিল গ্রহণের প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ.
বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই। তিনি আদেশ করেছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে। (সূরা ইউসুফ : ৪০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا. أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا.
হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের। কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা তাতে বিশ্বাস করে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়। যদিও তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। (সূরা নিসা : ৫৯—৬০)
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫)
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ.
কোনো ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করলো। (সূরা নিসা : ৮০)
تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (১৩) وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ}
এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে, আর এটাই মহা সাফল্য। (সূরা নিসা : ১৩—১৪)
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُوا عِبَادًا لِي مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ كُونُوا رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُونَ.
কোন মানুষের জন্য সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত ও নবুওয়াত দান করার পর সে মানুষকে বলবে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও। বরং সে বলবে, তোমরা রব্বানি (আল্লাহওয়ালা) হও, যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষাদান কর এবং যেহেতু তোমরা অধ্যয়ন কর। (সূরা আলে ইমরান : ৭৯)
কাজেই ঐ ব্যক্তির বিধানদানের ক্ষমতা কি করে হবে, আল্লাহ তাআলা যাকে কিতাব, হিকমত ও নবুওয়াত কোনোটিই দান করেননি!!?
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ.
তুমি বল, হে কিতাবিগণ! তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি অমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদত করবো না, তার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবো না এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ব্যতীত রব হিসেবে গ্রহণ করবো না। তারপরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে তোমরা বল, তোমরা সাক্ষী থাক, নিশ্চয় আমরা মুসলিম। ( সূরা আলে ইমরান : ৬৪)
اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ.
তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্যান্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। (সূরা আ’রাফ : ৩)
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ.
আমি তো তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি আল্লাহ তোমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার—ফয়সালা কর। (সূরা নিসা : ১০৫)
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। (সূরা মায়িদা : ৪৪)
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা জালিম। (সূরা মায়িদা : ৪৫)
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা ফাসিক। (সূরা মায়িদা : ৪৭)
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ فَاحْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ عَمَّا جَاءَكَ مِنَ الْحَقِّ}
আর আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যথাযথভাবে, এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সত্যায়নকারী এবং তার সংরক্ষকরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তুমি তার মাধ্যমে ফয়সালা কর এবং তোমার নিকট যে সত্য এসেছে তা ত্যাগ করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। (সূরা মায়িদা : ৪৮)
{وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ}
আর আল্লাহ যে কিতাব নাযিল করেছেন তাদের মধ্যে সে অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা কর এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের থেকে সতর্ক থাক যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার কিছু থেকে তারা তোমাকে বিচ্যুত করবে। (সূরা মায়িদা : ৪৯)
{أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ}
তবে কি তারা জাহেলি যুগের বিধি—বিধান কামনা করে? নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধানদানে আল্লাহ অপেক্ষা কে শ্রেষ্ঠতর? (সূরা মায়িদা : ৫০)
ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে তাদের পণ্ডিতদের ও সংসারবিরাগীদের আনুগত্য করেছিল। আল্লাহ তাআলা তাদের এ কাজের নিন্দা করেছেন এবং তাদের কাফের হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ, তাদের আনুগত্য এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছিল যে, তাদের আল্লাহ তাআলা কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম করা এবং আল্লাহ তাআলা কতৃর্ক হারামকৃত বিষয়ে হালাল করার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ.
তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে। (সূরা তাওবা : ৩১)
যেহেতু হযরত আদি ইবনে হাতেম রা. এ পবিত্র আয়াতের প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এবং তিনি ধারণা করেছিলেন, ইবাদতের অর্থ হলো, দীনের প্রতীকী বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করা এবং ধর্ম—কর্ম পালন করা এবং রাসূলুল্লাহ সা.—কে বললেন, তারা তো তাদের ধর্মগুরুদের উপাসনা উপাসনা করতো না। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাকে আয়াতের সঠিক অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে তার ধারণাকে শুধরে দিলেন।
হযরত আদি ইবনে হাতেম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি নবী সা.—এর সাক্ষাতে আসলাম, যখন আমার গলায় একটি স্বর্ণের ক্রোশ ঝুলন্ত ছিল। এ অবস্থা দেখে নবী সা. আমাকে বললেন, হে হাতেমের পুত্র। তোমার গলা থেকে এ মূর্তিটি ফেলে দাও। তখন আমি সেটি ফেলে দিলাম। এরপর নবীজি সা. সূরা বারাআহ (তাওবা) এর তিলাওয়াত শুরু করলেন, যখন তিনি এ আয়াতে পৌঁছলেন :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ.
(তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।) তখন আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো তাদের ইবাদত করতাম না। নবীজি সা. বললেন, তারা তোমাদের জন্য হারাম বিষয়কে হালাল ঘোষণা করতো, তখন কি তোমরা তাকে হালাল মনে করতে না? এবং হালাল বিষয়কে তোমাদের জন্য হারাম ঘোষণা করতো তখন কি তোমরা তাকে হারাম মনে করতে না? আমি বললাম, হাঁ। নবীজি সা. বললেন, এটিই হলো তাদের ইবাদত।
রাসূলুল্লাহ সা. থেকে প্রমাণিত এ সম্পর্কিত আরেকটি হাদিস হলো,
عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ، إِلَّا أَنْ يُؤْمَرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَإِنْ أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ، فَلَا سَمْعَ وَلَا طَاعَةَ.
মুসলিম ব্যক্তির জন্য আবশ্যক হলো, (শাসকের কথা) শ্রবণ করা এবং তার আনুগত্য করা, সেই কথা তার মনঃপুত হোক বা না হোক; যতক্ষণ না তাকে অন্যায় কাজের আদেশ করা হয়। যদি অন্যায় কাজের আদেশ করা হয় তাহলে শাসকের কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করা যাবে না। (সহিহ মুসলিম : খ. ১, পৃ. ৩২)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ আমার পূর্বে যত নবীকেই তার উম্মতের কাছে প্রেরণ করেছেন, উম্মতের মধ্য থেকে সেই নবীর কিছু অনুসারী ও সহচর তৈরি হয়েছে, যারা তার সুন্নাতকে আকড়ে ধরতো এবং তার আদেশের অনুসরণ করতো। অতঃপর তাদের পরে এমন এক প্রজন্মের আগমন হতো যারা এমন কথা বলতো, যা তারা করতো না এবং এমন কাজ করতো তাদেরকে যার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় হাত দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সে মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বা দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তর দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। এরপর ঈমানের সরিষা পরিমাণ দানাও অবশিষ্ট নেই। (আল—মুহাল্লাহ, ইবনু হাযম: খ. ৬, পৃ. ৩৬০)
উল্লেখিত শব্দসমূহের এ সকল অর্থ সুপ্রসিদ্ধ ও সংরক্ষিত। যে ব্যক্তি আরবি ভাষার কোনো একটি ভাষারীতিও জানে সে এসব শব্দের অর্থ ও মর্ম বুঝতে সক্ষম, যার দ্বারা তার অন্তর্দৃষ্টি আলোকোজ্জ্বল হতে পারে; যদিও সে শরিয়ার বিভিন্ন বিধানের মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে অনবহিত।
এক্ষেত্রে মুফাসসিরগণের দায়িত্ব হলো, যে ব্যক্তি আরবি ভাষা ভালো করে জানে তার জন্য এ শব্দগুলোর অর্থকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করা অথবা সংশ্লিষ্ট আয়াতের শানে নুযূল কিংবা সম্পৃক্ত হাদিসসমূহ উল্লেখ করা, অথবা আয়াত ও হাদিসের মধ্যে কিংবা দুই আয়াতের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করা, অতঃপর সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিস থেকে যে শরয়ি বিধান উদঘাটিত (ইস্তিম্বাত) হয় তার দিকে ইঙ্গিত করা।
আর যারা আরবি ভাষা জানে না তাদের জন্য মুফাসসির—এর কর্তব্য হলো, আয়াতের তরজমা করে দেওয়া। যদি সেই তরজমা বিশুদ্ধ হয় তাহলে তা উদ্দিষ্ট অর্থ আয়ত্বকরণ এবং মর্ম অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে; যদিও তরজমার মাধ্যমে কুরআনের আরবি ভাষার অলৌকিকত্বের পূর্ণপ্রকাশ অসম্ভব। আর যদি তরজমা বিশুদ্ধ না হয়, বরং তাতে বিকৃতির মিশ্রণ থাকে তাহলে তা আল্লাহ তাআলার প্রতি মিথ্যা আরোপ ও অন্যায় কথা হিসেবে গণ্য হবে।
এরপর আমাদের দ্বিতীয় আপত্তি হচ্ছে এ কথার ওপর যে, “কুরআনে কারিম নাযিল হয়েছে আরবে। আরবি ভাষাভাষীদের ওপর, যাদের প্রত্যেকেই ইলাহ ও রব এ দুটি শব্দের অর্থ ও উদ্দেশ্য ভালো করে জানতো। কারণ, ইলা ও রব শব্দদ্বয় তাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই বহুল প্রচলিত ছিল। ফলে এ দুটি শব্দের সকল অর্থ তাদের আয়ত্ত ছিল। এ কারণে যখন বলা হতো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই, তার উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) ও রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) এর ক্ষেত্রে কোনো শরিক নেই, তখন তারা এ আহ্বানের আদ্যোপান্ত অনুধাবন করতে পারতো। এ কথায় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সংশয় ও অস্পষ্টতা থাকতো না যে, বক্তা তাদেরকে কি বুঝাতে চেয়েছে? কোনো বিষয়কে নাকচ করেছে? তারা বুঝতে পারতোÑ আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্যাবলি কেবলই তাঁর সাথে নির্দিষ্ট। তিনি ব্যতীত আর কারও সাথে সেগুলো যুক্ত হতে পারে না। তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার সমীপে আত্মসমর্পণ করতো।”
আল্লাহ তাআলা সাহায্যে এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, এ কথার উদ্দেশ্য যদি হয় এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে সাব্যস্ত করা যে, রাসূল সা.—এর নবুওয়াত লাভের সময় নজদ ও হিজাযে যেসকল লোকের বসবাস ছিল তাদের প্রত্যেকে নির্দিষ্টরূপে তাদেরকে যে বিষয়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল তার মর্ম কোনো সন্দেহ সংশয় ব্যতিরেকে বুঝতে পেরেছিল এবং ‘ইলাহ’ ও ‘রব’ শব্দের বিস্তৃত অর্থ ও তাওহিদ (একত্ববাদ) সম্পর্কে তাদের পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান ছিল। মোটকথা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর সাক্ষ্যদানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা পরিপূর্ণরূপে অবগত ছিল। বক্তার উদ্দেশ্য যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমরা বলবো, এ কথার বিশুদ্ধতা প্রমাণের জন্য দলিল পেশ করতে হবে। এ কথার বিশুদ্ধতার জন্য এ দাবিই যথেষ্ট নয় যে, আরবি ভাষাভাষীদের মধ্যে তৎকালে ‘ইলাহ’ ও ‘রব’ শব্দদ্বয়ের অর্থসমূহ বহুল প্রচলিত ছিল। তার কারণ হলো :
এক. এ শব্দগুলো বহুল প্রচলিত ছিল। এ কথার অর্থ হলো, অধিকাংশ লোকই এগুলোর অর্থ সম্পর্কে পরিচিত ছিল। তবে এ কথা নিশ্চিতরূপে বলার সুযোগ নেই যে, নির্দিষ্টরূপে প্রত্যেক ব্যক্তি শব্দগুলোর অর্থ সম্পর্কে পরিচিত ছিল। নতুবা কে আছে এমন যে, তাদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে গণনা করে রেখেছে যে, পৃথক পৃথক রূপে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যাপারে সুনিশ্চিতভাবে বলতে পারে যে, তার এ সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি ছিল এবং এসব শদ্বের অর্থ সম্পর্কে তাদের ভুল করা বা অবগতি না থাকা অসম্ভব…?
দুই. নজদ, হিজায প্রভৃতি অঞ্চলে যাদের বসবাস ছিল তাদের সকলেই বিশুদ্ধ আরব ছিল না এবং তাদের প্রত্যেকেই আরবদের ন্যায় আরবি ভাষা জানতো না; রবং নিশ্চিতরূপে তাদের মধ্যে বহু সংখ্যক অনারব ও আযাদকৃত ক্রীতদাসের বসবাস ছিল, যাদেরকে বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতি—গোষ্ঠী থেকে আমদানি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেক ভিনদেশী অনারব স্বাধীন লোকও বসবাস করতো। কাজেই তাদের ব্যাপারে এ কথা যথার্থ হবে না যে, তারা আরবি ভাষাভাষীদের মতই এসব শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ রূপে জানতো। রবং আমরা ইতিহাসে এমন অনেক সাহাবির নাম খুঁজে পাই যারা ছিলেন রোম, পারস্য ও ইথিওপিয়ান বংশোদ্ভূত। কুরআনে কারিমেও এ রকম ভিনদেশীদের ব্যাপারে ইঙ্গি করা হয়েছে :
لِسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُبِينٌ.
যার দিকে তারা ইঙ্গিত করছে তার ভাষা হচ্ছে অনারবি, অথচ এটা হচ্ছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষা। (সূরা নাহল : ১০৩)
রাসূল সা.—এর দাওয়াতের লক্ষ্য ছিল, ধর্ম,জাতি, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ। রাসূল সা. যে কেউ কালিমার সাক্ষ্য প্রদান করেছে কোনো পার্থক্য ব্যতিরেকে তার ইসলাম গ্রহণ করেছেন। উল্লেখিত দাবিটি অমূলক ও দলিল বিহীন হওয়ার জন্য এ বিষয়টিই যথেষ্ট। এছাড়াও এর বিপরীতে আমরা আরেকটি হাদিস পেশ করেছি যেখানে রাসূল সা. একজন মুসলিম ব্যক্তিকে ইবাদতের অর্থ শিখিয়েছেন, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয়, বহু লোকই এসব শব্দের অর্থ সম্বন্ধে অনবহিত ছিল। তা সত্ত্বেও নবী সা. তাওহিদের কতক অর্থ ও কালিমা সাক্ষ্যদানের ভিত্তিতে তাদেরকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করেছেন।
ইমাম শাতেবি তার ‘আল—ইতিসাম’ নামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন, আবু ওয়াকেদ আল—লাইসি রা. থেকে একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমরা একবার রাসূলুল্লাহ সা.—এর সাথে খায়বার পানে যাত্রা করলাম, যখন আমরা ছিলাম নওমুসলিম। পথিমধ্যে আমরা একটি কুলবৃক্ষ দেখতে পেলাম, যার আশপাশে মুশরিকরা অবস্থান করতো এবং তাতে তাদের অস্ত্র—সস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। এটি ‘যাতু আনওয়াত’ নামে পরিচিত ছিল। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্যও ‘যাতু আনওয়াত’ এর ব্যবস্থা করে দিন, যেমন তাদের ‘যাতু আনওয়াত’ রয়েছে। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহু আকবার! তোমাদের কথা তো বনি ইসরাঈলের কথার মত, যারা বলেছিলো, ‘আমাদের জন্য ইলাহ নির্ধারণ করে দিন, যেমন তাদের অনেক ইলাহ রয়েছে।’ নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করবে, বিঘত—বিঘত ও হাত—হাত করে। এমনকি তারা যদি দব্ব (গুইসাপ জাতীয় প্রাণী) এর গর্তে প্রবেশ করে তাহলে এক্ষেত্রেও তোমরা তাদের অনুসরণ করবে। আমরা প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কথা বলছেন? রাসূল সা. বললেন, তারা নয় তো আর কারা? (আল—ইতিসাম, খ. ১, পৃ. ৪৫)
হাফেয ইবনে কাছির (তাফসিরে ইবনে কাছির, পৃ. ১৪৩), ইমাম কুরতুবি (খ. ৭, পৃ. ২৭৩) ও ইবনে হাযম (জামেউস সিয়ার, পৃ. ২৩৮) বিভিন্ন সূত্রে এ সম্পর্কিত অনেক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
অতএব, এসকল লোক যারা তাদের রাসূলের কাছে দাবি করেছে যে, ‘তাদের জন্যও যেন আল্লাহ তাআলা ছাড়াও ইলাহ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়’ তাদের ব্যাপারে কি এ কথা বলা যথার্থ হবে যে, যখন তারা ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি ব্যতীত কোনো রব নেই’ এ কথার সাক্ষ্য দিয়েছিল তখন তারা তাদেরকে যে বিষয়ের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল তার আদ্যোপান্ত অনুধাবন করেছিল? তারা কোনো প্রকার সংশয় ও অস্পষ্টতা ছাড়াই বুঝতে পেরেছিল যে, বক্তা তাদেরকে কি বুঝাতে চেয়েছে? তাদের প্রতি কোন বিষয়কে নাকচ করেছে? তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্যাবলি কেবলই তার সাথে নির্দিষ্ট। তিনি ব্যতীত আর কারও সাথে সেগুলো যুক্ত হতে পারে না।! ফলে তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার সমীপে আত্মসমর্পণ করেছিল!!?
ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, হযরত আদি ইবনে হাতেম রা. ইবাদত শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ফলে রাসূলুল্লাহ সা. তাঁকে এর সঠিক মর্ম বুঝিয়ে দেন।
‘কালিমার অর্থ না বুঝে তার সাক্ষ্য দিলে ইসলাম গৃহীত হবে না’ এর দাবির খণ্ডন
এখন আমরা ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলবো, যিনি বলেন, বর্তমানকালে কেউ কালিমার সাক্ষ্য দিলেই মুসলিম হবে না। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, “নবীজি সা.—এর নবুওয়াতকালে কালিমার যে অর্থ ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল পরবর্তর্ীকালে তা পরিবর্তিত হয়ে যায় এর প্রকৃত অর্থ বিলুপ্ত হয়ে যায়।” তার এ দাবির বিপরীতে আমরা বলবো, আমরা পূর্বে আপনার দলিলকে খণ্ডন করেছি এবং এ কথা প্রমাণ করেছি যে, কালিমার অর্থ এখনও পর্যন্ত মানুষের মধ্যে পরিচিত ও প্রচলিত। বরং বলা যায়, কুরআন নাযিলের পূর্বে তার যে অর্থ বিস্তৃত ছিল বর্তমান সময়ে তার বিস্তৃতি পূর্বের চেয়ে আরও বেশি এবং তার অর্থও অধিক স্পষ্ট।
তাছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতের অর্থের বিস্তৃতি এবং তাদের মধ্য হতে কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’—এর সাক্ষ্য দিলে তা গৃহীত হবে এবং তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবেÑ এ দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে বলে শরিয়তে কোনো প্রমাণ নেই। কাজেই উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতের অর্থের বিস্তৃতি থাকতে হবে, এ শর্তটি শরিয়তে এমন বাড়তি সংযোজন যার ওপর কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল থেকে দলিল—প্রমাণ ছাড়া তা গৃহীত হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা.—এর পবিত্র কথা ও কাজই সেই নবউদ্ভূত বাড়তি সংযোজনের বিপক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ।
আমরা হাদিস শরিফে দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ সা. স্বদেশী আরব, বহিরাগত আরব, স্থানীয় ক্রীতদাস, বর্হিদেশ থেকে আমদানিকৃত ক্রীতদাস, হীরাবাসী ও ইয়েমেনবাসী, রাসূলুল্লাহ সা.—এর জীবদ্দশায় যাদের দেশ জয় হয়েছে, রাসূল সা. তাদের সকলের ইসলামকে গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি এমন কোনো বিধান জারি করেননি যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেক ব্যক্তি ইসলামের ঘোষণাকালে কালিমার সাক্ষ্যদানের দ্বারা নির্দিষ্ট কোনো অর্থ বুঝেছে কি না, সে বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। অথবা তাদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কোনো অর্থ প্রচলিত ছিল, এমনও কোনো নির্দেশনা নেই। বরং বিপরীতে আমরা দেখিÑ রাসূল সা.—এর সামনে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, কতক আরব কিছু শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে অনবহিত ছিল, যেমনটি হযরত আদি ইবনে হাতেমের ঘটনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়। এমনকি রাসূল সা. যাদের ইসলাম গ্রহণের স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এর সাক্ষ্যদানের অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে অনবহিত ছিল, যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছিÑ একদল সাহাবি নবীজি সা.—এর কাছে আবেদন করেছিলÑ আমাদের জন্য ‘যাতু আনওয়াত’ এর ব্যবস্থা করুন, যেমন তাদের ‘যাতু আনওয়াত’ রয়েছে।
সুতরাং রাসূল সা.—এর কাজের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, যারা কালিমার সাক্ষ্যদান করবে তাদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান প্রয়োগের জন্য কতটুকু জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সেই সাথে এ বিষয়টিও প্রমাণিত হয় যে, কোনো ব্যক্তি উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত, ইবাদত, দীন, কালিমার সাক্ষ্যদানের মর্ম, এছাড়াও অন্যান্য শরয়ি বিধান সম্পর্কে অনবহিত থাকলে এতে তার ইসলামের কোনো ক্ষতি হবে না এবং এটা তার ইসলামের স্বীকৃতিদানের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক হবে না। সেই সাথে অন্য সকল মুসলিমের ন্যায় তার ওপরও শরয়ি বিধানসমূহ যথারীতি প্রয়োগ হবে।
এ দলিলটি আমাদের কাছে একটি বিশাল দলের অবিচ্ছিন্ন সূত্রে বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, যা তাওয়াতুর এর একটি শক্তিশালী প্রকার এবং কোনো খবরের বিশুদ্ধতা প্রমাণ এবং নিশ্চিত জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে অন্যতম মজবুত ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয়। তাছাড়া রাসূল সা. এ ব্যাপারে মোটেও অনবহিত ছিলেন না যে, তাঁকে আরব, অনারব নির্বিশেষে সকলের প্রতি লক্ষ্য করে প্রেরণ করা হয়েছে এবং তিনিই এ কথা ঘোষণা করেছেন যে,
أُمرتُ أن أُقَاتِلُ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِه …
আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এভং আমার পৃতি ও আমার আনীত দীনের প্রতি ঈমান আনয়ন করে…। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
এ হাদিসে মানুষ শব্দটি ব্যাপক। এখানে আরব—অনারব, আরবিভাষী বা আরবিভাষী নয়, এ রকম কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এটিই আল্লাহর বিধান, রাসূল সা. যার ঘোষণা করেছেন এবং স্বীয় কাজের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। যদি কালিমার সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে আরব ও অনারবদের বিধানে কোনো পার্থক্য থাকতো, কিংবা আরবের আরবিভাষী ও অনারব আরবিভাষীদের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য থাকতো যার ভিত্তিতে তাদের ইসলামের স্বীকৃতি দানের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা আসতো তাহলে নিঃসন্দেহে রাসূল সা. তা বর্ণনা করতেন। রাসূল সা.—এর পক্ষে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের বর্ণনা ও তার প্রয়োগ থেকে উদাসীন থাকার কল্পনা করা অসম্ভব। কারণ, আল্লাহ তাআল বলেছেন,
{وَمَا بَيْنَ ذَلِكَ وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا}
আপনার প্রতিপালক বিস্মৃত হওয়ার নন। (সূরা মারয়াম : ৬৪)
যে ব্যক্তি এ পার্থক্য ও বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি অতিরিক্ত শর্ত সংযোজন করলো সে স্পষ্টত রাসূল সা.—এর হাদিস এবং তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত নিশ্চিত বিশ্বাস ও শরিয়াহর অবিসংবাদিত বিষয়ের বিরোধিতা করলো। উপরন্তু আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর বাইরে দীনের মধ্যে নবআবিষ্কারের মাধ্যমে এক নতুন শরিয়াহ আবিষ্কার করলো, যে ব্যাপারে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল থেকে কোনো দলিল—প্রমাণ নেই।
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িগণের যুগে মুসলিমগণ সিরিয়া, পারস্য, ইরাক, মিসর ও বার্বারদের দেশ উত্তর আফ্রিকা, সুদান, আন্দালুস, তুরস্ক, বলকান ও হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল ও বহু দেশ জয় করেন। তখন এ সকল অঞ্চলের লোকেরা আরবি ভাষা জানতো না। একদিকে সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িগণের সর্বসম্মতিক্রমে Ñযা বহু লোকের অবিচ্ছিন্ন বর্ণনা সূত্রে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছেÑ শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এ কথার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই তাদের ইসলাম গৃহীত হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা লাভা করেছে এবং তাদের ওপর ইসলামি শরিয়াহর বিধান আরোপিত হয়েছে। এরপর তারা ধীরে ধীরে শরিয়াহর বিধান শিক্ষা লাভ করেছে। তখন কেউ এমন বলেননি যে, তাদের এ সাক্ষ্য গৃহীত হবে না, যতক্ষণ না তাদের সাক্ষ্য ও ইখলাসের ঘোষণার সাথে বাড়তি শর্তটি পাওয়া যাবে।
তাছাড়া যুক্তিও এ কথাকে সমর্থন করে না যে, উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত শব্দদ্বয়ের অর্থ জাহেলি যুগের আরব সমাজে যেমন প্রচলিত ছিল, আরবি ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ উল্লেখিত লোকদের মধ্যে আমাদের বর্তমান কালের চেয়েও আরও বেশি প্রচলিত ছিল।
আমলের শর্তারোপের দাবি খণ্ডন
এখন আমরা ঐ ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে বলবো, যিনি কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য কালিমার সাক্ষ্যদানের সাথে আমলের শর্তারোপ করেছেন। তার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা দ্বারা এ দাবির ভ্রান্তি প্রমাণিত হয়ে যায়। কেননা আমরা এ বিষয়ে অকাট্য দলিল পেশ করেছি যে, আল্লাহ তাআলার বিধান হলো, কোনো ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যদানের সাথে সাথেই মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি কালিমার সাক্ষ্যদান কালেই তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা আমাদের জন্য আবশ্যক হয়ে যায় এবং তার জীবন ও সম্পদের ওপর হস্তক্ষেপ করাও হারাম হয়ে যায়।
অতএব, এ শর্ত কোত্থেকে আমদানি হলো যে, কোনো ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণের স্বীকিৃতর জন্য তার কালিমার সাক্ষ্যদানের সাথে সাথে কাজের মাধ্যমে তাকে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে…!?
বরং এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই, হযরত আবু তালেব মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন আর রাসূল সা. তার পাশে বসে বারবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ পাঠ করার অনুরোধ করছিলেন, যাতে করে নবীজি সা. আল্লাহর তাআলার নিকট তার মুসলিম হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষী হতে পারেন। (সহিহ বুখারি, খ. ২, পৃ. ১১৯; সহিহ মুসলিম, খ. ১১, পৃ. ২১০)
অতএব, যদি শুধু কালিমা পাঠের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কুফরের সীমানা থেকে বেরিয়ে ইসলামে প্রবেশ করতো তাহলে এ সাক্ষ্য দানের তাৎপর্য ও মূল্য কী? আর কেনই বা রাসূল সা. আপন চাচাকে এ সাক্ষ্য দিতে বললেন…?
আর এ ক্ষেত্রে যে হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করা হয় যে,
ليس الإيمان بالتمنِّي، ولكن ما وقَر في القلب وصدّقه العمل
ঈমান শুধু আশা—আকাক্সক্ষার নাম নয়। বরং ঈমান হচ্ছে ঐ বিষয় যা অন্তরে বদ্ধমূল হয় এবং কাজে বাস্তবায়িত হয়।
এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, আমাদের হাতে যে হাদিসের বড় বড় কিতাব রয়েছে তাতে আমরা এ হাদিস খুঁজে পাইনি। এমনকি ফিকহের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে, যেখানে কুফর ও ঈমানের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, যেদিকে আমরাও ইঙ্গিত করেছি, সেখানে এ হাদিসে উল্লেখ নেই। বরং ইমাম ইবনে তাইমিয়া এবং গাযালি র. ‘ইহইয়াউল উলূম’ কিতাবে এবং কুরতুবি র.—ও উল্লেখ করেছেন যে, এটি মূলত হযরত হাসান বসরি র. অথবা আলী ইবনে আবি তালেব রা.—এর বাণী। কাজেই এর দ্বারা দলিল গ্রহণ বিশুদ্ধ নয়। আর যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, রাসূল সা.—এর দিকে এ বাণীর সম্পৃক্তকরণ বিশুদ্ধ, তবুও আমরা বলবো, রাসূল সা. কালিমার সাক্ষ্যদানকেও আমল বলে অভিহিত করেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলুল্লাহ সা.—কে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল সর্বোত্তম? নবীজি সা. বললেন, إِيمَانٌ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ (আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনয়ন), আবার প্রশ্ন করা হলো, এরপর কী? নবীজি সা. বললেন, الجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ (আল্লাহর পথে জিহাদ করা)। আবার প্রশ্ন করা হলো, এরপর কী? নবীজি সা. বললেন, حَجٌّ مَبْرُورٌ (কবুল হজ্জ)। (সহিহ বুখারি : ২৬, ১৫১৯)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আব্দুল কায়েসের একটি প্রতিনিধিদল নবীজি সা.—এর কাছে এসে বললো, যার ভাবার্থ হলো, মদিনা থেকে অনেক দূরে তাদের বসবাস। ফলে তারা হারাম মাস ব্যতীত অন্য সময় নবীজি সা.—এর কাছে এসে উপস্থিত হতে পারে না। তারা বললো, আমাদেরকে এমন কোনো কাজের আদেশ করুন, আমাদের অনুপস্থিত লোকদেরকে আমারা যার সংবাদ প্রদান করবো এবং এর মাধ্যমে আমরা জান্নাতে প্রবেশ করবো। তখন নবীজি সা. তাদেরকে চারটি কাজের আদেশ করলেন এবং চারটি কাজ থেকে নিষেধ করলেন।
সর্বপ্রথম তাদেরকে যে কাজের আদেশ করলেন তা হলো, এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন, এরপর নবী সা. বললেন, তোমরা জান কী, এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ কী? তারা বললো, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। নবীজি সা. বললেন, তা হলো, এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। (সহিহ বুখারি, খ. ১, পৃ. ৩২,১৩৯)
সুতরাং রাসূল সা. আমাদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমানের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন যে, তা হলো, এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। এমনিভাবে রাসূল সা. মুখে কালিমার সাক্ষ্যদানকেও আমল বলে অভিহিত করেছেন।
সুতরাং এ সম্পর্কিত হাদিসসমূহের আলোকে সমষ্টিগতভাবে এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি খাঁটি মনে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল, তাহলে সে এমন একটি কাজ সম্পাদন করলো, যা তার অন্তরের বন্ধমূল বিশ্বাসকে সত্যায়ন করে, আর আল্লাহ তাআলার বিধান হলো, এ কাজের মাধ্যমেই সে মুমিন ও মুসলিম বলে গণ্য হবে।
ইখলাস হলো, অন্তর ও আত্মার বিষয়, যে সম্পর্কে সকল গোপন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত মহান সত্তা ছাড়া আর কেউ অবগত হতে পারে না। আমাদের জন্য মানুষের মুখের বক্তব্য অনুযায়ী আচরণ করা ছাড়া অন্য কিছু সম্ভব নয়। হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. রাসূলুল্লাহ সা.—কে জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু নামাযি ব্যক্তি এমন আছে, যাদের কথার সাথে অন্তরের মিল নেই। তখন রাসূল সা. বললেন, আমি মানুষের অন্তর অনুসন্ধান করতে বা তাদের পেট বিদীর্ণ করতে আদিষ্ট হয়নি। (সহিহ মুসিলম : খ. ১১, পৃ. ২২০)
যেকোনো ব্যক্তিকে কালিমার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমেই, তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করতে হবে। এর সাথে এ বিষয়ের কোনো বিতর্ক নেই যে, কোনো ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে মুসলিম হওয়ার পর তাকে অন্যান্য ফযর বিধান পালন করতে হয়। অবশ্য এগুলোও ঈমানেরই অংশ। যেমনÑ নামায আদায় করা, যাকাত, প্রদান করা। সাওম ও হজ্জ পালন করা, জিহাদ করা, আল্লাহর পথে দাওয়াত প্রদান করা…. ইত্যাদি।
নেক কাজ করার দ্বারা ঈমান বৃদ্ধি পায়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا.
আর যাতে মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায়। (সূরা মুদ্দাসসির : ৩১)
وَيَزِيدُ اللَّهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى.
আর যারা সঠিক পথে চলে আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করেন। (সূরা মারয়াম : ৭৬)
وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا
এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। (সূরা আহযাব : ২২)
فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ.
অতএব, যারা মুমিন নিশ্চয় তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা আনন্দিত হয়। (সূরা তাওবা : ১২৪)
الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، وَالحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ
ঈমানের ষাটের অধিক শাখা রয়েছে। আর লজ্জা হচ্ছে ঈমানের একটি অন্যতম শাখা। (সহিহ বুখারি : ৯)
এরপরও যদি কেউ আমাদের দাবি মানতে না চায় তাহলে তার উদ্দেশ্যে আমরা বলবো, আমাদের সেই নির্দিষ্ট আমলটির কথা বলে দিন, যাকে আপনি কালিমা পাঠকারীর সত্যতার প্রমাণ বলে মনে করেন, যার ভিত্তিতে আমরা তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করতে পারি এবং আমাদেরকে সেই আমলটির বিবরণ ও তার পরিমাণ চিহ্নিত করে দিন…!!
আপনার পক্ষে তা কখনও সম্ভব হবে না। তবে যদি আপনি নিজের তরফ থেকে কোনো শরিয়াহর আবিষ্কার করেন, আল্লাহ তাআলা যার অনুমতি দেননি, আর আপনি এ অবস্থাকে ভয় করুন। কেননা যদি এমনটি করেনই তাহলে এমন কাজে প্রবৃত্ত হবেন যা থেকে আপনি নিজেই নিষেধ করেন, আর তখন আপনি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত ফয়সালা করতে বাধ্য হবেন। অথচ আপনার দাওয়াতের শ্লোগান হলো, لا حكم إلا لله (আল্লাহ ছাড়া আর কারও বিধান চলবে না)।
যদি কোনো ব্যক্তি এ প্রশ্ন করে যে, বর্তমানে মানুষের জীবনাচার কাযত একথা প্রমাণ করে যে, তারা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে শরিয়া বিরোধী নীতি ও আদর্শের অনুসরণ করছে। এর জবাবে আমরা বলবো, হাঁ, সত্য বলেছেন। এ রকম লোকের সংখ্যা প্রচুর এবং এর মাধ্যমে তারা আল্লাহ তাআলার নির্দেশাবলি অমান্য করছে।
কিন্তু যে ব্যক্তি এ অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলবে যে, মানুষের ঈমান—আকিদা নষ্ট হয়ে গেছে এবং তারা ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গেছে, তার উদ্দেশ্য আমরা বলবো, জনমানুষের ওপর ব্যাপকভাবে এ বিধান আরোপ করে আপনিই আল্লাহর বিধান অমান্য করেছেন। আর মানুষের আকিদা নষ্ট হওয়ার ভিত্তিতে তাদেরকে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার পক্ষে আপনার দলিলটি কেবল ধারণাপ্রসূত, যা কখনও অকাট্য ও নিশ্চিত প্রমাণের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
নিশ্চয় সত্যের বিপরীতে ধারণা কোনো কার্যকারিতা রাখে না। (সূরা ইউনুস : ৩৬)
নবীজি সা. বলেছেন,
إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ، فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الحَدِيثِ
তোমরা ধারণা থেকে বিরত থাক। কেননা ধারণা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। (সহিহ বুখারি : ৫১৪৩)
তবে হাঁ, কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে যদি নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, সে এমন কাজ করেছে বা এমন কথা বলেছে যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে কুফরের দিকে নিয়ে যায় তাহলে তাকে কাফের বলা হবে।
মানুষের প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হওয়া কিংবা তাদের বাহ্যিক অবস্থার কারণে আল্লাহর শরিয়তে আপনাকে এ অনুমতি দেওয়া হয়নি যে, আপনি মানুষদেরকে ব্যাপকভাবে ইসলাম থেকে বের করে কুফরের দিকে নিয়ে যাবেন, অথবা এ সিদ্ধান্ত দিবেন যে, কালিমার সাক্ষ্যদান সত্ত্বেও তারা ইসলামে প্রবেশ করেনি।
আমরা এমন কথা বলি না যে, কোনো ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যদান করার পর যাই করুক বা যাই বলুক তাকে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা কখনও এমন কথাও বলি না যে, মুসলিম ব্যক্তি তার কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে কুফরের দিকে ফিরে যেতে পারে না।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলাপ্রদত্ত শরিয়াহ কিছু কথা ও কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যা বললে বা করলে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বের হয়ে কুফরের দিকে ফিরে যায়।
আমাদে বক্তব্য হলো, আল্লাহ তাআলা যেসকল কথা ও কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং রাসূল সা. স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাতে আমাদের পক্ষ থেকে সংযোজন বা বিয়োজন করার কোনো অধিকার নেই।
যেমন আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তে আমাদেরকে এ অধিকার দেওয়া হয়নি যে, যখন কোনো মানবসমাজে ঐ সকল কথা ও কাজ ছড়িয়ে পড়বে তখন ব্যাপকভাবে তাদের সকলকে আমরা ইসলাম থেকে বের করে দেব, অথচ তখনও ইসলামের প্রতীকী বিধান তথা আযান, নামায রোযা ও হজ্জ ইত্যাদি বিধানগুলো তাদের মধ্যে প্রকাশ্যভাবে পালিত হয়।
এমনিভাবে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে নিশ্চিতরূপে না জেনে এ ধারণা করারও কোনো অবকাশ নেই যে, হয়তো সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে! বরং সে বাহ্যত মুসলিম হিসেবে বিবেচিত হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না শরিয়াহর নির্ভরযোগ্য দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হবে যে, সে এমন কথা বলেছে বা এমন কাজ করেছে, যার দ্বারা সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে কুফরের দিকে ফিরে গেছে।
সুতরাং ঐ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি যদি ঘোষণা করে, حي على الصلاة (নামাযের দিকে এসো) এবং আমরা সঠিকরূপে জানতে না পারি যে, সে অব্যাহত এমন কথা বলে বা এমন কাজ করে যার দ্বারা সে নিশ্চিতরূপে ইসলাম থেকে বেরিয়ে কুফরের দিকে ফিরে যায়Ñ তখন আমাদের জন্য এ কথা বলা জায়েয হবে না যে, ‘তার আহ্বানটি বাতিল এবং সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া আমাদের ওপর আবশ্যক নয়।’
সুতরাং বাহ্যত মুসলিম কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের নামাযে ইমামত করে তাহলে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমাদের জন্য জামাআত থেকে দূরে সরে থাকা ঠিক হবে না যে, এ ইমাম হয়তো এমন কথার প্রবক্তা বা এমন কাজের সাথে জড়িত যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়।
যদি শুধু ধারণার ভিত্তিতে শরিয়াহর বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বৈধতা থাকতো তাহলে অধিকাংশ ফরয বিধান পালন করা আমাদের জন্য জায়েয হতো না, এমনকি রাসূলুল্লাহ সা. এবং যাদের জন্য নবীজি জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তারা ব্যতীত আর কারও পিছনে Ñসে যেই হোক না কোনÑ জানাযার নামায আদায় করা আমাদের জন্য জায়েয হতো ন। কেননা সকল মানুষের প্রতিটি কথা ও কাজকে আয়ত্ত করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ আমাদের সামনে প্রকাশ্যে অনেক কাজ করে, যা ইসলামি শরিয়ার অনুকূল, তবে আমরা নিশ্চিত যে, তার অনেক কথা ও কাজ আমাদের দৃষ্টির অগোচরে গোপনই থেকে যায়। সেই গোপন বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা নিশ্চিতরূপে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবো না। এমনকি তার প্রকাশ্য কথা ও কাজগুলোর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যেহেতু এ সিদ্ধান্তের ভিত্তি হলো, ব্যক্তির বিশুদ্ধ নিয়ত ও অন্তরের পরিশুদ্ধি সম্পর্কে জানা। অর্থাৎ, সে তার কথা ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির ইচ্ছা করেছে কি না! আর বিষয়টি নিশ্চিতরূপে জানা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
ইতঃপূর্বে আমরা কিছু হাদিস উল্লেখ করেছি, যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, আমরা প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার বাহ্যিক কথা ও কাজ অনুযায়ী আচরণ করতে আদিষ্ট।
কবিরা গোনাহ ও কুফর
যদি কোনো ব্যক্তি এ কথা বলে যে, কবিরা গোনাহ হলো পাপাচার। আর পাপাচারের মাধ্যমে মানুষ ব্যাপকভাবে কাফের হয়ে যায়, তাহলে ঐ ব্যক্তির কথার জবাবে আমরা বলবো, আপনার সাথে বিতর্ক করার কোনো প্রয়োজন আমরা মনে করি না। কেননা আপনি তো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অন্তভুর্ক্ত নন। কারণ, আমরা শুরু থেকে জানি যে, ইতঃপূর্বে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত হতে বহির্ভুত একটি দলই এমন কথা বলেছিল।
আমরা আমাদের মিশনের শুরু থেকে ঘোষণা করেছি যে, আমরা কোনো মুসলিমকে গোনাহের কারণে কাফের সাব্যস্ত করি না। তবে আমরা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের উপকারার্থে আল্লাহর সাহায্যে বলছি যে, যারা গোনাহর কারণে কাফের সাব্যস্ত করে তাদের দলিলের সারকথা হলো,
১. নিশ্চয় ইবলিস (আল্লাহ আমাদেরকে তার থেকে হেফাযত করুন) মহান আল্লাহকে অস্বীকার করেনি। বরং সে আল্লাহ তাআলার আদেশ অমান্য করেছে এবং নাফরমানির ওপর অবিচল থেকেছে। একারণে আল্লাহ তাকে কাফের আখ্যা দিয়েছেন।
২. আল্লাহ তাঅলা বলেন,
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا.
কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি হলো জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন। (সূরা নিসা : ৯৩)
সুতরাং যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করলো সে আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করছে না; বরং সে একটি কবিরা গোনাহে লিপ্ত হয়েছে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে চিরস্থায়ী জাহান্নামি হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
৩. এক হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
لَا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلَا يَنْتَهِبُ نُهْبَةً يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ.
যখনই কোনো ব্যক্তি যিনায় (ব্যভিচার) লিপ্ত হয়, সেই যিনাকালীন সময়ে সে ঈমানহারা হয়ে যায়। যখনই কোনো চোর চুরি করে, চুরিকালীন সময়ে সে ঈমানহারা হয়ে যায়। যখনই কোনো ব্যক্তি মদপান করে, মদপানরত অবস্থায় সে ঈমানহারা হয়ে যায়। যখনই কোনো ব্যক্তি অন্যের সম্পদ লুট করে, যেকারণে মানুষ তার দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকে সেই লুটতরাজ অবস্থায় সে ঈমানহারা হয়ে যায়। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৯৩৬; সহিহ মুসলিম : ১০০)
এছাড়াও হযরত আবু হুরায়রা, আয়িশা ও ইবনে আব্বাস রা. প্রমুখ সাহাবি থেকে এ সম্পর্কিত আরও অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.—এর পবিত্র হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, যিনাকারী, চোর, মদপানকারী ছিনতাইকারী থেকে ঈমান উঠে যায়, আর যার থেকে ঈমান উঠে যায় সে কাফের হয়ে যায়।
প্রথম দলিলের জবাব হলো, ইবলিস (আল্লাহ তার প্রতি লানত করুন) আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করেনি। কারণ, সে আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তের যথার্থতার বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলা তার প্রতি যে আদম (আ.)—কে সিজদা করার আদেশ দিয়েছিলেন, সে তার ওপর আপত্তি করেছে। সে বলেছিল,
أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ.
আমি তার (আদম) থেকে শ্রেষ্ঠ। আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। (সূরা আরাফ : ১২)
قَالَ لَمْ أَكُنْ لِأَسْجُدَ لِبَشَرٍ خَلَقْتَهُ مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ.
সে বললো, আমি এমন নই যে, একজন মানুষকে সিজদা করবো, যাকে আপনি সৃষ্টি করেছেন শুকনো ঠনঠনে কালচে মাটি থেকে। (সূরা হিজর : ৩৩)
সুতরাং এ অভিশপ্ত ইবলিস আল্লাহ তাআলা তাকে যে আদম (আ.) কে সিজদার আদেশ দিয়েছিলেন তাতে দোষ খুঁজেছে এবং আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রতিপন্ন করেছে। এর মাধ্যমে সে মূলত আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তের যথার্থতাকে অস্বীকার করেছ। আর আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তকে ভুল মনে করার অর্থ হলো, মহান রবের পরিপূর্ণ গুণাবলিকে অস্বীকার করা এবং নিজেকে তার সমকক্ষ দাবি করা যে, সে তার ইচ্ছামত মহান রবের হুকুমসমূহকে সঠিক বলে মতামত দিতে পারে, কিংবা তাকে ভুল প্রতিপন্ন করতে পারে। আর এটিই হলো পরিপূর্ণ শিরক।
বিপরীতে হযরত আদম (আ.) আল্লাহর তাআলার হুকুমের যথার্থতা যাচাইয়ে বিতর্কে লিপ্ত হননি। বরং তিনি দ্রুত নিজের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন এ বলে যে,
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ.
হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদেরকে দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভুর্ক্ত হবো। (সূরা আরাফ : ২৩)
এটিই হলো, ঐ দুই ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্য, যাদের একজন ভুল করে নিজের অপরাধ স্বীকার করে এবং রবের আদেশ মান্য করে, আর অপরজন আল্লাহ তাআলা নির্দেশের বিরোধিতাকে নিজের জন্য বৈধ জ্ঞান করে।
মুসলিমদের মধ্যে এবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, যে ব্যক্তি গোনাহসমূহকে হালাল মনে করে সে মূলত আল্লাহর আদেশকে অস্বীকার করে এবং এর দ্বারা সে নিশ্চিতরূপে কাফের ও মুশরিক সাব্যস্ত হয়।
আল্লাহ তাআলার পবিত্র বাণী থেকেও এ কথাই প্রতীয়মান হয় :
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ.
আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যা ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি এবং নিশ্চয় তা গর্হিত। শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে প্ররোচনা দেয়, যাতে তারা তোমাদের সাথে বিবাদ করে, আর যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই মুশরিক। (সূরা আনআম : ১২১)
সুতরাং যে কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুমের যথার্থতা নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হবে সে—ই কাফের ও মুশরিক বলে গণ্য হবে। আর আলোচ্য প্রবক্তার দলিলের আরেকটি জবাব হলো,‘ অন্যায়ভাবে ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করলে হত্যাকারী চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে’ এর দ্বারা দলিল প্রদান সঠিক নয়। তার কারণ হলো :
১. উল্লেখিত আয়াতে নির্দিষ্ট অপরাধের আলোচনা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র আয়াতে এ অপরাধের শাস্তিও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কাজেই এ আয়াতটি ব্যাপক নয় এবং অন্য সকল কবিরা গোনাহের ওপর এ আয়াতটিকে প্রয়োগ করে এ কথা বলা যথার্থ হবে না যে, কোন মুসলিম কবিরা গোনাহ করলেই সে কাফের বা মুশরিক হয়ে যায়।
২. বিভিন্ন প্রকার নস (কুরআন ও হাদিসের বাণী)—এর মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করলে বোঝা যায়Ñ উল্লেখিত আয়াতে ‘চিরস্থায়ী’ শব্দটি তার ব্যাপক অর্থ তথা কাফের মুশরিকের মত চিরকাল জাহান্নামে থাকার অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। বরং এখানে এ শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
عن عبادة بن الصامت، قال: كنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم في مجلس، فقال: ্রتبايعوني على أن لا تشركوا بالله شيئا، ولا تزنوا، ولا تسرقوا، ولا تقتلوا النفس التي حرم الله إلا بالحق، فمن وفى منكم فأجره على الله، ومن أصاب شيئا من ذلك فعوقب به فهو كفارة له، ومن أصاب شيئا من ذلك فستره الله عليه، فأمره إلى الله، إن شاء عفا عنه، وإن شاء عذبه.
হযরত উবাদা ইবনুস সামেত রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, যেমন নারীদের থেকেও অঙ্গীকার নিয়েছেন। সেই অঙ্গীকারের বিষয়গুলো হলো, আমরা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরিক করবো না, চুরি করবো না, যিনা (ব্যভিচার) করবো না, আমাদের সন্তানদের হত্যা করবো না, পরস্পরে একে অপরের প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করবো না। নবীজি সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ এ অঙ্গীকার পূর্ণ করবে তার প্রতিদান সে আল্লাহর নিকট পাবে, আর তোমাদের মধ্য থেকে কোনো ব্যক্তি যদি হদ্দ (তথা নির্ধারিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ) —এ লিপ্ত হয় এবং তার ওপর সেই অপরাধের শাস্তি প্রয়োগ করা তাহলে এটিই তার অপরাদের কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর আল্লাহ যার অপরাধকে গোপন রেখেছেন তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ হবে। তিনি চাইলে ঐ ব্যক্তিকে শাস্তি দিবেন, অথবা তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। (সহিহ মুসলিম : ১৭০৯)
ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন, হযরত উবাদা ইবনুস সামেত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সা. এর সাথে বসে ছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার কাছে এ কথার বায়আত কর যে, তোমরা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, আল্লাহ যাকে হারাম করেছেন তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে না। তোমাদের মধ্য হতে যে কেউ এ অঙ্গীকার পূরণ করবে তার প্রতিদান আল্লাহর নিকট জমা থাকবে। আর যে উল্লেখিত অপরাধসমূহের কোনো একটিতে লিপ্ত হবে এবং এর জন্য যে সাজাপ্রাপ্তও হবে তাহলে এ সাজাই তার জন্য কাফফারা হয়ে যাবে। আর যে বক্তি কোনো অপরাধে লিপ্ত হলো, অতঃপর আল্লাহ তার অপরাধ গোপন করলেন তাহলে তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ হবে। তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন, অথবা তাকে শাস্তি প্রদান করবেন। (সহিহ মুসলিম : ১৭০৯; বুখারি : ৭২১৩; আল—মুহাল্লাহ : খ. ১১, পৃ. ১৫১)
উল্লেখিত হাদিস দুটির নির্দেশনা একেবারে স্পষ্ট। তাতে যেসকল অন্যায় ও পাপ কাজের উল্লেখ রয়েছে তন্মধ্যে একটি হলো হত্যা করা। যদি হত্যাকারীর ওপর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হয় তাহলে এটি তার জন্য কাফফারা ও পাপ মোচনের নিয়ামক বলে বিবেচিত হবে। আর যদি তিনি সেই অপরাধটি গোপন করেন তাহলে এর সিদ্ধান্ত তার নিকট সোপর্দ হবে। তিনি চাইলে সেই অপরাধের শাস্তি দিবে, অথবা চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তাআলার এই চাওয়ার মধ্যে কোনো কাফের ও মুশরিকের ঠাঁই হবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে তাঁর ইচ্ছার পরিধি বর্ণনা করে দিয়েছেন যে, তিনি কোনো কাফের ও মুশরিককে ক্ষমা করবেন না। কাফের ও মুশরিক ছাড়া অন্যদের অপরাধ তিনি ইচ্ছা করলে ক্ষমা করে দিবেন।
আর ‘যিনাকারী, চোর, মদপানকারী, সম্পদ লুণ্ঠনকারী থেকে ঈমান উঠে যায়’ এ দলিলের জবাব হলো :
একথা সত্য যে, রাসূল সা. থেকে পরিপূর্ণ সহিহ সনদে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে, যা দ্বারা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, যিনারত অবস্থায় যিনাকারী থেকে ঈমান উঠে যায়। এমনিভাব মদপানরত অবস্থায় মদপানকারী থেকে ঈমান উঠে যায় এবং সম্পদ লুটকারী থেকে লুটতরাজ অবস্থায় ঈমান উঠে যায়; কিন্তু মুতাওয়াতির সূত্রে এ কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী, চোর, আরিয়ত (ধারকৃত বস্তু) অস্বীকারকারী, সম্পদ লুটকারী ও মদপানকারীকে উপস্থিত করা হয়; কিন্তু নবীজি সা. তাদেরকে কাফের আখ্যা দেননি এবং তাদের ওপর রিদ্দাহ বা ধর্মত্যাগের দণ্ডবিধিও প্রয়োগ করেননি। উপরন্তু হযরত উসমান রা. হতে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
لَا يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلَّا بِإِحْدَى ثَلَاثٍ: كُفْرٌ بَعْدَ إِسْلَامٍ، أَوْ زِنًا بَعْدَ إِحْصَانٍ، أَوْ قَتْلُ نَفْسٍ بِغَيْرِ نَفْسٍ.
তিনটি ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো মুসলিমের রক্তপাত ঘটানো কারও জন্য হালাল হবে না। সেই কারণগুলো হলো, ঈমান গ্রহণের পর কুফরি করা, অথবা বৈধপন্থায় বিবাহিত হওয়ার পরও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া, কিংবা হত্যার অপরাধ ছাড়াই কাউকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করা। (সুনানে আবু দাউদ : ৪৫০২)
সুতরাং আমরা নিশ্চিতরূপে একথা বিশ্বাস করি যে, উল্লেখিত হাদিসে ঈমান চলে যাওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ঐ ব্যক্তির অন্তরের বিশ্বাসও দূরীভূত হয়ে যায়। এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় এ আলোচনা থেকে যে, ঈমানের সংজ্ঞা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দু’ধরনের মত রয়েছে। একটি হলো, ঈমান হচ্ছেÑ তিন জিনিসের সমষ্টির নাম। (এক.) অন্তরের বিশ্বাস; (দুই) মুখের স্বীকারোক্তি; (তিন) ফরয ও নফলসহ যাবতীয় নেক কাজ সম্পাদন করা এবং হারাম কাজ পরিহার করে চলা।
দ্বিতীয় মতটি হলো, ঈমান হচ্ছে দুটি জিনিসের সমষ্টির নাম। (এক.) অন্তরে বিশ্বাস; (দুই) মুখের স্বীকারোক্তি। আর যাবতীয় নেক কাজ সম্পাদন ও হারাম কাজসমূহ পরিহার করে চলা হচ্ছে ঈমানের শরয়ি বিধান। এগুলো সরাসরি ঈমান নয়। আর ব্যভিচারী, চোর, মদপানকারী, সম্পদ লুটকারী, এসব লোকের কাজসমূহকে মুখের স্বীকারোক্তি বলে না। যদি তাদের কাজগুলো মুখের স্বীকারোক্তির পর্যায়ভুক্ত হতো তাহলে রাসূল সা. তাদেরকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বিবেচনা করে তাদের ওপর ধর্মত্যাগর দণ্ড প্রয়োগ করতেন।
মুসলিমদের মধ্য হতে কেউ উল্লেখিত অপরাধসমূহে লিপ্ত হলে সে ভালো করেই জানে যে, তার অন্তরের বিশ্বাস সমূলে দূরীভূত হয়নি; বরং অপরাধে জড়ানোর পরও তা পূর্বের মতই বহাল আছে। আর যে কথার দ্বারা ঈমান নষ্ট যায় সে কথাগুলোও সুনির্দিষ্ট। কাজেই এ কথার ভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যেসকল হাদিসে নির্দিষ্ট অপরাধে জড়ানোর কারণে ঈমান চলে যাওয়ার কথা এসেছে সেখানে ঈমান বলে অন্তরের বিশ্বাস উদ্দেশ্য।
সেই সাথে এ কথাও নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, এসকল অপরাধে জড়ানোর কারণে যে ঈমান চলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা অন্তরের বিশ্বাস উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, কেবল আল্লাহ তাআলার আদেশের আনুগত্য করা এবং তার বিধান মান্য করা।
তাছাড়া এ বিষয়টি যুক্তির আলোকেও প্রমাণিত। কেননা আমরা জানিÑ ব্যভিচার, হত্যা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, লুণ্ঠন, মদপান ইত্যাদি কাজের মধ্যে আল্লাহ তাআলার কোনো আনুগত্য নেই। কাজেই তা ঈমানসমর্থিত নয়। যখন এসব কাজ ঈমানসমর্থিত নয়, কাজেই এসবে প্রবৃত্ত ব্যক্তি মুমিন তথা আল্লাহর আনুগত্যশীল নয়। কেননা, সে আনুগত্যের কাজ না করে অবাধ্য হয়েছে এবং পাপাচার করেছে। (আল—মুহাল্লা, ইবনু হাযম : খ. ১১, পৃ. ১১৮—১২২)
রাসূল সা.—এর একটি হাদিসের মাধ্যমেও এ কথার সমর্থন হয়, যা হযরত উবাদা রা. থেকে বর্ণিত। সেখানে বলা হয়েছে, চোর, ব্যভিচারী ও ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে হত্যাকারীর ওপর যদি দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হয় তাহলে এটি তার জন্য কাফ্ফারা হয়ে যাবে। আর যদি আল্লাহ তাআলা তা মানুষ থেকে গোপন করে তাহলে বিষয়টি আল্লাহ তাআলার নিকট ন্যস্ত হবে। তিনি চাইলে এর জন্য শাস্তি দিবেন, অথবা চাইলে ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ তাআলার এ চাওয়ার মধ্যে কোনো কাফের মুশরিকের ঠাঁই হবে না।
এছাড়া হযরত আবু যর রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَا مِنْ عَبْدٍ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، ثُمَّ مَاتَ عَلَى ذَلِكَ إِلَّا دَخَلَ الجَنَّةَ
কোন বান্দা যদি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে এর ওপর মৃত্যুবরণ করে তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? নবীজি সা. বললেন, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? নবীজি সা. বললেন, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে। আমি তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করলাম, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? নবীজি সা. বললেন, যদিও সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে; আবু যরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও। (সহিহ বুখারি : ৫৮২৭)
পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন,
الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ.
ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী, তাদের প্রত্যেককে একশটি করে বেত্রাঘাত কর। (সূরা নূর : ২)
الزَّانِي لَا يَنْكِحُ إِلَّا زَانِيَةً أَوْ مُشْرِكَةً وَالزَّانِيَةُ لَا يَنْكِحُهَا إِلَّا زَانٍ أَوْ مُشْرِكٌ.
ব্যাভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণী কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করবে। (সূরা নূর : ৩)
এভাবে আল্লাহ তাআলা ব্যভিচারী ও মুশরিক এবং ব্যভিচারিণী ও মুশরিক নারীর মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَالسَّارِقُ وَالسَّارِقَةُ فَاقْطَعُوا أَيْدِيَهُمَا جَزَاءً بِمَا كَسَبَا نَكَالًا مِنَ اللَّهِ.
আর পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও, তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিস্বরূপ। (সূরা মায়িদা : ৩৮)
সুতরাং এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী এবং পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রয়েছে, যা মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীর শাস্তি থেকে ভিন্ন। কারণ, তার শাস্তি হচ্ছেÑ তাকে হত্যা করা হবে, তার স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হবে এবং তার সম্পদসমূহ বাজেয়াপ্ত হবে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব
এ পর্যন্ত আমরা যা আলোচনা করেছি, এসবই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত।
‘আল—আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহ’ এর রচয়িতা ইমাম ত্বহাবি মিসরি হানাফি র. [যার পূর্ণ নাম হলো, আবু জাফর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন সালামাহ বিন সুলাইম বিন আব্দুল মালিজ আত—ত্বহাবি ] বলেন,
“আমরা আমাদের কিবলার অনুসারীদের মুসলিম বলবো, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নবী সা.—এর আনীত দীনকে নিজের দীন বলে স্বীকার করবে এবং তাঁর সকল কথা ও সংবাদকে সত্য বলে বিশ্বাস করবে। আমরা আল্লাহ তাআলার সত্তা সম্পর্কে প্রবৃত্ত হই না এবং দীনের ব্যাপারে বিতর্ক করি না। আমরা কুরআন নিয়ে বিকর্ত করি না এবং এ কথার সাক্ষ্য দেই যে, এটি বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের কালাম, যা বিশ্বস্ত আত্মা (জিবরিল আ.) নিয়ে এসেছেন এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মদ মুস্তফা সা.—কে শিখিয়েছেন। এটি মহান আল্লাহর কালাম। কোনো মাখলুকের কথা তার সমকক্ষ হতে পারে না। আমরা এ কুরআন সৃষ্ট হওয়ার প্রবক্তা নই। আমরা মুসলিমদের জামাআতের বিরোধিতা করি না এবং কিবলার অনুসারী কোনো ব্যক্তিকে কৃত গোনাহের কারণে কাফের মনে করি না, যদি না সে ঐ গোনাহকে হালাল মনে করে। আমরা এ কথাও বলি না যে, কৃত গোনাহ তার কর্তার ঈমানের কোনো ক্ষতি করে না।
মুসলিমদের মধ্য হতে সৎকর্মশীলদের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী যে, আল্লাহ তাদের অপরাধ মার্জনা করে আপন রহমতে তাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তবে তাদের জন্য আমরা জান্নাতের সাক্ষ্য দেই না।
তাদের মধ্য হতে যারা অন্যায় কাজে লিপ্ত আমরা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাদের ব্যাপারে আশঙ্কা করি। তবে তাদের নৈরাশ করি না। নিজের প্রতি অতি আস্থা ও নিরাশা উভয়টি ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিবলার অনুসারীদের জন্য সত্যের পথ এ দুই অবস্থার মাঝামাঝি। কোনো বান্দা ঈমান থেকে কেবল ঐ বিষয়কে অস্বীকার করার দ্বারা বেরিয়ে যাবে যা তাকে ঈমানে প্রবেশ করিয়েছে।
ঈমান হলোÑ মুখে স্বীকার করা এবং অন্তরে বিশ্বাস করা। রাসূল সা. থেকে প্রমাণিত সকল বিষয় সত্য। ঈমান একটি একক বিষয়। তার অনুসারীরা মৌলিকভাবে সমপর্যায়ের। তবে তাদের মধ্যে মর্যাদাগত পার্থক্য হবেÑ খোদাভীতি ও তাকওয়া অবলম্বন, প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ এবং উত্তম কাযার্বলি সম্পাদনের মাধ্যমে।
উম্মতে মুহাম্মদী সা.—এর কবিরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তবে তাওহিদের বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে তারা জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না; যদিও তারা আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভের পর তাওবা না করে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে। তাদের বিচার আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন থাকবে। তিনি চাইলে তাদেরকে আপন অনুগ্রহে মাফ করে দিবেন। যেমনটি পবিত্র কুরআনে বলেছেন :
وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ : এটা (শিরক) ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা : ৪৮) অথবা তিনি চাইলে স্বীয় ন্যায়নীতি অনুসারে তাদেরকে শাস্তিদান করবেন, অতঃপর আপন রহমতে তাদেরকে আনুগত্যশীল বান্দাদের সুপারিশে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাআলা ঐ সকল বান্দাদের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছেন যারা তাঁর পরিচয় লাভ করেছে। তাদেরকে তিনি দু’জাহানে ঐ সকল বান্দাদের পরিণতি ভোগ করাবেন না যারা তার পরিচয় লাভ করেনি; বরং হেদায়াত পাওয়ার পরও তারা নিজেদের ক্ষতি ডেকে এনেছে এবং আল্লাহ তাআলার অভিভাবকত্ব স্বীকার করেনি।
হে আল্লাহ! হে ইসলাম ও মুসলিমদের অভিভাবক! আপনি আমাদেরকে ইসলামের ওপর অবিচল রাখুন, যতদিন না আমরা আপনার দরবারে উপস্থিত হই।
আমরা আহলে কিবলার প্রত্যেক সৎকর্মশীল ও পাপাচারীর পেছনে নামায আদায়কে বৈধ মনে করি। আমরা তাদের মধ্য হতে যারা মৃত্যুবরণ করেছে অথবা জীবিত আছে, তাদেরকে কাউকে জান্নাত বা জাহান্নামে পৌঁছাই না এবং তাদের ব্যাপারে কুফর বা শিরকের সাক্ষ্য দেই না, যতক্ষণ না তাদের থেকে এমন কোনো কাজ প্রকাশ পায়। আমরা তাদের অন্তরের গোপন বিষয়গুলো আল্লাহ তাআলার প্রতি সোপর্দ করি।”
আহলে জাহেরের ইমামÑ মুহাদ্দিস, ফকিহ ও উসূলবিদ ‘আবু মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ বিন সাঈদ বিন হাযম’ বলেন,
প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে বিষয়টি সর্বপ্রথম আবশ্যক, যা ব্যতীত ইসলাম বিশুদ্ধ হয় না, তা হলোÑ ব্যক্তি ব্যক্তি পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করবে, যেখানে সন্দেহের কোনো লেশ থাকবে না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। এর প্রমাণ হলো, রাসূলুল্লাহ সা.—এর বাণী :
أمرت أن أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِهِ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ، عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ، وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّهَا، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللهِ.
আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি এবং আমার আনীত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করে। যদি তারা এ কাজগুলো করে ফেলে তাহলে তারা আমার থেকে তাদের জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করে নিল। তবে এসবের হকও আদায় করতে হবে। আর তাদের হিসাব আল্লাহর নিকট ন্যস্ত হবে। (সহিহ মুসলিম : ৩৪)
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ.
কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তভুর্ক্ত হবে। (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)
আর এ সাক্ষ্য অন্তর থেকে হতে হবে, এর প্রমাণ হলো আল্লাহর তাআলার বাণী :
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.
আর তারা আদিষ্ট হয়েছে আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্তে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে। (সূরা বায়্যিনা : ৫) আর ইখলাস বা একনিষ্ঠতা হলো অন্তরের বিষয়।
আর মুখে সেই কথার সাক্ষ্য দিতে হবে, এর কারণ হলোÑ এ সাক্ষ্যের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবন ও সম্পদে অন্য কারও হস্তক্ষেপ করা সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে যায়, যেমনটি রাসূল সা. বলেছেন। অতএব, এ কথা অবশ্যই মুখে উচ্চারণ করতে হবে।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ একথার সাক্ষ্যদানের ব্যাখ্যা হলো, অন্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ তাআলা নিজ সত্তা ব্যতীত সকল কিছুর ইলাহ এবং তিনি নিজ সত্তা ব্যতীত ব্যতীত সকল কিছুর স্রষ্টা। তিনি এক ও চিরঞ্জীব। তিনি বিশজগত সৃষ্টি করেছেন, আর এ সৃষ্টির পেছনে কোনো কার্যকারণ তাকে তাড়া করেনি। নফস বা আত্মা তাঁর সৃষ্ট এবং আরশও তাঁরই সৃষ্ট। আল্লাহ তাআলার মত আর কেউ নেই এবং তিনি কখনও কোনো আকৃতি গ্রহণ করেন না।
আর নবুওয়াত সত্য। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব সা. আল্লাহর রাসূল, যিনি কাফের ও মুমিনসহ সকল মানুষ ও জ্বিনের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন।
হযরত মুহাম্মাদ সা., ঈসা (আ.)—সহ সকল নবী—রাসূলগণ আল্লাহর সৃষ্টি এবং অন্য সকল মানুষের মতই মানুষ।
জান্নাত সত্য। জাহান্নাম সত্য। এগুলোর প্রত্যেকটি আল্লাহর সৃষ্টি ও আবাসস্থল। জান্নাতে কখনও কোনো কাফের প্রবেশ করতে পারবে না এবং জাহান্নামে মুমিন বান্দারা চিরকাল স্থায়ী হবে না।
মুসলিমদের মধ্য হতে যাদের গোনাহ ও পাপকর্ম তাদের নেকির চেয়ে ভারি হয়ে যাবে তারা আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর তারা শাফাআতের মাধ্যমে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ شَعِيرَةً، ثُمَّ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ بُرَّةً، ثُمَّ يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَكَانَ فِي قَلْبِهِ مِنَ الْخَيْرِ مَا يَزِنُ ذَرَّةً.
ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা’ বলবে, যখন তার অন্তরে যবের দানা পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) থাকবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, যখন তার অন্তরে গমের দানা পরিমাণ কল্যাণ থাকবে। অতঃপর ঐ ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, যখন তার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণ কল্যাণ থাকবে।” (সহিহ মুসলিম : ৩২৫; সহিহ বুখারি : ৪৪)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا.
কারও প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না। (সূরা আম্বিয়া : ৪৭)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَأَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِينُهُ (৬) فَهُوَ فِي عِيشَةٍ رَاضِيَةٍ (৭) وَأَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ (৮) فَأُمُّهُ هَاوِيَةٌ (৯) وَمَا أَدْرَاكَ مَا هِيَهْ (১০) نَارٌ حَامِيَةٌ .
যার পাল্লা ভারি হবে সে সন্তুষজনক জীবন লাভ করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে তার স্থান হবে হাবিয়া। তুমি কি জানÑ হাবিয়া কী? তা হচ্ছে উত্তপ্ত অগ্নি। (সূরা কারিআহ : ৬—১১)
আর যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.—এর কোনো হাদিস তার নিকট সহিহ সনদে পেঁৗছার পর তা অস্বীকার করবে অথবা রাসূল সা.—এর আনীত কোনো বিষয়ের ওপর মুমিনদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তা প্রত্যাখ্যান করবে সে কাফের বলে সাব্যস্ত হবে।
পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত মুসলিমদের হাতে যে কুরআন রয়েছে, সেখানে সূরা ফাতিহা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত সবটুকু অংশই আল্লাহর কালাম, যা তিনি স্বীয় নবী মুহাম্মাদ সা.—এর অন্তরে নাযিল করেছেন। যে ব্যক্তি এর একটি হরফও অস্বীকার করবে তাকেও কাফের বলা হবে।
কারও নিকট দীনের কোনো গোপন ভেদ নেই। মানুষের পুনরুত্থানের বিষয়টি সত্য। দাড়িপাল্লা স্থাপনের বিষয়টিও সত্য।
রাসূলুল্লাহ সা. কতৃর্ক তাঁর উম্মতের কবিরা গোনাহগারদের জন্য শাফাআতও সত্য। এ শাফাআতের বদৌলতে তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ.
কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে। (সূরা বাকারা : ২৫৫)
নবীজি সা. বলেন,
لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ دَعَاهَا لِأُمَّتِهِ، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
প্রত্যেক নবীরই তাঁর উম্মতের ব্যাপারে একটি মাকবুল দুআ রয়েছে, যা তিনি করে ফেলেছেন, আর আমি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্য আমার সেই দুআটি বিলম্বিত করেছি। (সহিহ মুসলিম : ২০০; সহিহ বুখারি : ৬৩০৪)
অপর এক হাদিসে নবীজি সা. বলেন,
أما أهل النار الذين هم أهلها، فإنهم لا يموتون فيها ولا يحيون، ولكن ناس أصابتهم النار بذنوبهم — أو قال بخطاياهم — فأماتهم إماتة حتى إذا كانوا فحما، أذن بالشفاعة، فجيء بهم ضبائر ضبائر، فبثوا على أنهار الجنة، ثم قيل: يا أهل الجنة، أفيضوا عليهم، فينبتون نبات الحبة تكون في حميل السيل.
আর যারা জাহান্নামবাসী হবে, সেখানে তাদের মৃত্যু ঘটবে না এবং তারা পুনর্জীবিতও হবে না। তবে তাদের মধ্যে কিছু লোক এমন থাকবে যারা তাদের গোনাহের কারণে অগ্নিদগ্ধ হবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মৃত্যুদান করবেন। অবশেষে যখন তারা পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে তখন তাদের জন্য শাফাআতের অনুমতি হবে। অতঃপর তাদেরকে দলে দলে নিয়ে আসা হবে এবং জান্নাতের নহরগুলোতে তাদেরকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর ঘোষণা হবে, হে জান্নাতবাসীরা! তোমরা তাদের ওপর পানি ঢেলে দাও। ফলে তারা ে¯্রাতবাহিত পলিতে গজিয়ে ওঠা শস্যদানার মত নবজীবন লাভ করবে। (সহিহ মুসলিম : ১৮৫; সহিহ বুখারি : ২২)
আর আমলনামা, যেখানে বান্দাদের আমলসমূহ লিখা হয়Ñ তা সত্য এবং ফেরেশতাদের অস্তিত্ব সত্য। আমরা তাদের প্রতি ঈমান রাখি; তবে তাদের আকৃতি কী, তা আমরা জানি না। আমরা এ কথাও বিশ্বাস করি যে, কিয়ামতের দিন মানুষকে তাদের আমলনামা দেওয়া হবে।
আর কবরের শাস্তি সত্য। মৃত্যুর পর রূহসমূহকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টিও সত্য। মৃত্যুর পর কোনো ব্যক্তি কিয়ামত পর্যন্ত আর জীবিত হবে না।
নেক কাজের পাল্লা ভারি হলে তা পাপকাজগুলোকে শেষ করে দিবে। তাওবা পাপকাজসমূহকে মিটিয়ে দেয়। নেক কাজের মাধ্যমে বদলা দেওয়ার বিষয়টিও সত্য। আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَإِنِّي لَغَفَّارٌ لِمَنْ تَابَ.
আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি যে তাওবা করে। (সূরা ত্বহা : ৮২)
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ.
সৎকাজসমূহ অবশ্যই মন্দ কাজসমূহকে মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদ : ১১৪)
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে :
أتدرون ما المفلس؟গ্ধ قالوا: المفلس فينا من لا درهم له ولا متاع، فقال: ্রإن المفلس من أمتي يأتي يوم القيامة بصلاة، وصيام، وزكاة، ويأتي قد شتم هذا، وقذف هذا، وأكل مال هذا، وسفك دم هذا، وضرب هذا، فيعطى هذا من حسناته، وهذا من حسناته، فإن فنيت حسناته قبل أن يقضى ما عليه أخذ من خطاياهم فطرحت عليه، ثم طرح في النار .
একদিন রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা বলতে পার কি, দরিদ্র কে? সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন : আমাদের মধ্যে যার দিরহাম (টাকা—পয়সা) ও আসবাবপত্র (ধন—সম্পদ) নেই সেই তো দরিদ্র। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, ওকে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ ভোগ করেছে, এর রক্ত ঝরিয়েছে এবং ওকে মেরেছে। এরপর একে (পাওনাদার) তার নেক আমলসমূহ থেকে দিয়ে দেওয়া হবে, একে তার নেক আমলসমূহ থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর তার দেনা পরিশোধের পূর্বেই তার নেক আমলসমূহ শেষ হয়ে গেলে পাওনাদারদের কিছু গোনাহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম : ২৫৮১)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{الْيَوْمَ تُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ}
আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল দেওয়া হবে। (সূরা মু’মিন : ১৭)
নবী সা.—এর মৃত্যুর মাধ্যমে ওহি চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে এবং দীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এখন দীনের মধ্যে কোনো সংযোজন, বিয়োজন ও কোনো ধরনের পরিবর্তন চলবে না।
মুমিন, কাফের, সৎকর্মপরায়ণ ও পাপাচারীÑ যার কাছেই সতর্কবার্তা পেঁৗছেছে তার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার দলিল প্রতিষ্ঠিত ও স্পষ্ট হয়ে গেছে।
সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর তার সামর্থ্য অনুপাতে ফরয। অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রথমে হাত দ্বারা করবে। কেউ তা না পারলে মুখের ভাষা দ্বারা করবে। তাও না পারলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। আর এটিই হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম স্তর। এরপর ঈমানের আর কোনো স্তর বাকি নেই।
সুতরাং কোনো ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে কিংবা অস্পটতার কারণে এসব কিছুর পরিচয় লাভে যদি অক্ষমও হয় তাহলে তার অন্ততপক্ষে অবশ্যই এ কথা বিশ্বাস করতে হবে এবং কালিমার ব্যাখ্যা জানার পর তার সামর্থ্য অনুপাতে মুখে বলতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল। তিনি যে জীবন—বিধান নিয়ে এসেছেন তা সত্য। তাঁর আনীত দীন ব্যতীত অন্য সকল দীন বাতিল।
যে ব্যক্তি তার সকল আমলকে নষ্ট করলো সে পাপাচারী মুমিন, যার ঈমান ত্রুটিপূর্ণ। তবে তাকে কাফের আখ্যা দেওয়া হবে না। কারণ, রাসূল সা.—এর এক দীর্ঘ এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :
حتى إذا فرغ الله من القضاء بين العباد، وأراد أن يخرج برحمته من أراد من أهل النار، أمر الملائكة أن يخرجوا من النار من كان لا يشرك بالله شيئا ممن أراد الله تعالى أن يرحمه ممن يقول: لا إله إلا الله.
এমনকি যখন আল্লাহ বান্দাদের মধ্যে বিচারকার্য শেষ করবেন এবং জাহান্নামবাসীদের মধ্য থেকে যাদেরকে স্বীয় রহমত দ্বারা জাহান্নাম থেকে বের করার ইচ্ছা করবেন এবং যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতো তাদের মধ্য হতে যাদের প্রতি দয়া করার করার ইচ্ছা করবেন তখন তিনি ফেরেশতাদেরকে আদেশ করবেনÑ তারা যেন জাহান্নাম থেকে ঐ সকল লোকদেরকে বের করে আনে যারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করতো না। (সহিহ মুসলিম : ১৮২; সহিহ বুখারি : ৬৫৭২)
ইয়াকিন (অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস) এর মধ্যে কম—বেশি হয় না; বরং যখন তাতে কোনো সংশয় বা অস্বীকৃতি প্রবেশ করে তখন সবটুকুই বাতিল হয়ে যায়।
পাপাচার হচ্ছে : ১. অশ্লীল কাজ ও কবিরা গোনাহ, ২. সগিরা বা ছোট গোনাহ, ৩. লামাম বা অন্তরে পাপ কাজের উদ্রেক হওয়া।
অন্তরে পাপ কাজের উদ্রেক হলে তা মার্জনীয়। আর অশ্লীল কাজ ও কবিরা গোনাহ হলো, ঐ সকল গোনাহ যার ওপর আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে অথবা তাঁর রাসূলের ভাষায় জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এ জাতীয় গোনাহ থেকে বিরত থাকবে তার অন্য সকল সগিরা গোনাহসমূহও ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ.
যারা রিবত থাকে কবিরা গোনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে। তবে ছোটখাট গোনাহের বিষয়টি ভিন্ন। নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের ক্ষমা অপরিসীম। (সূরা নাজম : ৩২)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنْ تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُدْخَلًا كَرِيمًا .তোমরা যদি সেসব কবিরা গোনাহ পরিহার কর, যা থেকে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে তাহলে আমি তোমাদের (ছোট—ছোট) গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক আবাশস্থলে প্রবেশ করাবো। (সূরা নিসা : ৩১)
লামাম অর্থ হচ্ছে, অন্তরে গোনাহের উদ্রেক হওয়া। এ প্রকার গোনাহ মাফ। নবীজি সা. বলেন,
إن الله تجاوز لأمتي ما حدثت به أنفسها، ما لم يتكلموا، أو يعملوا به
নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের অন্তরে যে গোনাহের উদ্রেক হয় তা ক্ষমা করে দিয়েছেন; যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তা মুখে উচ্চারণ করে অথবা কার্যে পরিণত করে। (সহিহ মুসলিম : ১২৭; সহিহ বুখারি : ৬৬৬৪)
যে ব্যক্তি কবিরা গোনাহসমূহ থেকে বিরত থাকে না, তার প্রতিটি কাজের হিসাব নেওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা তার নেক কাজসমূহ এবং তার ঐ সকল গোনাহের কাজসমূহের মধ্যে ওজন করবেন যেগুলো থেকে সে তাওবা করেনি এবং এবং দুনিয়াতে এর হদ্দ বা দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হয়নি। অতঃপর যার নেকির পাল্লা ভারি হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। অনুরূপ যার নেকির পাল্লা ও পাপের পাল্লা বরাবর হবে সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তাওবা পাপসমূহকে মোচন করে দেয়, এতে কোনো দ্বিমত নেই।
যাদের পাপের পাল্লাহ ভারি হবে তারা তাদের আমল অনুপাতে শাস্তি ভোগ করার পর শাফাআতের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে।
জান্নাতেও মানুষের মর্যাদার তারতম্য হবে। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি জান্নাতে সবার্ধিক উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। কুফর, ব্যভিচার, কওমে লূত (আ.) এর অপকর্ম, মদপান, হারাম খাদ্য গ্রহণ, যেমনÑ শুকর, রক্ত, মৃত জন্তু ইত্যাদি অপরাধকর্ম থেকে তাওবার পদ্ধতি হলো, কৃত গোনাহের ওপর লজ্জিত হওয়া, গোনাহের কাজটি বর্জন করা, কখনও সেই গোনাহের কাজে ফিরে না যাওয়ার সংকল্প করা এবং আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি সর্বসম্মত মত, যাতে কোনো দ্বিমত নেই।
মানুষের মান—মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা, কারও ওপর জুলুম করা এবং সম্পদ নষ্ট করার অপরাধ থেকে তাওবার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হলো, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্র সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া, সেই জুলুমের কারণে তার যেসব ক্ষতি হয়েছে তার সেগুলোর ক্ষতিপূরণ দেওয়া। কত লোকের ওপর জুলুম করেছে, যদি তাদের সংখ্যা ও পরিচয় জানা না থাকে তাহলে গরিব—মিসকিনদের মধ্যে সদকা করতে হবে এবং জনকল্যাণমূলক কাজে সম্পদ ব্যয় করতে হবে। সেই সাথে লজ্জিত হতে হবে, গোনাহ বর্জন করতে হবে, আল্লাহর কাছে কৃত গোনাহের কারণে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে এবং যাদের মর্যাদাহানি করা হয়েছে তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে এবং যাদের শারীরিক ক্ষতি করা হয়েছে তাদেরকে এর বদলা দিতে হবে। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে বিষয়টি আল্লাহ তাআলার নিকট ন্যস্ত হবে। কোনো সন্দেহ নেই যে, কিয়ামতের দিন মাজলুমের সাথে ইনসাফের আচরণ করা হবে, এটি সেই দিন যেদিন শিংবিশিষ্ট বকরি থেকে শিংবিহীন বকরির পক্ষে বদলা গ্রহণ করা হবে।
মানবহত্যা থেকে তাওবা উপরিউক্ত সকল অপরাধ থেকে বেশি গুরুতর। কেননা এর তাওবা শুধু এটাই যে, হত্যার বদলে ঘাতককে হত্যা করা হবে। তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে অধিক পরিমাণে নেকির কাজ করতে হবে, যাতে করে নেক আমলের পাল্লা ভারি হয়।
নিশ্চয় দাজ্জালের আগমন ঘটবে। দাজ্জাল হলোÑ কাফের, কানা, ধূর্ত ও প্রতারক। আর ইবলিস জীবিত অবস্থায় বিরাজমান।”
ইমাম নববি র. বলেন, “জেনে রাখা উচিত যে, হকপন্থীদের মাযহাব হলো, কিবলার অনুসারী কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা হবে না এবং প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদআতপন্থীদেরকেও কাফের সাব্যস্ত করা হবে না। তবে কোনো ব্যক্তি যদি দীনের অপরিহার্য কোনো বিষয়কে অস্বীকার করে তাহলে তার ব্যাপারে মুরতাদ ও কাফের হয়ে যাওয়ার বিধান আরোপ করা হবে। কিন্তু যদি সে নওমুসলিম হয় অথবা লোকালয় থেকে দূরে নির্জন গ্রামে বসবাস করে, যেকারণে ইসলামের বিধান তার নিকট অস্পষ্ট থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে ইসলামের বিধান সম্পর্কে অবহিত করা হবে।”
ইমাম আবুল হাসান আলী বিন খালাফ বিন বাত্তাল আল—মালিকি আল—মাগরিবি তাঁর রচিত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘শরহু সহিহিল বুখারি’তে বলেন, “উম্মতের পূর্বসূরি ও উত্তরসূরিদের মধ্য হতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, ঈমান হলো কথা ও কাজের সম্মিলিত রূপ, যার মধ্যে হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে। ঈমানের হ্রাস—বৃদ্ধির ব্যাপারে দলিল হিসেবে ইমাম বুখারি পবিত্র কুরআনের কয়েকটি আয়াত পেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ .
যেন তাদের ঈমানের সাথে ঈমান বৃদ্ধি পায়। (সূরা ফাত্হ : ৪)
{ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا}
এতে তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণই বৃদ্ধি পেল। (সূরা আহযাব : ২২)
সুতরাং যার ঈমানে বৃদ্ধি ঘটেনি তার ঈমান অসম্পূর্ণ। এখন যদি কেউ এ প্রশ্ন করে যে, ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে সত্যায়ন করা করা, তাহলে এর জবাবে আমরা বলবো, যাবতীয় নেক কাজের মাধ্যমে সত্যায়ন পরিপূর্ণতা লাভ করে। অতএব, যখনই মুমিন অধিক পরিমাণে নেক কাজ করে তার ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। অতএব প্রতীয়মান হলো যে, অধিক পরিমাণে নেক কাজ করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়, আর নেক কাজ কমে গেলে ঈমান হ্রাস পায়। কাজেই যখন কোনো ব্যক্তির নেক কাজে ঘাটতি আসবে তখন তার ঈমানের পূর্ণতায়ও ঘাটতি দেখা দেবে। আর যখন নেক কাজে বৃদ্ধি ঘটবে তখন ঈমানের পূর্ণতা বৃদ্ধি পাবে। ঈমান সম্পর্কে এটিই হচ্ছে সঠিক ও মধ্যমপন্থী কথা। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলকে সত্য বলে স্বীকার করার বিষয়টি, তাতে কোনো হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে না।”
ইমাম ইসফাহানি শাফেয়ি রহিমাহুল্লাহ বলেন, “শরিয়াহর পরিভাষায় ঈমান বলা হয় অন্তরের সত্যায়ন ও কাজের বাস্তবায়নকে। অতএব, এ ব্যাখ্যা অনুসারে ঈমানের মধ্যে হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটতে পারে। এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মাযহাব।” (শরহুন নববি আলা মুসলিম : খ. ১, পৃ. ১৪৭)
আমরা এ আলোচনার মাধ্যমে কোনো গোনাহের প্রতি তুচ্ছতা প্রকাশ করছি না, চাই তা কবিরা হোক বা সগিরা। আল্লাহ তাআলার জন্যই যাবতীয় পবিত্রতা। বরং আমরা বলবো, আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণ করা এবং আনুগত্য স্বীকার করাই অবধারিত।
এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট যে, ছোট—বড় সকল বিষয়ে আল্লাহ তাআলার আদেশের আনুগত্য করা আমাদের ওপর অবশ্য কর্তব্য। কেননা মুসলিমের আসল পরিচয় হলো, সে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যকে নিজের জন্য অপরিহার্য মনে করবে। কোনো সগিরা গোনাহকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে না এবং কবিরা গোনাহর দুঃসাহস করবে না।
আমরা আল্লাহর দরবারে কামনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সাহায্য করেন, যেন আমরা তাঁর সকল আদেশকে মেনে চলতে পারি এবং সকল নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারি।
আমরা আমাদের মিশনের শুরু থেকে নিজেদের জন্য এবং সকলের জন্য সুস্পষ্টরূপে এ আহ্বান জানিয়ে এসেছি যে, তোমরা নিজেদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াতকে প্রতিষ্ঠা কর, তাহলে তোমাদের ভূখণ্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।
পরিশেষে আমরা পাঠ করছি সেই দুআ যা রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে শিখিয়েছেন :
اللهُمَّ رَبَّ جَبْرَائِيلَ، وَمِيكَائِيلَ، وَإِسْرَافِيلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ، اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ، إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ.
“হে আল্লাহ! জিবরাঈল, মিকাঈল ও ইসরাফিলের রব, আসমানসমূহ ও যমিনের সৃষ্টিকর্তা, সকল অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাত। আপনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে ঐ বিষয়ে ফয়সালা করে দিন যে বিষয়ে তারা বিবাদে লিপ্ত। আপনি আপন অনুগ্রহে আমাকে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে সত্যের প্রতি হেদায়াত দান করুন। নিশ্চয় আপনি যাকে চার সরল পথের হেদায়াত দান করেন। (সহিহ মুসলিম : ৭৭০)” হে আল্লাহ! আপনি রহমত বর্ষণ করুন আমাদের সর্দার মুহাম্মাদ সা.—এর প্রতি এবং তাঁর সকল পরিবার—পরিজন ও সাহাবায়ে কেরামের প্রতি।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
জুহুদ, কুফর, শিরক, রিদ্দাহ ও নিফাকের অর্থ
জুহুদ :
জুহুদ (جحود) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছেÑ অস্বীকার করা, মিথ্যারোপ করা।
পরিভাষায় জুহুদ বলা হয়, আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ে ঈমান আনা ফরয করেছেন সে বিষয়ে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তা অস্বীকার করা।
এ অস্বীকার মুখের ভাষা ব্যতীত শুধু অন্তর দ্বারা হতে পারে, অথবা অন্তর ব্যতীত শুধু মুখের ভাষা দ্বারাও হতে পারে; তবে কাউকে মুখে অস্বীকারের জন্য বলপ্রয়োগ করা হলে তার বিষয়টি ভিন্ন। অথবা একই সাথে মুখের ভাষা ও অন্তর উভয়টি দ্বারা হতে পারে।
কুফর :
কুফর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ঢেকে ফেলা, পর্দাবৃত করা।
পারিভাষায় কুফর বলা হয়, এমন কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া, কুরআন ও হাদিসের ভাষ্যমতে যার কর্তা ঈমানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়।
এর প্রমাণ হলো, রাসূলুল্লাহ সা.—এর বাণী :
أمرت أن أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِهِ.
“আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি এবং আমার আনীত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করে।” (সহিহ মুসলিম : ৩৪)
সুতরাং কেউ যদি রাসূল সা. আনীত কোনো বিষয়কে মিথ্যারোপ করে বা অস্বীকার করে তাহলে রাসূল সা.—এর হাদিসের ভাষ্যমতে তার ঈমান চলে যাবে।
‘রাসূল সা. আনীত কোনো বিষয়কে অস্বীকার’ আবশ্যিকরূপে এ কথার দাবি করে যে, অস্বীকারকারী এ বিষয়ে অবগত হতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা কোন কোন বিষয়ে ঈমান আনয়নকে অপরিহার্য করেছেন। অর্থাৎ, ঐ ব্যক্তির কাছে সত্য পেঁৗছতে হবে এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে, সে যে বিষয়কে মিথ্যারোপ করছে বা অস্বীকার করছে আল্লাহ তাআলা সেই বিষয়ে ঈমান আনয়ন অপরিহার্য করেছেন।
শুধু অন্তর দ্বারা অস্বীকার করলেও ঈমান চলে যাওয়ার দলিল হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.
আর তারা আদিষ্ট হয়েছে আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে। (সূরা বায়্যিনা : ৫) আর ইখলাস বা একনিষ্ঠতা হলো অন্তরের বিষয়।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ (৮) يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (৯) فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ.
আর মানুষের মধ্যে এমনও লোক আছে, যারা বলেÑ আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি; কিন্তু তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহ এবং মুমিনদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে, নিজেদেরকে ছাড়া আর কাউকে প্রতারিত করে না, তা তারা বুঝতে পারে না। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন। তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। কারণ, তারা মিথ্যাবাদী। (সূরা বাকারা : ৮—১০)
সুতরাং আল্লাহ তাআলা এ অকাট্য সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যে, কেউ যদি অন্তরের বিশ্বাস ব্যতীত শুধু মুখে ঈমানের দাবি করে তাহলে সে কাফেরই থাকবে। অতএব, যেসব বিষয়ে ঈমান আনয়নকে আল্লাহ তাআলা ফরয করেছেন যে ব্যক্তি সেসব বিষয়কে অন্তর দ্বারা অস্বীকার করলো সে তার ঈমানের দাবিতে মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তাআলা তার ঈমান বাতিল হয়ে যাওয়া এবং কঠিন শাস্তির বিধান দিয়েছেন। এটি হচ্ছে, আল্লাহর নিকট অন্তরে অস্বীকারকারীর বিধান।
আর আমাদের মত সাধারণ মানুষের জন্য অন্যের অন্তর্নিহিত বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া অসম্ভব। তাই আমাদের কাজ হচ্ছে, মানুষের মুখের ভাষা অনুযায়ী তার সাথে আচরণ করা। যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অন্তরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ভালো করে জানে। অতএব, প্রত্যেকেই যেন নিজের বিষয়ে চিন্তা করে এবং একথা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে সম্মক অবগত। তিনি জানেন, কার অন্তরে কোন কথার উদয় হচ্ছে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ.
আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি, তার প্রবৃত্তি তাকে কি কুমন্ত্রণা দেয়। আর আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষা নিকটতর। (সূরা ক্বাফ : ১৬)
আমরা যে বলেছি, অন্তর ব্যতীত শুধু মুখে অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়, তার প্রমাণ হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ .
কেউ ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে (তার ওপর পতিত হবে আল্লাহ গযব); তবে তার জন্য নয় যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয়; কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল। (সূরা নাহল : ১০৬)
অতএব, এ আয়াতের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, কাউকে যদি কুফরির জন্য বাধ্য করা না হয় এবং এমতাবস্থায় সে কুফরির কালিমা উচ্চারণ করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে যদি কাউকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় এবং তার অন্তর ঈমানে অবিচল থাকে তবে সেই ব্যক্তির কথা ও কাজ ধর্তব্য হবে না; বরং সে আল্লাহর নিকট মুমিন ও মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা অন্তরের গোপন ভেদ জানেন। তিনি জানেন, কার অন্তরে কখন কোন বিষয়ের উদয় হয়।
কালিমার সাক্ষ্যদান সত্ত্বেও যেসব কাজের মাধ্যমে ঈমান চলে যাওয়ার কথা কুরআন ও হাদিসে বিবৃত হয়েছে, এগুলো ব্যতিরেকে অন্য কোনো অন্যায় কাজ করলে আল্লাহ তাআলা সেগুলোর জন্য ভিন্ন বিধান ধার্য করেছেন। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের বিপরীত কাজ করলে সেই ব্যক্তি অবাধ্য ও পাপাচারী হবে; সে অস্বীকারকারী ও মিথ্যারোপকারী হবে না। এ কারণে আমরা বলেছি, “কুফর বলা হয়, এমন কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া, কুরআন ও হাদিসের ভাষ্যমতে যার কর্তা ঈমানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়।”
অতএব, কাফের শুধু ঐ ব্যক্তিকেই বলা হবে, যে দীনের কোনো অকাট্য বিষয়কে মিথ্যারোপ করে অথবা আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ে ঈমান আনা ফরয করেছেন সে বিষয়ের সংবাদ তার নিকট পেঁৗছার মাধ্যমে দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাকে অস্বীকার করে। কিংবা এমন কোনো কাজ করে যার কর্তাকে কুরআন ও হাদিসে ঈমান থেকে বহিষ্কৃত ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কাউকে কাফের বলা হবে না। আর তা এ কারণে যে, আল্লাহ তাআলা কুফর শব্দটিকে তার মূল ও আভিধানিক অর্থ তথা ঢেকে দেওয়া ও আবৃত করার অর্থে ব্যবহার করেছেন এবং কুফরের জন্য একটি বিশেষ অর্থ (পারিভাষিক অর্থ) নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেমনটি আমরা ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি। অতএব, কুফরের আভিধানিক ও মৌলিক অর্থ এবং পারিভাষিক অর্থের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট।
এ কারণে আমাদের জন্য কেবল ঐ ব্যক্তিকেই কাফের বলা বৈধ হবে আল্লাহ তাআলা যাকে কাফের বলেছেন। অন্যথায় বাস্তবতা হলো, প্রত্যেক ব্যক্তি কিছু বিষয়কে বিশ্বাস করে এবং কিছু বিষয়কে অস্বীকার করে। যেমনÑ মুসলিমরা ইহুদিদের বিশ্বাস ‘উযাইর (আ.) আল্লাহর পুত্র’ এবং খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস ‘ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র’—কে অস্বীকার করে। আর এটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, এ অস্বীকৃতির কারণে কোনো মুসলিমকে ব্যাপকভাবে কাফের বলা বৈধ হবে না। বরং এমন বলা যেতে পারে যে, অমুক এ বিষয়টিকে অস্বীকার করে। অনুরূপ ইহুদিরা বিশ্বাস করেÑ মূসা (আ.) আল্লাহর রাসূল। আর এটিও সর্বসম্মত মত যে, শুধু এ বিশ্বাসের কারণে তাদেরকে ব্যাপকভাবে মুমিন বলা হবে না; বরং নির্দিষ্টরূপে এমন বলা হবে যে, অমুক এ বিষয়ে বিশ্বাস করে।
শিরক :
শিরকের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, একটি জিনিসকে অপর একটি জিনিসের সাথে মিলিয়ে পরস্পরকে কোনো কাজে অংশীদার করে দেওয়া।
আর শরিয়াহর পরিভাষায় এটি কুফরের সমার্থক। কেননা আল্লাহ কুফর ও শিরক শব্দ দুটিকে পাশাপাশি সমার্থক রূপে ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর প্রত্যেকটি একটি নির্দিষ্ট শরয়ি অর্থকে বুঝায়। এর কিছু প্রমাণ কুফরের অর্থ বর্ণনা এবং আল্লাহ শব্দের নামকরণের আলোচনায় উল্লেখ করেছি। আরও প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَدَخَلَ جَنَّتَهُ وَهُوَ ظَالِمٌ لِنَفْسِهِ قَالَ مَا أَظُنُّ أَنْ تَبِيدَ هَذِهِ أَبَدًا. وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُدِدْتُ إِلَى رَبِّي لَأَجِدَنَّ خَيْرًا مِنْهَا مُنْقَلَبًا (৩৬) قَالَ لَهُ صَاحِبُهُ وَهُوَ يُحَاوِرُهُ أَكَفَرْتَ بِالَّذِي خَلَقَكَ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُطْفَةٍ ثُمَّ سَوَّاكَ رَجُلًا (৩৭) لَكِنَّا هُوَ اللَّهُ رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِرَبِّي أَحَدًا (৩৮) وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ إِنْ تَرَنِ أَنَا أَقَلَّ مِنْكَ مَالًا وَوَلَدًا (৩৯) فَعَسَى رَبِّي أَنْ يُؤْتِيَنِ خَيْرًا مِنْ جَنَّتِكَ وَيُرْسِلَ عَلَيْهَا حُسْبَانًا مِنَ السَّمَاءِ فَتُصْبِحَ صَعِيدًا زَلَقًا (৪০) أَوْ يُصْبِحَ مَاؤُهَا غَوْرًا فَلَنْ تَسْتَطِيعَ لَهُ طَلَبًا (৪১) وَأُحِيطَ بِثَمَرِهِ فَأَصْبَحَ يُقَلِّبُ كَفَّيْهِ عَلَى مَا أَنْفَقَ فِيهَا وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا وَيَقُولُ يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا.
আর সে নিজের প্রতি জুলুমরত অবস্থায় তার বাগানে প্রবেশ করলো। সে বললো, আমি মনে করি না যে, এটি কখনও ধ্বংস হবে। আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। আর আমাকে যদি আমার রবের কাছে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তবে নিশ্চয় আমি এর চেয়ে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল পাবো। তদুত্তরে তার সঙ্গী বললো, তুমি কি তাকে অস্বীকার করছো, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে, অতঃপর শুক্র থেকে এবং এরপর তোমাকে মানুষের অবয়ব দিয়েছেন? কিন্তু তিনিই আল্লাহ, আমার রব। আর আমি আমার রবের সাথে কাউকে শরিক করি না। আর তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন কেন তুমি বললে না, মাশাআল্লাহ! আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোনো শক্তি নেই। তুমি যদি ধনে ও সম্পদে আমাকে তোমার চেয়ে স্বল্পতর মনে কর তবে হয় তো আমার প্রতিপালক আমাকে তোমার বাগান অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কিছু দান করবেন এবং তোমার বাগানের ওপর আকাশ থেকে নির্ধারিত বিপর্যয় প্রেরণ করবেন, ফলে তা উদ্ভিদশূন্য ময়দানে পরিণত হবে। কিংবা তার পানি মাটির গভীরে চলে যাবে, ফলে তুমি কখনও তার সন্ধান লাভে সক্ষম হবে না। আর তার ফল—সম্পদ বিপর্যয় বেষ্টিত হলো এবং সে তাতে যে ব্যয় করেছিল তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগলো, যখন তা মাচানসহ ভূমিসাৎ হয়েছিল, তখন সে বলতে লাগলো, হায় আক্ষেপ! আমি যদি আমার রবের সাথে কাউকে শরিক না করতাম! (সূরা কাহফ : ৩৫—৪২)
উপরিউক্ত আয়াতসমূহে কুফর ও শিরক শব্দদ্বয় একটি সমার্থক শরয়ি পরিভাষা রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যার প্রয়োগ হয়েছে ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে নিজের প্রতি জুলুমরত অবস্থায় তার বাগানে প্রবেশ করেছিল। সে ধারণা করেছিল, তার বাগান ও ধন—সম্পদ অবিনশ্বর এবং সে মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও আখিরাতে সন্দেহ পোষণ করতো।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ (৩০) اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ.
ইহুদিরা বলে উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিষ্টানরা বলে ‘মাসিহ আল্লাহর পুত্র’। এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন, এরা কোনো উল্টা পথে চলে যাচ্ছে। তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসার—বিরাগীদিগকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে এবং মারয়াম—তনয়কেও। অথচ তারা এক ইলাহর ইবাদতের জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে তাঁর শরিক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি কত পবিত্র! (সূরা তাওবা : ৩০—৩১)
{بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (১) فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ (২) وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ.
সম্পর্কচ্ছেদ করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঐ সকল মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। অতঃপর তোমরা চার মাসকাল এ দেশে পরিভ্রমণ কর এবং জেনে রেখো, তোমরা আল্লাহকে পরাভূত করতে পারবে না, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত করে থাকেন। মহান হজ্বের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অবশ্য যদি তোমরা তাওবা কর, তবে তা তোমাদের জন্যেও কল্যাণকর, আর যদি মুখ ফেরাও, তবে জেনে রেখোÑ আল্লাহকে তোমরা পরাভূত করতে পারবে না। আর কাফেরদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও। (সূরা তাওবা : ১—৩)
কারও কারও মতে মুশরিক ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কাছে সতর্কবার্তা পেঁৗছেনি এবং সে ইসলামের দাওয়াত সম্পর্কে অবহিত হয়নি। আর কাফের কেবল ঐ ব্যক্তিকেই বলা হয়, যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছেছে, অতঃপর সে তার প্রতি বিশ্বাস না করে এর বিরোধিতা করেছে এবং আল্লাহর পথে দাওয়াতের মোকাবেলায় প্রবৃত্ত হয়েছে।
তবে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত দ্বারা এ মতটি খণ্ডিত হয়ে যায়। যেমন—
إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوكُمْ شَيْئًا.
তবে যে মুশরিকদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ, অতঃপর যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোনো ত্রুটি করেনি। (সূরা তাওবা : ৪)
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَنْ يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ.
মুশরিকরা এ যোগ্যতা রাখে না যে, তারা আল্লাহর মসজিদ আবাদ করবে, যখন তারা নিজেরাই নিজেদের কুফরির স্বীকৃতি দেয়। (সূরা তাওবা : ১৭)
كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِنْدَ اللَّهِ وَعِنْدَ رَسُولِهِ إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُوا لَكُمْ فَاسْتَقِيمُوا لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ [৭] كَيْفَ وَإِنْ يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لَا يَرْقُبُوا فِيكُمْ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً يُرْضُونَكُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ (৮) اشْتَرَوْا بِآيَاتِ اللَّهِ ثَمَنًا قَلِيلًا فَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِهِ إِنَّهُمْ سَاءَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ (৯) لَا يَرْقُبُونَ فِي مُؤْمِنٍ إِلًّا وَلَا ذِمَّةً وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُعْتَدُونَ (১০) فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ (১১) وَإِنْ نَكَثُوا أَيْمَانَهُمْ مِنْ بَعْدِ عَهْدِهِمْ وَطَعَنُوا فِي دِينِكُمْ فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لَا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنْتَهُونَ.
মুশরিকদের চুক্তি আল্লাহর নিকট ও তাঁর রাসূলের নিকট কীরূপে বলবৎ থাকবে? তবে যাদের সাথে তোমরা চুক্তি সম্পাদন করেছ মসজিদুল হারামের নিকট। অতএব, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে, তোমরাও তাদের চুক্তিতে স্থির থাকবে। নিঃসন্দেহের আল্লাহ মুত্তাকিগণকে পছন্দ করেন। কেমন করে থাকবে? তারা তোমাদের ওপর জয়ী হলে তোমাদের আত্মীয়তার ও অঙ্গীকারের কোনো মর্যাদা দেবে না। তারা মুখে তোমাদের সন্তুষ্ট করে, কিন্তু তাদের অন্তরসমূহ তা অস্বীকার করে, আর তাদের অধিকাংশই প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গকারী। তারা আল্লাহর আয়াতসমূহ তুচ্ছ মুল্যে বিক্রয় করে এবং লোকদেরকে তাঁর পথ থেকে নিবৃত্ত করে। নিশ্চয় তারা যা করছে, তা অতি নিকৃষ্ট। তারা কোনো মুমিনের সাথে আত্মীয়তা ও অঙ্গীকারের মর্যাদা রক্ষা করে না। তারাই সীমালঙ্ঘনকারী। অবশ্য তারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে আর যাকাত আদায় করে, তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই। আর আমি জ্ঞানী লোকদের জন্যে নিদর্শনসমূহ সবিস্তারে র্বণনা করি। তাদের চুক্তির পর যদি তারা তাদের প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে বিদ্রƒপ করে, তবে কুফরপ্রধানদের সাথে যুদ্ধ কর। কারণ, এরা এমন লোক যাদের কোনো শপথ বাকি রইল না, যাতে তারা নিবৃত্ত হয়। (সূরা তাওবা : ৭—১২)
এ সকল আয়াত সূরা তাওবার অংশ যা অবতীর্ণ হয়েছে মক্কা বিজয়ের পর এবং রাসূল সা.—এর দাওয়াতি মিশন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর। এছাড়া ইতোমধ্যে জাযিরাতুল আরবের ভিতরে ও বাইরে আল্লাহর কালিমা সমুন্নত হয়ে পড়েছে এবং নিকটবর্তী ও দূরবর্তী সকলেই ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। উপরন্তু আয়াতে সুস্পষ্টরূপে এ কথাও বিবৃত হয়েছে যে, অমুসলিমদের সাথে Ñআল্লাহ তাআলা যাদেরকে মুশরিক বলে নামকরণ করেছেনÑ রাসূল ও মুমিনদের মধ্যে চুক্তি সংঘটিত হয়েছে। আর রাসূলুল্লাহ সা. অমুসলিমদেরকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান, তাদের কাছে ইসলামের সতর্কবার্তা পেঁৗছানো এবং তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার সামনে অপারগতা প্রকাশের পূর্বে তাদের সাথে কখনই চুক্তি সম্পাদন করেননি। কেননা ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছানো, এটিই ছিল নবীজি সা.—এর প্রধান দায়িত্ব ও মিশন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ.
হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের নিকট থেকে আপনার নিকট যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি বার্তা প্রচার করলেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। (সূরা মায়িদা : ৬৭)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ (১) قُمْ فَأَنْذِرْ.
হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, আর সতর্ক করুন। (সূরা মুদ্দাছছির : ১—২)
সুতরাং ঐ ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না, যার নিকট প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তথাপি সে ধারণা করে যে, রাসূল সা. কোনো কওমের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন; অথচ তাদের থেকে আপন রিসালাতকে গোপন করেছেন এবং তাদের কাছে আল্লাহর ঐ নির্দেশ পেঁৗছাননি, যার অনুসরণ করলে তারা ইসলামে প্রবেশকারী হয়ে যেতো। সুতরাং এসকল লোকদেরকে আল্লাহ তাআলা ‘মুশরিক’ বলে নামকরণ করেছেন, যাদের কাছে কোনোরূপ সন্দেহ ও সংশয় ব্যতিরেকে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছেছিল। তা সত্ত্বেও তারা হঠকারিতা ও অবিশ্বাস করেছে এবং ইসলামের দাওয়াতের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আবার কেউ কেউ কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য সাব্যস্ত করার জন্য নিম্নোক্ত আয়াতসমূহের দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছে :
আল্লাহ তাআলার বাণী :
لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ مُنْفَكِّينَ حَتَّى تَأْتِيَهُمُ الْبَيِّنَةُ.
আহলে—কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরি করে তারা ও মুশরিকরা, তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ না আসা পর্যন্ত (নিজেদের অবিশ্বাসে) অবিচল থাকবে। (সূরা বায়্যিনাহ : ১)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَالْمُشْرِكِينَ فِي نَارِ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا أُولَئِكَ هُمْ شَرُّ الْبَرِيَّةِ.
নিশ্চয় আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরি করেছে, তারা ও মুশরিকরা জাহান্নামের আগুনে স্থায়ীভাবে থাকবে। তারাই সৃষ্টির অধম। (সূরা বায়্যিনাহ : ৬)
এ মতের প্রবক্তারা বলেন, উল্লেখিত আয়াতদ্বয় কাফের, মুশরিক ও আহলে কিতাবের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট করে দিয়েছে।
যদি এ দুটি আয়াত ব্যতীত অন্য কোনো আয়াত না থাকতো তাহলে আমরা বলতাম, এটিই যথার্থ কথা। কিন্তু ইতঃপূর্বে আমরা যেসকল আয়াত উল্লেখ করেছি তা দ্বারা নিশ্চিতরূপে প্রমাণ হয় যে, কুফর ও শিরক শব্দদ্বয় একটি অভিন্ন শরয়ি পরিভাষারূপে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং সূরা বায়্যিনাহর উল্লেখিত আয়াত দুটি দ্বারা প্রতীয়মান হয়, সেখানে প্রথমে কাফের শব্দকে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ব্যাপক অর্থবোধক। অতঃপর আহলে কিতাব ও মুশরিক শব্দদ্বয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা কাফের থেকে সীমিত অর্থবোধক। আর ব্যাপক অর্থবোধক শব্দের পর সীমিত অর্থবোধক শব্দ উল্লেখ করা আরবি ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত বিষয়। এমনকি পবিত্র কুরআন মাজিদেও এর ব্যবহার রয়েছে। যেমনÑ আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ كَانَ عَدُوًّا لِلَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَرُسُلِهِ وَجِبْرِيلَ وَمِيكَالَ فَإِنَّ اللَّهَ عَدُوٌّ لِلْكَافِرِينَ.
যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণের, তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরিল ও মিকাঈলের শত্রু, সে জেনে রাখুকÑ নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদের শত্রু। (সূরা বাকারা : ৯৮)
এ আয়াতে জিবরিল ও মিকাঈল (আ.)—এর পর ‘রাসূলগণ’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, হযরত জিবরিল ও মিকাঈল (আ.)—ও আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এবং ফেরেশতাগণের অন্তভুর্ক্ত।
অপর একটি হাদিস দ্বারাও আমাদের দাবির সমর্থন হয়। আর তা হচ্ছে, যখন রাসূল সা. ও মুমিনগণ উহুদ পাহাড়ের নিকট কুরাইশের কাফেরদের মোকাবেলার জন্য বের হলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল রাসূল সা.—এর সাথে থাকা এক—তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে চলে গেল। কারণ, পরামর্শ সভায় তার মতের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত না হওয়ায় সে রুষ্ট হয়েছিল। কেননা সে মদিনার ভিতরে অবস্থান করে কুরাইশের কাফেরদের মোকাবেলার মত দিয়েছিল। রাসূল সা.—এর নিকট এ বিষয়ের আলোচনাকালে একদল আনসারি সাহাবি নবীজি সা.—এর নিকট ইহুদি মিত্রদের সহযোগিতা নেওয়ার প্রস্তাব করলে নবীজি সা. সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন,
إِنَّا لَا نَسْتَعِينُ بِمُشْرِكٍ.
আমরা মুশরিকদের সাহায্য গ্রহণ করি না। (আল—মুহাল্লা : খ. ৭, পৃ. ৩৩৫)
উক্ত হাদিসে রাসূল সা. ইহুদিদেরকে মুশরিক বলে নামকরণ করেছেন, অথচ তারা আহলে কিতাব। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূল সা. মদিনায় আগমনের পর এসকল ইহুদিদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছেছিল; বরং নবীজি সা.—এর মদিনায় আগমনের পূর্বে তারা ইসলামের দাওয়াত পেয়েছিল। কিন্তু তারা হঠকারিতা করেছে এবং ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। উপরন্তু বনু কায়নুকার ইহুদিদের বিরুদ্ধে নবীজি সা.—এর যুদ্ধ এবং কা’ব বিন আশরাফকে হত্যার জন্য সেনা প্রেরণের ঘটনাটি উহুদ যুদ্ধের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল।
আবার কারও কারও মতে, যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছার পর সে এর বিরোধিতা করবে তাকে কাফের ও মুশরিক উভয়টি বলা হবে। আর যার কাছে ইসলামের দাওয়াত পেঁৗছবে না, সে শুধু মুশরিক; কাফের নয়।
আমরা বলবো, এ মতের পক্ষেও কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল থেকে দলিল পেশ করতে হবে। আমরা এ—ও আলোচনা করেছি যে, শরয়ি নামকরণের অধিকার কেবল আল্লাহ তাআলার জন্য সংরক্ষিত। তিনি ব্যতীত আর কারও সেই অধিকার নেই। আর ইতঃপূর্বে আমরা বেশ কিছু দলিল পেশ করেছি যে, কুরআনে কারিম ও রাসূল সা. কাফের ও মুশরিক শব্দদ্বয় দুটি অভিন্ন অর্থবোধক শরয়ি পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুশরিকের মধ্যে আবশ্যিকভাবে কাফেরের গুণও পাওয়া যায়। কারণ, আল্লাহ তাআলা তাঁর অস্তিত্ব ও একত্ববাদের ওপর এমন অকাট্য দলিল পেশ করেছেন, যাকে অস্বীকার ও মিথারোপের কোনো সুযোগ নেই। এরপরও যে শিরক করবে এবং আল্লাহ তাআলাকে অস্বীকার করবে অথবা আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ নির্ধারণ করবে তাহলে সে যেন সত্যকে গোপন করার মাধ্যমে কুফরি করলো। এমনিভাবে কাফেরের মধ্যে আবশ্যিকভাবে মুশরিকের গুণও পাওয়া যায়। কারণ, যখন সে আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব ও একত্ববাদের ওপর পূর্ণাঙ্গ দলিলকে অস্বীকার করলো এর মাধ্যমে যেন সে সেই দলিলকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিল। এভাবে সে তার উদ্ভাবিত দলিলকে অথবা এক্ষেত্রে তার অনুসৃত ব্যক্তির দলিলকে আল্লাহ তাআলার দলিলের চেয়ে অধিক পূর্ণাঙ্গ ও যুক্তিযুক্ত স্থির করলো। এর মাধ্যমে সে নিজেকে অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ স্থির করলো। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে সে একই সাথে কাফের ও মুশরিক।
শিরকের একটি প্রকার হলোÑ এ কথা বিশ্বাস করা যে, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরেও নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে, যদিও সে সেই ক্ষমতাকে আল্লাহর ক্ষমতার সমকক্ষ মনে করা না হয়।
এটি শিরক হওয়ার কারণ হলো, যখন সে কোনো জিনিসকে মহান আল্লাহর ক্ষমতার গণ্ডির বাইরে ধারণা করলো, এর দ্বারা সে মূলত আল্লাহর ক্ষমতাকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করলো এবং তা পরিপূর্ণ ও সর্বব্যাপী হওয়ার বিশ্বাস পোষণ করলো না। আর যার ক্ষমতা ত্রুটিপূর্ণ, সে হয় মাখলুক, যার অনেক প্রতিপক্ষ ও অংশীদার থাকে। আল্লাহ তাআলা এর থেকে পবিত্র এবং বহু ঊর্ধ্বে।
শিরকের এ প্রকারের আরেকটি উদাহরণ হলোÑ এ বিশ্বাস করা যে, কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর এমন ক্ষমতা রয়েছে যে, আল্লাহর নিকট সে সুপারিশ করলে তা অবশ্যই কবুল হবে। এটি শিরক হওয়ার কারণ হলো, সুপারিশ অবিার্যরূপে কবুল হওয়ার দাবি হলো, সেই সুপারিশকারীর আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে, আল্লাহ তাআলা যা মেনে নিতে বাধ্য। Ñনাউযুবিল্লাহÑ আর এটিই হচ্ছে শিরক। আল্লাহ তাআলা এর থেকেও পবিত্র এবং বহু ঊর্ধ্বে।
আর এ বিশ্বাস করা যে, কোনো ব্যক্তি দুআ করলে আল্লাহর দরবারে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অধিক, এটি শিরক নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন,
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
কে আছে এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? (সূরা বাকারা : ২৫৫)
এক হাদিসে নবী কারিম সা. বলেন,
لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ دَعَاهَا لِأُمَّتِهِ، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
প্রত্যেক নবীরই তাঁর উম্মতের ব্যাপারে একটি মাকবুল দুআ রয়েছে, যা তিনি করে ফেলেছেন, আর আমি কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের শাফাআতের জন্য আমার সেই দুআটি বিলম্বিত করেছি। (সহিহ মুসলিম : ২০০; সহিহ বুখারি : ৬৩০৪)
শিরকের আরেকটি প্রকার হলো, হযরত নবী কারিম সা.—এর রিসালাতকে অথবা তার আনীত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করা। ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, শিরক ও কুফর শব্দ দুটি শরয়ি পরিভাষা, যা দ্বারা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে বুঝায়, যে ঐ বিষয়কে অস্বীকার করে বা মিথ্যারোপ করে যা আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর ফরয করেছেন অথবা তার ওপর ঈমান আনা আবশ্যক করেছেন।
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা নবী মুহাম্মাদ সা.—এর রিসালাত এবং তাঁর আনীত বিষয়ের সত্যতার ওপর অকাট্য প্রমাণ পেশ করেছেন। নবী কারিম সা.—এর যাবতীয় কথা ও বাণী দীনের অংশ এবং আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত ওহি। সুতরাং যে ব্যক্তি সেই দলিলকে অস্বীকার করলো এবং মিথ্যারোপ করলো অথবা তাঁর আনীত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করলো তাহলে সে যেন এক্ষেত্রে তার দলিলকে অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তির দলিলকে আল্লাহ তাআলার দলিলের থেকে অধিকতর পূণার্ঙ্গ, যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মনে করলো এবং আল্লাহর দলিলকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যা দিল। এভাবে সে নিজেকে অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ স্থির করলো। আল্লাহ তাআলা এর থেকেও পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে।
এমনিভাবে ঐ ব্যক্তির বেলায় একথাই প্রযোজ্য হবে, যে আল্লাহর বিধানের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে অন্য কারও ফয়সালাকে আল্লাহর ফয়সালার ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করে অথবা আল্লাহ তাআলা যে বিষয়কে হারাম করেছেন সে বিষয়কে হালাল মনে করে, কিংবা আল্লাহ তাআলা যে বিষয়কে হারাম করেছেন সে বিষয়কে হালাল মনে করে, অথচ তার কাছে সত্য পেঁৗছেছে এবং এ ব্যাপারে দলিল—প্রমাণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ, এ কাজের মাধ্যমে সে মূলত কুরআনের বাণী ও রাসূল সা.—এর হাদিসকে অস্বীকার করছে এবং তার অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তির ফয়সালাকে মহান আল্লাহর ফয়সালার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করছে। এভাবে সে নিজেকে অথবা তার অনুসৃত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ স্থির করছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ.
তুমি কি লক্ষ্য করেছ ঐ ব্যক্তিকে, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা জাছিয়া : ২৩)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَنْ لَا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ .
হে আদম—সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে এ নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না। নিশ্চয় সে তেমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা ইয়াসিন : ৬০)
এছাড়াও ইতঃপূর্বে আমরা হযরত আদি ইবনে হাতেম রা.—এর সূত্রে রাসূলুল্লাহ সা.—এর হাদিস উল্লেখ করেছি, যেখানে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার এ বাণীর ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদেরকে নিজেদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ঐ সকল পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীরা তাদের জন্য আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত বিষয়কে হালাল ঘোষণা করতো, অতঃপর তারা সেটিকে হালাল মনে করতো। এমনিভাবে তারা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম ঘোষণা করতো, অতঃপর তারা সেটিকে হারাম মনে করতো।
আমরা এখানে আমল ও আকিদার মধ্যকার পার্থক্যটি স্পষ্ট করে দেওয়া সঙ্গত মনে করছি। আর তা হলো, কখনও কখনও একজন ব্যক্তি কোনো নির্দেশের বিপরীতে আমল করে, অথচ তখনও তার বিশ্বাস এমন থাকে যে, নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও ফয়সালা সত্য ও সঠিক। এমতাবস্থায় ঐ আমলকারী তার এ কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী হবে বটে; তবে তার এ গোনাহ তাকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে কুফরে নিয়ে যাবে না।
আবার কখনও একজন ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত কাজ করে, এমতাবস্থায় যে, সে অন্তরে আল্লাহ তাআলার বিধানের প্রতি অসন্তুষ্টি পোষণ করে অথবা সে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, আল্লাহর বিধানটি বাতিল ও অকেজো; কিংবা সে অন্যের ফয়সালাকে আল্লাহর বিধানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে। এর মাধ্যমে সে ইসলামের সীমানা থেকে বেরিয়ে কুফর ও শিরকের গণ্ডিতে প্রবেশ করবে। কারণ, আল্লাহর ফয়সালার প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং তার প্রতি পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ না করা কিংবা আল্লাহর বিধানকে বাতিল ও অকেজো মনে করা এবং অন্যের বিধান ও ফয়সালাকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা স্পষ্ট কুফর ও শিরক; যদিও এর সাথে কাজের মিশ্রণ না ঘটুক। কেননা মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং তারা সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫)
অতএব, কেউ যদি গিবত সম্পর্কে আল্লাহর বিধান জানে যে, আল্লাহ তাআলা গিবতকে হারাম করেছেন এবং তা থেকে নিষেধ করেছেন। সে যদি আল্লাহর এ বিধানকে সত্য, সঠিক ও অবশ্য পালনীয় জেনেও গিবতে লিপ্ত হয় তাহলে সে গোনাহগার হবে বটে, তবে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে না। কিন্তু সে যদি আল্লাহর বিধানের প্রতি অসন্তুষ্টচিত্তে, তার বিধানকে অযৌক্তিক মনে করে, কিংবা অন্যের বিধানকে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে গিবতে লিপ্ত হয় তাহলে সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে। তবে এটি গিবতে লিপ্ত হওয়ার কারণে নয়। বরং আল্লাহ তাআলার বিধানের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ, তার সামনে আত্মসমর্পণ না করা, তাকে বাতিল মনে করা এবং অন্যের ফয়সালাকে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার কারণে।
এমনিভাবে অন্য সকল আদেশ ও নিষেধের বেলায়ও এ নীতিই প্রযোজ্য হবে। তবে ঐসকল কাজ এর ব্যতিক্রম, যে ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে যে, এ কাজে জড়িত হলে ব্যক্তি ঈমান থেকে বেরিয়ে যাবে, সেক্ষেত্রে তার আকিদা—বিশ্বাসের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করা হবে না।
প্রতিটি মুসলিম, যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’—এর সাক্ষ্য দিয়েছে এবং রাসূল সা.—এর আনীত সকল বিষয়ে ঈমান এনেছে, তার ক্ষেত্রে স্বীকৃত মূলনীতি হলো, সে আল্লাহ তাআলার বিধানকে স্বীকার করে এবং তাকে সত্য, সঠিক ও অবশ্য পালনীয় মনে করে। অতঃপর সেই মুসলিম যদি ইসলামের কোনো আদেশ বা নিষেধ অমান্য করে তাহলে সে নাফরমান ও গোনাহগার হবে। তবে তার ক্ষেত্রে সেই মূলনীতি বহাল থাকবে যে, সে একত্ববাদকে স্বীকার করে এবং আল্লাহ তাআলার বিধানকে যথার্থ মনে করে।
অতএব, এমন ব্যক্তি কোনো আদেশ অমান্য করলে এ কথা জিজ্ঞেস করা হবে না যে, সে কি আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে, নাকি অস্বীকার ব্যতিরেকে শুধু অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে? বরং সে কোনো অপরাধ করলে তার ওপর শরয়ি দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে অথবা উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু যদি সে নিজেই প্রচার করে যে, সে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করেছে, কারণ সে এ বিরুদ্ধাচারণকে বৈধ মনে করে, আল্লাহ তাআলার বিধানের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং তার আবশ্যিকতাকে অস্বীকার করে। যদি সে প্রকাশ্যে এমনটি করে তাহলে তার ওপর কুফর ও শিরকের বিধান আরোপ করা হবে এবং তার ওপর রিদ্দাহ (ধর্মত্যাগ)—এর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে।
এর প্রমাণ হলো, রাসূল সা.—এর বাস্তব আমল, যা আমাদের নিকট বহু লোকের নির্ভরযোগ্য অবিচ্ছিন্ন ও বিশুদ্ধ সনদে (তাওয়াতুর) বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সা. চোর, ধারকৃত বস্তু অস্বীকারকারী, ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর ওপর হদ্দ (দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করেছেন এবং মদপানকারীকে বেত্রাঘাত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন অপরাধ—কর্মের ওপর Ñযা তাঁর উপস্থিতিতে সংঘটিত হয়েছে অথবা যে বিষয়ে তিনি অবহিত হয়েছেনÑ ধমক দিয়েছেন, কঠোরতা করেছেন অথবা উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করেছেন।
যেমনÑ হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা তাবুক যুদ্ধের বছর রাসূলুল্লাহ সা.—এর সাথে সফরে বের হলাম। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আল্লাহ চাহেন তো তোমরা আগামীকাল তাবুকের ঝরনার ধারে উপনীত হবে। তোমরা কিছুতেই পূর্বাহ্নের পূর্বে সেখানে উপস্থিত হবে না। তোমাদের মধ্যে যে সেখানে পেঁৗছে যাবে সে যেন আমার আগমনের পূর্বে সেই ঝরনার পানি স্পর্শ না করে।
অতঃপর আমরা সেখানে উপস্থিত হলাম; কিন্তু আমাদের আগমনের পূর্বেই দু’জন ব্যক্তি সেখানে পেঁৗছে গিয়েছিল। ঝরনার প্রবাহ ছিল জুতার ফিতার মত। (অর্থাৎ, ঝরনা পানি অল্প অল্প করে প্রবাহিত হচ্ছিল)। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তাদের দু’জনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি এ ঝরনার পানি স্পর্শ করেছো? তারা বললো, হাঁ। তখন নবীজি সা. তাদেরকে আল্লাহর মর্জি অনুসারে ভর্ৎসনা করলেন। …. (ইবনু হাযম রচিত আল—ইহকাম : খ. ৩, পৃ. ১৮)
এ জাতীয় আরও বহু ঘটনা রয়েছে। কিন্তু কোথাও আমার নিকট এমন খবর পেঁৗছেনি যে, রাসূল সা. যাদের ওপর তাদের কৃতকর্মের হদ্দ (দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করেছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, তোমরা কি এ অন্যায় কাজকে বৈধ ও হালাল মনে করেছ, এবং আল্লাহর নির্দেশকে অস্বীকার করেছ কি না? যদি এ বিষয়ে প্রশ্ন করা ফরয হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ অবশ্যই প্রশ্ন করতেন এবং আমাদের কাছে এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য সংবাদ পেঁৗছতো।
সুতরাং রাসূল সা.—এর বাস্তব আমল প্রমাণ করে, কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে এ প্রশ্ন করা অত্যাবশ্যক নয় যে, সে কি অলসতা বশত এমন করেছে, নাকি হারামকে অস্বীকার বশত হালাল মনে করেছে? উপরন্তু কুরআনে কারিমের আয়াত বা নবী কারিম সা.—এর হাদিসেও এ সম্পর্কিত কোনো বর্ণনা আসেনি। এসবের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এ কথার সাক্ষ্য দেওয়ার পরও কোনো গোনাহ করেছে, তার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় ধরে নেওয়া হবে, সে একত্ববাদের ওপর বহাল আছে এবং আল্লাহর বিধানকে স্বীকার করে, তাকে সত্য, সঠিক ও অবশ্য পালনীয় মনে করে। এটাকে অস্বীকার ও মিথ্যারোপ করে না। তবে এর থেকে ব্যতিক্রম হলো, ঐসব কাজ যার কর্তাকে সাধারণভাবে অস্বীকারকারী ও মিথ্যারোপকারী গণ্য করে শুধু কাজের দ্বারাই তার ওপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা হবে। এর জন্য তার মৌখিক স্বীকারোক্তির প্রয়োজন হবে না।
কোনো পাপাচারী ব্যক্তি যখন আল্লাহর আদেশ অমান্য করে তখন তার ব্যাপারে বলা হবে, সে প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে, অথবা এক্ষেত্রে শয়তানের অনুসরণ করেছে। কিন্তু এ কথা বলা বৈধ হবে না যে, সে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করেছে, অথবা সে শয়তানের ইবাদত করেছে। তবে যদি সে এমন কাজ করে যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেবে, তখন বলা হবে, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করেছে, যা স্পষ্ট কুফর ও শিরক। কাজেই এ অবস্থা না হলে তাকে কাফের ও মুশরিক বলা যাবে না।
আর পাপাচারী ব্যক্তি যদি একত্ববাদকে স্বীকার করে এবং তার কৃত কাজটির ব্যাপারে যদি এমন স্পষ্ট বর্ণনা না থাকে যে, সেই কাজটি করার মাধ্যমে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে তাহলে তাকে কাফের বা মুশরিক বলা যাবে না। তাছাড়া সাধারণত ইবাদত বলতে বুঝায়, নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও অনুসরণ এবং কাউকে প্রভু রূপে গ্রহণ করা। এটি যদি হয় আল্লাহ তাআলা ভিন্ন অন্য কারও প্রতি, তাহলে সেটি হবে কুফর ও শিরক। অতএব, এমন অবস্থার সৃষ্টি না হলে কাউকে কাফের বা মুশরিক বলা যাবে না।
রিদ্দাহ :
রিদ্দাহ (الردة) শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, পূর্বের কৃত কাজ থেকে ফিরে আসা। যেমন— তুমি বললে, ارتد عن سفره, (সে সফর থেকে ফিরে আসলো)। ارتد هبته (সে তার অনুদান ফেরত নিল)।
আর তার পারিভাষিক অর্থ হলো, ইসলামের পর কুফরে ফিরে আসা।
ইসলামে মুরতাদের বিধান হলো, তাকে শাস্তি স্বরূপ হত্যা করা হবে। যেমন— নবী কারিম সা. বলেছেন,
مَنْ بَدَّلَ دِينَهُ فَاقْتُلُوهُ.
যে তার ধর্ম পরিবর্তন করে তাকে হত্যা কর। (সহিহ বুখারি : ৩০১৭)
হযরত ইবনে মাসউদ রা. সূত্রে ইমাম তিরমিযি একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন :
لَا يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إلَّا فِي إحْدَى ثَلَاثٍ: رَجُلٌ كَفَرَ بَعْدَ إيمَانِهِ، أَوْ زَنَى بَعْدَ إحْصَانِهِ، أَوْ نَفْسٌ بِنَفْسٍ .
যে মুসলিম ব্যক্তি এ কথা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তিনটি অপরাধের কোনো একটি ছাড়া তার রক্ত প্রবাহিত করা বৈধ হবে না। (সেই কারণগুলো হলো 🙂 কোনো ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরি করলো, অথবা বিবাহিত হওয়ার পরও ব্যভিচার করলো, কিংবা কাউকে হত্যা করলো, বিনিময়ে তাকেও হত্যা করা হলো, (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১২, পৃ. ১৬৫)
অপর এক হাদিসে হযরত উসমান রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, যখন তিনি স্বীয় বাড়িতে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন তখন বলেছিলেন, তোমরা কেন আমাকে হত্যা করবে? আমি রাসূলুল্লাহ সা.—কে বলতে শুনেছি :
لَا يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إلَّا بِإِحْدَى ثَلَاثٍ: رَجُلٌ كَفَرَ بَعْدَ إيمَانٍ، أَوْ زَنَى بَعْدَ إحْصَانٍ، أَوْ قَتَلَ نَفْسًا فَقُتِلَ بِهَا.
কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করা তিনটি অপরাধের কোনো একটি ছাড়া বৈধ হবে না : কোনো ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরি করলো, অথবা বিবাহিত হওয়ার পরও ব্যভিচারে লিপ্ত হলো, কিংবা কাউকে হত্যা করলো, বিনিময়ে তাকেও হত্যা করা হলো। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১২, পৃ. ১৬৫)
ইমাম বুখারি ও মুসলিমও হাদিসটি নিম্নে বর্ণিত শব্দে বর্ণনা করেছেন,
لاَ يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ، يَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ، إِلَّا بِإِحْدَى ثَلاَثٍ: النَّفْسُ بِالنَّفْسِ، وَالثَّيِّبُ الزَّانِي، وَالمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التَّارِكُ لِلْجَمَاعَةِ.
যে মুসলিম ব্যক্তি এ কথা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং আমি আল্লাহর রাসূল, তিনটি অপরাধের কোনো একটি ব্যতিরেকে তার রক্ত প্রবাহিত করা বৈধ হবে না : কাউকে হত্যা করলো, বিনিময়ে তাকেও হত্যা করা হলো, বিবাহিত হওয়ার পরও ব্যভিচারে লিপ্ত হলো, দীন থেকে বেরিয়ে গেল এবং মুসলিমদের জামাআতকে বর্জন করলো। Ñসহিহ বুখারি : ৬৮৭৮; সহিহ মুসলিম : ১৬৭৬। [ইমাম শাতেবি রচিত ‘আল—ইতিসাম]
এ ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি ঐ বিষয়কে অস্বীকার করবে, যার প্রতি ঈমান আনয়নকে আল্লাহ ফরয করেছেন, তাহলে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাফের হয়ে যাবে। তবে সেই অস্বীকারকারী যদি শরিয়ার বিধান সম্পর্কে অনবহিত হয় তাহলে তাকে শরিয়ার বিধান সম্পর্কে অবহিত করা হবে এবং তাকে জানানো হবেÑ কোন বিষয়ের ওপর ঈমান আনা ওয়াজিব এবং এর দ্বারা তার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হবে। তারপরও যদি সে অস্বীকার ও মিথ্যারোপের ওপর অটল থাকে তাহলে তার ব্যাপারে কাফের ও মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা হবে।
এ অস্বীকার স্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা হতে হবে। তবে যে কাজের ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, শুধু কাজের দ্বারাই তার কর্তা থেকে ঈমান চলে যাবে; যদিও সে মুখে কিছু না বলে, সে বিষয়টি এর থেকে ব্যতিক্রম।
আভিধানিক অর্থে বক্তব্য বলতে যা বুঝায় এখানে সেটিই ধর্তব্য হবে, তার রূপ ও পদ্ধতি যাই হোক এবং তাকে যে নামেই ব্যক্ত করা হোক। যেমনÑ লিখিত বক্তব্য, এটি গ্রন্থাকারে হোক, অথবা কোনো পত্রিকায় বা ম্যাগাজিনে ছাপা হোক, কিংবা চিত্রাঙ্কন হোক, বা তাকে আইন, নোটিশ বা রায় ইত্যাদি যে নামেই নামকরণ করা হোক, তা লিখিত বক্তব্য হিসেবে ধর্তব্য হবে।
মোটকথা, এ বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, অস্বীকারকারীর ওপর কাফের ও মুরতাদের বিধান আরোপিত হবে। তবে কখনও কখনও বক্তব্য বুঝতে সমস্যা হয় যে, তা অস্বীকার ও মিথ্যারোপকে অন্তভুর্ক্ত করে কি না? যে ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যদান করে তার ব্যাপারে মূলনীতি হলো, সে মুমিন ও মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে এবং ধারণাবশত তাকে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং মুরতাদ হয়ে যাওয়ার বিধার আরোপ করা হবে না। বরং তাকে কাফের ও মুরতাদ কেবল তখনই বলা হবে যখন তার বক্তব্য সুস্পষ্টরূপে অস্বীকার ও মিথ্যারোপ বোঝাবে এবং তাতে ব্যাখ্যার কোনো সুযোগ না থাকবে।
অতএব, অস্বীকারকারী ও মিথ্যারোপকারীর প্রতি মুরতাদের বিধান আরোপ হবে এবং কুরআন ও হাদিসে যে কাজের কর্তাকে মুরতাদ বলে অভিহিত করা হয়েছে তার ওপরও মুরতাদের বিধান আরোপ হবে, এ দুটি বিষয়ে ইজমা’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কিছু কিছু কাজের ব্যাপারে মতভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে যে, এসব কাজের কর্তাকে মুরতাদ বলা হবে কি না?
এ মতভিন্নতার ভিত্তি মূলত দুটি বিষয়ের ওপর :
এক. নুসুস (কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য) অনুধাবনে মতভিন্নতা
দুই. রাসূলুল্লাহ সা.—এর দিকে সম্পৃক্ত কিছু হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মতভিন্নতা। একদল লোক কিছু হাদিসসমূহকে বিশুদ্ধরূপে গ্রহণ করেছেন, আবার অপর একদল সেসব হাদিসের সনদের আপত্তি তুলে তা গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। যেমন কতক ফকিহর মতে নামায বর্জনকারী সম্পর্কিত রাসূল সা.—এর এ হাদিসটি সহিহ :
بين المسلم وبين الكافر ترك الصلاة
মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য হলো, নামায বর্জন করা।
সহিহ মুসলিমে হাদিসটি নিম্নোক্ত শব্দে বর্ণিত হয়েছে :
بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلَاةِ.
একজন (মুমিন) ব্যক্তির মধ্যে এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হলো, নামায বর্জন করা। (সহিহ মুসলিম : ৮২)
তবে একদল লোকের মতে এ হাদিসটি প্রমাণিত নয় বলে তারা এটিকে গ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে একজন হলেন, ইবনে হাযম জাহেরি। তিনি এ হাদিসের সনদের ওপর আপত্তি করেছেন।
যারা উক্ত হাদিসটিকে সহিহ আখ্যা দিয়েছেন তাদের বিপক্ষে আরেকটি হাদিস রয়েছে। আর তা হচ্ছে :
خَمْسُ صَلَوَاتٍ كَتَبَهُنَّ اللَّهُ عَلَى الْعِبَادِ، فَمَنْ جَاءَ بِهِنَّ لَمْ يُضَيِّعْ مِنْهُنَّ شَيْئًا اسْتِخْفَافًا بِحَقِّهِنَّ، كَانَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ، وَمَنْ لَمْ يَأْتِ بِهِنَّ فَلَيْسَ لَهُ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدٌ، إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ، وَإِنْ شَاءَ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ.
পাঁচ ওয়াক্ত নামায, যা আল্লাহ বান্দাদের ওপর ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি সেই নামাযগুলো যথাযথ আদায় করবে, তাতে কোনো ত্রুটি না করবে, সেগুলোর হক আদায়ে অবহেলা না করবে, তার জন্য আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রম্নতি থাকবে যে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। আর যে ব্যক্তি সেই নামাযগুলো আদায় না করবে, তার জন্য আল্লাহর নিকট কোনো প্রতিশ্রম্নতি থাকবে না। তিনি চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন, আর যদি চান তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (সুনানে আবু দাউদ : ১৪২০; মুসনাদে আহমদ : ২২৭২০; সুনানে নাসায়ি, সহিহ ইবনে হিব্বান)
এই শেষোক্ত হাদিসের দাবি অনুযায়ী নামায বর্জনকারী সেই আসল অর্থে কাফের হবে না। কারণ, পূর্বে অহিবাহিত হয়েছে যে, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী কাফেররা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ কারণে প্রথম হাদিসটির ক্ষেত্রে তারা দুটি ব্যাখ্যা করেছেন :
এক. প্রথম হাদিসের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে নামাযকে অস্বীকার বশত বর্জন করবে সে কোনো বিনা বাক্যব্যয়ে কাফের ও মুশরিক বলে গণ্য হবে।
দুই. হাদিসে বর্ণিত কুফর শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, চরম অবাধ্যতা। এটিকে ভীতি প্রদর্শন ও এর জঘন্যতা প্রকাশার্থে কুফর বলা হয়েছে।
আমরা এখানে ঐ সকল কাজের বিবরণ পেশ করবো না, যেগুলোর কর্তাকে কুরআন ও হাদিসে ঈমানের গণ্ডি থেকে বহিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সেসম্পর্কিত ফকিহগণের মতভেদ উল্লেখ করবো এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ফকিহগণের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্পষ্ট করার লক্ষে একটি পর্যালোচনা পেশ করবো। আর কিছু হাদিস উল্লেখ করবো, রাসূল সা.—এর দিকে যেগুলোর সম্পৃক্ততার বিশুদ্ধতার মতভেদ রয়েছে, যদিও ফকিহগণ সেগুলোকে সহিহ বলেই উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আবু জাফর আহমদ বিন মুহাম্মাদ বিন সালামাহ আযদি, ত্বহাবি, হানাফি ‘আল—আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহ’ গ্রন্থে বলেন, “আমরা কিবলার অনুসারীদের কাউকে গোনাহের কারণে কাফের আখ্যা দেইনা, যতক্ষণ না সে ঐ গোনাহকে হালাল মনে করে। আমরা একথাও বলি না যে, ঈমানের সাথে কেউ গোনাহ করলে তাতে তার কোনো ক্ষতি হবে না।”
‘আল—আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যাহ’র ব্যাখ্যাকারক উপরিউক্ত কথার ব্যাখায় বলেন, “গ্রন্থকারের উক্ত বক্তব্যের ওপর একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আর তা হলো, শরিয়াহপ্রণেতা কিছু কিছু গোনাহকে সরাসরি কুফর বলেছেন। যেমনÑ আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। (সূরা মায়িদা : ৪৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন,
سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ.
মুসলিমকে গালি দেওয়া পাপ এবং তাকে হত্যা করা কুফর। (সহিহ বুখারি : ৭০৭৬; সহিহ মুসলিম : ৬৪)
হযরত জারির রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা. বলেন :
لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ.
আমার পরে তোমরা কাফের হয়ে ফিরে যেও না যে, একজন অপরজনের গ্রীবায় আঘাত করবে। (সহিহ বুখারি : ১২১; সহিহ মুসলিম : ২৯)
হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন,
إِذَا قَالَ الرَّجُلُ لِأَخِيهِ يَا كَافِرُ، فَقَدْ بَاءَ بِهِ أَحَدُهُمَا.
যখন কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে লক্ষ্য করে বললো, হে কাফের! তখন তাদের দু’জনের একজন তা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলো। (সহিহ বুখারি : ৬১০৩; সহিহ মুসলিম : ৬০)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন,
أربع من كن فيه كان منافقا خالصا، ومن كانت فيه خصلة منهن كانت فيه خصلة من النفاق حتى يدعها: إذا اؤتمن خان، وإذا حدث كذب، وإذا عاهد غدر، وإذا خاصم فجر.
চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে হবে খাঁটি মুনাফিক। আর যার মধ্যে সেই স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকবে তার মধ্যে নিফাকের একটি স্বভাব রয়েছে; যতক্ষণ না সে ঐ স্বভাবকে বর্জন করে। (স্বভাব চারটি হলো 🙂 যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় সে আমানের খেয়ানত করে। যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন প্রতিশ্রম্নতি দেয় প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করে, আর যখন ঝগড়া করে গাল—মন্দ করে। (সহিহ বুখারি : ৩৪; সহিহ মুসলিম : ৫৮)
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন,
لا يزني الزاني حين يزني وهو مؤمن، ولا يسرق حين يسرق وهو مؤمن، ولا يشرب حين يشربها وهو مؤمن، والتوبة معروضة بعد
যখনই কোনো যিনাকারী যিনায় (ব্যভিচার) লিপ্ত হয়, যিনাকালীন সময়ে সে ঈমানহারা হয়ে যায়। যখনই কোনো চোর চুরি করে, চুরিকালীন সময়ে সে ঈমানহারা হয়ে যায়। যখনই কোনো ব্যক্তি মদপান করে, মদপানরত অবস্থায় সে ঈমানহারা হয়ে যায়। এরপর তার জন্য তাওবার অবকাশ থাকে। (সহিহ বুখারি : ৬৮১০; সহিহ মুসলিম : ৫৭)
হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সা.—কে বলতে শুনেছি,
بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلَاةِ.
একজন (মুমিন) ব্যক্তির মধ্যে এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে পার্থক্য হলো, নামায বর্জন করা। (সহিহ মুসলিম : ৮২)
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেছেন,
من أتى حائضا، أو امرأة في دبرها، أو كاهنا، فقد كفر بما أنزل على محمد.
যে ব্যক্তি ঋতুবতী নারীর কাছে গমন করলো, অথবা স্ত্রীর সাথে পায়ুপথে মিলিত হলো, অথবা গণকের কাছে গেল সে মুহাম্মাদ সা.—এর ওপর নাযিলকৃত বিষয়ের সাথে কুফরি করলো। (জামে তিরমিযি : ১৩৫; সুনানে ইবনে মাজাহ : ৬৩৯)
হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন,
من حلف بغير الله فقد أشرك.
যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নামে শপথ করলো সে শিরক করলো। (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৪৫; সুনানে আবু দাউদ : ৩২৫১)
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
اثنتان في الناس هما بهم كفر: الطعن في النسب والنياحة على الميت.
মানুষের মধ্যে দু’টি কাজ কুফর : বংশ নিয়ে কটাক্ষ করা এবং মৃতের জন্য বিলাপ করা। (সহিহ মুসলিম : ৬৭)
এ ছাড়াও এ জাতীয় আরও বহু হাদিস রয়েছে।
এ জাতীয় হাদিসের জবাব হলো, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, কোনো ব্যক্তি কবিরা গোনাহ করলে এর কারণে সে কাফের হবে না এবং মুসলিম মিল্লাত থেকে বেরিয়ে যাবে না, যেমনটি খারেজি সম্প্রদায় মনে করে। কারণ, কবিরা গোনাহকারীকে যদি কাফের ধরা হয় তাহলে সে হবে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী। আর ধর্মত্যাগীর বিধান হলো, তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে। আর যদি তাই হয় তাহলে কিসাসের অধিকারী (ওলী) ব্যক্তির পক্ষ থেকে হত্যাকারীকে মাফ করে দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ব্যভিচার, চুরি, মদপান ইত্যাদি অপরাধের দণ্ডবিধি কার্যকর করারও সুযোগ থাকবে না। স্পষ্টত এ কথাটি ভ্রান্ত ও বাতিল এবং দীনে ইসলামের সাথে এর আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এ বিষয়েও একমত যে, কবিরা গোনাহকারী ঈমান ও ইসলাম থেকে বহিষ্কার হবে না, সে কুফরে প্রবেশ করবে না এবং কাফেরদের সাথে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না, যেমনটি মুতাযিলারা মনে করে। তাদের এ মতবাদটিও বাতিল। কারণ, আল্লাহ তাআলা কবিরা গোনাহকারীদেরকে মুমিন হিসেবে গণ্য করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنْثَى بِالْأُنْثَى فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ.
হে মুমিনগণ! নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতাদের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী। তবে কাউকে যদি তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা করা হয় তাহলে ন্যায়সঙ্গতভাবে তার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। (সূরা বাকারা : ১৭৮)
এ আয়াতে হত্যাকারীকে ঈমানদারদের কাতার থেকে বের না করে তাকে কিসাসের অধিকারীর ভাই ঘোষণা করা হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ভাই দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে দীনি ভাই।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ (৯) إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ .
যদি মুমিনদের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর যদি তাদের একদল অপর দলের ওপর সীমালঙ্ঘন করে, তবে তোমরা সেই সীমালঙ্ঘনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে; যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়ানুগ পন্থায় মীমাংসা করে দিবে এবং ন্যায়বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই—ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। (সূরা হুজুরাত : ৯—১০)
পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত যে, ব্যভিচারী, চোর ও অপবাদ আরোপকারীকে হত্যা করা হবে না, বরং তার ওপর হদ্দ (শরয়ি দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করা হবে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, কবিরা গোনাহকারী মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) নয়। তাছাড়া নবী কারিম সা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন :
من كانت له مظلمة لأخيه من عرضه أو شيء، فليتحلله منه اليوم، قبل أن لا يكون دينار ولا درهم، إن كان له عمل صالح أخذ منه بقدر مظلمته، وإن لم تكن له حسنات أخذ من سيئات صاحبه فحمل عليه.
কারও পক্ষ থেকে যদি তার ভাইয়ের সম্মান বা অন্য কিছুর ব্যাপারে জুলুম হয়ে থাকে তাহলে যেন আজই তা মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার পূর্বে যেদিন দিনার, দিরহাম কিছুই থাকবে না। সেদিন যদি তার নেক আমল থাকে তাহলে জুলুমের পরিমাণ অনুযায়ী তার থেকে নেকি নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি নেকি না থেকে তাহলে তার সঙ্গীর কিছু মন্দ আমল নিয়ে তাকে বহন করানো হবে। (সহিহ বুখারি : ২৪৪৯)
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, জালেমেরও নেকি থাকবে, যার থেকে মাজলুমের হক আদায় করা হবে।
এমনিভাবে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা বলতে পার কি, দরিদ্র কে? সাহাবায়ে কেরাম উত্তর দিলেন : আমাদের মধ্যে যার দিরহাম (টাকা—পয়সা) ও আসবাবপত্র (ধন—সম্পদ) নেই সেই তো দরিদ্র। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে প্রকৃত দরিদ্র সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও যাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ ভোগ করেছে, কারও রক্ত ঝরিয়েছে এবং কাউকে মেরেছে। এরপর পাওনাদারদেরকে এক এক করে তার নেক আমলসমূহ থেকে দিয়ে দেওয়া হবে। এভাবে দেনা পরিশোধের পূর্বেই তার নেক আমলসমূহ শেষ হয়ে গেলে পাওনাদারদের কিছু গোনাহ নিয়ে তার ওপর নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম : ২৫৮১)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ.
সৎকর্মসমূহ অবশ্যই অসৎকর্মসমূহকে মিটিয়ে দেয়। (সূরা হুদ : ১১৪)
এর দ্বারা প্রমাণ হয়, গোনাহকারী ব্যক্তি গোনাহরত অবস্থায়ও নেক আমল করে, যা তার কৃত গোনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়। বড় বড় কিতাবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
আখিরাতের বিধানের বেলায় মুতাযিলারা খারেজি সম্প্রদায়ের সাথে একমত। কারণ, তারা সকলেই মনে করে, কবিরা গোনাহকারী ব্যক্তি জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। তবে পার্থক্য হলোÑ খারেজি সম্প্রদায় বলে, আমরা তাকে কাফের বলে নামকরণ করবো, আর মু’তাযিলা সম্প্রদায় বলে, আমরা তাকে ফাসেক (পাপাচারী) বলে নামকরণ করবো। অতএব, তাদের মধ্যকার এ পার্থক্য শুধুই শাব্দিক।
আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, কবিরা গোনাহকারী ব্যক্তি কৃত গোনাহের কারণে ধমকি ও সতর্কবার্তার সম্মুখীন হবে, যেমনটি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। তাদের বক্তব্য মুরজিয়াদের মত নয়, যারা বলে, ঈমানের সাথে গোনাহ করলে তাতে কোনো ক্ষতি হবে না এবং কুফরের সাথে নেকি করলে তাতে কোনো উপকার হবে না।
এখন যদি মুরজিয়াদের গৃহীত দলিল—প্রমাণ এবং খারেজি ও মুতাযিলা সম্প্রদায়ের গৃহীত দলিল—প্রমাণ এক সাথে রাখা হয় তাহলে এক পক্ষের দলিল দ্বারা অপর পক্ষের দাবি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। অতএব, তাদের মতবাদ আলোচনায় বিশেষ কোনো উপকার নেই। উপকার শুধু এতটুকু যে, পাঠক জানতে পারবেÑ প্রত্যেক দলের বক্তব্য দ্বারা অপর দলের বক্তব্য খণ্ডিত হয়ে যায়।
উল্লেখিত মতৈক্যের পর কথা হলো, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মধ্যে আবার শাব্দিক মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, যার দ্বারা নতুন করে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না। আর তা হলো, কুফরের মধ্যেও কি ছোট—বড় বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যেমন কারও কারও মতে ঈমানের মধ্যেও ছোট—বড় বিভিন্ন স্তর রয়েছে? এ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে মূলত ঈমানের বিষয়বস্তু নির্ধারণ সম্পর্কিত মতপার্থক্য থেকে। আর তা হলো, ঈমান কি কথা ও কাজের সমষ্টি, যার মধ্যে হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে? নাকি তার মধ্যে কোনো হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে না?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যাকে কাফের ঘোষণা করেছেন আমরাও তাকে কাফের ঘোষণা করবো। কারণ, এটি অসম্ভব যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত কোনো ব্যক্তি বিচার—ফয়সালা করলে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তাকে কাফের ঘোষণা করবেন, অথচ আমরা তাকে কাফের ঘোষণা করবো না।
যারা বলে, ঈমান হচ্ছে কথা ও কাজের সমষ্টি, যার মধ্যে হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে, তাদের বক্তব্য হলো, উল্লেখিত আয়াতে যে কুফরের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে কর্মগত কুফর, আকিদাগত কুফর নয়। অর্থাৎ, তাদের মতে ঈমানের ন্যায় কুফরের মধ্যেও বিভিন্ন স্তর রয়েছে।
আর যারা বলে, ঈমান হচ্ছে শুধু অন্তরের বিশ্বাসের নাম, যেখানে কাজের কোনো দখল নেই, আর কুফর হচ্ছে অন্তরের অস্বীকৃতির নাম, যার মধ্যে কোনো হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটে না, তাদের বক্তব্য হলো, উল্লেখিত আয়াতে রূপক কুফর উদ্দেশ্য, প্রকৃত কুফর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, প্রকৃত কুফর তাকেই বলা হয় যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। এমনিভাবে তারা কতক আমলের ব্যাপারেও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। যেমনÑ আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ.
আর আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করবেন। (সূরা বাকারা : ১৪৩)
এ মতের প্রবক্তাদের মতে উক্ত আয়াতে ঈমান দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায় করা। এটিকে রূপক অর্থে ঈমান বলে নামকরণ করা হয়েছে। কারণ, নামায বিশুদ্ধ হওয়া ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া নামায ঈমানের আলামত। কেননা কোনো ব্যক্তির নামায আদায় দ্বারা বুঝা যায় যে, লোকটি ঈমানদার। এ কারণে কোনো কাফের যদি ছদ্মবেশে আমাদের সাথে নামায আদায় করে তাহলে তাকে বাহ্যত মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়।
অতএব, উম্মতের ফকিহগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, গোনাহগার লোকেরা যদি প্রকাশ্যে ও মনে মনে রাসূলুল্লাহ সা.—এর আনীত দীনকে নিজের দীন বলে স্বীকার করে এবং দীনের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলোকে মান্য করে তাহলে তারা যদিও ঈমানহারা হবে না, তবে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত ধমকি ও সতর্কবার্তার সম্মুখীন হবে। তবে এক্ষেত্রে ভ্রান্ত মতবাদ হচ্ছে, ঐ সকল লোকদের কথা যারা বলেÑ কবিরা গোনাহকারীরা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, যেমনটি খারেজি ও মুতাযিলা সম্প্রদায় মনে করে।
তবে এক্ষেত্রে অধিকতর মন্দ বিষয়টি হলো, বিরোধী মতাবলম্বীদের প্রতি অন্যায়, অবিচার করা। তাদের প্রতি অবাস্তব কথা আরোপ করা এবং মিথ্যা নিন্দা করা। যেহেতু আমরা কাফেরদের সাথে বিতর্কের ক্ষেত্রেও ন্যায়ানুগ থাকতে আদিষ্ট হয়েছি এবং আরও আদিষ্ট হয়েছি উত্তমরূপে বিতর্ক করতে তাহলে আমরা পরস্পর এ জাতীয় মতভিন্নতার ক্ষেত্রে কেনই বা ইনসাফ করবো না? আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ}
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে অবিচল থাকবে। কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে। কারণ, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ তাআলা সেসম্পর্কে সম্যক অবগত। (সূরা মায়িদা : ৮)
এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আর তা হলো, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের খেলাফ বিচার—ফয়সালা করা কখনও কুফর হয়, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। কখনও কবিরা গোনাহ হয়, আবার কখনও সগিরা গোনাহ হয়। কুফরের মধ্যেও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারভেদ। কখনও রূপক অর্থে কুফর হয়, আবার কখনও তুলনামূলক ছোট কুফর, যেমনটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এ তারতম্য হবে বিচারকের অবস্থার তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে। বিচারক যদি মনে করে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা করা ওয়াজিব নয়, বরং এ সেই বিধান গ্রহণ না করারও অবকাশ রয়েছে, অথবা সে আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করে, অথচ সে জানে যে, এটি নিশ্চিতরূপেই আল্লাহর বিধান তাহলে এটি হবে বড় কুফর।
আর যদি সে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা করাকে ওয়াজিব বলে বিশ্বাস করে এবং আলোচ্য বিষয়ে সে আল্লাহর বিধান জানেও, উপরন্তু সে এ কথা স্বীকার করে যে, সেই বিধান অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা না করলে সে শাস্তির উপযুক্ত হবে তাহলে সে গোনাহগার হবে। তবে এটি হবে রূপক অর্থে কুফর বা তুলনামূলক ছোট কুফর। কিন্তু যদি সে তার সাধ্যের সবটুকু চেষ্টা সত্ত্বেও আল্লাহর বিধান জানতে অক্ষম হয়, অথবা ভুল করে তাহলে সে হবে এমন ভুলকারী, যে তার ইজতিহাদের জন্য একটি নেকি পায় এবং সেক্ষেত্রে তার ভুলটি হবে মার্জনীয়।
ইমাম ত্বহাবি র. তার বাণী “আমরা এ কথা বলি না যে, ঈমানের সাথে কোনো গোনাহ করলে এটি তার কর্তার কোনো ক্ষতি করবে না” এ কথার দ্বারা মূলত মুরজিয়া ও তাদের অনুরূপ অন্যান্য লোকদের মতের বিরোধিতা প্রকাশ করেছেন, যারা পূর্বের যুগেও ছিল। সাহাবায়ের কেরাম রা. তাদের ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, যদি তারা এর থেকে তাওবা না করে তাহলে তাদেরকে হত্যা করতে হবে। যেমন কুদামা ইবনে আব্দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি মদপান হারাম হওয়ার পরও মদপান করে। সে এবং তার অনুসারী একদল লোক এক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে :
لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا.
যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে তারা যা আহার করেছে তাতে কোনো পাপ নেই। (সূরা মায়িদা : ৯৩)
হযরত উমর রা.—এর কাছে এ বিষয় আলোচনা করা হলে তিনি এবং হযরত আলী রা.—সহ সকল সাহাবি এ কথায় একমত হন যে, যদি তারা মদপান হারাম হওয়াকে স্বীকার করে তাহলে তাদেরকে বেত্রাঘাত করা হবে। আর যদি এটিকে হালাল মনে করার ওপর অবিচল থাকে তাহলে তাদেরকে হত্যা করা হবে। তখন উমর রা. কুদামাকে লক্ষ্য করে বলেন, তোমার নিতম্ব নিশানায় ভুল করেছে। যদি তুমি তাকওয়া অবলম্বন করতে, ঈমান আনয়ন করতে এবং সৎকর্ম করতে তাহলে মদপান করতে না।
উল্লেখিত আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হলো, উহুদ যুদ্ধের পর যখন আল্লাহ তাআলা মদপান হারাম করলেন তখন কতক সাহাবি বলাবলি করতে লাগলো, মদপান যদি হারামই হয় তাহলে আমাদের সঙ্গীদের অবস্থা কী হবে, যারা মদপানে অভ্যস্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে? তখন আল্লাহ তাআলা এ আয়াত নাযিল করলেন, যেখানে বলা হয়েছেÑ যারা হারাম ঘোষণার পূর্বে মদপান করেছে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না, যদি তারা মুমিন, মুত্তাকি ও সৎকর্মশীল হয়ে থাকে। বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামায আদায়ের বিষয়টিও অনুরূপ।
পরে এসকল লোকেরা মদপানের কারণে নিন্দিত হয়েছে, কারণ তারা ভুল করে তাওবা থেকে নিরাশ হয়ে পড়েছিল। এ কারণে হযরত উমর রা. কুদামা বরাবর পত্র লিখেন :
حم (১) تَنْزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ (২) غَافِرِ الذَّنْبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيدِ الْعِقَابِ.
হা—মীম। এ কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট থেকে। যিনি পাপ ক্ষমা করেন, তাওবা কবুল করেন এবং কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। (সূরা মুমিন : ১—৩) আমার জানা নেই, তোমার দুটি গোনাহর মধ্যে কোনটি অধিকতর বড়? হারাম জিনিসকে হালাম মনে করা, নাকি আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া?
সাহাবায়ে কেরামের এ ঐকমত্যের সাথে পরবর্তীকালের ইমামগণও একমত পোষণ করেছেন। (শরহুল আকিদাতিত ত্বহাবিয়্যাহ : পৃ. ২৯৭—৩০৩)
নিফাক :
নিফাক (النفاق) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোনো বিষয়কে অন্তরে গোপন রেখে তার বিপরীত প্রকাশ করা। যে ব্যক্তি এমন করে তাকে মুনাফিক বলে। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মূলত ঐ ইঁদুরের সাথে সাদৃশ্য দেওয়া হয়, যে একটি দুমুখো গর্ত করে, যার একটিকে বলে নাফিকা’ (النافقاء), আর অপরটিকে বলে কাসিআ’ (القاصعاء)। তার গর্ত করার নিয়ম হলো, সে মাটির নিচ থেকে গর্ত খুঁড়তে থাকে। যখন মাটি খুঁড়ে ওপরাংশের কাছে চলে আসে তখন মাটির পাতলা আবরণ রেখে দেয়, যেন বাহির থেকে তার গর্তটি বুঝা না যায়। যখন গর্ত থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন হয় তখন তার মাথা দ্বারা মাটি সরিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আবার যখন গর্তে ঢুকে পড়ে তখন মাটির আস্তর ফেলে দেয়। এভাবে তার গর্তটিকে সে আড়াল করে। (তাফসিরে কুরতুবি : খ. ১, পৃ. ১৯৫) এমনিভাবে যেহেতু মুনাফিক বা কপট ব্যক্তি তার অন্তরের কথাকে গোপন করে এর বিপরীত প্রকাশ করে তাই তাকে ‘মুনাফিক’ বলে নামকরণ করা হয়।
আর শরিয়াহর পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে অন্তরে দীনের কোনো বিষয়কে গোপন করে বাইরে এর বিপরীত প্রকাশ করে।
এ নিফাক দুই প্রকার : এক প্রকার হলো, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে কুফরের গণ্ডিতে নিয়ে যায়। আরেক প্রকার হলো, যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে না; তবে সে বড় গোনাহগার হয়।
যে প্রকারটি ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়, তা হচ্ছেÑ আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ের প্রতি ঈমান আনাকে ফরয করেছেন, কোনো ব্যক্তি সেই বিষয়কে অস্বীকার করে এবং মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ (৮) يُخَادِعُونَ اللَّهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ (৯) فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ.
আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা বলে, ‘আমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান এনেছি’; কিন্তু তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহ ও মুমিনদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা বুঝতে পারে না যে, তারা কেবল তাদের নিজেদেরকেই প্রতারিত করছে। তাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের সেই ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন। তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী। (সূরা বাকারা : ৮—১০)
অতএব, আল্লাহ তাআলা ‘তারা মুমিন নয়’ এ কথার মাধ্যমে তাদের ঈমান না থাকার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা এ সিদ্ধান্তও দিয়েছেন যে, আল্লাহ যে বিষয়ে ঈমান আনাকে ফরয করেছেন সে বিষয়ে অন্তরে ঈমান না এনে শুধু মুখে স্বীকারোক্তি প্রদানকারী হলো মিথ্যুক। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ.
নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। (সূরা নিসা : ১৪৫)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ.
যখন মুনাফিকরা আপনার নিকট আসে তখন তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। আল্লাহ জানেন যে, নিশ্চয় আপনি তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী। (সূরা মুনাফিকুন : ১)
এটি হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নিকট এ প্রকার মুনাফিকের বিধান। আর আমাদের মত মানুষের নিকট এবং জাগতিক বিধান হলো, একজন মুনাফিককে কেবল তখনই মুনাফিক বলে আখ্যা দেওয়া হবে, যখন সে তার অন্তরের গোপন কুফরটি প্রকাশ করে দিবে। কিন্তু যদি সে তার কুফরের বিষয়টি প্রকাশ না করে; বরং ঈমান ও ইসলামের কথা স্বীকার করে তাহলে সে বাহ্যত মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। তখন তার সাথে আমাদের মুসলিমের ন্যায় আচরণ করতে হবে এবং তার ওপর মুসলিমদের বিধান প্রযোজ্য হবে।
তবে পবিত্র কুরআন মাজিদ ও সহিহ হাদিস শরিফে মুনাফিকদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে; যাতে করে এসবের মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অবস্থা যাচাই করতে পারে এবং আল্লাহর বিচারে তার অবস্থা কি হবে তা বুঝতে পারে। আমরা যদি মানুষের মধ্যে এসকল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা এ জাতীয় অন্য কোনো স্বভাব দেখতে পাই তাহলে ধারণার বশবর্তী হয়ে তার ওপর মুনাফিকের বিধান প্রয়োগ করা ঠিক হবে না এবং কারও মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি পাওয়া গেলে তার ওপর ভিত্তি করে তাকে নিশ্চিতরূপে কাফের আখ্যা দেওয়া যাবে না। তবে আমাদের কর্তব্য হলো, তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা এবং মুখে এর প্রতিবাদ করা, যেন সে ঐসকল মন্দ স্বভাব বর্জন করে।
ইমাম তাবারি ‘আল—জামে লিআহকামিল কুরআন’ (খ. ১, পৃ. ২০০)—এ বলেন, আল্লাহ তাআলা বান্দার বাহ্যিক অবস্থার ওপর বিধান প্রয়োগের আদেশ করেছেন এবং বান্দার অন্তর্নিহিত অবস্থার ওপর বিধান প্রয়োগের দায়িত্ব কোনো সৃষ্টিকে না দিয়ে এ দায়িত্ব স্বয়ং নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। অতএব, কারও অন্তর্নিহিত অবস্থার ওপর বিধান প্রয়োগের ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। কারণ, তা কেবলই ধারণাপ্রসূত বিষয়। যদি এ ক্ষমতা কাউকে ন্যস্ত করা হতো তাহলে রাসূলুল্লাহ সা.—ই ছিলেন এর সর্বাধিক উপযুক্ত ব্যক্তি। অথচ আমরা দেখি, রাসূলুল্লাহ সা. মুনাফিকদের বাহ্যিক অবস্থার ওপর বিধান প্রয়োগ করেছেন এবং তাদের অন্তর্নিহিত বিষয়কে আল্লাহ তাআলার নিকট সোপর্দ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ি র. বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর পবিত্র কিতাবে যে ঘোষণা করেছেন,
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّار
নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। (সূরা নিসা : ১৪৫)
এ পবিত্র আয়াত শাসকদের জন্য এ বিষয় আবশ্যক করেছে যে, মানুষের অন্তর্নিহিত বিষয়কে পরিহার করে তার বাহ্যিক অবস্থা তথা কথা, কাজ, স্বীকারোক্তি, দলিল—প্রমাণ, সাক্ষ্য ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে বিধান প্রয়োগ করতে হবে এবং আরও নির্দেশ করেছে যে, তাদের কতর্ব্য হলো, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ যে সীমারেখা দিয়েছেন সে পর্যন্ত এসে থেমে যাওয়া। সেই সীমারেখাকে অতিক্রম না করা, আর যেখানে আল্লাহ অথবা তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্ত বিদ্যমান আছে তাতে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান না করা। (আর—রিসালাতু লিলইমাম আশ—শাফেয়ী পৃ. ১৫১—১৫৭)।
আর কুফরের চেয়ে নিম্ন স্তরের নিফাকটি হলো, এমন কাজকে গোপন করা শরিয়াহ যাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং তাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করেছে। যেমনÑ রাসূল সা. বলেছেন,
ثلاث من كن فيه كان منافقا خالصا : إذا حدث كذب وإذا وعد أخلف وإذا اؤتمن خان وإن صام وصلى وزعم أنه مسلم.
তিনটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে হবে খাঁটি মুনাফিক : যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে, ওয়াদা ভঙ্গ করে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে আমানতের খেয়ানত করে। সে মুনাফিক; যদিও সে রোযা রাখে, নামায পড়ে এবং নিজেকে মুসলিম বলে ধারণা করে। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১১, পৃ. ২০২)
অপর এক হাদিসে নবীজি সা. বলেছেন,
أربع من كن فيه كان منافقاخالصا ومن كانت فيه خلة منهن كانت فيه خلة من نفاق حتى يدعها: إذا حدث كذب، إذا وعد أخلف، إذا عاهد غدر، وإذا خاصم فجر
চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকবে সে হবে খাঁটি মুনাফিক। যার মধ্যে সে স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকবে তার মধ্যে যেন নিফাকের একটি স্বভাব রয়েছে; যতক্ষণ না সে তা বর্জন করে : যখন কথা বলে মিথ্যা বলে। যখন ওয়াদা করে ওয়াদার খেলাফ করে। যখন প্রতিশ্রম্নতি দেয় প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করে, আর যখন বিবাদ করে গালি—গালাজ করে। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১১, পৃ. ২০২) সহিহ বুখারিতেও এ বিষয়ে হাদিস রয়েছে (খ. ১, পৃ. ১৫)।
অতএব, যার মধ্যে এসব নিন্দনীয় স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকবে, সে যদি তার বাহ্যিক আচরণের খেলাফ অন্তরে কোনো বিষয়কে গোপন করে এবং এমন কথা বলে তার কাজের সাথে যার কোনো মিল নেই তবে তার সেই কাজটি হবে নিন্দিত নিফাক ও পাপ। তবে এ কারণে সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে না। তার প্রমাণ হলো, যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায় তার ব্যাপারে বিধান হলো, তাকে হত্যা করা হবে। আর উপরোল্লিখিত স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তি তথা বিবাদের সময় গাল—মন্দকারী, প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গকারী, ওয়াদা খেলাফকারী, আমানতের খেয়ানতকারী, কথায় মিথ্যাবাদী, এ জাতীয় ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে না। কারণ, তাদেরকে হত্যার ব্যাপারে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি। এমনকি এ ব্যাপারে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হওয়া তো দূরের কথা, কোনো ফকিহও এমন মত প্রদান করেননি।
আর যে মুনাফিক অন্তরে কুফরকে গোপন করে মুখে ঈমান ও ইসলামের কথা প্রকাশ করে সে মূলত নিজেকেই ধেঁাকা দিচ্ছে। আরবের এক বিজ্ঞজন বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি এমন সত্তাকে ধেঁাকা দেয় যাকে ধেঁাকা দেওয়া অসম্ভব, সে আসলে নিজেকেই ধেঁাকা দিচ্ছে।’
মুনাফিক মূলত তার কপটতার কারণে আল্লাহর পরিচয় জানে না। যদি সে বাস্তবে আল্লাহর পরিচয় জানতো তাহলে এ কথা বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ তাঁর অন্তরের গোপন কথাও জানেন এবং আল্লাহ তাআলাকে কেউ ধেঁাকা দিতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন :
لَا تُخَادِعِ الله فإنه من يخادع الله يخدعه الله وَنَفْسَهُ يَخْدَعُ لَوْ يَشْعُرُ.
“তুমি আল্লাহকে ধেঁাকা দিও না। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ধেঁাকা দেয় আল্লাহ তাকে ধেঁাকায় ফেলে রাখেন, ফলে সে প্রতারিত হতে থাকে। যদি সে বুঝতো!” তখন সাহাবায়ে কেরাম প্রশ্ন করলেন, মানুষ আল্লাহকে কীভাবে ধেঁাকা দেয়? জবাবে নবীজি সা. বললেন,
تَعْمَلُ بِمَا أَمَرَكَ اللَّهُ بِهِ وَتَطْلُبُ بِهِ غَيْرَهُ.
যেমন তুমি আল্লাহর নির্দেশ পালন করলে; কিন্তু আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও থেকে বিনিময় আশা করলে। (আদাবুন নাফস, তাবারি; তাফসিরে কুরতুবি : খ. ১, পৃ. ১৯)
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শাসন
হাদিস শরিফ :
আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন,
أمران تركتهما فيكم لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله تعالى وسنة نبيه صلى الله عليه وسلم.
‘আমি তোমাদের মধ্যে দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা সেগুলোকে আকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। সে দুটি বিষয় হচ্ছেÑ আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর (সা.) সুন্নাত।’ [ইবনে হাযম রচি আল—ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম, খ. ৮, পৃ. ৩০]
কিছু কিছু মানুষের মুখে একটি পরিভাষ শোনা যায়, তা হচ্ছে হাকিমিয়াত (الحاكمية) বা শাসন। এর দ্বারা তারা ঐ সকল বিষয় ও বিধানকে বুঝিয়ে থাকেন যা কুরআনে কারিমের আয়াত ও হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর এ শব্দটিকে আবার আল্লাহ তাআলার দিকে সম্পৃক্ত করে বলেন, হাকিমিয়াতুল্লাহ (حاكمية الله) বা আল্লাহর শাসন।
এরপর মহান আল্লাহর দিকে সম্পৃক্তকরণের সূত্র ধরে সেখান থেকে কিছু শাখাগত বিধান রচনা করেন। এক্ষেত্রে তারা বলেন, আল্লাহ শাসনের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন এমন…। আর তার দাবি হচ্ছে, ব্যক্তি এই বিষয়গুলো বিশ্বাস করবে। তখন অমুক অমুক কাজ করা তার ওপর ফরয হয়ে যাবে। যদি সে সেই কাজগুলো না করে; বরং এর বিপরীত কাজ করে তাহলে সে আল্লাহর শাসনের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর তারা সেই অমান্যকারী ব্যক্তিকে একটি বিশেষ উপাধিতে বিশেষায়িত করে।
আমরা বিশ্বাস করি, ‘হাকিমিয়াত’ শব্দটি কুরআনে কারিমের কোনো আয়াতে বর্ণিত হয়নি। এমনকি আমাদের অনুসন্ধানে কোনো সহিহ হাদিসেও হাকিমিয়াত শব্দটি পাওয়া যায়নি। আর মহান আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করে ‘হাকিমিয়াতুল্লাহ’ শব্দের ব্যবহার তো সুদূর পরাহত বিষয়।
অভিজ্ঞতা ও মানুষের বাস্তব অনুশীলন দ্বারা প্রতীয়মান হয়, গবেষক ও চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ কুরআনে কারিমের কিছু আয়াত এবং কিছু হাদিস শরিফের বক্তব্য ও মর্মের মধ্যে সম্পর্ক নিরূপণ করেন, অতঃপর সেগুলো নিয়ে গভীর চিন্তা—ভাবনার মাধ্যমে একটি পরিভাষা রচনা করেন।
তবে কিছুকাল যেতে না যেতেই মানুষ সেই উদ্ভাবিত পরিভাষাটিকে সহজ বিবেচনা করে। মানুষের মধ্যে এর ব্যাপক চর্চা হয়, অতঃপর মানুষ এর পক্ষে জোর গলায় কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য, যারা এ পরিভাষার ভিত্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গবেষক ও চিন্তকদের প্রবন্ধ ও রচনাবলি অধ্যয়ন করে এবং তারা যে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বা বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন তার প্রতি খেয়াল করে। আর এ অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে গবেষক ও চিন্তকদের সমগ্র রচনাবলি পাঠ করেছে এবং তাদের বক্তব্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবনে সক্ষম হয়েছে। বরং তাদের অধিকাংশের অবস্থা হলো এমন যে, তারা পরিভাষার চর্চা করে; অথচ এর প্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই জানে না। বরং সে কিছু ভাসা ভাসা বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে, কিংবা এমন বক্তার কথা শুনে, যে না নিজে ভালো করে অনুধাবন করতে পেরেছে, আর না সঠিকরূপে ব্যক্ত করতে পেরেছে।
দীর্ঘ সময় না পেরোতেই সেই পরিভাষাটি মানুষের চিন্তায় একটি স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে এবং তারা মনে করতে থাকে যে, এ পরিভাষাটিই ভিত্তি ও প্রত্যবর্তনস্থল এবং এটিই হচ্ছে মূলনীতি ও সামগ্রিক বিধান, যার আলোকে বিভিন্ন শাখাগত বিধান নির্গত হয়। তখন তারা ভুলে যায়, এ পরিভাষার পেছনে রয়েছে পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত ও হাদিস, যা তার উৎ ও মূলভিত্তি এবং তা—ই হচ্ছে আসল প্রত্যাবর্তনস্থল। বরং তাদের মাথা থেকে এ কথা উধাও হয়ে যায় যে, এ পরিভাষা প্রণেতাদের উদ্দেশ্য কেবল এটাই ছিল যে, একটি সামগ্রিক অর্থবিশিষ্ট শব্দের মাধ্যমে এর দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং তার গুরুত্ব তুলে ধরা। কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে ফিকহি বিধান প্রণয়ন করা, বিশেষত শাখাগত বিধানÑ এটি কখনও উদ্দেশ্য ছিল না।
এমনিভাবে কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী একটি পরিভাষা তৈরি করে, যার স্বপক্ষে কিতাবুল্লাহ বা সুন্নাতে রাসূল হতে কোনো দলিল নেই। তারা এমন মানুষের কথাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে, যে নিষ্পাপ নয়; উপরন্তু তার মধ্যে ভুল—ত্রুটির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার বক্তব্যের পেছনে থাকে অস্পষ্ট ও ভুল জ্ঞান।
এ কারণে আমাদের জন্য আবশ্যক হচ্ছে, সাধারণ মানুষের প্রণীত পরিভাষায় [যারা নিষ্পাপ নয়] নিজেদের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ না করা; রবং বিশ্বজগতের পালনকর্তা এবং রাসূলকুল শিরোমনি হযরত মুহাম্মাদ সা.—এর কথা ও বাণীর আশ্রয়গ্রহণ এবং তাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী হচ্ছে চূড়ান্ত, যেখানে ভুল—ত্রুটি ও বিস্মৃতির কোনো সম্ভাবনা নেই। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী পরিপূূর্ণরূপে সংরক্ষিত, যেখানে কিয়ামত অবধি কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন হবে না। এটি সেই পবিত্র কালাম যার মধ্যে কোনো বৈপরীত্য বা পারস্পরিক সংঘর্ষ নেই। এটি সেই পবিত্র কালাম, যা বাহ্যত একই রকম হলেও এর কতক অংশ কতক অংশের ব্যাখ্যা করে এবং তার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে।
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, একটি আয়াত অর্থের বিবেচনায় অত্যন্ত ব্যাপক, অতঃপর আরেকটি আয়াত দেখবেন, পূর্বের আয়াতকে সীমিত করেছে এবং তার থেকে কিছু বিষয়কে বাদ দিয়েছে। এরপর হাদিস শরিফে দেখবেন, পূর্ববর্তী দুই আয়াতের পরিপূরক শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
আমরা এমনও দেখেছি যে, পবিত্র কুরআনের আয়াতে দুটি শব্দের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলোর নির্দিষ্ট আভিধানিক অর্থ রয়েছে। অতঃপর হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছেÑ উল্লেখিত শব্দ দুটি দ্বারা তার আভিধানিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়; বরং তারা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট শরয়ি অর্থ।
শরয়ি বিধান গ্রহণ করা হয় মহান আল্লাহর কালাম ও রাসূল সা.—এর বাণী দ্বারা। সাধারণ মানুষের কথা বা তাদের প্রণীত পরিভাষা দ্বারা নয়, সেই ব্যক্তি যেই হোক না কেন।
শরিয়ার দৃষ্টিতে বিধান গ্রহণের নিয়ম হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের আয়াত ও হাদিস শরিফে বর্ণিত নীতিমালার আলোকে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস থেকে বিধান আহরণ করতে হবে। অতএব, আমাদেরকে সর্বদা পবিত্র কুরআনের আয়াতের দিকেই ফিরে যেতে হবে এবং তার মধ্যে চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ.
এটি একটি কল্যাণময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা স—দ : ২৯)
আর বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত রাসূল সা.—এর হাদিসসমূহকেই সকল আয়াতের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ.
আর আমি আপনার কাছে কুরআন অবতীর্ণ করেছি; যাতে করে আপনি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন ঐ বিষয় যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, আর যাতে তারা চিন্তা করে। (সূরা নাহল : ৪৪)
অতএব, মানবরচিত পরিভাষা কখনও পবিত্র কুরআন ও হাদিসের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। কেননা মানুষ প্রায়শই ভুলের শিকার হয়। এ কারণে কিতাবুল্লাহ ও রাসূল সা.—এর হাদিস থাকা সত্ত্বেও মানবরচিত পরিভাষাসমূহকে আকড়ে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
‘বিধান দেওয়ার অধিকার কেবল আল্লাহর’
আমাদের আকিদা
আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে Ñযাতে সন্দেহের কোনো লেশ নেইÑ, বিধান দেওয়ার ক্ষমতা কেবল আল্লাহর এবং যাবতীয় আদেশ ও নিষেধ জারির অধিকার কেবল আল্লাহ তাআলার, তিনি ছাড়া আর কেউ নন। তিনিই হালালকে হালাল করেন এবং হারামকে হারাম করেন। তিনি ছাড়া এ অধিকার আর কারও নেই। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হয়েছে :
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ
বিধান দেওয়ার অধিকার কেবল আল্লাহর। (সূরা ইউসুফ : ৪০)
أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ
জেনে রাখ, সৃষ্টি ও আদেশ কেবল তাঁরই। (সূরা আরাফ : ৫৪)
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ .
তোমাদের জিহ্বা মিথ্যারোপ করে বলে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা রটনা করার জন্য বলো না, এটা হালাল এবং এটা হারাম। (সূরা নাহল : ১১৬)
আমরা পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহই একমাত্র সত্য ও সঠিক। এছাড়া অন্য সকল মতবাদ ও মতাদর্শ বাতিল ও জুলুমের সূতিকাগার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ.
আমি সত্যসহ কুরআন নাযিল করেছি এবং তা সত্যসহই নাযিল হয়েছে। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১০৫)
فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَال.
সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কী থাকে? (সূরা ইউনুস : ৩২)
আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মান্য করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। আল্লাহ কতৃর্ক আদেশের দাবিতেই তা আমাদের জন্য আবশ্যক। কোনো শাসক তা পছন্দ করুক বা না করুক, তাতে কিছু আসে যায় না।
আমরা পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহকে পৃথিবীর বুকে বাস্তবায়িত করা অপরিহার্য এবং প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব হচ্ছে, এর দাবি অনুযায়ী আমল করা এবং নিজের পূর্ণ সামর্থ্য অনুযায়ী তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। শাসক সেই বিধানকে বাস্তবায়ন করুক অথবা তাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করুক, সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ না করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا.
আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না। যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলো সে স্পষ্টত পথভ্রষ্ট হলো। (সূরা আহযাব : ৩৬)
আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস হলো, আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহ ব্যতিরেকে ভিন্ন কোনো মতাদর্শ গ্রহণ করা নাজায়েয ও অবৈধ। সেই শরিয়াহই হচ্ছে হালাল ও হারামের মানদণ্ড। এমনিভাবে ফরয, ওয়াজিব, মুস্তাহাব ও মাকরূহ ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে শরিয়াহর নির্দেশনাই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫)
আল্লাহ যে বিষয়কে হালাল করেছেন তা কিয়ামত অবধি হালালই থাকবে। পৃথিবীর কেউ তাকে হারাম করার ক্ষমতা রাখে না।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা : ৩)
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ .
সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে তোমার প্রতিপালকের বাণী পরিপূর্ণ। তাঁর কথা পরিবর্তন করার সাধ্য কারও নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা আনআম : ১১৫)
আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, এ বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কারও কাছে সত্য পেঁৗছার এবং তার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যদি এ কথা বিশ্বাস করে যে, কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দল বা অন্য কারও আল্লাহ কতৃর্ক হারাম বিষয়কে হালাল করার ক্ষমতা রয়েছে, অথচ রাসূল সা.—এর ইন্তিকালের সাথে সাথে তাঁর নিকট ওহির আগমন বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে তার চিরন্তন হারাম হওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, অথবা সে আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম করে, অথচ রাসূল সা.—এর ইন্তিকালের সাথে সাথে তাঁর নিকট ওহির আগমন বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে তার চিরন্তন হালাল হওয়ার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, অথবা এমন কোনো কাজকে ওয়াজিব করে, রাসূল সা.—এর ইন্তিকালের সময় যা ওয়াজিব ছিল না, অথবা এমন বিধান প্রণয়ন করে, নবীজি সা.—এর জীবদ্দশায় যার বৈধতা ছিল নাÑ যে ব্যক্তি তার নিকট সত্য উপস্থিত হওয়া এবং প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এমনটি বিশ্বাস করবে এবং এক্ষেত্রে সে কিতাবুল্লাহ বা সুন্নাতে রাসূল হতে কোনো ব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ না করবে তাহলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে এবং কাফের ও মুশরিকে পরিণত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ.
তাদের কি এমন কিছু শরিক আছে, যারা তাদের জন্য এমন দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা : ২১)
আমরা বিষয়টিকে অধিকতর স্পষ্ট করার জন্য আল্লাহর সাহায্যে বলবো, আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমানের দাবি, তাঁর একত্ববাদের দাবি, অন্য কথায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’—এর সাক্ষ্যদানের দাবি হচ্ছে, এ কথা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা যে, একমাত্র আল্লাহ তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যার ক্ষমতার কোনো সীমা—পরিসীমা নেই। তিনি ছাড়া এমন ক্ষমতা আর কারও নেই। তিনি যা ইচ্ছা আদেশ করেন। যা ইচ্ছা ফয়সালা করেন। যখন ইচ্ছা, যা ইচ্ছা বিচার করেন। তাঁর এ আদেশ, ফয়সালা ও বিচারের পেছনে কোনো জবাবদিহিতা নেই। কেননা তিনি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। তিনি কেন এমন ফয়সালা করেছেন, বা আদেশ করেছেন অথবা বিচার করেছেন, এমন জিজ্ঞাসা করার ক্ষমতা কারও নেই। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেন,
لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ.
তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না; বরং তাদেরকেই প্রশ্ন করা হবে। (সূরা আম্বিয়া : ২৩)
কোন ব্যক্তি যদি তার কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও এ কথা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা, তাঁর আদেশ বা বিচারের কোনো সীমারেখা আছে তাহলে সে শিরক করলো। কারণ, যদি আল্লাহর ক্ষমতার মধ্যে সীমারেখা থাকা বিশুদ্ধ হয় তাহলে এটিও আবশ্যিক রূপে সাব্যস্ত হবে যে, এমন কোনো ব্যক্তি আছে, যে এ ক্ষমতার ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, যার ওপর আল্লাহর ক্ষমতা কার্যকর নয়। তার মানে হচ্ছে, সে আল্লাহর সমকক্ষ। আর এটাকেই শিরক বলে। আল্লাহ আমাদেরকে শিরক থেকে রক্ষা করুন।
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান ও তাঁর একত্ববাদের দাবি হচ্ছে, এ কথা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র মাবুদ বা উপাস্য। নিরঙ্কুশ আনুগত্য ও অনুসরণের উপযুক্ত শুধুই তিনি। তিনি ছাড়া আর কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া আর কারও সামনে আত্মসমর্পণ করা যাবে না। কারণ, যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য সামান্য আনুগত্য ও অনুসরণ আবশ্যক হয়, অথার্ৎ, তাঁর অনুমতি ব্যতীত অন্য কারও সামনে আত্মসমর্পণ অবধারিত হয় তাহলে সেই ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে এবং সে আল্লাহর সমক্ষ ও শরিক হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা এর থেকেও পবিত্র ও সুমহান।
আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান ও তাঁর একত্ববাদের আরও দাবি হচ্ছে, তিনিই একমাত্র সঠিক উপাস্য। নিরঙ্কুশ আনুগত্য কেবল তাঁরই প্রাপ্য। আর এ বিষয়ের দাবি হলো, আল্লাহর নির্দেশকে বাস্তবায়িত করা। তাঁর আদেশসমূহকে মান্য করা এবং নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা। এটিই ইবাদতের সারকথা এবং আল্লাহ তাআলাকে একমাত্র সঠিক ইলাহ বলে বিশ্বাসের আবশ্যিক দাবি। তাছাড়া বিশুদ্ধ ও অকাট্য নস (শরিয়ার মূলপাঠ) দ্বারাও বিষয়টি প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের। (সূরা নিসা : ৫৯)
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ.
আমি রাসূল এ উদ্দেশ্যেই প্রেরণ করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে তার আনুগত্য করা হবে। (সূরা নিসা : ৬৪)
وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ.
কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত হবে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে এবং এটাই মহাসাফল্য। (সূরা নিসা : ১৩)
এসকল আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদের এ কথাই বুঝিয়েছেন যে, আমাদের থেকে তাঁর আনুগত্য এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্যের স্বীকৃতির দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তাঁর আদেশসমূহ পালন করা এবং নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকা। আর তাঁর অবাধ্যচারণের পরিণতি কী হবে, আল্লাহ তাআলা সেসম্পর্কেও সতর্ক করেছেন :
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ.
আর কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (সূরা নিসা : ১৪)
অন্যত্র ঘোষণা হয়েছে :
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ.
যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে তারা সতর্ক হোক যে, তাদের ওপর আপতিত হবে বিপর্যয় অথবা মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা নূর : ৬৩)
فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ (৭) وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ.
কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তাও দেখবে। (সূরা যিলযাল : ৭—৮)
হাফেয ইবনে কাছির তাঁর তাফসির গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (খ. ৪, পৃ. ৪৮২), ইমাম তিরমিযি হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
إن العبد إذا أخطأ خطيئة نكتت في قلبه نكتة سوداء، فإذا هو نزع واستغفر وتاب صقل قلبه، وإن عاد زيد فيها حتى تعلو قلبه، وهو الران الذي ذكر الله {كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ}.
বান্দা যখন কোনো গোনাহ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে সেই গোনাহকে বর্জন করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাওবা করে তাহলে তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে পুনরায় গোনাহ করে তাহলে তার অন্তরের দাগ আরও বেড়ে যায়, এমনকি এক পর্যায়ে তা অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এটিই হচ্ছে সেই জং, আল্লাহ যার আলোচনা করেছেন : كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ : কখনও নয়, বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে জং ধরিয়েছে (সূরা মুতাফফিফিন : ১৪)। [জামে তিরমিযি : ৩৩৩৪]
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আদেশ অনুযায়ী কাজ করা এবং তাঁর নিষিদ্ধ কাজসমূহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করলো সেই আল্লাহর প্রকৃত ইবাদত করলো। এ প্রকার আনুগত্যের সাথে সাথে তাঁর ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো গোনাহ করলো, ধরা হবেÑ সে এ সম্পর্কিত আদেশের ক্ষেত্রে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করেনি। বরং সে আল্লাহর অন্য সকল আদেশের ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করেছে এবং তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি যে, নেক কাজের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং গোনাহের কাজে জড়ালে ঈমান হ্রাস পায়। যে ব্যক্তি তার নিকট সত্য পেঁৗছা এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ কথা বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ যে শরিয়াহকে বাস্তবায়নের এবং সে অনুযায়ী জীবন গড়ার আদেশ করেছেন, তা কোনো ব্যক্তি বিশেষ, সংগঠন, দল অথবা অন্য কারও অনুমতির ওপর নির্ভরশীল তাহলে প্রতীয়মান হবে যে, সে তাদের ক্ষমতাকে আল্লাহর ক্ষমতা থেকে পৃথক করে তাদেরকে আল্লাহর ওপর কতৃর্ত্বশীল করেছে। এর মাধ্যমে সে তাদেরকে আল্লাহর সাথে শরিক করেছে। আল্লাহ তাআলা এর থেকে পবিত্র ও সুমহান।
কেউ যদি এ কথা বিশ্বাস করে যে, কোনো সৃষ্টি Ñসে যেই হোক না কেনÑ আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল করার ক্ষমতা রাখে অথবা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার ক্ষমতা রাখে তাহলে সে ঐ সৃষ্টিকেও আল্লাহর সাথে শরিক করলো। আল্লাহ তাআলা এর থেকেও পবিত্র ও সুমহান।
আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে অনবহিত ব্যক্তির বিধান, তার কর্তব্য এবং তার প্রতি সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য
মহান আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছানুসারে রাসূলগণকে নির্দিষ্ট শরিয়াহ দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। সেই শরিয়াহ মানুষকে আদেশ করেছেÑ তারা যেন দীনের প্রধান প্রধান বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু কাজের আদেশ করেছে এবং কিছু কাজ থেকে নিষেধ করেছে। কিছু বিষয়কে হালাল ঘোষণা করেছে, আর কিছু বিষয়কে হারাম ঘোষণা করেছে। সুশৃঙ্খল করেছে সাধারণ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে, এমনিভাবে সাধারণ মানুষ এবং তাদের দায়িত্বশীল ও শাসকদের মধ্যকার সম্পর্ককে।
আল্লাহ তাআলার এসকল বিধান পালন তখনই সম্ভব হবে যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের কাছে এসবের জ্ঞান পেঁৗছবে। সুতরাং যখন কারও কাছে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছে যায় এবং তার ওপর দলিল প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে তার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ওয়াজিব, নিষেধ, হালাল, হারাম ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক হয়ে যায় এবং সেই শরিয়াহ অনুযায়ী আমল করাও তার জন্য অবধারিত হয়ে যায়।
তবে কারও কাছে যদি এসকল বিষয় বা তার আংশিকের জ্ঞানও না পেঁৗছে তাহলে তার অজ্ঞতার কারণে তাকে অপারগ বিবেচনা করা হবে। সেক্ষেত্রে তাকে কাফের, ফাসেক ও গোনাহগার বলা হবে না। তবে কুরআন ও হাদিসে যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে তা এর ব্যতিক্রম। আর মুসলিমদের মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এ কথার সাক্ষ্য না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে না। এ কারণে আলেমগণ বলেছেন, এটি দীনের একটি আবশ্যিক জ্ঞান। অতএব, কোনো ব্যক্তি যদি এ বিষয়ে অনবহিত হয় তাহলে তাকে দুনিয়াতে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে না এবং তার সাথে মুসলিমের ন্যায় আচরণও করা হবে না।
এ কারণে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যেসব বিষয়ের আদেশ করেছেন তা পালন করা কেবল তখনই আবশ্যক হবে যখন আদিষ্ট ব্যক্তির কাছে সেই আদেশের খবর পেঁৗছবে। এমনিভাবে নিষেধের বেলায়ও একই বিধান প্রযোজ্য হবে। আর আদেশ ও নিষেধের খবর পেঁৗছার পূর্বে ঐ ব্যক্তি সেই বিধান পালনের জন্য আদিষ্ট হবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ أَئِنَّكُمْ.
যাতে আমি এর দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট এ কুরআন পেঁৗছবে তাদেরকে । (সূরা আনআম : ১৯)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا.
আল্লাহ কারও ওপর তার সাধ্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব অপর্ণ করেন না। (সূরা বাকারা : ২৮৬)
হাদিস শরিফে রাসূল সা. বলেন, কোনো ইহুদি অথবা খ্রিষ্টান এ কথা শোনার পরও যদি তাতে ঈমান না আনে তাহলে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে যাবে।
হযরত কাতাদা আবদুল আসওয়াদ ইবনে সারি’ থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী সা. বলেছেন,
أربعة يحتجون يوم القيامة: رجل أصم، ورجل أحمق، ورجل هرم، ورجل مات في الفترة، فأما الأصم فيقول: يا رب قد جاء الإسلام وأنا لا أسمع شيئا، وأما الهرم فيقول: رب قد جاء الإسلام وما أعقل، وأما الذي مات على الفترة فيقول: يا رب، ما أتاني لك رسول، وأما الأحمق فيقول: لقد جاء الإسلام والصبيان يخذفونني بالبعر، فيأخذ مواثيقهم ليطيعنه، فيرسل إليهم رسولا أن ادخلوا النار، قال: فوالذي نفسي بيده لو دخلوها لكانت عليهم بردا وسلاما “
চার ব্যক্তি কিয়ামতের দিন বিবাদ করবে। বধির, নির্বোধ, অতিশয় বৃদ্ধ এবং ঐ ব্যক্তি যে নবীজি সা.—এর আগমনের পূর্বে অন্তবর্তীকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অতঃপর বধির বলবে, হে আমার রব! ইসলাম এসেছে; কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পেতাম না। অতিশয় বৃদ্ধ বলবে, যখন ইসলাম এসেছে তখন আমার বিবেক—জ্ঞান ছিল না। যে ব্যক্তি অন্তবর্তীকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছে সে বলবে, হে আমার রব! আমার নিকট আপনার পক্ষ থেকে কোনো রাসূল আসেননি। নির্বোধ বলবে, হে আমার রব! ইসলাম এসেছে, যখন বাচ্চারা আমার গায়ে পশুমল নিক্ষেপ করতো (অর্থাৎ, আমারও বিবেক—বুদ্ধি ছিল না)। অতঃপর আল্লাহ তাদের থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করবেন যে, তারা তাঁর আদেশের আনুগত্য করবে। এরপর আল্লাহ তাদের কাছে একজন রাসূল মারফত সংবাদ পাঠাবেন যে, তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! তারা যদি জাহান্নামে প্রবেশ করতো তাহলে এটি তাদের জন্য শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যেতো। (মারিফাতুস সাহাবা, আবু নুআইম : ৯১১)
আবু হুরায়রা রা. থেকেও অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আরেকটি কথা অতিরিক্ত আছে : আর যে তাতে প্রবেশ করবে না সেÑই প্রকৃত জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে শরিয়াহর বার্তা পেঁৗছার পরই সতর্কবাতার্ পূর্ণতা পাবে। আর কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি এবং কারও কাছে শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছার পূর্বেই অদৃশ্যের জ্ঞানের মাধ্যমে সেসম্পর্কে জানাও সম্ভব নয়। অতএব, এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, যার কাছে শরিয়াহর জ্ঞান আসেনি সে শরিয়াহর ওপর আমল করতে আদিষ্ট নয়। (ইবনে হাযম রচিত ‘আল—ইহকাম’ : খ. ১, পৃ. ৬০)
যখন বিশুদ্ধরূপে এ কথা প্রমাণিত হলো যে, কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর শরিয়াহ সম্পর্কে অনবহিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর ইবাদতের অংশ হিসেবে দীনের প্রধান প্রধান বিধানগুলো প্রতিষ্ঠা করা এবং ফরয় বিধানগুলো পালনের করতে আদেশ করেছেন, মন্দ কাজসমূহ থেকে নিষেধ করেছেন, সাধারণ মানুষের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক রাখা, এমনিভাবে শাসক ও দায়িত্বশীলদের সাথেও একটি নির্দিষ্ট নিয়ম—নীতির আলোকে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, কোনো ব্যক্তি এসব বিষয় না জানলে তাকে কাফের, ফাসেক বা পাপাচারী আখ্যা দেওয়া হবে না। বরং তার অজ্ঞতার কারণে তাকে অপরাগ ধরা হবে। তবে হঁ্যা, যদি তার কাছে এ বার্তা পেঁৗছে যে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আল্লাহর বিধান জানা তার জন্য আবশ্যক, তা সত্ত্বেও সে বিধান জানার চেষ্টা না করে বসে থাকে, কিন্তু সে আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে না তাহলে চেষ্টা না করে অলস বসে থাকার কারণে তাকে পাপী হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু যদি আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে অলস বসে থাকে তাহলে সে হবে নিশ্চিত কাফের ও মুশরিক।
শরিয়াহর সকল বিধানের ক্ষেত্রে এ নীতিই প্রযোজ্য। যেমনÑ অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করা, ব্যভিচার করা, হারাম সম্পদ ভক্ষণ করা, কারও সম্ভ্রমহানি করা ইত্যাদি। এসব অপকর্ম কেউ যদি না জেনে করে যে, এগুলো আল্লাহর বিধানের খেলাফ, নবী কারিম সা. এসব কাজ থেকে নিষেধ করেছেন তাহলে সে হবে ফাসেক। আর যদি আল্লাহর বিধান জানা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃত সেটিকে হালাল মনে করে করে তাহলে সে হবে কাফের। (ইবনু হাযম রচিত ‘আল—ইহকাম’ : খ. ৮, পৃ. ১৪০)
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল সা.—এর ভাষায় মুমিনদের ওপর Ñযাদের কাছে শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছেছেÑ ফরয করেছেন যে, তাদের মধ্য হতে একটি দল দীনের গভীর জ্ঞান অর্জনে ব্রতী হবে এবং তারা ফিরে এসে তাদের কওমকে সতর্ক করবে। অর্থাৎ, তাদের কাছে বিশদভাবে বর্ণনা করবে, আল্লাহ তাদের প্রতি কী আদেশ করেছেন, কী নিষেধ করেছেন এবং তাদের ওপর কী কী কাজের বিধান দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ.
তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং যখন তারা কওমের কাছে ফিরে আসবে তখন কওমের লোকদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবা : ১২২)
রাসূল সা. বিদায় হজ্জের ভাষণে অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে দীনের বিধান পেঁৗছে দেওয়া আদেশ করে বলেছেন :
ألا فليبلغ الشاهد الغائب.
সতর্ক হও, উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে বার্তা পেঁৗছে দেয়। (আল—ইহকাম, ইবনু হাযম : খ. ২, পৃ. ১৪৩)
আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুমিনকে তার সাধ্যানুপাতে দীনের বিধান জানার চেষ্টা করার আদেশ করেছেন :
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ.
যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর। (সূরা নাহল : ৪৩)
সতর্কবার্তা পেঁৗছে দেওয়া হলো ফরযে কিফায়া। অর্থর্াৎ, এটি এমন একটি ফরয বিধান, যার জন্য সমগ্র মুসলিম জাতিকে জবাবদিহিতা করতে হবে। যদি তাদের কেউ এ দায়িত্ব পালন না করে, যার দ্বারা মানুষের দীনী প্রয়োজন পূরণ হয় এবং প্রত্যেকে এ ফরয বিধানটি প্রতিষ্ঠার জন্য তার সাধ্যের সবটুটু সামর্থ্য ব্যয় না করে তাহলে উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তি গোনাহগার হবে। আর যদি কিছু মানুষ এ প্রয়োজন পূরনের জন্য তৎপর হয়, যার দ্বারা উম্মতের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় তাহলে সকলেই গোনাহ থেকে বেঁচে যাবে।
আর দীন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির জন্য ফরয হলো, সে তার সামনে আপতিত বিষয়ে আল্লাহর হুকুম জানার চেষ্টা করবে। যদি সে এক্ষেত্রে ত্রুটি করে এবং তার দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তার বিধান ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে এ অবহেলার কারণে গোনাহগার হবে।
অতএব, উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ কথার ভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, “শুধু রুবুবিয়্যাত ও ইবাদতের কল্পনাই সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাত ইত্যাদি দীনের প্রধান প্রধান বিধানগুলো প্রতিষ্ঠার দাবি করে” এ আকিদা ও চিন্তা ভুল। কারণ, ঈমান ও ইবাদতের শুধু কল্পনা ধর্তব্য নয় এবং এ কল্পনার দ্বারা কেউ মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে না। বরং আদিষ্ট ব্যক্তির কাছে দীনের বিধান পৌছাই ধর্তব্য। সুতরাং কোনো ব্যক্তির কাছে যদি সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদির জ্ঞান পেঁৗছে; কিন্তু এছাড়া শরিয়াহর অন্যান্য বিধান, যেমনÑ বেচাকেনা, ঋণ, বর্গাচাষ ইত্যাদির বিশদ জ্ঞান তার কাছে না পেঁৗছে তাহলে এ অজ্ঞতার কারণে তাকে অপারগ ধরা হবে এবং এ কারণে তাকে কাফের, ফাসেক, পাপী ইত্যাদি আখ্যা দেওয়া হবে না, যখন তার আকিদা ও বিশ্বাস ঠিক থাকবে; যদিও সে বাস্তবতার বিপরীত সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ এসব বিধানকেই পূর্ণাঙ্গ দীন মনে করে।
এ শ্রেণির লোকÑ যাদের কাছে নিত্য দিনের বিভিন্ন কাজের শরয়ি বিধানের জ্ঞান পেঁৗছেনি এবং তাদের জ্ঞান সালাত, যাকাত, সাওম ও হজ্জের মধ্যেই সীমিতÑ তাদের ব্যাপারে আমাদের কর্তব্য হলো, আমরা তাদের কাছে শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছানোর চেষ্টা করবো, তাদেরকে আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে সতর্ক করবো এবং সেই বিধানগুলো যথাযথভাবে পালনে উদ্বুদ্ধ করবো। এর আগ পর্যন্ত তারা মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে এবং শরিয়াহর জ্ঞান না থাকার কারণে তাদের আকিদার কোনো ক্ষতি হবে না।
‘হাকিমিয়াতুল্লাহ’ (আল্লাহর শাসন) এর ব্যাখ্যায় উসতায মওদুদি তার ‘চারটি পরিভাষা’ নামক গ্রন্থে বলেন,
“সবোর্চ্চ ক্ষমতাধরের একত্ববাদের দাবি হলোÑ সকল ক্ষমতা ও শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হবে এক পরাক্রমশালী সত্তা এবং তার শাসনের কোনো অংশও অন্যের দিকে স্থানান্তরিত হবে না। কেননা যখন সকল সৃষ্টি কেবল তাঁরই, এক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরিক নেই, তিনিই সকল মানুষকে রিযিক দান করেন, তাঁর ক্ষমতায় কারও কোনো হাত নেই, বিশ্বজগতের সবকিছুর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার মালিক শুধুই তিনি, এক্ষেত্রে তার কোনো শরিক নেই, এসব কারণে বিবেকের দাবি হলোÑ শাসন, ক্ষমতা ও বিধান প্রদানের বিষয়টি কেবল তাঁর হাতেই ন্যাস্ত হবে।”
তার এ বক্তব্য থেকে কেউ কেউ ধারণা করেছে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে তাদের জীবনে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য নিয়ম—কানুন ও আইন প্রণয়নের অনুমতি প্রদান করবেন, এটি অসম্ভব।
মনে রাখা উচিত যে, এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা বক্তার উদ্দেশ্য পরিপন্থী। যেমনিভাবে আমাদের বিবেক—বুদ্ধি আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেন না, এমনিভাবে কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয়, সে তার যুক্তি দ্বারা আল্লাহ তাআলার ক্ষমতায় কোনো সীমা নিধারণ করবে।
যে ব্যক্তি দেশের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য আইন—কানুন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার অনুমতি প্রদানের বিষয়টিকে অস্বীকার করে, সে মূলত তার বিবেক—বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ তাআলার ক্ষমতায় সীমা নির্ধারণ করে এবং সেই বিবেক—বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ তাআলার ওপরে সিদ্ধান্ত প্রদান করে। এভাবে সে নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কেননা সে প্রকারান্তরে নিজেকে আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ ও তাঁর ওপর কতৃর্ত্বশীল মনে করছে। আল্লাহ এর থেকে পবিত্র ও বহু ঊর্ধ্বে।
আল্লাহ চাইলে আমাদেরকে শরিয়াহবিহীন ছেড়ে দিতে পারতেন। আর তখন আমরা নিজেদের বিচার—বুদ্ধি দ্বারা আমাদের বৈষয়িক যাবতীয় বিষয়ের আইন—কানুন প্রণয়ন করতাম। আল্লাহ তাআলা যদি এমন করতেন তাহলে এতে তার মহান ক্ষমতায় কোনো কমতি হতো না এবং তাঁর সুমহান মর্যাদায় কোনো ঘাটতিও হতো না। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার প্রজ্ঞায় কোনো ত্রুটি হতো না। কিন্তু আমরা নিশ্চিতরূপে জানিÑ এমনটি হয়নি এবং কখনও হবেও না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَنْ يُتْرَكَ سُدًى.
মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেওয়া হবে? (সূরা কিয়ামাহ : ৩৬)
আয়াতে বর্ণিত ‘সুদা’ শব্দের অর্থ হলো নিরর্থক। অর্থাৎ, যাকে কোনো কিছুর আদেশ—নিষেধ কিছুই করা হয়নি। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে এবং আমাদের পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের কাছে দীন ও হিদায়াতসহ রাসূল প্রেরণ করেছেন। রাসূলগণ এসে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ সম্পর্কে উম্মতকে অবহিত করেছেন এবং রবের বার্তা পেঁৗছে দিয়েছেন। তাঁরা আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার আদেশ করেছেন এবং তাঁর অবাধ্য হলে কঠিন শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সেই সাথে তাঁরা এ প্রতিশ্রম্নতিও দিয়েছেন যে, আমরা যদি আল্লাহর বিধান মেনে চলি তাহলে তিনি আমাদেরকে চিরস্থায়ী সুখের আবাস দান করবেন।
আইন—কানুন ও নীতিমালা প্রণয়ন
আসল কথা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার অনেক বিষয় আমাদের প্রতি ন্যস্ত করেছেন, যেখানে আমরা আল্লাহ তাআলার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পালন ও সীমারেখা বজায় রেখে আমাদের বিবেক—বিবেচনা অনুযায়ী জনস্বার্থে আইন প্রণয়ন করবো এবং তিনি আমাদেরকে সেগুলো বাস্তবায়নের আদেশও করেছেন। তবে শর্ত হলো, আমরা এর মাধ্যমে কোনো হারামকে হালাল করবো না এবং কোনো হালালকে হারামও করবো না।
কেননা আমরা দেখি, শরিয়াহর বিধানগুলোর কিছু শ্রেণি বিন্যাস রয়েছে। যেমনÑ হয়তো তা ফরয় হবে, অথবা হারাম কিংবা মুবাহ বা বৈধ হবে।
ফরয : ঐ বিধানকে বলে যা আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আবশ্যিকরূপে দান করেছেন। তার আবশ্যিকতাকে দূর করা বা তা রহিত করার ক্ষমতা কারও নেই। কারও কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং এ সম্পর্কে দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যদি কেউ তা অস্বীকার করে তাহলে সে হবে কিতাবুল্লাহকে অস্বীকারকারী এবং তাঁর রবকে মিথ্যারোপকারী। আর এর দ্বারা সে নির্দ্বিধায় কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
হারাম : মহান আল্লাহ যে কাজকে হারাম (অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ) করেছেন তা কিয়ামত অবধি হারামই থাকবে। সেই কাজকে হালাল করার ক্ষমতা কারও নেই। কারও কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং এ সম্পর্কে দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যদি কেউ তা অস্বীকার করে তাহলে সে হবে কিতাবুল্লাহকে অস্বীকারকারী এবং তাঁর রবকে মিথ্যারোপকারী, আর এর দ্বারা সে নির্দ্বিধায় কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
আর মুবাহ বা বৈধ কাজে মুসলিমদের জন্য প্রয়োজন মাফিক আইন—কানুন ও নীতিমালা প্রণয়নের সুযোগ রয়েছে, তাকে সিদ্ধান্ত, নোটিস বা কানুন যে নামেই নামকরণ করা হোক। আর এর মাধ্যমেও মূলত শরিয়াহর ঐসকল বক্তব্যের বাস্তবায়ন উদ্দেশ্য, যেখানে জনস্বার্থ রক্ষার তাকিদ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যে পরামর্শ ব্যবস্থা কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন তাও এ প্রকারেরই অন্তভুর্ক্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
আর তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করে। (সূরা শুরা : ৩৮)
وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ.
আর কাজে—কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
এমনিভাবে মহাসড়কে চলার আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, কৃষি খাতের বিপর্যয় মোকাবেলা সংক্রান্ত নীতিমালা, সেচ ব্যবহার আইন, শিক্ষানীতি, বিভিন্ন পেশা সংক্রান্ত আইন, যেমনÑ স্বাস্থ্যসেবা, প্রকৌশল ও ফার্মাসির নীতিমালা এবং এজাতীয় পেশায় যারা জড়িত হবে তাদের মধ্যে যেসব শর্তের সমাবেশ থাকতে হবে তা নির্ধারণ। এমনিভাবে প্রশাসন পরিচালনা, জনকল্যাণ নিশ্চিত করা, প্রতিটি পেশা ও কাজের বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা নিধারণ, সেনাবাহিনীর বিন্যাস, সেনা বাহিনীতে যোগদানের প্রয়োজনীয় শর্ত নির্ধারণ, সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা বিধানের নীতিমালা প্রণয়ন, আবাসিক ভবন নির্মাণসংক্রান্ত শর্ত ও নীতিমালা প্রণয়ন, যার দ্বারা জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা হবে, এমনিভাবে কল—কারখানা ও মিল—ফ্যাক্টরি নির্মাণের ক্ষেত্রে আবশ্যিক শর্তাবলি এবং জনসমাবেশের শৃঙ্খলা বিধান সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি।
এখন আমরা মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধানসংক্রান্ত নীতিমালার দৃষ্টান্ত পেশ করছি। একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে রাসূল সা. বলেছেন,
إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم وأبشاركم عليكم حرام.
নিশ্চয় তোমাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ও দেহ (এসবের ক্ষতি সাধন করা) তোমদের জন্য হারাম। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১১, পৃ. ১৫৫)
অপর একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা. বলেছেন,
المسلم أخو المسلم، لا يظلمه ولا يسلمه.
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে অসহায় অবস্থায় ছাড়বে না। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ১১, পৃ. ১৪৩)
সুতরাং উপরিউক্ত হাদিসসমূহের দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, আমাদেরকে নিজেদের জীবন, দৈহিক সুরক্ষা এবং সম্ভ্রম রক্ষার প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং আমাদের মধ্য হতে কাউকে ধ্বংসাত্মক অবস্থা বা ক্ষতির সম্মুখীন দেখে তাকে অসহায় অবস্থায় ছাড়া যাবে না। আর আমরা জানি যে, যদি মহাসড়কে যানবাহন, গাড়ী, রিক্সা ও সাইকেল ইত্যাদি চলাচলের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম করে দেওয়া না হয় এবং প্রত্যেকে তার ইচ্ছামাফিক স্বাধীনভাবে চলাচল করে তাহলে এতে মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা হবে না। বরং তারা জান—মালের ব্যাপক ক্ষয়—ক্ষতির শিকার হবে এবং ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
এ কারণে মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব হলো, তারা নিজেদের জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের সুরক্ষার জন্য আইন—কানুন ও নীতিমালা প্রণয়ন করবে এবং ধ্বংস ও বিপর্যয় থেকে নিজেদেরকে বাঁচাবে। সেই সাথে যারা এসকল আইন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করবে তাদের জন্য শরিয়ার নির্দেশনার আলোকে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
তবে কারও জন্য এ ধারণা করা ঠিক হবে না যে, রাস্তায় চলাচলের এসকল নিয়ম বুঝি আল্লাহর আইন। বরং প্রকৃত কথা হচ্ছে, এগুলো হলো জনস্বার্থে আমাদের চিন্তা ও গবেষণাপ্রসূত আইন। আর আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার আদেশ করেছেন। যোগাযোগ মাধ্যমের ভিন্নতার কারণে এসকল আইন—কানুনের মধ্যেও ভিন্নতা আসতে পারে এবং আমরা সেই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভুলের ঊর্ধ্বে নই। আমাদের কাজে—কর্মে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার কখনও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে গিয়ে আমরা সঠিক ও সুন্দর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না এবং আমাদের ভুলের কারণে কিছু মানুষের নিরাপত্তার পরিবর্তে জান—মালের ক্ষয়ক্ষতিও হয়।
অতএব, এ আলোচনার মাধ্যমে ঐ ব্যক্তির কথার ভ্রান্তি প্রমাণিত হয়ে যায়, যে বলেÑ “বিধান দেওয়া হলো আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্য। অতএব, যে ব্যক্তি নিজে আইন প্রণয়ন করলো সে যেন আল্লাহ তাআলার একটি বৈশিষ্ট্যকে নিজের জন্য ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো এবং আল্লাহর ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলো।” তবে এ কথা তখন সঠিক হতে পারে, যদি আইন প্রণেতার আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ কতৃর্ক হালালকে হারাম করা অথবা হারামকে হালাল করা উদ্দেশ্য হয়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি কেবল আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্য।
আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে, যে আইন বা সংবিধান Ñতার বাহ্যিক আকৃতি যাই হোক না কেনÑ আল্লাহ কর্তৃক হারামকে হালাল করে অথবা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকে হারাম করে, অথবা আল্লাহর ফরযকৃত কাজের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, কিংবা আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজের আদেশ করে তাহলে তা বাতিল ও অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে এবং তার অনুসরণ করাও জায়েয হবে না। সেই আইনপ্রণেতা যদি তার কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণকে বৈধ মনে করে তাহলে সে নিঃসন্দেহে কাফের ও মুশরিক বলে বিবেচিত হবে। কারণ এ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সে আল্লাহর আদেশকে অস্বীকার করছে এবং মহান পালনকর্তাকে মিথ্যারোপ করছে। উল্লেখ্য যে, অস্বীকারের পদ্ধতি হলো, বিচারক আল্লাহর শরিয়াহর খেলাফ আইন প্রণয়ন করবে এবং নির্বাহী ক্ষমতা বলে মানুষকে তা বাস্তবায়নে বাধ্য করবে।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তাআলার নাম ও বৈশিষ্ট্য শরিয়াহর সুস্পষ্ট ভাষ্য দ্বারা সুনির্ধারিত। অতএব, এর বিপরীতে আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে আল্লাহ তাআলার নাম ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা বৈধ হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ.
আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব, তোমরা তাকে সেই সকল নামেই ডাকবে, আর যারা তার নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করবে। (সূরা আরাফ : ১৮০)
অতঃপর যারা বলে, “আল্লাহর হাকিমিয়াত (শাসন) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ—এর সাক্ষ্যের সারমর্ম থেকে অথবা আল্লাহ তাআলাই একমাত্র রব, তিনি ছাড়া আর কোনো রব নেইÑ এর দাবি থেকে গৃহীত” তাদের উদ্দেশ্যে আমরা বলবো,
এর দ্বারা আপনাদের উদ্দেশ্য যদি হয় এ কথা যে, আল্লাহ তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, তার আদেশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তিনি যখন যা ইচ্ছা ফয়সালা করেন এবং বিধান দান করেন। অতএব, আল্লাহ তাআলা যদি কোনো কিছুর ফয়সালা করেন, অথবা আদেশ করেন কিংবা বিধান দান করেন তাহলে তার আনুগত্য করা আমাদের জন্য আবশ্যক। কেননা তাঁর আদেশ যথার্থ, সম্পূর্ণরূপে ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণÑ তাহলে আমরা বলবো, তাই যদি হয় তাহলে আমরা এবং আপনারা উভয় পক্ষই সরল পথে প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই, যেমনিভাবে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোনো ব্যক্তি যদি তার কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করে, স্বাধীনভাবে বিধান প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী মনে করে, তার প্রণীত বিধানকে আল্লাহর বিধানের মত অবশ্য পালনীয় মনে করে এবং তার আদেশকে আল্লাহর আদেশের মত অবশ্য পালনীয় মনে করে তাহলে সে নিজেকে আল্লাহ তাঅলার সমকক্ষ ও শরিক নির্ধারণ করলো।
আর যদি আপনাদের উদ্দেশ্য হয়, কারও জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে সনদ ব্যতীত এ কথা বলা জায়েয নেই যে, এটা আল্লাহর নিকট হালাল, অথবা এটা আল্লাহর নিকট হারামÑ তাহলে এ বিষয়ে আমরাও আপনাদের সাথে একমত এবং আমাদের আকিদাও তাই। কারণ, যে ব্যক্তি দলিল—প্রমাণ ছাড়া বলে, এটা হালাল, এটা হারাম, এটা ফরয, এটা নিষিদ্ধÑ সে আল্লাহ সম্পর্কে না জেনে কথা বলে। আর এটিই হচ্ছে আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যারোপ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর থেকে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَقُولُوا لِمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هَذَا حَلَالٌ وَهَذَا حَرَامٌ لِتَفْتَرُوا عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ.
তোমাদের জিহ্বা মিথ্যারোপ করে বলে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা রটনা করার জন্য বলো না, এটা হালাল এবং এটা হারাম। (সূরা নাহল : ১১৬)
আর যদি ‘হাকিমিয়াত’ বলে আপনাদের উদ্দেশ্য হয় একথা যে, কোনো ব্যক্তি নিজে থেকে আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত বিষয়কে হালাল করতে পারে না, অথবা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম করতে পারে না, তাহলে আমরা বলবো, আমরাও একথাকে সমর্থন করি। কেননা আমাদের ঈমান ও আকিদাও তা—ই। আমরা মনে করি, কারও কাছে সত্য উপস্থিত হওয়া এবং তার কাছে দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যদি সে বিশ^াস করে অথবা বলে যে, তার আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত বিষয়কে হালাল করার অথবা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার ক্ষমতা রয়েছে তাহলে সে নিজেকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলো এবং এর মাধ্যমে সে নির্দ্বিধায় কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
আর যদি আপনাদের এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য হয় যে, মানুষের জন্য এ বিশ^াস পোষণ করা আবশ্যক যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি ব্যতীত কেউ আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত বিষয়কে হালাল করতে পারে না, অথবা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত বিষয়কে হারাম করতে পারে না, কেউ যদি এর বৈধতার বিশ^াসী হয়, যদিও এর ওপর আমল না করে তাহলে সে আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কোনো রব গ্রহণ করলো এবং আল্লাহর সাথে ভিন্ন কোনো ইলাহ নির্ধারণ করলোÑ তাহলে আমরা বলবো, আমাদের বিশ^াসও তাই। এ বিষয়ে আমরা কখনও কোনো সন্দেহ করবো না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُمْ مِنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللَّهُ.
তাদের কি এমন কতগুলো শরিক আছে, যারা তাদের জন্য এমন দীনের বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি? (সূরা শুরা : ২১)
হযরত আদি ইবনে হাতেম রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি নবী সা.—এর কাছে আসলাম, যখন আমার গলায় একটি স্বর্ণের ক্রোশ ঝুলন্ত ছিল। এটা দেখে নবী সা. বললেন, হে হাতেমের পুত্র! এ মূর্তিটি তোমার গলা থেকে ফেলে দাও। আমি তা ফেলে দিলাম। এরপর নবী সা. সূরা তাওবা পাঠ করা শুরু করলেন। যখন এ আয়াতে পেঁৗছলেন,
{اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ} : তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তো তাদের ইবাদত করতাম না। জবাবে রাসূল সা. বললেন, তারা হারাম বিষয়কে তোমাদের জন্য হালাল ঘোষণা করতো, অতঃপর তোমরা তাকে হালাল মনে করতে এবং হালাল বিষয়কে তোমাদের জন্য হারাম ঘোষণা করতো, অতঃপর তোমরা তাকে হারাম মনে করতে। (এমন নয় কি?) আমি বললাম, হাঁ। রাসূল সা. বললেন, এটিই হচ্ছে তাদের ইবাদত।
আর যদি ‘আল্লাহর শাসন’ দ্বারা আপনাদের উদ্দেশ্য হয়, আবশ্যিকরূপে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, কোনো বিষয়ে আল্লাহর শরিয়াহর সাথে অন্য কোনো বিধান বা মতাদর্শের বিরোধ হলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আল্লাহর শরিয়াহর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে; অন্য কোনো মতবাদের দিকে নয়। আর কোনো ব্যক্তি যদি Ñতার কাছে দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরওÑ এ বিশ্বাস পোষণ করে যে, তার কাছে মহান আল্লাহ প্রদত্ত যে শরিয়াহ পেঁৗছেছে তা ভিন্ন অন্য কোনো শরিয়াহর দিকে আবশ্যিকরূপে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, অথবা মনে করেÑ আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা আবশ্যক নয়; যদিও সে তা কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়িত না করে অথবা কার্যত তার দ্বারা কোনো বিচার—ফয়সালা না করে, তথাপি সে কাফের, মুশরিক ও আল্লাহর বিধান অস্বীকারকারী রূপে হিসেবে হবে।
অনুরূপ কোনো ব্যক্তি যদি স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে প্রকাশ্যে একথা প্রচার করে যে, সে হালাল, হারাম, ফরয, নিষিদ্ধ কাজ, তার অধিকার ও কর্তব্য ইত্যাদি জানার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ভিন্ন অন্য কোনো মতবাদ বা মতাদর্শের দ্বারস্থ হতে চায় তাহলে সে এর দ্বারা নিজের ফাসেদ ও ভ্রান্ত আকিদাই প্রকাশ করলো। তাছাড়া সে তার কাছে আল্লাহপ্রদত্ত যে শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছেছে তার ওপর ঐ শরিয়াহকে প্রাধান্য দিচ্ছে, সে যার দ্বারস্থ হতে চায়। এভাবে সে আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহকে অস্বীকারের কারণে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার অন্তরের অবস্থা কী, আমরা তা যাচাই করতে যাবো না। কারণ, যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় ঐ বিষয়কে অস্বীকার করলো, যার প্রতি ঈমান আনাকে আল্লাহ ফরয করেছেন, সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাফের ও মুশরিক হয়ে গেলো। আপনাদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমরা বলবো, আমাদের আকিদাও তাই। আল্লাহর তাওফিকে আমরা কখনও এ আকিদা থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হবো না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচারভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং তারা সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫)
অন্যত্র তিনি বলেন,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ .
যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর, যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান রাখ। (সূরা নিসা : ৫৯)
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
মুমিনদের কথা তো এইÑ যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্য আল্লাহ এবং তার রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তারা বলে, ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম’। আর তারাই সফলকাম। (সূরা নূর : ৫১)
এরপর আমরা পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলবো, আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যার ক্ষমতার কোনো সীমা—পরিসীমা নেই। তার আদেশ সবকিছুর ঊর্ধ্বে, তিনি যখন যা ইচ্ছা ফয়সালা করেন এবং বিধান প্রদান করেন। অতএব, আল্লাহ তাআলা যদি কোনো কিছুর ফয়সালা করেন, অথবা আদেশ করেন কিংবা বিধান প্রদান করেন তাহলে তার আনুগত্য করা আমাদের জন্য আবশ্যক। কেননা তাঁর আদেশ যথার্থ, শতভাগ ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ।
শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য ও অকাট্য দলিল—প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত এবং যুক্তির দাবিও তাই যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর মর্মকথা হলো, আল্লাহ তাআলা সকল প্রকার দোষ—ত্রুটি থেকে মুক্ত। সকল পরিপূর্ণ গুণাবলি এবং প্রকৃত মাহাত্ম আল্লাহ তাআলার জন্য প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বিশ্বজগতের সকল কিছুর ¯্রষ্টা। তিনি সকল কিছুর ওপর পরাক্রমশালী। তার রাজত্বে কোনো বিাবদকারী নেই এবং তার ক্ষমতায় কোনো শরিক নেই।
এমনিভাবে পূর্বে আমরা আরও বলেছি যে, আল্লাহ তাআলার ক্ষমতার সীমানির্ধারণের যে বিশ্বাস রয়েছে, তার অপরিহার্য দাবি হলোÑ কোনো ব্যক্তি এমনও আছে যে আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ, যার ওপর আল্লাহর ক্ষমতা কার্যকর নয়। আর আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে যে থাকবে সে মাখলুক ছাড়া ভিন্ন কিছু হতে পারে না। অর্থাৎ, সেও আল্লাহর সাথে ভিন্ন ইলাহ। অথবা অন্য কোনো ¯্রষ্টা তাকে সৃষ্টি করেছে। তার মানে হচ্ছে, সে হলো অন্য কোনো ইলাহের সৃষ্টি। এসব কিছুই শিরক। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর থেকে হেফাযত করুন।
একটি লক্ষণীয় পার্থক্য
এখানে একটি পার্থক্যের বিষয়ে পরিপূর্ণ সজাগ থাকতে হবে। আর তা হলো, যে ভ্রান্ত আকিদা যা আল্লাহ তাআলার সাথে শিরককে আবশ্যক করে তার মধ্যে এবং ঐ ব্যক্তির আকিদার মধ্যে যে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কে কিছুই জানে না; বরং তার কাছে শরিয়াহর সামান্য বিষয়ের জ্ঞান আছে এবং এর ভিত্তিতে সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মানুষের জীবন, কর্ম ও পারস্পরিক সম্পর্কের নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে। এছাড়াও আল্লাহ তাআলা ব্যক্তি এবং যে সমাজে ব্যক্তির বসবাস সেই সমাজের প্রতি অনেক বিষয়কে ন্যস্ত করেছেন, যেখানে তারা জীবনের আনুষাঙ্গিক দিকগুলো সুষ্ঠুরূপে পরিচালনা এবং অন্য সকল মানুষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে নিজেদের মত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে।
মনে রাখতে হবে, এই শেষোক্ত আকিদাটি কুফর ও শিরকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। বরং আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ এবং তাঁর আনুগত্যের আবশ্যিকতার বিশ্বাস থেকেই এ আকিদার সৃষ্টি। আমরা ইতঃপূর্বে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বিভিন্ন দলিল—প্রমাণ পেশ করেছি, যে ব্যক্তি এমন আকিদা পোষণ করবে সে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ বিবেচিত হবে বটে, তবে সে কাফের, ফাসেক ও গোনাহগার হবে না।
অতএব, পূর্বোক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়Ñ এ কথাটি সঠিক নয় যে, বর্তমানকালের মুসলমাদের Ñযাদের মধ্যে আমরা বাস করছিÑ আকিদা নষ্ট হয়ে তারা দীন ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। কারণ, মহান আল্লাহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে শৃঙ্খলা বিধানের জন্য যে শরিয়াহকে মানুষের ওপর আবশ্যক করেছেন তারা এর অধিকাংশ বিষয়ে অজ্ঞতার শিকার। এমনকি তাদের অধিকাংশের অবস্থা হলো, তারা শুধু নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে এবং এছাড়া পানাহার, পোশাক—পরিচ্ছদ ও বৈধ—অবৈধ সম্পর্কে নিতান্ত সামান্যই জানে। এর ভিত্তিতে তারা ধারণা করতে শুরু করেছে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ বুঝি বিশেষ কিছু ইবাদত এবং সামান্য কিছু বৈধ—অবৈধ বিষয়ের ওপরই সীমাবদ্ধ।
মনে রাখতে হবে, এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা, যা পরিহার করা এবং তার দিকে মানুষকে আহ্বান করা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ, ইতঃপূর্বে আমরা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল থেকে দলিল পেশ করেছি যে, কারও কাছে শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছা, সে বিষয়ে অবগতি লাভ করা এবং তার আবশ্যিকতার ওপর দলিল—প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত শরিয়াহর বিধান পালন করা কারও জন্য আবশ্যক নয়। আর এর পূর্ব পর্যন্ত অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ বলে বিবেচিত হবে।
যারা আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহর জ্ঞান লাভ করেছে, সে বিষয়ে গভীরতা অর্জন করেছে এবং অন্যদেরকে সতর্ক করার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, তাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, তারা মানুষের কাছে শরিয়াহর বিধি—বিধানের জ্ঞান পেঁৗছে দিবে, তার কথার স্বপক্ষে কুরআনে কারিম এবং নবী সা.—এর হাদিস শরিফ থেকে দলিল পেশ করবে এবং মানুষকে আল্লাহপ্রদত্ত সঠিক আকিদা ও আমলের দিকে আহ্বান করবে। আর এটিই হচ্ছে ইসলামের দাঈদের কর্তব্য ও মিশন।
ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, মানুষের জন্য এ বিশ্বাস পোষণ করা আবশ্যক যে, কোনো মানুষের এ ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি ব্যতীত এমন বিষয়কে হারাম করবে, আল্লাহ তাআলা যা মানুষের জন্য হালাল করেছেন, অথবা এমন বিষয়কে হালাল করবে আল্লাহ তাআলা যা মানুষের জন্য হারাম করেছেন। কারণ, এটিও আল্লাহ তাআলার একত্ববাদ ও তার সর্বময় ক্ষমতার বিশ্বাসের দাবি। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমতি ব্যতীত নিজেকে শরিয়াহর মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের অধিকারী বলে মনে করে, তাকে হতে হবে আল্লাহর সমকক্ষ এবং আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা বহিভূর্ত। নাউযুবিল্লাহ! আর এটাই হচ্ছে শিরক।
এমনিভাবে উপরিউক্ত ভ্রান্ত ও শিরকি আকিদা এবং ঐ ব্যক্তির আকিদার পার্থক্যের বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে, যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের কিছু বক্তব্যের মধ্যে ব্যাখার বশবর্তী হয়ে মনে করেÑ ইসলাম মানুষকে যে শরিয়াহ প্রদান করেছে তা সময়, পরিবেশ ও চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে।
অনুরূপ সাধারণ জনগণের আকিদার পার্থক্যও জানতে হবে, যারা মনে করেÑ ক্ষমতাশীলদের জন্য আইন—কানুন ও বিধান প্রণয়ণের অধিকার রয়েছে, যা তাদের জন্য অবশ্য পালনীয়। এক্ষেত্রে তাদের দলিল হচ্ছে, পবিত্র কুরাআনের কিছু আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সা.—এর কিছু হাদিস, যার মধ্য হতে কিছু তো সহিহ ও বিশুদ্ধ, আবার কিছু হাদিস এমন যা মূলত সহিহ ও বিশুদ্ধ নয়; কিন্তু তারা সেটিকে সহিহ মনে করে।
অতএব, কেউ যদি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বক্তব্যের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এ কথা বিশ্বাস করে যে, শরিয়াহর কিছু বিধান পরিবর্তন ও পরিবর্ধনযোগ্যÑ তাহলে এর মাধ্যমে সে নিজেকে আল্লাহ তাআলার সমকক্ষ নির্ধারণ করছে না; রবং সে বুঝাতে চাচ্ছেÑ আল্লাহ তাআলা তাকে এ বিষয়ের অনুমতি ও বৈধতা দান করেছেন। অতএব, তার এ ভুল ধারণার কারণে সে অপারগ বিবেচিত হবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ.
আর এ ব্যাপারে তোমরা অনিচ্ছাকৃত ভুল করলে কোনো অপরাধ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (তা অপরাধ হবে)। (সূরা আহযাব : ৫)
এক হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন,
عفي لأمتي عن الخطأ والنسيان وما استكرهوا عليه.
আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি ও তাদের ওপর বলপ্রয়োগকে ক্ষমা করা হয়েছে। (আল—মুহাল্লাহ বিল আল—আছার : খ. ২, পৃ. ৩৩৪)
অন্যত্র রাসূল সা. বলেন,
إذا اجتهد الحاكم فأخطأ فله أجر وإن أصاب فله أجران.
যদি বিচারক ইজতিহাদ করে (রায় প্রদানে) ভুল করে তাহলে সে একটি নেকি পায়। আর যদি ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করে তাহলে সে দুটি নেকি পায়। (আল—ইহকাম ফি উসূলিল আহকাম : খ. ৮, পৃ. ১৩৭)
আর নিয়ম হচ্ছে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির যার মধ্যে ইজতিহাদের শর্তসমূহ বিদ্যমান আছে, যখন সে দীনি বিষয়ে কোনো কথা বলে তখন সে ঐ বিষয়ে হাকিম বা বিচারক বলে গণ্য হয়।
ভুল ও ব্যাখ্যার সীমারেখা
স্পষ্টত, যে ব্যক্তির শরিয়াহ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই এবং কুরআনের ভাষাজ্ঞানও জানে না, সে ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে পারবে না। এমন ব্যক্তি যদি অজ্ঞতা বশত দীনের ব্যাপারে কোনো কথা বলে, যখন সে তার অজ্ঞতা, কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য অনুধাবনে অক্ষমতা এবং বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে বিধান আহরণে অপারগতা সম্পর্কে জানে তাহলে সেই ব্যক্তি আল্লাহর দীনের ব্যাপারে ইলমবিহীন প্রবৃত্ত, আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে জ্ঞানহীন বক্তা এবং আল্লাহ তাআলার দীনকে তুচ্ছজ্ঞানকারী হিসেবে গণ্য হবে।
উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআনের আয়াত সম্পর্কে কেবল সেই ব্যাখ্যা অনুমোদিত কুরআনের ভাষা যার সম্ভাবনা রাখে। কিন্তু যে বিষয়ে ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যাতে নতুন করে ইজহিতাদের কোনো সুযোগ নেই, এমনকি ভুল বা ব্যাখ্যারও কোনো সম্ভাবনা নেই তাতে ব্যাখ্যার আশ্রয়গ্রহণ অনুমোদিত নয়।
কেউ যদি এমন ক্ষেত্রে ব্যাখ্যার অপপ্রয়াস চালায় তাহলে প্রথমত তার বিরুদ্ধে দলিল—প্রমাণ পেশ করে তার ভুল প্রকাশ করে দিতে হবে এবং তাকে সত্য ও সঠিক বিষয়টি অবহিত করতে হবে। তার দাবির বিরুদ্ধে স্পষ্ট দলিল—প্রমাণ, যাতে বিতর্কের অবকাশ নেইÑ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও যদি সে তার দাবি বা বিশ্বাসের ওপর অনড় থাকে তাহলে ধরে নিতে হবেÑ আল্লাহ তাআলা যে বিষয়ের ওপর ঈমান আনাকে ফরয করেছে সে ঐ বিষয়কে অস্বীকার করছে। অতএব, সে কাফের ও মুশরিক বলে গণ্য হবে।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস যে, ক্ষমতাশীলদের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের শৃঙ্খলা বিধানের নিমিত্তে আইন—কানুন ও বিধান প্রণয়নের অধিকার রয়েছে এবং এক্ষেত্রে তারা কুরআনে কারিম ও হাদিস শরিফের কিছু বক্তব্য দ্বারা দলিল গ্রহণ করে থাকে। আমাদের মতে এ বিশ্বাসের মধ্যেও কুফর ও শিরকের কোনো সংশয় নেই। বরং এ বিশ্বাস মূলত সত্য ও সঠিক।
পূর্বে আমরা এ বিষয়েও দলিল—প্রমাণ পেশ করেছি যে, আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জনস্বার্থ রক্ষার আদেশ করেছেন। আর তার অংশ হচ্ছে, মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা করা এবং দৈহিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর এসব কিছুর সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনস্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য আল্লাহ তাআলা ইজতিহাদ বা গবেষণার সুযোগ অবারিত রেখেছেন। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে শাসক শ্রেণি ও ক্ষমতাশীলদের আনুগত্যকে আবশ্যক বলা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যে সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ হচ্ছে, এ বিষয়ে ক্ষমতাশীলদের সীমারেখা সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা। এমনিভাবে তারা জানে না, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তে যে ‘উলুল আমর’ বা ক্ষমতাশীলদের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে কোন কোন শর্ত ও গুণাবলি থাকতে হবে। এ অজ্ঞতার কারণে তারা এমন ক্ষমতাশীলদের আনুগত্য করছে, যারা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ক্ষমতাশীল নয় এবং তারা বিশ্বাস করছেÑ এসকল ক্ষমতাশীলদের আইন ও আদেশ জারি করার অধিকার আছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতাশীলদের ঐ সকল আইন ও আদেশের অধিকাংশই এমন, যা আল্লাহ প্রদত্ত সীমারেখা লঙ্ঘন করেছে।
পূর্বে আমরা এ বিষয়েও প্রমাণ পেশ করেছি যে, অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সে কাফের, ফাসেক বা পাপাচারী হিসেবে গণ্য হবে না। যারা নিজেদেরকে আল্লাহর দীনের দাঈ বলে পরিচয় দেয় তাদের কর্তব্য হচ্ছে, মানুষের সামনে আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহর প্রকৃত রূপ তুলে ধরা এবং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল হতে দলিল—প্রমাণের মাধ্যমে বিশদভাবে বর্ণনা করা যে, আল্লাহ আমাদের জন্য কোন কোন বিষয় বিষয়কে হালাল ও বৈধ করেছেন এবং কোনো বিষয়কে হারাম করেছেন। তারা আরও বর্ণনা করবেন, আল্লাহপ্রদত্ত শরিয়াহর কোনো বিষয়গুলো এমন যেখানে ক্ষমতাশীল বা অন্য কারও জন্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা ক্ষমতাশীলদের জন্য আইন প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আদেশ জারির ক্ষেত্রে কি সীমারেখা বেঁধে দিয়েছেন। সেই সাথে একথাও বর্ণনা করবেন যে, আল্লাহ তাআলা যে ক্ষমতাশীলদের আনুগত্যের আদেশ করেছেন তাদের মধ্যে কোন কোন বিষয় শর্তের সমাবেশ থাকতে হবে।
যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে এ বিষয়গুলো বর্ণনা করা এবং তাদের সামনে দলিল—প্রমাণ উপস্থিত করা না হবে, তারা মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে এবং এ কারণে তাদেরকে ফাসেক বা পাপাচারী আখ্যা দেওয়া ঠিক হবে না। তবে ঐ ব্যক্তির ব্যাপারটি এর থেকে ব্যতিক্রম, যার সম্পর্কে শরয়ি দলিল—প্রমাণের মাধ্যমে আমরা জানতে পারবো যে, সে সত্যিই আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত আদেশদাতার আনুগত্য করছে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাকে নিজের রব বানিয়ে নিয়েছে। ইমাম মুসলিম উম্মুল মুমিনিন হযরত উম্মে সালামা রা.—এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, নবীজি সা. বলেছেন,
سَتَكُونُ أُمَرَاءُ فَتَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ، فَمَنْ عَرَفَ بَرِئَ، وَمَنْ أَنْكَرَ سَلِمَ، وَلَكِنْ مَنْ رَضِيَ وَتَابَعَ.
অচিরেই এমন অনেক শাসকের আবির্ভাব হবে, তোমরা যাদের (অন্যায় কাজ) সম্পর্কে জানবে এবং ঘৃণা করবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায় কাজ সম্পর্কে জেনে এর প্রতিবাদ করবে সে দায়মুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি ঘৃণা করবে সেও নিরাপদ থাকবে। কিন্তু যে সন্তুষ্টচিত্তে তাদের আনুগত্য করবে সে গোনাহগার হবে। (সহিহ মুসলিম : ১৮৫৪)
বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ মুসলিমদের অধিকাংশই ক্ষমতাশীলদের পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতায় বিশ্বাস করে না, কিংবা এমন ধারণা করে না যে, তাদের আদেশ আল্লাহ তাআলার আদেশাবলির মতই অবশ্য পালনীয়, অথবা তাদের জন্য ঐ বিষয়কে হালাল করার অধিকার রয়েছে আল্লাহ যাকে হারাম করেছেন, অথবা ঐ বিষয়কে হারাম করার অধিকার রয়েছে আল্লাহ যাকে হালাল করেছেন। বরং প্রকৃত কথা হচ্ছে, যেখানে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ সুস্পষ্ট ও সুবিদিত এবং সেখানে কারও কোনো মতভেদের সুযোগও নেই, এমন ক্ষেত্রে সাধারণ মুসলিমদের কেউই এ বিষয়ে সন্দেহ করে না যে, আল্লাহর নির্দেশ সত্য, সঠিক ও অবশ্য পালনীয় এবং কোনো বক্তার বক্তব্য বা কোনো ক্ষমতাধরের আইন যাকে বাতিল করতে পারে না। যেমনÑ বহু কাল ধরে সাধারণ মুসলিমরা দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাস করে যে, মদপান হারাম। অথচ মুসলিম দেশগুলোর ক্ষমতাশীল ব্যক্তিবর্গ মদপানকারীকে কোনো প্রকার শাস্তি দেয় না। সাধারণ মুসলিমদের মনে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ব্যভিচার হারাম; যদিও বর্তমানে এর ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা গেছে এবং প্রকাশ্যে ব্যভিচার চলছে। অথচ শাসক শ্রেণি এ অন্যায় কাজের জন্য দণ্ডবিধি প্রয়োগে অবহেলা করছে।
এমনিভাবে সাধারণ মুসলিমদের বিশ্বাস হলো, সুদ হারাম। সুদ গ্রহণকারী ও প্রদানকারী, উভয়ই পাপী; যদিও সুদের বিশদ বিবরণ সম্পর্কে তারা অনবহিত। অথচ প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে সুদ বৈধ এবং তার জন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেই। এরকম আরও অনেক অন্যায় কাজ আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে।
অতএব, এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, যদিও বহু মানুষ প্রকাশ্যে এসকল অন্যায় কাজে লিপ্ত হচ্ছে, কারণ তারা জানেÑ এ অপরাধের কারণে তাদের কোনো শাস্তি হবে না, আবার তাদের মধ্যে এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি আল্লাহর আইনে অপরাধ, তারপরও আল্লাহর বিধান প্রয়োগে শাসক শ্রেণির অবহেলা কখনও এসকল অন্যায় কাজের বৈধতা দিতে পারবে না।
অনুরূপ আমরা যে বলেছি, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর সাথে কোনো আইন বা বিধানের বিরোধ হলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে। আর যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করবে অথবা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার বিধান জানা সত্ত্বেও সে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এর বিরপীত বিষয়টিকে বৈধ জ্ঞান করবে তাকে অস্বীকারকারী হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে যার সমগ্র দীনের প্রতি ঈমান আছে, কিন্তু দীনের বিভিন্ন কাজের বিধান তার জানা নেই এবং সে ধারণা করে, বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার কোনো বিধান নেই, অথবা সে বিশ্বাস করেÑ বিরোধপূর্ণ বিষয়টিতে যে আমল প্রচলিত আছে তা আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মোতাবেক, অথবা এ বিষয়ে ক্ষমতাশীলদের আনুগত্য করা ওয়াজিব তাহলে এসব ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ, তাকে কাফের, ফাসেক ও পাপাচারী আখ্যা দেওয়া হবে না। কারণ, ইতঃপূর্বে আমরা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সা. থেকে দলিল পেশ করেছি যে, শরিয়াহ পালন কেবল তার জন্যই আবশ্যক হয় যার কাছে এর জ্ঞান পেঁৗছে এবং দীন সম্পর্কে অনবহিত ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ (মাজুর) হিসেবে গণ্য হবে এবং ভুলকারীর থেকে ভুলের বিধান রহিত হয়ে যাবে।
যারা নিজেদেরকে ইসলামের দাঈ, ধমীর্য় নেতা এবং আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বশীল হিসেবে পরিচয় দেন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে, মানুষের কাছে আল্লাহর বিধানের প্রকৃত রূপরেখা পেঁৗছে দেবে, তাদের সামনে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ও তার বিধান Ñযার প্রতি ঈমান আনা এবং তার ওপর আমল করা অত্যাবশ্যকÑ স্পষ্টরূপে তুলে ধরবে, সেই সাথে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল হতে এসবের দলিল—প্রমাণ তুলে ধরবে, যাতে মানুষের প্রতি প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগ পর্যন্ত তাদেরকে তাদের অজ্ঞতার কারণে অপারগ (মাজুর) ধরা হবে। অতএব, তারা মুসলিম এবং তাদের আকিদায় কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যার কাছে দলিল প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হলো, অতঃপর দলিল—প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত হলো, সে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও তার থেকে বিমুখ হয়েছে তাহলে সে সরাসরি কাফের, ফাসেক ও মুশরিক বলে বিবেচিত হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করে এবং তার থেকে বিমুখ হয় না, কিন্তু কখনও কখনও আল্লাহর বিধানের খেলাফ বিচার—ফয়সালা করে তাহলে সে ফাসেক ও পাপাচারী বিবেচিত হবে, যেমনটি পূর্বে এর বিশদ বিবরণ অতিবাহিত হয়েছে।
বলপ্রয়োগ ও বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির বিধান
পূর্বে আমরা ইসলামি শরিয়াহর সামগ্রিক নীতিমালা হতে দুটি মূলনীতির বিষয়ে আলোচনা করেছি। সেগুলো হচ্ছে, অজ্ঞতা (الجهل) এবং ভুল (الخطأ)। এ দুটি বিষয় এমন সামগ্রিক মূলনীতির অন্তভুর্ক্ত যার ওপর ভিত্তি করে সমস্ত কথা ও কাজের বিধান নির্ণিত হয়। এ দুটি মূলনীতির বিবেচনা আবশ্যিক হওয়ার ওপর আমরা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল হতে স্পষ্ট দলিল পেশ করেছি। আমরা আরও আলোচনা করেছি, শরিয়াহর দৃষ্টিতে অজ্ঞতার বিধান হলো, অজ্ঞ ব্যক্তিকে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ (মাজুর) বিবেচনা করা হয় এবং ভুলকারীকে তার ইজতিহাদের কারণে সওয়াব দেওয়া হয়, সেই সাথে তার ভুলটি ক্ষমা করা হয়।
তৃতীয় আরেকটি মূলনীতি আছে, আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করাও সঙ্গত মনে করছি। কেননা এটিও এমন সামগ্রিক মূলনীতির অন্তভুর্ক্ত, যার ভিত্তিতে কথা ও কাজের বিধান নির্ণিত হয়। কুফরের সংজ্ঞা বর্ণনার সময় আমরা এ মূলনীতির দিকে ইঙ্গিত করেছি। সেখানে আমরা বলেছি, কাউকে যদি কুফরি কালিমা উচ্চারণে বলপ্রয়োগ ও বাধ্য করা হয় তাহলে সেই কুফরি কালিমা উচ্চারণকারীকে কাফের আখ্যা দেওয়া হবে না এবং তার ওপর মুরতাদের (ধর্মত্যাগী) বিধান কার্যকর হবে না। কারণ, সে স্বেচ্ছায় কুফরি কালিমা উচ্চারণ করেনি, বরং সে তা করতে বাধ্য হয়েছে। এমনিভাবে কেউ যদি এমন কাজ করে, শরিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী যার কর্তা থেকে ঈমান চলে যায়, কিন্তু ঐ ব্যক্তি সেই কাজটি করেছিল তার ওপর বলপ্রয়োগের কারণে বাধ্য হয়ে, তাহলে তাকেও কাফের আখ্যা দিয়ে তার ওপর মুরতাদের বিধান আরোপ করা হবে না।
এ মূলনীতির আলোকে আমরা ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ইচ্ছাধিকার থাকার শর্ত করেছি, যে তার কাছে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর জ্ঞান পেঁৗছা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ভিন্ন কোনো আইন বা মতবাদের দ্বারস্থ হতে ইচ্ছুক বলে ঘোষণা দেয়। কেননা এ মূলনীতিকে তার গুরুত্বের কারণে ঐসকল মৌলিক স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়, যার ভিত্তিতে ইসলামি শরিয়াহর বিধান নির্ণিত হয়। এর স্বপক্ষে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ.
কেউ আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর তার সাথে কুফরি করলে এবং কুফরির জন্য তার হৃদয়কে উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর পতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয়; কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল। (সূরা নাহল : ১৬)
এ পবিত্র আয়াতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, কেউ যদি বাধ্য হয়ে এমন কাজ করে যা স্বাভাবিক অবস্থায় করলে তাকে কাফের ও মুরতাদ বিবেচনা করা হয়; কিন্তু বাধ্য হয়ে করার কারণে তাকে এখন কাফের ও মুরতাদ বলা হবে না। আয়াতের মর্ম ব্যাপক, যা প্রত্যেক ঐ কথা ও কাজকে অন্তভুর্ক্ত করে যার কারণে মুসলিম ব্যক্তি থেকে ঈমান চলে যায়।
ইমাম কুরতুবি তাঁর রচিত ‘আল—জামে লিআহকামিল কুরআন’ নামক তাফসির গ্রন্থে (খ. ১০, পৃ. ১৮০) বলেন, এ আয়াতটি হযরত আম্মর বিন ইয়াসির রা. সম্পর্কে নাযিল হয়েছিল। ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, মক্কার মুশরিকরা আম্মারকে এবং তাঁর পিতা ও মাতা সুমাইয়াকে, এছাড়াও সুহাইব, বেলাল, খাব্বাব ও সালেমকে (রা.) বন্দী করে। সুমাইয়া রা.—কে দুটি উটের মধ্যখানে বাঁধা হয় এবং বর্শা দ্বারা তার লজ্জাস্থানে আঘাত করা হয়। আর তাঁকে বলা হয়, তুই এসকল লোকদের কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছিস! অতঃপর তাঁকে এবং তাঁর স্বামী ইয়াসির রা.—কে হত্যা করা হয়। তাঁরাই ছিলেন ইসলামের সর্বপ্রথম শহিদ। আর আম্মার রা., তারা যে কথা বলতে বাধ্য করেছিল তিনি তাই বলেছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে গিয়ে তিনি নিজের অবস্থা জানালেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অন্তরের অবস্থা কী? তিনি উত্তর দিলেন, ঈমানের ওপর অবিচল। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তারা যদি পুনরায় তোমাকে বাধ্য করে তাহলে তুমি এমনটিই করবে।
ইমাম কুরতুবি আরও বর্ণনা করেছেন, মুসাইলামা কায্যাবের কয়েকজন গুপ্তচর রাসূলুল্লাহ সা.—এর দুজন সাহাবিকে আটক করে মুসাইলামার নিকট নিয়ে গেল। অতঃপর মুসাইলামা তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, হাঁ। সে আবার প্রশ্ন করলো, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, আমি আল্লাহর রাসূল? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। তখন সে তাকে মুক্ত করে দিল।
এরপর দ্বিতীয়জনকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল? সাহাবি বললেন, হাঁ। সে আবার প্রশ্ন করলো, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, আমি আল্লাহর রাসূল? তিনি উত্তর দিলেন, আমি বধির, কিছুই শুনি না। তখন সে তাকে নিয়ে গিয়ে গর্দান দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে। এরপর প্রথমজন রাসূল সা.—এর কাছে এসে বললেন, আমি ধ্বংস হয়েছি। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, কিসে তোমাকে ধ্বংস করলো? এরপর তিনি দীর্ঘ হাদিস বর্ণনা করেন এবং এর শেষাংশে নবীজি সা. বলেন, তোমার সঙ্গী দৃঢ়তা অবলম্বন করেছে। অপর বর্ণনামতে, তোমার সঙ্গী ঈমানের ওপর অবিচল থেকেছে, আর তুমি রুখসাত (অবকাশ) গ্রহণ করেছো। এখন তোমার অবস্থা কী? সাহাবি উত্তর দিল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছিÑ আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূল সা. বললেন, তুমি ঈমানের ওপর অবিচল আছো।
ইমাম কুরতুবি এর সাথে সংযোজন করে বলেন, যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলপ্রয়োগের অবস্থায় কুফরের অবকাশ দিয়েছেন এবং তার কারণে কোনো পাকড়াও করেননি, এর ভিত্তিতে আলেমগণ শরিয়াহর এ সম্পর্কিত সকল শাখা মাসআলার বিধান উদঘাটন করেছেন। অতএব, কাউকে কোনো কাজে বাধ্য করলে এজন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হবে না এবং তার ওপর বিধান আরোপিত হবে না।
তবে আরেকদল আলেমের মতে, এ অবকাশ শুধু কথার ক্ষেত্রে, কাজের ক্ষেত্রে নয়। যেমনÑ গায়রুল্লাহকে সিজদা করতে বাধ্য করা, কিবলার দিক ব্যতিরেকে ভিন্ন দিকে ফিরে নামায আদায় করা, কোনো মুসলিমকে হত্যা করা, তাকে প্রহার করা, তার সম্পদ ভক্ষণ করা, ব্যভিচার করা, মদপান করা, সুদ খাওয়া ইত্যাদি। তৃতীয় একদল আলেমের মতে [যাদের মধ্যে আছেন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা., মাকহুল, ইমাম মালেক এবং ইরাকের একদল আলেম], ঈমান ঠিক থাকলে কথা ও কাজে বলপ্রয়োগের বিধান একই।
এরপর ইমাম কুরতুবি বলেন, আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কাউকে যদি কুফরি করতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু সে কুফরি না করে হত্যার পথ বেছে নেয় তাহলে সে আল্লাহর নিকট ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক নেকি পাবে যে রুখসাত (অবকাশ) গ্রহণ করেছে। তবে ঐ ব্যক্তির সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, যাকে কুফর ব্যতীত কোনো হারাম কাজে বাধ্য করা হয়। মালেকি মাযহাবের আলেমগণ বলেন, এমতাবস্থায় দৃঢ়তা অবলম্বন করে হত্যা ও প্রহারের পথ বেছে নেওয়াটাই আল্লাহর নিকট অবকাশ গ্রহণের চেয়ে উত্তম।
ইবনু সাহনুন ইরাকবাসীদের মত উল্লেখ করে বলেন, কাউকে যদি হত্যা, অঙ্গহানি বা এমন প্রহারের হুমকি দেওয়া হয়, যার কারণে তার প্রাণ নাশের আশংকা রয়েছে তাহলে তাকে যে কাজের জন্য বলপ্রয়োগ করা হয়েছে তা করে ফেলার সুযোগ রয়েছে। যেমনÑ মদপান করা, শুকরের গোশত ভক্ষণ করা ইত্যাদি। যদি এসব কাজ না করার কারণে তাকে হত্যা করা হয় তাহলে আমরা মনে করিÑ সে এ কারণে গোনাহগার হবে। কেননা তার অবস্থা ছিল অপারগের মত।
ইমাম কুরতুবি আরও বলেন, খাব্বাব ইবনুল আরাত রা. বর্ণনা করেছেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে অভিযোগ করে বললাম Ñযখন তিনি কা’বা শরিফের ছায়ায় চাদর গায়ে জড়িয়ে বসেছিলেন, আপনি কেন আমাদের জন্য সাহায্য কামনা করছেন না? আমাদের জন্য দুআ করছেন না? তখন রাসূল সা. বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে এমন হতো যে, একজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হতো, অতঃপর মাটিতে গর্ত করে তাকে তাতে পঁুতে রাখা হতো, অতঃপর করাত এনে তার মাথার ওপর রাখা হতো এবং তাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়া হতো। এছাড়াও লোহার চিরুনি দ্বারা তারা শরীরের গোশত আচড়ানো হতো, যা হাড্ডি পর্যন্ত পেঁৗছে যেতো। এসব কিছু তাকে নিজ দীন থেকে ফেরাতে পারতো না। আল্লাহর শপথ! আল্লাহ এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন, ফলে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যে, একজন আরোহি ব্যক্তি সানআ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে; অথচ তার অন্তরে কেবল আল্লাহর ভয় এবং তার বকরির ওপর নেকড়ের ভয় ছাড়া আর কোনো ভয় থাকবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছো। (তাফসিরে কুরতুবি : খ. ১০, পৃ. ১৮৮; সহিহ বুখারি : ৩৬১২)
হাদিসটি উল্লেখ করে ইমাম কুরতুবি র. বলেন, নবীজি সা. এ হাদিসে পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রশংসা করেছেন যে, তারা আল্লাহ তাআলার জন্য কষ্টদায় কাজে ধৈর্য ধারণ করেছেন। তারা শাস্তি থেকে বাঁচতে অন্তরে ঈমানকে গোপন করে মুখে কুফরের কথা স্বীকার করেননি। সুতরাং এ হাদিসটি ঐ দলের প্রমাণ, যারা ঈমানের প্রশ্নে অবকাশ গ্রহণের তুলনায় নিহত, প্রহৃত ও লাঞ্ছিত হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইমাম কুরতুবি আরও বলেছেন, আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, কাউকে যদি অন্যকে হত্যা করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তার জন্য অন্যকে হত্যা, বেত্রাঘাত বা অন্য কোনো ভাবে মানহানি করা জায়েয হবে না। বরং তখন ঐ ব্যক্তির কর্তব্য হবে, সে তার ওপর আপতিত বিপদের ওপর ধৈর্যধারণ করবে। কেননা তার জন্য এটা বৈধ হবে না যে, সে অন্যের ক্ষতি করে নিজেকে রক্ষা করবে এবং আল্লাহর কাছে শুধু নিজের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সুস্থতা ও নিরাপত্তা কামনা করবে।
ইমাম কুরতুবি আরও বলেন, এ বাধ্যকরণের সীমারেখা সম্পর্কেও আলেমগণের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন, কোনো ব্যক্তি নিরাপদ নয় যখন তুমি তাকে ভয় দেখাবে, অথবা তাকে বেঁধে রাখবে কিংবা প্রহার করবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘যদি একটি কথার দ্বারা আমার থেকে দুটি বেতের আঘাত সরে যায় তাহলে আমি সে কথাটি অবশ্যই বলবো।’
হাসান বসরি র. বলেন, মুমিনদের জন্য আত্মরক্ষার্থে কৌশলমূলক কথা বলা (তাকিয়্যা) কিয়ামত পর্যন্ত জায়েয থাকবে। তবে আল্লাহ তাআলা কাউকে হত্যার ব্যাপারে কৌশল গ্রহণ করেন না।
ইবরাহিম নাখয়ি র. বলেন, কাউকে আটক করা এবং জেলখানায় বন্দী করা বলপ্রয়োগ হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম মালেক র.—এর মতও তাই। তবে তিনি আরেকটু সংযোজন করে বলেন, ভীতিপ্রদায়ক হুমকি বলপ্রয়োগের অন্তর্ভুক্ত; যদিও সীমালঙ্ঘনকারীর জুলুম বাস্তবে রূপ না নেয় এবং হুমকিদাতা যে বিষয়েরর হুমকি দিয়েছিল তা বাস্তবায়িত না করে।
ইমাম মালেক র. ও তাঁর অনুসারীদের মতে প্রহার বা জেলখানায় আটকের ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা নেই; বরং যে প্রহারের কারণে কষ্ট হয় এবং জেলখানায় বন্দীর কারণে বন্দীর ওপর সংকীর্ণতা আরোপিত হয় তাই বলপ্রয়োগ হিসেবে গণ্য হবে। ইমাম মালেক র.—এর মতে কাউকে যদি হুমকি, জেলখানায় বন্দী বা প্রহারের মাধ্যমে কসম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে কসম করবে এবং এ কসম ভঙ্গের কারণে তাকে কাফ্ফারা দিতে হবে না। এটি ইমাম শাফেয়ি, আহমদ, আবু ছাওর ও অধিকাংশ আলেমের মত।
বস্তুত কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাহর মূলবক্তব্যগুলো শর্তহীন, ব্যাপক ও সামগ্রিক এবং এগুলো একটি মূলনীতিকে সমর্থন করে, যা শরিয়াহর সকল বিধানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর তার দাবি হচ্ছে, নিরুপায় ব্যক্তি গোনাহ থেকে মাফ পাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ.
আর যা তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন তা তিনি বিশদভাবে তোমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, তবে তোমরা নিরুপায় হলে তা ব্যতিক্রম। (সূরা আনআম : ১১৯)
নবীজি সা. বলেছেন,
عفي لأمتي عن الخطأ والنسيان وما استكرهوا عليه.
আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি ও নিরুপায় অবস্থাকে ক্ষমা করা হয়েছে। (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ২, পৃ. ৩৩৪)
শরিয়াহর একটি স্বীকৃত মূলনীতি হলো,
إن العام يحمل على عمومه إلا فيما ورد فيه نص أو إجماع باستثنائه.
“ব্যাপক অর্থবোধক বক্তব্যের ক্ষেত্রে তার ব্যাপকতাই অর্থই ধর্তব্য হবে। তবে যেখানে এর বিপরীত নস (শরিয়ার বক্তব্য) বা ইজমা’ রয়েছে তা এর ব্যতিক্রম।”
অতএব, যদি এমন কোনো নস বা ইজমা পাওয়া যায় যা দ্বারা প্রতীয়মান হয়Ñ কিছু নির্দিষ্ট কথা বা কাজে নিরুপায় হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গোনাহ থেকে রেহাই পাবে না। যেমনÑ অন্যকে হত্যা করা, মানহানি করা ইত্যাদি, তবে সেক্ষেত্রে আমরাও একথাই বলবো যে, ঐ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট কাজের গোনাহ থেকে রেহাই পাবে না।
ইমাম ইবনে হাযম আল—মুহাল্লা গ্রন্থে (খ. ৮, পৃ. ৩২৯) এ সম্পর্কে বলেন,
“কাউকে বাধ্যকরণের বিষয়টি দুই প্রকার : কোনো নির্দিষ্ট কথায় বাধ্য করা, অথবা কোনো নির্দিষ্ট কাজে বাধ্য করা। কথায় বাধ্য করলে এর কারণে কোনো কিছু ওয়াজিব হয় না; যদিও বাধ্যকৃত ব্যক্তি তা উচ্চারণ করে ফেলে। যেমনÑ কুফরি কালিমা, কারও প্রতি অপবাদ আরোপ করা, কারও জন্য সম্পদের স্বীকারোক্তি দেওয়া, বিবাহ করা, বিবাহ দেওয়া, রাজআত বা তালাক প্রত্যাহার করে নেওয়া, তালাক প্রদান করা, ক্রয়—বিক্রয় করা, মানত করা, কসম করা, গোলাম আযাদ করা, হিবা করা, আহলে কিতাব জিম্মিকে ঈমান গ্রহণে বাধ্য করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের স্বীকারোক্তি দ্বারা কোনো কিছু ওয়াজিব হবে না। কারণ, সে নিরুপায় হয়ে যে কথাটি উচ্চারণ করেছে সেক্ষেত্রে সে মূলত আদিষ্ট হয়ে একটি কথা নকল বা বর্ণনা করেছে মাত্র। আর সর্বসম্মতিক্রমে বর্ণনাকারীর ওপর কোনো কিছু ওয়াজিব হয় না। রাসূল সা. বলেছেন,
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى.
“সকল কাজ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।” (সহিহ বুখারি : ১)
অতএব, এ হাদিসের আলোকে বিশুদ্ধরূপে প্রতীয়মান হলো যে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কথা বলতে বাধ্য হয়, কিন্তু বাস্তবে সে তার নিয়ত না করে তাহলে এ কারণে তার ওপর কোনো কিছু ওয়াজিব হবে না।
আর কাজে বাধ্য করার বিষয়টি আবার দুই প্রকার :
এক. এমন কাজ যা নিরুপায় অবস্থায় বৈধ হয়ে যায়। যেমনÑ খাওয়া, পান করা। এমন কাজে বাধ্য হলে কাজটি সম্পন্ন করা বৈধ হয়ে যায়। কেননা বাধ্য হওয়াও একটি নিরুপায় অবস্থা। অতএব, এ জাতীয় কাজ করতে যদি কেউ বাধ্য হয় তাহলে তার ওপর কোনো শাস্তি বা জরিমানা আসবে না। কারণ, সে একটি বৈধ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে বৈকি।
দুই. এমন কাজ যা নিরুপায় অবস্থায় বৈধ হয় না। যেমনÑ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, আহত করা বা প্রহার করা, কারও সম্পদ নষ্ট করা ইত্যাদি। এ জাতীয় কাজ করতে বাধ্য হওয়া তার বৈধতা প্রদান করে না। অতএব, কোনো ব্যক্তি যদি নিরুপায় অবস্থায় এমন কোনো কাজ করে ফেলে তাহলে তার ওপর কিসাস বা জরিমানা অবধারিত হবে। কেননা সে একটি হারাম কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে।
বলপ্রয়োগ (الإكراه) দ্বারা প্রত্যেক ঐ কাজ উদ্দেশ্য, আভিধানিক অর্থে যাকে বলপ্রয়োগ বলে অভিহিত করা হয় এবং সুস্থ রুচি ও জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ সেটিকে বলপ্রয়োগ বলে মনে করে। যেমনÑ এমন প্রভাবশালী ব্যক্তির পক্ষ থেকে হত্যার হুমকি, যে স্বীয় হুমকি বাস্তবায়নে সক্ষম বলে আশঙ্কা করা হয়। এমনিভাবে মারধর করার হুমকি, জেলখানায় বন্দী করার হুমকি, অথবা সম্পদ নষ্ট করার হুমকি। অনুরূপ অন্য কোনো মুসলিম বা অমুসলিমের ব্যাপারে হত্যা, মারধর, জেলখানায় বন্দী করা বা সম্পদ নষ্ট করার হুমকি। কারণ, হাদিস শরিফে এসেছে, নবীজি সা. বলেছেন,
المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يسلمه.
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করবে না এবং তাকে নিরুপায় অবস্থায় ছাড়বে না। (সহিহ বুখারি : ২৪৪২; সহিহ মুসলিম : ২৫৮০)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ.
আর যা তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন তা তিনি বিশদভাবে তোমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, তবে তোমরা নিরুপায় হলে তা ব্যতিক্রম। (সূরা আনআম : ১১৯)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِإِثْمٍ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ .
তবে যে তীব্র ক্ষুধার কারণে বাধ্য হবে, কোনো পাপের দিকে ঝুঁকে নয় (তাকে ক্ষমা করা হবে), নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মায়িদা : ৩)
এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেÑ এ দলিলের ভিত্তিতে আপনারা কেন নিরুপায় ব্যক্তির জন্য কাউকে হত্যা করা, ব্যভিচার করা, আহত করা, মারধর করা ও অন্যের সম্পদ নষ্ট করার বৈধতা দিলেন না?
এর জবাবে আমরা বলবো, কারণ, নস কখনও অন্যের পক্ষ থেকে সীমালঙ্ঘন ব্যতিরেকে তার ওপর জুলুম করে নিজের ওপর থেকে বিপদ দূরা করার বৈধতা দেয় না। বরং কাউকে এমন কাজে বাধ্য করা হলে তার কর্তব্য হচ্ছে, জালেমকে প্রতিহত করা, অথবা তাকে হত্যা করা। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ.
সৎকর্ম ও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর এবং মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। (সূরা মায়িদা : ২)
হাদিস শরিফে রাসূল সা. বলেছেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده إن استطاع فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان، ليس وراء ذلك من الإيمان شيء.
তোমাদের মধ্য হতে যদি কেউ কোনো অন্যায় কাজ দেখে তাহলে সামর্থ্য থাকলে হাত দ্বারা তা প্রতিহত করবে। যদি সেই সামর্থ্য না থাকে তাহলে মুখে প্রতিবাদ করবে। যদি সে সামর্থ্যও না থাকে তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতম স্তর। এরপর ঈমানের আর কোনো স্তর নেই। (আল—মুহাল্লা : খ. ৭, পৃ. ২০৪; সহিহ মুসলিম : ৪৯)
অতএব, একথা প্রমাণিত হলো যে, নিরুপায় কিংবা স্বাভাবিক কোনো অবস্থাতেই জুলুমের কাজে সহযোগিতার সুযোগ নেই। বরং কোনো ব্যক্তি তার হাত ও মুখের ভাষা দ্বারা অন্যায় কাজ প্রতিহত করতে সমর্থ্য না হলে তার জন্য অন্তর দ্বারা ঘৃণা করার সুযোগ রয়েছে। আর তখন আল্লাহ তাআলার ফয়সালার জন্য ধৈর্য ধারণ করবে।”
আর নিরুপায় হওয়ার কারণে অন্তরের বিশ্বাস ও অবিচলতায় কোনো পরিবর্তন আসার বৈধতা নেই, এর প্রমাণ হলোÑ আল্লাহ তাআলার বাণী :
إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ.
তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয়; কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল। (সূরা নাহল : ১০৬)
সুতরাং উপরিউক্ত আয়াতে সুস্পষ্টরূপে ঘোষণা হয়েছে যে, অন্তরের পরিবর্তনের অপরাধ অমার্জনীয়, যদিও তাকে এজন্য বাধ্য করা হয়। অতএব, বলপ্রয়োগের কারণে অন্তরের পরিবর্তন বৈধ হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ.
কিন্তু যে ব্যক্তি কুফরির জন্য তার হৃদয়কে উন্মুক্ত রাখলো তার ওপর পতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা নাহল : ১০৬)
অন্তরের পরিবর্তন ও হৃদয়কে উন্মুক্ত রাখা হচ্ছে অন্তরের কাজ, যে বিষয়ে মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ অবগত নন। কারণ, তিনি জানেনÑ অন্তর মানুষকে কী কুমন্ত্রণা দেয় এবং সে কী গোপন করে? তাছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই নিজের অবস্থা জানে যে, তার অন্তরের প্রকৃত অবস্থা কী? আর আমাদের মত মানুষের জন্য বাহ্যিক অবস্থা ছাড়া অন্য কিছু জানার সুযোগ নেই। কারণ, অন্যের বুক চিড়ে তার মনের কথা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব, কারও ওপর নিরুপায় অবস্থা আপতিত হলে সেক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হলো, নিরুপায় ব্যক্তির কথা বা কাজের ওপর শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য বা ইজমা ব্যতিরেকে গোনাহের বিধান আরোপ না করা এবং তার অন্তর্নিহিত বিষয়কে আল্লাহ তাআলার প্রতি ন্যস্ত করা।
তাছাড়া আমাদের কাছে এমন কোনো নস্ নেই, যা দ্বারা বলপ্রয়োগের পরিমাণ ও মাত্রা নির্ণয় করা যায়। এমতাবস্থায় আভিধানে বলপ্রয়োগ (الإكراه) বলতে যা বুঝায়, এ সম্পর্কিত নসের ক্ষেত্রে সেই ব্যাপক অর্থই প্রযোজ্য হবে।
‘আল—কামুসুল মুহিত’ গ্রন্থকার বলেন, আল—ইযতিরার (الاضطرار) শব্দের অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছুর দিকে মুখাপেক্ষী হওয়া। যেমন বলা হয়, اضطره إلى الشيئ : তাকে ঐ জিনিসের মুখাপেক্ষী ও সাহায্যপ্রার্থী করলো। اضطره على الأمر : তাকে উক্ত কাজে বাধ্য করলো।
‘আল—কামুসুল মুনজিদ’ গ্রন্থকার বলেন, أكره فلانا على الأمر এর অর্থ হচ্ছে, তাকে উক্ত কাজে জোরপূর্বক প্রবৃত্ত করলো। كره و تكاره الأمر অর্থ হলো, সে উক্ত জিনিসটিকে অপছন্দ করলো।
অতএব, এ আভিধানিক সংজ্ঞার ভিত্তিতে যা পূর্বে আলোচিত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন এবং অভিধান ও শরিয়া বিশেষজ্ঞদের মতের অনুরূপ আমরা বক্তব্য হচ্ছে, প্রত্যেক এমন কাজ যা দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে কষ্ট দেওয়া হয়, অথবা কোনো ব্যক্তির জীবন, সম্পদ বা অন্য কোনো মুসলিমের ক্ষতি করার হুমকি দেওয়া হয়, যা সে অপছন্দ করে এবং এর কারণে তার অন্তর সঙ্কুচিত হয় এবং তা সহ্য করার মত সামর্থ্য তার নেই তাহলে এমন কাজটি আভিধানিক অর্থে বলপ্রয়োগ বা নিরুপায় অবস্থা বলে বিবেচিত হবে। এ অবস্থাটি ব্যক্তিভেদে ভিন্ন রকম হতে পারে। প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা তাকে যে শক্তি, সামর্থ্য ও সহ্য ক্ষমতা দান করেছেন তাই ধর্তব্য হবে। আল্লাহ তাআলাই প্রত্যেক মানুষের মনের কথা এবং অন্তরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সম্মক অবহিত। আমাদের সাধারণ মানুষদের জন্য বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনা করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।
অতএব, কোনো ব্যক্তির ওপর যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা দ্বারা তার জীবন বা সম্পদের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, অতঃপর এ নিরুপায় অবস্থায় তার থেকে যে কথা বা কাজ প্রকাশ পেল সেক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হলো, শরিয়াহর বিধান মান্য করা এবং শরিয়াহর সুস্পষ্ট বক্তব্য বা ইজমা ছাড়া উক্ত কথা ও কাজের ওপর শাস্তি আরোপ না করা। কেননা এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, উক্ত ব্যক্তি এবং আমরা, একদিন সকলেই আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও রূপকার মহান আল্লাহ তাআলার কাছে ফিরে যাবো এবং এমন একদিন তাঁর সামনে দণ্ডায়মান হবো, যেদিন কারও মিথ্যা দাবি, ধন—সম্পদ, সন্তান—সন্তুতি কোনো কিছুই কোনো উপকার করবে না। তবে যে ব্যক্তি পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে কেবল সেই রক্ষা পাবে।
সবর সবচেয়ে উত্তম ও প্রিয় পন্থা
আল্লাহ তাআলা হকের কালিমাকে সমুন্নত করা, হকের প্রচার—প্রসার করা, যমিনে হক প্রতিষ্ঠা করা এবং অন্যায়, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ধৈর্য ও অবিচলতার সাথে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েছেন। আর যারা এ পথের কর্মী হবে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিদান এবং চিরসুখের নিবাস জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভের ঘোষণা করেছেন। ইমাম কুরতুবি একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যেখানে রাসূল সা. পূর্ববর্তী উম্মতদের প্রশংসা করেছেন। কারণ, তারা বহু নিপীড়ন ও কঠিন শাস্তির শিকার হওয়া সত্ত্বেও ধৈর্য ধারণ করেছে।
কুরআনে কারিম আমাদের সামনে এ বিষয়ে জীবন্ত নমুনা পেশ করেছে এবং পরিপূর্ণরূপে উপস্থাপন করেছে যে, সজীব অন্তরে ঈমান কী করে সাহসিকতা, ধৈর্য ও সহনশীলতা এবং ত্যাগের মানসিকতা সৃষ্টি করে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের পথে ধৈর্যের পরিচয় দেবে, আল্লাহ তাআলার রজ্জুকে শক্তভাবে ধারণ করবে, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার বদলে চিরস্থায়ী জান্নাতের সওদা করবে, আল্লাহ তাআলার আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে নিয়তকে বিশুদ্ধ করে নিবে, বিনয় ও ন¤্রতা অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর নিধার্রণের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে, আল্লাহ তাআলা তার এসব কাজের ওপর যে আবশ্যিক প্রতিদানের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন তাও আমাদের সামনে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সামনে ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, যে সত্যের সমর্থনে এবং আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য শহরের প্রান্ত থেকে দৌড়ে এসে বলেছিল :
يَا قَوْمِ اتَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ (২০) اتَّبِعُوا مَنْ لَا يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُمْ مُهْتَدُونَ (২১) وَمَا لِيَ لَا أَعْبُدُ الَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ (২২) أَأَتَّخِذُ مِنْ دُونِهِ آلِهَةً إِنْ يُرِدْنِ الرَّحْمَنُ بِضُرٍّ لَا تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلَا يُنْقِذُونِ (২৩) إِنِّي إِذًا لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (২৪) إِنِّي آمَنْتُ بِرَبِّكُمْ فَاسْمَعُونِ (২৫)
হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা রাসূলগণের অনুসরণ কর; অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চান না এবং তারাই সুপথপ্রাপ্ত। আমার কি যুক্তি আছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর নিকটই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আমি তাঁর ইবাদত করবো না? আমি কি তার পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করবো? পরম করুণাময় আল্লাহ আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধারও করতে পারবে না। এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বো। আমি তো আমার প্রতিপালকের ওপর ঈমান এনেছি, অতএব তোমরা আমার কথা শোনো। (সূরা ইয়াসিন : ২০—২৫)
قِيلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُونَ (২৬) بِمَا غَفَرَ لِي رَبِّي وَجَعَلَنِي مِنَ الْمُكْرَمِينَ .
তাকে বলা হলো, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বললো, আমার সম্প্রদায় যদি জানতোÑ কীভাবে আমার প্রতিপালক আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিত করেছেন। (সূরা ইয়াসিন : ২৬—২৭)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সামনে ফেরআউর পরিবারের আরেকজন মুমিন বান্দার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, যে নিজের ঈমানকে গোপন করেছিল, অতঃপর সে মূসা আ.—এর সাহায্যে দাঁড়িয়ে যায় এবং সত্যের পক্ষ অবলম্বন, আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে বলে,
أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ وَقَدْ جَاءَكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ مِنْ رَبِّكُمْ وَإِنْ يَكُ كَاذِبًا فَعَلَيْهِ كَذِبُهُ وَإِنْ يَكُ صَادِقًا يُصِبْكُمْ بَعْضُ الَّذِي يَعِدُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ مُسْرِفٌ كَذَّابٌ (২৮) يَا قَوْمِ لَكُمُ الْمُلْكُ الْيَوْمَ ظَاهِرِينَ فِي الْأَرْضِ فَمَنْ يَنْصُرُنَا مِنْ بَأْسِ اللَّهِ إِنْ جَاءَنَا قَالَ فِرْعَوْنُ مَا أُرِيكُمْ إِلَّا مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلَّا سَبِيلَ الرَّشَادِ.
তোমরা কি এক ব্যক্তিকে এজন্য হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার প্রতিপালক আল্লাহ, অথচ সে তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের নিকট এসেছে? সে মিথ্যাবাদী হলে তার মিথ্যার জন্য সে দায়ী হবে, আর যদি সে সত্যবাদী হয় তাহলে যে শাস্তির কথা সে তোমাদেরকে বলে তার কিছু তো তোমাদের ওপর আপতিত হবেই। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী ও মিথ্যাবাদীকে হেদায়াত দান করেন না। হে আমার সম্প্রদায়! আজ কতৃর্ত্ব তোমাদের, দেশে তোমরাই প্রবল; কিন্তু আমাদের ওপর আল্লাহর শাস্তি এসে গেলে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে? (সূরা মুমিন : ২৮—২৯)
কিন্তু যখন ফেরআউন অহংকারী ও উদ্ধত স্বরে বললো,
مَا أُرِيكُمْ إِلَّا مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلَّا سَبِيلَ الرَّشَادِ.
আমি যা বুঝি তোমাদেরকে তাই বলছি এবং আমি তোমাদেরকে কেবল সৎপথই দেখাই। (সূরা মুমিন : ৯২) তখন ঐ মুমিনের মধ্যে তার দাওয়াতের প্রতি বিশ^াস আরও বেড়ে গেল। ফলে সে অনবরত তার দাওয়াতের কাজ চালিয়ে গেল, তার প্রচার—প্রসার করলো এবং তার সম্প্রদায়কে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করার থেকে সতর্ক করলো এ বলে যে,
إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ مِثْلَ يَوْمِ الْأَحْزَابِ (৩০) مِثْلَ دَأْبِ قَوْمِ نُوحٍ وَعَادٍ وَثَمُودَ وَالَّذِينَ مِنْ بَعْدِهِمْ وَمَا اللَّهُ يُرِيدُ ظُلْمًا لِلْعِبَادِ (৩১) وَيَا قَوْمِ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ يَوْمَ التَّنَادِ (৩২) يَوْمَ تُوَلُّونَ مُدْبِرِينَ مَا لَكُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ.
হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য পূর্ববর্তী সম্প্রদায়সমূহের শাস্তির দিনের অনুরূপ দুর্দিনের আশঙ্কা করছিÑ যেমনটি ঘটেছিল নূহ, আদ, ছামুদ এবং তাদের পূর্ববর্তীদের ব্যাপারে। আর আল্লাহ তো বান্দাদের প্রতি জুলুম করতে চান না। হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য আশঙ্কা করছি আর্তনাদ দিবসের, যেদিন তোমরা পশ্চাতে পলায়ন করতে চাইবে। সেদিন আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করার কেউ থাকবে না। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোনো পথপ্রদর্শক নাই। (সূরা মুমিন : ৩০—৩৩) অতঃপর, তার ফলাফল এই দাঁড়াল যে,
فَوَقَاهُ اللَّهُ سَيِّئَاتِ مَا مَكَرُوا وَحَاقَ بِآلِ فِرْعَوْنَ سُوءُ الْعَذَابِ
অতঃপর আল্লাহ তাকে তাদের ষড়যন্ত্রের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন এবং ফেরআউনের সম্প্রদায়কে ঘিরে ফেলল কঠিন শাস্তি। (সূরা মুমিন : ৪৫)
মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন :
قُلْ هَلْ تَرَبَّصُونَ بِنَا إِلَّا إِحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ. وَنَحْنُ نَتَرَبَّصُ بِكُمْ أَنْ يُصِيبَكُمُ اللَّهُ بِعَذَابٍ مِنْ عِنْدِهِ أَوْ بِأَيْدِينَا فَتَرَبَّصُوا إِنَّا مَعَكُمْ مُتَرَبِّصُونَ.
বলুন, তোমরা আমাদের দুটি মঙ্গলের একটি প্রতীক্ষা করছো এবং আমরা প্রতীক্ষা করছি যে, আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দিবেন সরাসরি নিজের পক্ষ থেকে অথবা আমাদের হাত দ্বারা। অতএব, তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমরাও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি। (সূরা তাওবা : ৫২)
আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কিতাবে ধৈর্যশীল ও পরিশ্রমীদের প্রশংসা করেছেন এবং আমাদেরকে এর মাধ্যমে সরল ও সঠিক পথে অবিচল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ (১৫৩) وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَكِنْ لَا تَشْعُرُونَ (১৫৪) وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ (১৫৫) الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ (১৫৬) أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ.
হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছে। যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদের মৃত বলো না; বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না। আমি তোমাদেরকে অব্যশ্যই কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন—সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করবো। আর আপনি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দিনÑ যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই, আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। এরাই তারা যাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষিত হয়, আর তারাই সঠিক পথে পরিচালিত। (সূরা বাকারা : ১৫৩—১৫৭)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (১৭৩)
যাদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক। (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩)
وَكَأَيِّنْ مِنْ نَبِيٍّ قَاتَلَ مَعَهُ رِبِّيُّونَ كَثِيرٌ فَمَا وَهَنُوا لِمَا أَصَابَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَا ضَعُفُوا وَمَا اسْتَكَانُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الصَّابِرِينَ (১৪৬) وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَنْ قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ (১৪৭)
আর কত নবী যুদ্ধ করেছেন, তাদের সাথে ছিল বহু আল্লাহওয়ালা। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি, দুর্বল হয় এবং নত হয়নি, আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে ভালোবাসেন। এ কথা ছাড়া তাদের আর কোনো কথা ছিল না যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পাপ ও আমাদের কাজের সীমালঙ্ঘন আপনি ক্ষমা করুন, আমাদের পা সুদৃঢ় রাখুন এবং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩)
كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ.
আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে! আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা বাকারা : ২৪৯)
রাসূল সা.—ও এ বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
لتأمرن بِالْمَعْرُوفِ ولتنهون عَن الْمُنكر أَو ليعمنكم الله بِعَذَاب من عِنْده
তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, নতুবা আল্লাহ তোমাদের সবাইকে স্বীয় শাস্তি দ্বারা ঢেকে নিবেন। (আল—ফিসাল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ইবনু হাযম, পৃ. ১৭৭)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً.
আর তোমা ফিতনাকে ভয় কর, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্য থেকে যারা যালেম শুধু তাদের ওপরই আপতিত হবে না। (সূরা আনফাল : ২৫)
বাস্তবতা হচ্ছে, জগতের নিয়ম দ্বারা এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত যে, বিভিন্ন দাওয়াতের কাজ ও উম্মতসমূহকে সাহায্য করা হয় এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ঐ সকল সত্যনিষ্ঠ, ধৈর্যশীল ও অবিচল ব্যক্তিদের মাধ্যমে আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে যাদেরকে দাওয়াতের কাজে ব্যবহার করেন, যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে বিসর্জন দেয় এবং যারা প্রতিটি কথা ও কাজে আল্লাহ সন্তুষ্টি কামনা করে, হকের বিষয়ে তারা কোনো নিন্দুকের নিন্দা, দুনিয়াবি স্বার্থ বিসর্জন অথবা মর্যাদাহানির তোয়াক্কা করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ.
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। (সূরা তাওবা : ১১১)
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا.
তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতো না। আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আহযাব : ৩৯)
সর্বসম্মত তিনটি মূলনীতি
অতঃপর আল্লাহর সাহায্যে বলবো, পূর্বে যে তিনটি মূলনীতির ব্যাখ্যা করা হয়েছে তথাÑ অজ্ঞতা, ভুল ও বাধ্যকরণÑ এগুলোর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে মুসলিম আলেম ও ফকিহগণ সবাই একমত। এগুলোর আইনানুগতা ও বিবেচনা আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে কারও ভিন্ন কোনো মত নেই; যদিও এগুলোর সংজ্ঞা ও এগুলোর ভিত্তিতে আরোপিত বিধানে কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। অতএব, কোনো বিচারক যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে শরয়ি বিধান প্রয়োগ করতে চায় তাহলে এ বিষয়গুলোকে আবশ্যিকরূপে বিবেচনা করতে হবে এবং নিজের পক্ষ থেকে এগুলোর প্রতিক্রিয়াকে আমলে নিতে হবে; যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এর মাধ্যমে আত্মরক্ষা না করে এবং এ বিষয়গুলো যে শরিয়তে ধর্তব্য এবং এগুলোর কিছু বিশেষ প্রভাব রয়েছে, সে বিষয়ে সে অনবহিত হয়।
বিচারক ও দাঈর কাজের মধ্যে পার্থক্য
এ কারণে আমরা বলবো, বিচারক ও দাঈর কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। কারণ, বিচারকের দায়িত্ব হলো, তিনি নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে তার ওপর শরয়ি বিধান প্রয়োগ করবেন। কোনো মামলা সামনে এলে তিনি সমস্যার গভীরে পেঁৗছে তার মূল কারণটি উদঘাটন করবেন, তার সূক্ষ্ম ও গোপন দিকগুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হবেন, সাক্ষীদের বক্তব্য শুনবেন, তাদের দলিল—প্রমাণগুলো খতিয়ে দেখবেন এবং বাদী ও বিবাদী প্রত্যেক পক্ষকে তার দাবি প্রমাণের সুযোগ করে দিবেন। এসব কিছুই হবে দলিল—প্রমাণের আলোকে নির্দিষ্ট নিয়ম—কানুন অনুসারে। এসকল ধাপ শেষ করার পর তিনি নিজের পূর্ণ সামর্থ্য ব্যয় করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তার ওপর আল্লাহ বিধান বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবেন।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক রাসূল সা. আমাদেরকে শিখিয়েছেনÑ কোনো ঘটনার তদন্ত করা এবং তার বাস্তবতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শরয়ি বিধান প্রয়োগে একজন বিচারকের করণীয় কী? ইমাম মুসলিম সুলাইমান ইবনে ইয়াযিদের সূত্রে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, মায়েয ইবনে মালিক রা. রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে এসে বললেন, আমাকে পবিত্র করুন। রাসূল সা. বললেন, আফসোস তোমার জন্য! তুমি ফিরে যাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর।
মায়েয রা. কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন। রাসূল সা. তাকে পূর্বের ন্যায় সেই কথাই বললেন। এভাবে চতুর্থবার রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, তোমাকে কিসের থেকে পবিত্র করবো? তিনি বললেন, ব্যভিচার থেকে। রাসূলুল্লাহ সা. জিজ্ঞেস করলেন, সে কি পাগল হয়েছে? লোকেরা বললো, না, সে পাগল নয়। অন্য বর্ণনামতে রাসূল সা. তার কওমের কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি কেউ জান যে, তার মাথায় কোনো সমস্যা আছে? তার কোনো কাজের ওপর কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে? তখন তার কওমের লোকেরা বললো, আমরা তার ব্যাপারে এটাই জানি যে, সে বিবেক—বুদ্ধির দিক থেকে আমাদের সৎ ও ভালো লোকদের একজন। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, সে কি মদপান করেছে? তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে তার মুখের ঘ্রাণ শুকলো; কিন্তু তাতে কোনো মদের গন্ধ পায়নি। তখন রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ব্যভিচার করেছ? তিনি উত্তর দিলেন, হাঁ। হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনায়Ñ রাসূলুল্লাহ সা. মায়েয রা.—কে বললেন, আফসোস তোমার জন্য, হয়তো তুমি চুম্বন করেছ, অথবা চোখটিপ দিয়েছ কিংবা দৃষ্টিপাত করেছ। তিনি বললেন, না। তখন রাসূল সা.—এর আদেশ মোতাবেক তাকে প্রস্তারাঘাত করা হলো।
মায়েয আসলামি রা.—এর ঘটনায় নবী সা. তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি কি জানÑ ব্যভিচার কী? তখন তিনি বললেন, হাঁ, আমি তার সাথে হারাম কাজে লিপ্ত হয়েছি, যেমনটি একজন পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে হালালভাবে করে থাকে।
এ হাদিসে আমরা দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহ সা. শরয়ি বিধান প্রয়োগের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির স্বীকারোক্তি দ্বারা অপরাধের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন। কেননা স্বীকারোক্তি হচ্ছে সবচেয়ে প্রধান ও শক্তিশালী দলিল। আর অন্য সকল দলিলের শক্তি এর চেয়ে কম। বিষয়টি আরও জোরালো হয়েছে, যখন অপরাধী ব্যক্তি নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে যিনা বা ব্যভিচারের শরয়ি অর্থ ভালো করেই বুঝে এবং সে এ ব্যাপারে অজ্ঞ বা ভুলকারী নয়, যেমন নবীজি সা. নিশ্চিত হয়েছেন যে, সাহাবির মাথা ঠিক আছে এবং তিনি অপরাধ স্বীকারকালে সেই অপরাধ সম্পর্কে সচেতন ও জ্ঞানবান ছিলেন, তখন তার মাথায় স্থায়ী বা সাময়িক কোনো সমস্যা ছিল না।
পূর্ববর্তী মূলনীতিগুলোর বিভিন্ন প্রয়োগ
আমরা উল্লেখিত তিনটি মূলনীতির প্রামাণিকতার ওপর কিতাবুল্লাহ এবং রাসূল সা.—এর সহিহ হাদিস দ্বারা দলিল প্রদান এবং প্রত্যেকটির বিধান বর্ণনার পর এখন আল্লাহর সাহায্যে এগুলোর বিভিন্ন প্রয়োগিক দৃষ্টান্ত আলোচনা করবো, যেগুলো রাসূলুল্লাহ সা.—এর বড় বড় সাহাবি, তাবেয়িন এবং উম্মতের শীর্ষস্থানীয় ফকিহগণের সাথে সম্পৃক্ত।
ইসলামের সর্বপ্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রা. তার পূর্ণ খিলাফত আমল জুড়ে জাযিরাতুল আরব থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের দেশান্তরের আবশ্যিকতার বিধান সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যু এমতাবস্থায় হয়েছে যে, তিনি তাদেরকে জাযিরাতুল আরবে অবস্থানের সুযোগ দিয়েছিলেন। আমিরুল মুমিনিন উমর রা. তাঁর খেলাফত আমলের বেশ কয়েক বছর এ সিদ্ধান্তের ওপরই বহান ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাদেরকে বহিষ্কার করেন এবং তখন থেকে এ বিষয়ে মুসলিমদের মধ্যে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, জাযিরাতুল আরবের মধ্যে ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম পালন করা যাবে না। আবার এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, আবু বকর ও উমর রা. পূর্বের সেই সিদ্ধান্তের কারণে গোনাহগার হননি।
এমনিভাবে আবু বকর সিদ্দিক রা. জানতেন না যে, দাদী উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে কতটুকু অংশ পায়? তখন মুহাম্মাদ ইবনে মুসায়লামা ও মুগিরা ইবনে শু’বা রা. তাকে এ বিষয়ে অবহিত করেন। এছাড়াও আবু বকর রা. উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা.—কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাফনের কাপড় কয়টি হবে?
আবু বকর রা. মুরতাদদের (ইসলাম ত্যাগকারী) স্ত্রীদেরকে বন্দী করে রাখতেন। কিন্তু উমর রা.—এর খেলাফত আমলে তিনি এবং অন্যান্য সাহাবিগণ এ বিষয়টিকে অবৈধ মনে করলেন এবং এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, এখন থেকে মুরতাদদের স্ত্রীদের বন্দী করা যাবে না। কিন্তু এমনটি কেউ বলেননি যে, আবু বকর রা. পূর্বের সেই সিদ্ধান্তের কারণে গোনাহগার হয়েছেন।
উমর রা.—এর কাছে কালালাহ্র মাসআলাটি জটিল মনে হয়েছিল, যে কারণে তিনি রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে এর অর্থটি বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন। রাসূল সা. তাঁর বারবার প্রশ্নের কারণে তাকে ধমন দিলেন এবং বললেন, উমর এর অর্থ কখনও বুঝবে না।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা.—এর কাছে যখন রাসূল সা.—এর মৃত্যুসংবাদ পৌঁছল তখন তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সা. মারা যাননি এবং যতদিন আমরা বেঁচে থাকবো তাঁর মৃত্যু হবে না। অথবা তিনি জাতীয় কোনো কথা বলেছেন। কিন্তু যখন তার সামনে এ আয়াত তিলাওয়াত করা হলো,
إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ.
নিশ্চয় আপনি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। (সূরা যুমার : ৩০)
তখন তার হাত থেকে তরবারি পড়ে গেল এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমার কাছে মনে হয়েছেÑ এ আয়াত আমি কখনও পাঠ করিনি।
এর পরের দিন ভোরে তিনি মসজিদে গেলেন। তখন লোকজন হযরত আবু বকর রা.—এর হাতে বায়আত হওয়ার জন্য মসজিদে সমবেত হয়েছিল। যখন আবু বকর রা. মিম্বরে আসীন হলেন তখন তিনি তাঁর পূর্বে কালিমা শাহাদাত পাঠ করলেন অতঃপর বললেন, আমি গতকাল তোমাদেরকে একটি কথা বলেছিলাম; কিন্তু আমি যেমনটি বলেছিলাম বাস্তবতা তেমন নয়। আমি যে কথাটি বলেছিলাম তা কিতাবুল্লাহয় পায়নি এবং রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে এ জাতীয় কোনো প্রতিশ্রম্নতি দেননি। বরং আসল কথা হচ্ছে, আমি আশা করতাম, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের মধ্যে অবস্থান করবেন এবং আমাদের সর্বশেষ ব্যক্তি তিনিই হবেন। কিন্তু আল্লাহ স্বীয় রাসূলের জন্য তোমাদের কাছে যা আছে তার তুলনায় তাঁর কাছে যে নিয়ামতরাজি আছে তাকেই পছন্দ করেছেন। এই যে কিতাব আল্লাহর রাসূল সা. যার প্রতি হেদায়াত করেছেন, তোমরা এটিকে গ্রহণ কর, রাসূলুল্লাহ সা.—এর এ হেদায়াত মেনে চললে তোমরা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।
এ বর্ণনায় আমরা দেখি, উমর রা. মসজিদে নববিতে সকল সাহাবির সামনে ঘোষণা করছেন, তিনি এমন কথা বলেছেন যা কিতাবুল্লাহয় নেই এবং সুন্নাতে রাসূলের সা.—এর মাঝেও নেই। তিনি এমন সিদ্ধান্ত করেছেন যা কুরআন ও সুন্নাহর কোনোটিতেই নেই এবং এমন কথা বলে তিনি ভুল করেছেন।
এ বিষয়টি সকল আলেমের নিকট বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত যে, মুসলিমরা যখন হাবশায় (ইথিওপিয়া) ছিল এবং জাযিরাতুল আরবের প্রান্তে অবস্থান করছিল তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এমন বিধান নাযিল হয় ইতঃপূর্বে যে বিষয়ে কোনো বিধান নাযিল হয়নি। যেমন রোযা ও যাকাতের বিধান নাযিল হয় এবং এমন বিষয় হারাম ঘোষণা করা হয় ইতঃপূর্বে যা হারাম ছিল না। যেমনÑ মদপান এবং মুশরিক স্ত্রীদেরকে নিজের অধীনে রাখা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কেউ যদি এ সম্পর্কিত বিধান না জানার কারণে নিষিদ্ধ কাজের ওপর বহাল থাকে তাহলে সে গোনাহগার হবে না।
এমনিভাবে তখন এমন বিধান নাযিল হতো যা পূর্বের বিধানের বিপরীত। যেমন বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে কিবলার দিক পরিবর্তন। এতেও কোনো সন্দেহ নেই যে, কেউ যদি নতুন বিধান না জানার কারণে রহিত বিধানের ওপর বহাল থাকে তাহলে সে গোনাহগার হবে না।
হিশান ইবনে উরওয়াহ স্বীয় পিতার সূত্রে ইয়াহইয়া ইবনে আবদুর রহমান ইবনে হাতেব থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আবদুর রহমান ইবনে হাতেবের মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার নামাযি ও রোযাদার দাসদের মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তাঁর একজন নুবিয়ান দাসী ছিল, যে নামায আদায় করতো এবং রোযা পালন করতো। সে ছিল অনারবি, যে দীনের জ্ঞান শিক্ষা করেনি। তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন, সে গর্ভবতী এবং সে নিজের কুমারিত্ব হারিয়েছে। তখন তিনি উমর ইবনুল খাত্তার রা.—এর নিকট গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিলেন। তখন উমর রা. ঐ দাসীর কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গর্ভবতী? সে বললো, হাঁ। মারগুশ দুই দিরহামের বিনিময়ে আমার সাথে এ কাজ করেছে। এ সময় তাকে খুব হাসি—খুশি দেখাচ্ছিল, যেন সে কিছুই লুকাচ্ছে না।
এমন সময় তাঁর নিকট অকস্মাৎ আলী ইবনে আবু তালেব, আবদুর রহমান ইবনে আওফ ও উসমান ইবনে আফ্ফান প্রমুখ সাহাবির আগম হয়। উমর রা. তাদেরকে জিজ্ঞেস বললেন, তোমরা আমাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দাও। উসমান রা. সোজা হয়ে বসেছিলেন, অতঃপর তিনি হেলান দিয়ে বসে পড়লেন। আলী ও আবদুর রহমান রা. বললেন, তার ওপর হদ্দ (দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করা আবশ্যক হয়েছে। উমর রা. বললেন, হে উসমান! তোমার পরামর্শ কী? তিনি বললেন, আপনার দুজন ভাই পরামর্শ দিয়েছেনই তো। উমর রা. বললেন, এখন তুমি পরামর্শ দাও। উসমান রা. বললেন, আমি দেখছি সে এ জন্য খুব হাসি—খুশি, যেন সে এর বিধান সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর হদ্দ (দণ্ডবিধি) কেবল তার ওপরই ওয়াজিব হয় যে সংশ্লিষ্ট অপরাধের বিধান জানে।
অতঃপর ওপর রা. তাকে একশত বেত্রাঘাত এবং তার শিক্ষাদানের নিমিত্তে এক বছর দেশান্তরের হুকুম দিলেন; কারণ সে দীনের জরুরি বিধান সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই বসেছিল। (আল—ইহকাম, খ. ৪, পৃ. ১৮১—১৮৩।)
এ ঘটনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানতে পারি :
১. হযরত উমর ও উসমান রা. আলী ও আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা.—এর সামনে এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে মাজুর বা অপারগ হিসেবে গণ্য হবে এবং কৃত অপরাধটি যে হারাম ছিল এ বিষয়ে না জানার কারণে তার ওপর হদ্দ (দণ্ডবিধি) প্রয়োগ হবে না।
২. আলী ও আবদুর রহমান রা. যে ঐ দাসীর ওপর তার অজ্ঞতার বিবেচনা না করেই হদ্দ প্রয়োগের যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তা ভুল ছিল।
৩. এ অনারবি দাসী এত বেশি অজ্ঞ ও অবুঝ ছিল যে, সে জানতোই না ব্যভিচার হারাম; অথচ তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল এবং নামায ও রোযার শর্ত পূরণের কারণে তাকে স্বাধীন করে দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখিত সাহাবি চতুষ্টয়ের কেউ তার ইসলাম সম্পর্কে কোনো সন্দেহ পোষণ করেননি এবং কেউ এ কথা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেননি যে, সে কালিমার সাক্ষ্যদানের অর্থ বুঝেছে কি না?
৪. সাহাবি চতুষ্টয়ের কেউ এমন বলেননি যে, সে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে অথবা শরিয়াহর একটি অতি প্রসিদ্ধ বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে।
৫. অজ্ঞ ব্যক্তির ওপর তার অজ্ঞতার কারণে হদ্দ প্রয়োগ করা যাবে না; তবে দীনের জরুরি বিষয় জানার জন্য চেষ্টা না করার কারণে তাকে তা’যির বা লঘু শাস্তি দেওয়া হবে।
হযরত উমর রা. একদিন মসজিদে নববির মিম্বরে বসে স্ত্রীদের মহর অতিমাত্রায় ধার্য করা থেকে নিষেধ করলেন। এক্ষেত্রে তিনি রাসূল সা.—এর পবিত্র স্ত্রীগণের মহর কম হওয়াকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন এক মহিলা তাঁর বিপক্ষে এ আয়াত পাঠ করলো,
وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا
এবং তাদের একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাক। (সূরা নিসা : ২০) তখন তিনি সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন।
উমর রা. একদিন এক পাগলিকে রজম (প্রস্তারাঘাতে হত্যা) করার নির্দেশ জারি করলেন। পরে যখন রাসূল সা.—এর হাদিস জানতে পারলেন যে, তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে (তাদের মধ্যে একজন হলো পাগল) তখন তিনি তাকে রজম না করার আদেশ করলেন।
হযরত উসমান রা. এক মহিলাকে রজম (প্রস্তারাঘাতে হত্যা) করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে ছয়মাসে বাচ্চা প্রসব করেছিল, তখন আলী ইবনে আবি তালেব রা. তাঁকে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী স্মরণ করিয়ে দিলেন :
{وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا.
তাকে গর্ভে ধারণ করতে এবং তার স্তন্য ছাড়াতে লাগে ত্রিশ মাস। (সূরা আহকাফ : ১৫)
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ.
আর যে স্তন্য পানকাল পূর্ণ করতে চায় তার জন্য জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর স্তন্য পান করাবে। (সূরা বাকারা : ২৩৩) অতঃপর তিনি রজমের আদেশ প্রত্যাহার করেন।
কারও গৃহে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণের হাদিসটি হযরত উমর রা.—এর কাছে অস্পষ্ট ছিল। তখন তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন : রাসূল সা.—এর এ নির্দেশও আমার কাছে অস্পষ্ট রয়ে গেল? বাজারে লেনদেন চুক্তি আমাকে উদাসীন করে রেখেছিল।
আনসারি সাহাবিগণসহ উসমান, আলি, তালহা, যুবায়ের ও হাফসা রা.—এর মত শীর্ষস্থানীয় মুহাজির সাহাবিদের কাছে বীর্যপাত ব্যতীত সহবাসেও যে গোসল ফরয হয়, এ মাসআলাটি অজানা ছিল। এমনিভাবে উম্মুল মুমিনিন আয়েশা, উম্মে হাবিবা, ইবনে উমর, আবু হুরায়রা, আবু মূসা, যায়েদ বিন সাবেত রা. এবং সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব র.—সহ মদিনার সকল ফকিহ ও অন্যান্য অঞ্চলের ফকিহগণেরও অজানা ছিল যে, আগুনে পাকানো খাবার খেলে অজু ভেঙ্গে যাওয়ার বিধানটি রহিত হয়ে গেছে।
ইমাম কুরতুবি বর্ণনা করেছেন, ইমাম মুসলিম র. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.—কে মদের একটি পাত্র হাদিয়া দিল, তখন রাসূল সা. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান নাÑ আল্লাহ এটিকে হারাম করেছেন? সে উত্তম দিলÑ না। অতঃপর লোকটি অন্য এক ব্যক্তির সাথে চুপিসারে কিছু একটা বললো। রাসূলুল্লাহ সা. তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চুপিসারে তাকে কি বললে? সে উত্তর দিল, আমি তাকে এটি বিক্রয় করতে আদেশ করেছি। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, যে সত্তা মদ পান করা হারাম করেছেন তিনি এর বিক্রয়কেও হারাম করেছেন। অতঃপর লোকটি পাত্রের মুখ খুলে এর ভিতরে থাকা সমস্ত মদ ফেলে দিল। (আল—জামে লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবি : খ. ৬,পৃ. ২৮৯ )
এ হাদিসে আমরা জানতে পারি, রাসূল সা.—এর নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, ঐ ব্যক্তি হারামকৃত মদ সংগ্রহ করেছেন; কিন্তু নবীজি সা. যখন জানতে পারলেন যে, সে মদ হারাম হওয়ার বিধান সম্পর্কে অবগত নয়, তখন তার ওপর হদ্দ (দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করেননি, তাকে লঘু শাস্তি (তাযির) দেননি এবং তার প্রতি কঠোরতাও করেননি, না তার মদ সংগ্রহে রাখার কারণে, আর না এর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে।
তাবেয়িগণ ও তাদের পরবর্তী ইমামগণ যেমনÑ ইমাম আবু হানিফা, সুফিয়ান ছাওরি, ইবনু আবি লাইলা, ইবনু জুরাইজ, মালেক, ইবনুল মাজিশুন, উসমান আল—বাত্তি, আওযায়ি, লাইস, শাফেয়ি, আহমদ বিন হাম্বল, ইবনু হাযম, ইবনু তাইমিয়া র. প্রমুখ ইমামগণের মধ্যে যে কত শত মাসআলায় মতপার্থক্য হয়েছে তা গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য ছিল, ‘যখন হাদিস বিশুদ্ধ রূপে প্রমাণিত হবে তখন আমার কথাকে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারবে এবং তখন হাদিসই হবে আমার মাযহাব।’ এর মাধ্যমে মূলত তারা পরোক্ষভাবে শরিয়াহর অনেক বিধান সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞতার কথা স্বীকার করেছেন। তাছাড়া তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর দীনের ব্যাপারে ফয়সালা প্রদানের ক্ষেত্রে কম—বেশি ভুলের শিকার হয়েছেন।
বিপজ্জনক অনিবার্য ফলাফল
বাস্তবতা হচ্ছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আদেশ—নিষেধ ও শরিয়াহর বিধিবিধান সম্পর্কে অজ্ঞ তার আকিদা নষ্ট হয়ে সে কাফের হয়ে যাবে এবং তখন সে আর মুসলিম থাকবে না”Ñ একথার অনিবার্য দাবি হলো, নবী কারিম সা.—এর নবুওয়াত লাভের পর থেকে অদ্যাবধি পৃথিবীর বুকে নবীজি সা. ব্যতীত আর কোনো মুসলিম ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। কারণ, কেবল নবীজি সা.—ই একক ব্যক্তি যিনি শরিয়াহর সকল বিষয়ের জ্ঞান রাখেন। আর এতে কোনো সন্দেহও নেই; কিন্তু তিনি ব্যতীত বাকি সবার অবস্থা হলো, শরিয়ার কিছু বিধান সম্পর্কে অনবহিত এবং আল্লাহ তাআলার কিছু আদেশ—নিষেধ তার অজানা।
আর যদি এমনটি বলা হয় যে, মুসলিম হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার কিছু আদেশ—নিষেধ সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, আর বাকি কিছু সম্পর্কে অবহিত না হলেও চলবে এবং শরিয়াহর কিছু বিধান আবশ্যিকরূপে জানতে হবে, বাকিগুলো না জানলেও চলবেÑ তাহলে এটি হবে নিজের পক্ষ থেকে একটি সীমারেখা তৈরির মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত সিদ্ধান্ত প্রদান এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ। তবে ঐ বিষয়গুলো এর ব্যতিক্রম রাসূলুল্লাহ সা.—এর বিশুদ্ধ হাদিসের মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে যে বিষয়গুলোর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমনÑ মুসলিম হওয়ার জন্য অবশ্যই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, রাসূল সা. আনীত যাবতীয় বিষয়ের ওপর ঈমান আনয়ন এবং গায়েবের প্রতি বিশ^াস। কেননা উপরিউক্ত কথার সাক্ষ্যদান আবশ্যিকরূপে সে বিষয়ে জ্ঞান থাকার দাবি করে। আর এ ছাড়া অতিরিক্ত যেসব বিষয় রয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সেসব বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তাহলে তার এ অজ্ঞতার কারণে তাকে অপারগ বিবেচনা করা হবে, তবে এ কারণে সে কাফের, ফাসেক বা পাপাচারী গণ্য হবে না।
আর এ বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি যদি লোকালয় থেকে দূরে পৃথিবীর কোনো প্রান্তসীমায় অবস্থান করে এবং তার কাছে এ কথা ছাড়া আর কোনো সংবাদ না পেঁৗছে যে, আল্লাহ একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যার নাম হলো মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ, যিনি মানুষকে আহ্বান করেছেন, তারা যেন এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি আল্লাহর রাসূল’। অতঃপর সে মুখে এ বিষয়ে ঈমান আনয়ন করে এবং সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়, কিন্তু সে জানে নাÑ কোনো ব্যক্তি রাসূল সা.—কে সত্য বলে বিশ^াস না করলে এবং কালিমার সাক্ষ্যদান না করলে তার বিধান কী? এমনকি এ বিষয়ে তার মধ্যে কোনো চিন্তাও জাগ্রত না হয়। এছাড়া সে আরও জানে নাÑ আল্লাহ তাআলা মানুষের মৃত্যুর পর অচিরেই পরকালে তাদেরকে পুনর্জীবিত করবেন, অথবা অনেক ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন, কিংবা পূর্ববর্তী উম্মতদের মধ্যে অনেক নবী—রাসূল প্রেরণ করেছেন অথবা আসমানি কিতাব নাযিল করেছেন এবং সে জানে নাÑ আল্লাহ বান্দাদের জন্য কিছু বিষয় হালাল ও কিছু বিষয় হারাম করেছেন, অথবা কিছু ফরয বিধান দিয়েছেন কিংবা সীমারেখা এঁকে দিয়েছেনÑ এমন ব্যক্তির ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, এ ব্যক্তি মুমিন ও মুসলিম ছিল, তার মৃত্যু ঈমানের ওপর হয়েছে এবং সে নিশ্চিতরূপে জান্নাতি।
তাছাড়া রাসূল সা.—এর পর পৃথিবীতে আগমনকারী শীর্ষস্থানীয় সাহাবা, মুসলিম ইমাম ও ফকিহগণ, যারা মানুষকে সতর্ককরণ ও ইজতিহাদের জন্য আদিষ্ট ছিলেনÑ তারা সকলেই শরিয়াহর কোনো একটি বিধানের ক্ষেত্রে হলেও ভুল করেছেন। অতএব, একমাত্র রাসূল সা.—ই নিষ্পাপ। তিনি ছাড় আর কেউ নিষ্পাপ নয়।
আর সাধারণ মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তো তাদের তুলনায় অনেক কম। দলিল—প্রমাণ নিয়ে চিন্তা—ভাবনা ও গবেষণার সক্ষমতাও তাদের কম এবং শরিয়াহর বক্তব্য অনুধাবন করে তার থেকে বিধান আহরণের ক্ষেত্রে তারা অতি মাত্রায় ভুলের শিকার হয়; বরং তাদের অধিকাংশই দলিল—প্রমাণ নিয়ে গবেষণা করতে অক্ষম এবং বিধান জানার জন্য দলিল প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ, শরিয়াহর অনেক বিধান সম্পর্কে বিপরীতমুখী বক্তব্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার সামর্থ্যও তাদের নেই। অতএব, আল্লাহর বিধান জানতে ভুল করা অথবা ভুলে আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কাজের কারণের কোনো মুসলিম যদি ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়; যদিও তার নিয়ত বিশুদ্ধ হয় এবং সে আল্লাহর বিধান জানা এবং তার অনুসরণের ইচ্ছা করে তাহলে নিষ্পাপ সত্তা রাসূল সা.—এর পর ভূ—পৃষ্ঠে কোনো মুসলিম পাওয়া যেত না।
সুতরাং যে ব্যক্তি বিভিন্ন বিধানের ভুলের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলবে সে হবে দলিল বিহীন দাবিদার এবং রাসূলুল্লাহ সা.—এর হাদিসের ব্যাপকতাকে সংকীর্ণকারী। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন,
عفي لأمتي عن الخطأ والنسيان وما استكرهوا عليه.
আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি ও তাদের ওপর বলপ্রয়োগকে ক্ষমা করা হয়েছে। (আল—মুহাল্লা বিল আল—আছার : খ. ২, পৃ. ৩৩৪)
অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে, “যদি বিচারক ইজতিহাদ করে ভুল করে তাহলে সে একটি নেকি পাবে, আর যদি ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাহলে সে দুটি নেকি পাবে।” আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ.
এবং এ ব্যাপারে ভুল করলে তোমাদের অপরাধ নেই, কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে অপরাধ হবে। (সূরা আহযাব : ৫)
তবে কিছু বিষয় এর ব্যতিক্রম, যে ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। যেমনÑ কেউ যদি কোনো মুসলিমকে ভুলক্রমে হত্যা করে তাহলে তার ওপর কাফফারা ও দিয়ত ওয়াজিব হবে; কিন্তু তার ঈমান নষ্ট হবে না। অতএব, যে ব্যক্তি শরিয়াহর বক্তব্যকে উপেক্ষা করলো সে নিজে নিজের ওপরই জুলুম করলো এবং আল্লাহর দীনের ব্যাপারে মনগড়া কথা বললো এবং তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আকিদার ক্ষেত্রে ভুল ও অজ্ঞতা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ .
নিশ্চয় তোমাদের নিকট এসেছেন তোমাদের মধ্য হতেই এমন একজন রাসূূল, তোমাদের যে দুঃক—কষ্ট হয়ে থাকে তা তার নিকট বড়ই বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি করুণাশীল ও অতি দয়ালু। (সূরা তাওবা : ১২৮)
একদল আলেমের মতে যে ব্যক্তি আকিদা, ইবাদত অথবা শরিয়াহর বিধান বা ফাতওয়ার ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত নির্ভরযোগ্য ইমামগণের বিরোধিতা করবে সে কাফের হয়ে যাবে। তবে আরেকদল আলেমের মতে যে ব্যক্তি আকিদার ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করবে সে কাফের হয়ে যাবে, আর যদি বিধানগত মাসআলা অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে বিরোধিতা করে তাহলে কাফের বা ফাসেক কোনোটিই হবে না; তবে তাকে অপারগ ইজতিহাদকারী হিসেবে ধরা হবে এবং ভুল করলেও তার নিয়ত ঠিক থাকার কারণে তাকে একটি নেকি প্রদান করা হবে।
আরেক দল আলেমের মতে যদি বিরোধিতা অথবা অজ্ঞতা হয় আল্লাহ তাআলার গুণাবলি সম্পর্কে তাহলে সেই বিরোধিতাকারী কাফের হয়ে যাবে, আর যদি বিরোধিতা হয় এ ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে তাহলে সে ফাসেক হবে।
তবে আরেক দল আলেমের মতে কোনো মুসলিমকে আকিদা, ইবাদত বা বিধানের ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামতের কারণে কিংবা এসব বিষয়ে তার অজ্ঞতার কারণে কাফের বা ফাসেক বলা হবে না। যে ব্যক্তি এসব বিষয়ে ইজতিহাদ করবে এবং যে বিষয়টিকে সে সঠিক বলে মনে করে তাই গ্রহণ করবে তাকে সর্বাবস্থায় নেকি প্রদান করা হবে। যদি সে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে তাহলে দুটি নেকি পাবে, আর যদি ভুল করে তাহলে একটি নেকি পাবে। এটি ইমাম ইবনু আবি লাইলা, আবু হানিফা, শাফেয়ি, সুফিয়ান ছাওরি, দাউদ বিন আলী ও ইবনে হাযম রা. সকলের মত।
সাহাবা রাযিয়াল্লাহু আনহুমদের থেকে এ মাসআলায় যাদের মতামত জানা যায় সকলের বক্তব্যও তাই। অর্থাৎ, তাদের কেউই আলোচ্য মাসআলায় কোনো দ্বিমত করেননি। তবে তাদের মধ্যে কিছু মাসআলায় মতভিন্নতা পাওয়া যায়। যেমনÑ কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃত নামায ছেড়ে দেয়, এমনকি নামাযের ওয়াক্ত শেষ যায় তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে কি না? এমনিভাবে কেউ যদি যাকাত প্রদান না করে, হজ্জ না করে, রোযা ছেড়ে দেয় অথবা তিনবার হদ্দ প্রয়োগের পরও মদ পান করে তাহলে সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে কি না? এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
সঠিক কথা হচ্ছে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যার জন্য একবার ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হয়েছে তার থেকে সেই বন্ধন দূরীভূত হবে না, যদি না তার বিপরীত শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য বা ইজমা পাওয়া যায়, অথবা সে নিজের মুখে ইলামের বিপরীত কোনো কিছুর দাবি করে। এছাড়া শুধু মনগড়া কথা দ্বারা কাউকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেওয়া যাবে না।
অতএব, কোনো ব্যক্তিকে শুধু তার কথার কারণে কাফের আখ্যা দেওয়া যাবে না, যদি না তার কাছে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত হয় যে, তার কথাটি আল্লাহ তাআলার কথার বিপরীত অথবা রাসূল সা.—এর কথার বিপরীত, তা সত্ত্বেও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করাকে বৈধ মনে করছে; এ বিষয়টি দীনের মৌলিক বিধান সংক্রান্ত হোক বা আকিদার ক্ষেত্রে কিংবা ফাতওয়া ও মাসআলার ক্ষেত্রে। এমনিভাবে তার নিকট প্রমাণিত বিষয়টি রাসূল সা.—এর হাদিস হোক যা ইজমা ও তাওয়াতুর এর ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক বর্ণনাকারীর বর্ণনার ভিত্তিতে বর্ণিত হয়েছে। তবে কেউ যদি নিশ্চিত প্রমাণিত ইজমার বিরোধিতা করে তাহলে সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তার দাবি বাতিল বলে গণ্য হবে এবং সে কাফের হয়ে যাবে।
আমাদের এ দাবির প্রমাণ হলো আল্লাহ তাআলার বাণী :
{فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا} [النساء: ৬৫]
কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং তারা সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫ )
পবিত্র কুরআনের এ বাণীর মধ্যে ভিন্ন ব্যাখ্যার কোনো সুযোগ নেই, তাছাড়া এমন কোনো নস (শরিয়ার বক্তব্য) আসেনি যা আয়াতের বাহ্যিক অর্থ পরিবর্তন করে দিবে এবং এমন কোনো দলিলও বর্ণিত হয়নি যা আয়াতে আলোচিত ঈমানের অর্থকে সীমিত করে দিবে।
অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার বিপরীত সিদ্ধান্ত দেওয়াকে বৈধ জ্ঞান করবে পবিত্র আয়াতের সুস্পষ্ট ভাষ্য অনুযায়ী সে ঈমানের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে।
দীনি বিধানের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। যেমনÑ হারাম বা অকাট্যরূপে নিষিদ্ধ, ওয়াজিব বা আবশ্যক, মুবাহ বা সাধারণভাবে বৈধ, মাকরূহ বা অপছন্দনীয়, আর কিছু বিষয় আছে ঐচ্ছিক। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিরোধিতাকে বৈধ মনে করার বিষয়টি আকিদার বিষয়ে হোক, বা ইবাদত সম্পর্কিত বিষয়ে কিংবা অন্যান্য বিধান ও ফাতওয়ার বিষয়ে, সকল ক্ষেত্রে একই বিধান প্রযোজ্য হবে।
তবে কোনো ব্যক্তির বিপক্ষে যদি প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে জানা না যায় যে, তার কাছে সত্য ও সঠিক বার্তা উপস্থিত হয়েছে এবং তার কাছে তার দাবির বিপক্ষে দলিল প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও সে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধিতাকে বৈধ মনে করছে তাহলে সে কাফের হবে না; কিন্তু যদি এমতাবস্থায়ও তাকে কাফের ঘোষণার বিষয়ে শরিয়ার কোনো বক্তব্য (নস) পাওয়া যায় তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। অর্থাৎ, এমতাবস্থায় তার কাফের হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে শরিয়ার বক্তব্য পাওয়া যাওয়ার ওপর। যেমনÑ কোনো ব্যক্তি লোকালয় থেকে দূরে অবস্থান করে এবং তার কাছে নবী সা.—এর আলোচনা পেঁৗছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও সে নবীজি সা.—এর ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান করা ব্যতিরেকে তাঁকে অস্বীকার করে তাহলে কাফের হয়ে যাবে।
অতএব কোনো ব্যক্তি যদি সাক্ষ্য দেয় যে, “আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল” এবং সে বলে, “আমি জানি না, তিনি কি জীবিত না মৃত, তিনি কি আমার সামনে উপস্থিত আছেন, না ভিন্ন কেউ?” এবং সে আরও বলে, আমি জানি নাÑ “তিনি কি কুরাইশি না তামিমি না ফারেসি, তিনি কি হিজাযের ছিলেন না খোরসানের?” এ কথার প্রবক্তা যদি অজ্ঞ হয়, যার সিরাত ও নবী চরিত সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে এতে তার কোনো ক্ষতি হবে না; বরং তখন তাকে এ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করতে বলা হবে। কিন্তু সে যদি জানে এবং তার কাছে এ বিষয়ে সত্য ও সঠিক বার্তা পেঁৗছে, তা সত্ত্বেও সে হঠকারিতা করে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে এবং তার ওপর মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীর বিধান প্রযোজ্য হবে।
কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে উপযুক্ত দলিল ব্যতীত শুধু তার কথার ওপর ভিত্তি করে কাফের সাব্যস্ত করে অথবা তার অজ্ঞতার কারণে কাফের সাব্যস্ত করে এবং তার মাধ্যমে সে রাসূল সা.—এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয় কিংবা রাসূল সা. আনীত দীনের ব্যাপারে তার অন্তরে সংশয় পোষণ করে, তাহলে ঐ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে আমরা বলবো, আপনি আমাদেরকে বলুন, রাসূল সা. কি ইসলামের এমন কোনো বিষয় ছেড়ে দিয়েছেন যা না বললে বা না জানলে ঐ ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে? নিশ্চয় রাসূল সা. তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন এবং সকল মানুষকে এর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, বিষয়টি এমন নয় কি? এর উত্তরে অবশ্যই হাঁ বলতে হবে। কেউ যদি তা অস্বীকার করে তাহলে সে নিদ্বির্ধায় কাফের হয়ে যাবে।
যদি এ বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে আমাদের পরবর্তী কথা হলো, কোনো হাদিসে কি এমন বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সা. কোনো গ্রাম বা মহল্লাবাসী কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি Ñহোক সে স্বাধীন, গোলাম কিংবা নারীÑ এর ইসলামকে গ্রহণ করেননি যতক্ষণ না তাকে কালিমার মর্ম জিজ্ঞেস করেছেন? অথবা “ইলাহ, রব, ইবাদত ও দীন”—এর অর্থ জিজ্ঞেস করেছেন? কিংবা তাওহিদ বা একত্ববাদের অর্থ, শিরকে লিপ্ত হওয়ার উপকরণসমূহ এবং রুবুবিয়্যাতের অর্থ ও তার দাবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন? অথবা এ জাতীয় কোনো প্রশ্ন, যেমনÑ শক্তি ও সামর্থ্য কি কাজের পূর্ব থেকেই বিরাজমান থাকে না কাজে উদ্যোগী হওয়ার সাথে সাথে অর্জিত হয়? কুরআন কি মাখলুক (সৃষ্ট)? আল্লাহ তাআলা দেখেন কি না? তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়, চোখ ও জীবন আছে কি না? কালাম শাস্ত্রবিদদের এ জাতীয় বাহুল্য বিষয়, শয়তান মুসলিমদের মধ্যে বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য যে প্রশ্নগুলোর উদ্রেক ঘটায়।
কেউ যদি দাবি করেÑ রাসূল সা. কাউকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেননি, যতক্ষণ না তাকে এসকল বিষয়ের অর্থ সম্পর্কে অবগত করেছেন, তাহলে সে হবে বিশে^র সকল মুসলিমের ঐক্যমত অনুযায়ী মিথ্যাবাদী এবং এমন কথার প্রবক্তা, যে ব্যাপারে সে নিজেই নিজেকে মিথ্যুক মনে করে। সেই সাথে সে যেন দাবি করছেÑ ‘সকল সাহাবি সম্মিলিতভাবে রাসূল সা.—এর এ কাজটিকে গোপন করেছেন।’ আর তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
কারণ, এটি স্বভাবত অসম্ভব যে, পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে সম্মানিত ও মর্যাদাবান শত শত মানুষ, বরং হাজারো মানুষ একটি মিথ্যা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গোপন করার ওপর একমত হবে এবং পরবর্তীতে তাদের সেই মিথ্যা কখনও প্রকাশিত হবে না এবং সত্য ও সঠিক বিষয়টি কখনও উন্মোচিত হবে না। উপরন্তু এ দাবির মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের দিকে [রাযিয়াল্লাহু আনহুম] কুফরের নিসবত করা হয়। কারণ, তার মানে দাঁড়ায়Ñ তাঁরা এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গোপন করতে একমত হয়েছেন, যা ছাড়া কারও ইসলাম পরিপূর্ণ হয় না।
কেউ যদি বলে, রাসূল সা. এসব বিষয়ের প্রতি সরাসরি দাওয়াত প্রদান করেননি বটে; তবে এ বিষয়গুলো কুরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে প্রচ্ছন্নভাবে গচ্ছিত আছে, তাহলে এর জবাবে তাকে বলা হবেÑ ধরে নিলাম আপনি সত্য বলেছেন, আর তার দাবি হলো, এসকল বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞতা যদি কুফর হতো তাহলে রাসূল সা. স্বাধীন ও ক্রীতদাস নারী—পুরুষের কাছে তা বর্ণনা করা থেকে কখনও বিরত থাকতেন না। তারপরও কেউ যদি এমন কথা বলে তাহলে ধরা হবে, সে যেন বলছেÑ রাসূল সা.—কে যেভাবে দীন প্রচারের আদেশ করা হয়েছিল তিনি সেভাবে দীন প্রচার করেননি এবং তিনি ঐ ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করেছেন যাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা বৈধ নয়। আর যে ব্যক্তি এ কথার অনুমোদন দিবে সে নিরেট কুফরে লিপ্ত হবে।
মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান, অগ্নিপূজারী, মানি ধর্মবিশ^াসী এবং বস্তুবাদীÑ এদের মধ্য হতে যারই নবীজি সা.—এর সিরাত সম্পর্কে ধারণা আছে, সে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ করবে না যে, রাসূলুল্লাহ সা. নবুওয়তপ্রাপ্তির পর থেকে বিরাট সংখ্যক মানুষকে আল্লাহ এবং তার আনীত দীনের প্রতি ঈমান আনয়নের দাওয়াত দিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ঐসকল বিরুদ্ধবাদীদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তাদের রক্ত প্রবাহিত করা, তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করা এবং তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করাকে বৈধ মনে করে। তারা আত্মসমর্পণ করলে নবীজি সা. তাদের থেকে জিযয়া গ্রহণ করেছেন, ঈমান আনলে তার ঈমান গ্রহণ করেছেন। তার জীবন, সম্পদ, সন্তান—সন্তুতি ও পরিবার—পরিজনের নিরাপত্তা দিয়েছেন এবং তাকে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এ শ্রেণির লোকদের মধ্যে বেদুইন, রাখাল, সাধারণ প্রজা, দাস, মরুচারী, হিং¯্র—বর্বর, আফ্রিকান নিগ্রো নারীÑপুরুষ, বন্দী, রোমান ও নিচু প্রকৃতির মানুষও ছিল, আরও ছিল নিরক্ষর ও দুর্বল বোধশক্তি সম্পন্ন লোকজন। তাদের মধ্যে হতে কাউকে অথবা তারা ভিন্ন অন্য কাউকে নবী সা. কখনও এমন বলেননি যে, আমি তোমার ইসলাম গ্রহণ করবো না এবং তোমার দীন বিশুদ্ধ হবে না, যতক্ষণ না তুমি কালিমার সাক্ষ্যদানের অর্থ, রুবুবিয়্যাত, আল্লাহর বিচারক হওয়ার অর্থ, আল্লাহর গুণাবলি, তাঁর নামসমূহ ও কুদরত ইত্যাদির অর্থ জানবে।
আর ইসলামের অনুসারীদের মতে এটা একেবারেই অসম্ভব যে, রাসূল সা. উম্মতের সামনে এমন বিষয় বর্ণনা করতে ভুলে যাবেন যা ছাড়া তাদের ইসলাম বিশুদ্ধ হয় না, অথবা তারা সকলে এমন বিষয় বর্ণনা করতে ভুলে যাবেন কিংবা নবী সা. ইচ্ছাকৃত উম্মতের জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করবেন না। এখন কেউ যদি মনে করেÑ নবী সা.—এর যুগে সকলে শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ কথার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে উল্লেখিত বিষয়সমূহের অর্থ নিশ্চিতরূপে জানতো এবং বুঝতো তাহলে সে হবে একজন মিথ্যা দাবিদার এবং এমন কথার প্রবক্তা যার বিশুদ্ধতার ওপর কোনো দলিল নেই। উপরন্তু তার সেই কথা হবে রাসূল সা. থেকে প্রমাণিত বিশুদ্ধ হাদিসসমূহ ও বাস্তবতা বিরোধী।
কারণ, বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে প্রমাণিতÑ নবীজি সা.—এর জীবদ্দশায় যারা নজ্দ, হিজায ও এর আশপাশে বসবাস করত তারা সবাই খাঁটি আরব ছিল না; বরং তাদের মধ্যে অনেক বহিরাগত আরব, ইথিওপিয়ান, পারসিক ও অন্যান্য জাতি—প্রজাতির লোকদের অবস্থান ছিল। আবার এটাও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত যে, যারা খাঁটি আরব ছিল তাদের মধ্যেও কিছু লোক ‘ইলাহ, রব, ইবাদত ও দীন’ ইত্যাদি শব্দের অর্থ, তাওহিদ বা একত্ববাদের অর্থ সম্পর্কে অনবহিত ছিল। রাসূল সা. এ বিষয়টি জানতেন; এমনকি নবীজির সা.—এর সামনেও এসব বিষয়ের অর্থ অনুধাবনে মানুষের ভুল—ভ্রান্তির ঘটনা ঘটেছে।
একটি স্বীকৃত কথা হলো, যদি কোথাও দশ হাজার মানুষের সমাগম হয় তাহলে দেখা যাবেÑ তাদের সকলের বোধ—জ্ঞান, মেধা, অনুধাবন শক্তি, আয়ত্ত করার ক্ষমতা এবং দৃষ্টির প্রসারতা এক সমান নয়। বরং এর চেয়ে আরও অনেক কম সংখ্যক লোক কোথাও একত্র হলে সেখানেও দেখা যাবেÑ কিছু লোক অতি মেধাবী, কিছু লোক একেবারেই মেধাহীন, আবার অনেকে এতদুভয়ের মাঝামাঝি অবস্থানকারী। কিছু লোকের বোধশক্তি অনেক বেশি, কিছু লোকের অনেক কম, আবার অনেকে এতদুভয়ের মাঝামাঝি অবস্থানকারী। কিছু লোক বিস্তৃত জ্ঞান ও তীক্ষ্ম দূরদৃষ্টির অধিকারী এবং দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, কিছু লোক অজ্ঞ, যাদের আয়ত্ত করার ক্ষমতা একেবারেই কম, আবার কিছু লোক এতদুভয়ের মাঝামাঝি অবস্থানকারী।
এরপরও কেউ যদি এ বিষয়ে একগুঁয়েমি ও হঠকারিতা করে তাহলে আমরা বলবোÑ সে মূলত সকল যুগ ও সকল অঞ্চলের সকল জাতি—গোষ্ঠী ও সমাজের মধ্যে বিরাজমান অনুভূত বাস্তবতার বিরোধিতা করে একটি অনর্থক প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছে।
وليس يصح في الأذهان شيء *** إذا احتاج النهار إلى دليل
দিবস প্রমাণে দলিলের প্রয়োজন হবে যবে
শুদ্ধ হবে না কো কিছু আকলের কাছে তবে।
অতএব আবশ্যিকরূপে প্রমাণিত হলো যে, পূর্বোল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞতা কালিমা পাঠকারীর জন্য ক্ষতিকারক নয় এবং তা ঐ ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করারও প্রতিবন্ধক নয়।
এমন পরিস্থিতিতে আলেম শ্রেণি, যাদেরকে আল্লাহ দীনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা অনুগ্রহ করেছেন এবং তাদের জন্য মানুষকে সতর্ক করা আবশ্যক করেছেনÑ তাদের দায়িত্ব হলো, অজ্ঞ ব্যক্তিকে তার জন্য আবশ্যিক বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষা দান করা, যা তার জন্য অতি প্রয়োজনীয়, যেন সে শিরক ও গোমরাহির অতল গহ্বরে পতিত না হয়। আর যে বিষয়গুলো প্রয়োজন ও আবশ্যিকতার সীমানার মধ্যে পড়ে না তা বাহুল্য কথার অন্তভুর্ক্ত, শয়তার যার উদ্রেক করে, যাতে করে মুমিনদের মধ্যে সে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পারে, তাদের মধ্যে বিচ্ছেদের চিড় ধরিয়ে তাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে পারে। এ ব্যাপারে কথা বলা তখনই আবশ্যক হবে, যখন মানুষ এমন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে লিপ্ত হবে, আর তখনই পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সত্য উপস্থাপন করতে হবে। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেছেন :
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ.
হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। (সূরা মায়িদা : ৮)
অতএব, যে ব্যক্তি তার কাছে সত্য উপাস্থাপন ও উপযুক্ত প্রমাণ প্রদানের পরও এর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হবে সে কাফের হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, রাসূল সা. কখনও এমন কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করেননি। তাছাড়া সে রাসূল সা. কতৃর্ক প্রদত্ত সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি।
তাই আমাদের উচিতÑ আমরা পূর্বে যেসব দলিল উল্লেখ করেছি তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং এর যথাযথ মূল্যায়ন করা। কারণ, সেগুলো হলো রাসূল সা. কতৃর্ক প্রায়োগিক দলিল। আর রাসূল সা.—এর হাদিসের ব্যাপারে কোনো মুসলিম তো নয়ই; বরং অমুসলিমরাও দ্বিমত করে না যে, তা হলো শরিয়াহর বিবরণ ও অবশ্য পালনীয় বিধান। তাছাড়া এ বিষয়টি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের কাছে বর্ণিত হয়েছে, যা তাওয়াতুরের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ইজমার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ প্রকার।
তাছাড়া আমরা রাসূল সা.—এর নবুওয়তপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে তাঁর আনীত দীন ও কাজ সম্পর্কে যে জ্ঞান লাভ করেছি, তা সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম এর মাধ্যমেই পেয়েছি। আর সাহাবায়ে কেরামের বর্ণিত সকল বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকার হলো, যার ওপর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং একটি বিশাল দলের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বর্ণিত হয়েছে।
কারণ, আমাদের কাছে যে কুরআন আছে এবং রাসূল সা.—এর যে সকল হাদিস বর্ণিত হয়েছে, সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যম ছাড়া তার একটি হরফের বিশুদ্ধতার ব্যাপারেও আমরা নিশ্চিত হতে পারবো না। আমরা কেবল ঐ বিষয়কেই নিশ্চিত বলতে পারিÑ যার ওপর সাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমত হয়েছেন এবং বিশাল একটি দল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের কাছে তা বর্ণনা করেছেন।
রাসূল সা.—এর যে হাদিসের ওপর সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ইজমা সংঘটিত হয়েছে এবং একটি বিশাল দল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আমাদের কাছে তা বর্ণনা করেছেনÑ কেউ যদি তাতে সন্দেহ করাকে বৈধ মনে করে তাহলে সে এর মাধ্যমে রাসূল সা.—এর নবুওয়তপ্রাপ্তির বিশুদ্ধতা, তাঁর আনীত পুরো দীন ও কুরআন মাজিদের বিশুদ্ধতার প্রমাণকে বাতিল ঘোষণা করলো; অথচ রাসূল সা. কতৃর্ক উচ্চারিত প্রতিটি হরফ সত্য, যেখানে এর সূচনালগ্ন থেকে কোনো পরিবর্তন—পরিবর্ধন সাধিত হয়নি।
আরেকটি প্রমাণ হলো, রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি জীবনে কখনও ভালো কাজ করেনি। যখন তার মৃত্যু ঘনিয়ে এলো তখন তিনি তার পরিবারকে বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে জ¦ালিয়ে দিবে, অতঃপর আমার ছাইকে এক প্রবল বাতাসের দিনে উড়িয়ে দিবে। অর্ধেক সাগরে আর বাকি অর্ধেক স্থলভাগে। আল্লাহর কসম! যদি আল্লাহ আমাকে ধরতে পারেন তাহলে তিনি আমাকে এমন শাস্তি দিবেন পৃথিবীর কোনো সৃষ্টিকে তিনি এমন শাস্তি দেননি। এরপর আল্লাহ তার ছাইকে একত্র করে পুনর্জীবিত করলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এমনটি কেন করলে? সে উত্তর দিল, হে আমার রব! আপনার ভয়ে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাকে তার এ কথার কারণে ক্ষমা করে দিলেন।
এ হাদিসে আলোচিত ব্যক্তিটি মৃত্যু পর্যন্ত জানত না যে, আল্লাহ তার ছাইসমূহকে একত্র করে তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম; অথচ আল্লাহ তাআলা তাকে তার সরল স্বীকারোক্তি, ভয় ও অজ্ঞতার কারণে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব, নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, এ ব্যক্তি যে আল্লাহর কুদরত ও সুমহান ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞÑ সে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে সে কাফের ও মুশরিক কোনোটিই হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{ إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ } [النساء: ৪৮]
নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না। এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা : ৪৮)
কেউ কেউ এ দলিলে ভিন্ন ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে এর প্রামাণিকতা নষ্ট করতে চেয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো, ‘যদি আল্লাহ আমাকে ধরতে পারেন’ এ কথার অর্থ হলো, যদি আল্লাহ আমার ওপর সংকীর্ণতা আরোপ করেন, যেমন তিনি এক আয়াতে বলেছেনÑ
{وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ} [الفجر: ১৬]
আর যখন তাকে পরীক্ষা করেন তার রিযক সংকুচিত করে দেন। (সূরা ফাজর : ১৬)
এটি একটি ভুল ব্যাখ্যা, যার সমর্থনে কোনো দলিল নেই। কারণ, এ ব্যাখ্যা যদি সঠিক হতো তাহলে ঐ ব্যক্তির তার সন্তানদেরকে তাকে জ¦ালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার আদেশের কোনো অর্থ হতো না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, সে ঐ কাজের আদেশ করেছিল কেবল আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই। কারণ, সে ধারণা করেছিলÑ যদি সে এমনটি করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে একত্র করে পুনর্জীবিত করতে পারবেন না।
তৃতীয় দলিল
এ দলিলটি অধিক স্পষ্ট ও পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ } [المائدة: ১১২]
স্মরণ কর, যখন হাওয়ারিগণ বলেছিল, হে মারইয়াম—তনয় ঈসা! আপনার রব কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম? (সূরা মায়িদা : ১১২)
{وَنَعْلَمَ أَنْ قَدْ صَدَقْتَنَا} [المائدة: ১১৩]
আর আমরা জানবো যে, আপনি আমাদেরকে সত্য বলেছেন। (সূরা মায়িদা : ১১২)
এ হাওয়ারিগণ, আল্লাহ তাআলা যাদের প্রসংসা করেছেনÑ তারা অজ্ঞতা বশত ঈসা আলাইহিস সালামকে বলেছিল, আপনার রব কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম? আর এ কারণে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়নি।
কেউ কেউ এ দলিল থেকে এভাবে নিষ্কৃতি লাভের চেষ্টা করেছে যে, এ আয়াতে ভিন্ন একটি কিরাআত রয়েছে, আর তা হলো,
هَلْ تَستطيعُ ربَّك (আপনি কি আপনার রবকে রাজি করাতে সক্ষম?) অর্থাৎ, আপনি যদি তার কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করেন তাহলে তিনি কি আপনার ডাকে সাড়া দিবেন?
যদি মেনেও নেওয়া হয় যে, এ কিরাআতটি সঠিক, তারপরও আমরা বলবো, ইলমে কিরাআতের একটি আবশ্যকীয় মূলনীতি হলো, যদি একটি আয়াতের একাধিক কিরাআত থাকে তাহলে কর্তব্য হলো, বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত প্রতিটি কিরাআতকে কার্যকর বিবেচনা করা এবং প্রতিটি কিরআতের নির্দেশিত অর্থকে গ্রহণ করা। কারণ, যখন সেই কিরাআতগুলো রাসূল সা. থেকে প্রমাণিত হবে তখন মনে করতে হবে, সবগুলোই পবিত্র কুরআনের অংশ, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি স্বরূপ নাযিল হয়েছে, আর কুরআনের কোনোই অংশ অপর অংশ থেকে অধিক অগ্রগণ্য নয়।
কারণ, পবিত্র কুরআনে এক কিরাআতকে বাদ দিয়ে অন্য কিরাআত গ্রহণের অর্থ হলো, দুই কিরাআতের একটিকে বাতিল বলে বিবেচনা করা, আর তার মাধ্যমে কুরআনের কতক অংশকে বাতিল করা গণ্য করা হয়। যেহেতু উপরোল্লেখিত দুই কিরাআতের একটি সর্বসম্মতিক্রমে সঠিক এবং মানুষের হাতে হাতে প্রচলিত পবিত্র কুরআনের কপিগুলোতে এমনটিই লিখিত আছে, কাজেই এটিকেই গ্রহণ করতে হবে এবং তার অর্থের নির্দেশনাকে বিবেচনা করতে হবে।
কারও কারও মতে আয়াতে বর্ণিত প্রশ্নটি হাওয়ারিগণের পক্ষ থেকে ছিল না; বরং তাদের সাথে থাকা অন্যান্য লোকদের পক্ষ থেকে ছিল। তাদের এ দাবি খণ্ডনের জন্য এ কথাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা পবিত্র আয়াতে স্পষ্ট বলেছেন, প্রশ্নটি স্বয়ং হাওয়ারিগণের পক্ষ থেকেই ছিল : إِذْ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ (স্মরণ কর, যখন হাওয়ারিগণ বলেছিল)।
চতুর্থ দলিল
ইমাম বুখারি রহিমাহুল্লাহ আনাস বিন মালেক রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন রুবাইয়ি রা. [আনাস বিন মালেকের ফুফু] এক আনসারি মেয়ের মুখের সম্মুখ ভাগের দাঁত ভেঙে ফেলে। তখন তার কওম রাসূল সা.—এর নিকট এসে কিসাস (সমপরিমাণ বদলা) দাবি করে এবং নবীজি সা. কিসাসের ফয়সালা প্রদান করেন। তখন আনাস বিন নযর [আনাস বিন মালেকের চাচা] বলেন, না! হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর শপথ, তার দাঁত ভাঙা হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, হে আনাস! কিতাবুল্লাহ কিসাসের বিধান দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে বাদীর কওম আর্থিক জরিমানা (দিয়ত) গ্রহণে সম্মত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন,
إِنَّ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ مَنْ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لَأَبَرَّهُ.
আল্লাহর কিছু বান্দা এমন আছে, তারা যদি আল্লাহর নামে কসম করে কিছু বলে তাহলে আল্লাহ সেই কসম পূরণের ব্যবস্থা করে দেন। (সহিহ বুখারি : ২৭০৩)
পঞ্চম দলিল
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَاوَزْنَا بِبَنِي إِسْرَائِيلَ الْبَحْرَ فَأَتَوْا عَلَى قَوْمٍ يَعْكُفُونَ عَلَى أَصْنَامٍ لَهُمْ قَالُوا يَا مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ.
আর আমি বনি ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে দিয়েছি, অতঃপর তারা প্রতিমা পূজায় রত এক জাতির নিকট উপস্থিত হয়। তারা বললো, হে মূসা! তাদের দেবতার ন্যায় আমাদের জন্যও একটি দেবতার ব্যবস্থা করুন। (সূরা আরাফ : ১৩৮)
উক্ত আয়াতে মূসা আ.—এর কওম আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম্য এবং তিনি যে তুলনা ও শরিক হতে পবিত্রÑ এ বিষয়ে অজ্ঞ ছিল। আমরা কিন্তু আমাদের অজ্ঞতার কারণে এমনটি বলি না। তাদের এ কথার জবাবে মূসা আ. বলেছিলেন, إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ : নিশ্চয় তোমরা তো অজ্ঞ সম্প্রদায়। (সূরা আরাফ : ১৩৮)
ষষ্ঠ দলিল
ইতঃপূর্বে আমি ইমাম শাতেবি র. থেকে একটি হাদিস বর্ণনা করেছি, যা ইমাম ইবনু হাযম, কুরতুবি ও ইবনু কাসিরও বর্ণনা করেছেন যে, আরবের কিছু অজ্ঞ লোক রাসূল সা.—কে বললো, আমাদের জন্য যাতু আনওয়াতের ব্যবস্থা করুন, যেমন তাদের যাতু আনওয়াত রয়েছে। তখন রাসূল সা. তাদেরকে বললেন, ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কথা তো মূসা আ.—এর কথার মতই, যারা বলেছিল, আমাদের জন্য দেবতার ব্যবস্থার করুন, যেমন তাদের দেবতা রয়েছে। তখন মূসা আ. তাদেরকে বলেছিলেন, নিশ্চয় তোমরা অজ্ঞ সম্প্রদায়। এটি হলো পূর্ববর্তীদের রীতি। নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতির অনুসরণ করবে। (জাওয়ামিউস সিরাহ, ইবনু হাযম : পৃ. ২৩৮)
উক্ত দলিল এ ধারণাকে খণ্ডন করে দেয় যে, রাসূল সা. যেসকল লোকের ঈমান গ্রহণ করেছেন তাদের প্রত্যেকে উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত ও তাওহিদের সকল অর্থ সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখতেন। আর পূর্বের ন্যায় এ দলিলও প্রমাণ করে যে, অজ্ঞ ব্যক্তি তার ওপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ বিবেচিত হবে।
সপ্তম দলিল
ইমাম আহমদ ও তাবারি র. আবু মূসা আশআরি রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করলেন। সেই খুতবায় তিনি বলেন, হে মানুষ সকল! তোমরা এ শিরক থেকে সতর্কতার সাথে বেঁচে থাক। কারণ, তা পিঁপড়ার পদচারণা চেয়েও অধিক গোপন। তখন আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় উপস্থিত এক ব্যক্তি বললো, আমরা কিভাবে শিরক থেকে বেঁচে থাকবো, যখন তা পিঁপড়ার পদচারণা থেকেও অধিক গোপন? তখন নবীজি সা. বললেন, তোমরা বল,
ماللهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ.
হে আল্লাহ! আমরা আপনার সাথে এমন বিষয় শরিক করা থেকে আপনার আশ্রয় কামনা করছি যা আমরা জানি এবং আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এমন অপরাধ থেকে যা আমাদের জানা নেই।
উক্ত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, শিরক হলো দুই প্রকার : এক প্রকার হলো, প্রকাশ্য যা আমাদের সকলের জানা আছে। দ্বিতীয় প্রকার হলো, যা আমাদের থেকে প্রচ্ছন্ন। অতঃপর নবী সা. আমাদেরকে আদেশ করেছেন, আমরা যেন আল্লাহর কাছে অজ্ঞতা বশত শিরকে পতিত হওয়া থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করি। অর্থাৎ, যে কাজকে আমরা শিরক হিসেবে জানি না। আমরা নিশ্চিতরূপে বিশ^াস করি, রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে এমন অপরাধ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আদেশ করবেন, যে ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করার অনুমোদন দিয়েছেন। অতএব, এ কথা প্রমাণিত হলো যে, মানুষ যে শিরক সম্পর্কে অজ্ঞ নিম্নোক্ত আয়াতে তা উদ্দেশ্য নয় :
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ.
নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শরিক করাকে ক্ষমা করবেন না, এটা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। (সূরা নিসা : ৪৮)
অর্থাৎ, যে শিরকে লিপ্ত ব্যক্তিকে শরিয়াহর দৃষ্টিতে মুশরিক আখ্যা দেওয়া হয়, হাদিস শরিফে তা উদ্দেশ্য নয়। আরও প্রমাণিত হলো যে, অজ্ঞ ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ বিবেচিত হবে। কারণ, উম্মতের ইমামগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, যেকোনো প্রকারের শিরক যদি ব্যক্তির সামনে প্রকাশ পায় এবং সে তা জানতে পারে, তার কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট না হয়, বরং সে তা ভালো করে বুঝতে পারে, এরপরও সে জেনেশুনে উক্ত শিরকে লিপ্ত হয় তাহলে সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে এবং তার ওপর মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীর বিধান প্রযোজ্য হবে।
অষ্টম দলিল
ইমাম শাফেয়ি র. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কৃর্তক এক ব্যক্তির ঈমান পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা ইমাম মালেক র.—ও মুআত্তায় এবং ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ি প্রমুখ বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি হলো,
মুআবিয়া ইবনুল হাকাম রা. বলেন, একদিন আমি একটি দাসী নিয়ে রাসূল সা.—এর নিকট এলাম এবং বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ওপর একটি ক্রীতদাস মুক্ত করার দায় রয়েছে। এর জন্য আমি কি তাকে মুক্ত করতে পারবো? তখন রাসূল সা. দাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে উত্তর দিল, আকাশে। রাসূল সা. আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি কে? সে বললো, আপনি আল্লাহর রাসূল। অতঃপর রাসূল সা. বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও। (আর—রিসালা, ইমাম শাফেয়ি : পৃ. ৭৫)
নবম দলিল
এটি একটি নিশ্চিত দলিল, যাতে কোনো দ্বিমত নেই। আর তা হলো, উম্মতের সকলে এ বিষয়ে একমত যে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃত কুরআন মাজিদের একটি আয়াত পরিবর্তন করে, অথচ সে জানে যে, কুরআন মাজিদে এর বিপরীত রয়েছে, অথবা আয়াত থেকে কোনো শব্দকে বাদ দিয়ে দেয়, কিংবা ইচ্ছাকৃত একটি শব্দ বাড়িয়ে দেয় তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে সে কাফের হয়ে যাবে।
কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি তিলাওয়াতে ভুল করে একটি শব্দ বাড়িয়ে দেয় অথবা কমিয়ে দেয় কিংবা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর কালামে কোনো পরিবর্তন করে, অথচ তার ধারণাÑ সে সঠিক পড়ছে, অতঃপর যখন কেউ এসে তার ভুল ধরলো, সে না জেনে তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো, এর দ্বারা সে উম্মতের কারও নিকট কাফের, ফাসেক বা গোনাহগার হবে না। অতঃপর যদি সে কুরআন মাজিদ দেখে তার ভুল বুঝতে পারে অথবা কোনো নির্ভরযোগ্য ক্বারি তাকে সঠিক বিষয়টি বাতলে দেন, তা সত্ত্বেও যদি সে তার ভুলের ওপর অটল থাকে তাহলে সে এর দ্বারা আল্লাহর নিকট অবশ্যই কাফের হিসেবে গণ্য হবে। দীনের সকল বিষয়ে এ বিধান প্রযোজ্য।
একদল লোক দাবি করেন, যে ব্যক্তি তাদের আকিদার বিরোধিতা করবে সেই কাফের হয়ে যাবে এবং এ দাবির স্বপক্ষে তারা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন, রাসূল সা. বলেছেন, “কাদরিয়্যা, মুরজিয়্যারা এ উম্মতের মূর্তিপূজক।” অপর এক হাদিসে এসেছে, “এ উম্মত সত্তোরের অধিক দলে বিভক্ত হবে। সকল দল জাহান্নামে যাবে; একটি দল ব্যতীত, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এর জবাবে আমরা বলবো, এ দুটি হাদিস সনদের বিচারে সহিহ নয়। আর যে হাদিসের অবস্থা এমন, তা দলিল হতে পারে না।
যারা বলেন যে, কোনো ব্যক্তি তাদের আকিদার বিরোধী হলে বা আকিদা সম্পর্কে অজ্ঞ হলে তাকে কাফের বলা হবেÑ তাদের আরেকটি দলিল হলো আল্লাহ তাআলার বাণী :
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا.
বলুন, আমি কি তোমাদেরকে ঐ সকল লোকদের সংবাদ দিব, যারা তাদের কর্মে ক্ষতিগ্রস্ত? পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পণ্ড হয়েছে; যদিও তারা মনে করেÑ তারা সৎকর্ম করছে। (সূরা কাহফ : ১০৩—১০৪)
আমরা বলবো, এ আয়াতের শেষাংশই তাদের দলিলকে খণ্ডন করে। কারণ, আল্লাহ তাআলা এর পরই বলেছেন,
{أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِآيَاتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَزْنًا (১০৫) ذَلِكَ جَزَاؤُهُمْ جَهَنَّمُ بِمَا كَفَرُوا وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَرُسُلِي هُزُوًا } [الكهف: ১০৫، ১০৬]
তারা ঐ সকল লোক যারা তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি ও তাঁর সাথে তাদের সাক্ষাতের বিষয়কে অস্বীকার করে, ফলে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়; সুতরাং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য ওজনের কোনো ব্যবস্থা রাখবো না। জাহান্নামই তাদের প্রতিফল। কারণ, তারা কুফুরি করেছে এবং আমার নির্দশনাবলি ও রাসূলগণকে নিয়ে বিদ্রƒপ করেছে। (সূরা কাহ্ফ : ১০৫—১০৬) এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, আয়াতের শুরু অংশ কাফেরদের সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যারা সামগ্রিকভাবে দীন ইসলামের বিরোধিতায় লিপ্ত।
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, যদি আপনারা মুজতাহিদগণকে তাদের ভুল করা সত্ত্বেও এবং অজ্ঞদেরকে তাদের অজ্ঞতা সত্ত্বেও অপারগ গণ্য করেন তাহলে ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অন্য সকল ধর্মের অনুসারীদেরকেও অপারগ গণ্য করুন; কারণ, তারাও তো ইজতিহাদ করে এবং কল্যাণ কামনা করে।
এর জবাবে আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, আসলে আমরা আমাদের নিজস্ব মতামত অনুযায়ী কাউকে অপারগ গণ্য করি না, যেমনটি আমরা কারও প্রতি নিজেদের ধারণা ও খেয়াল খুশি অনুযায়ী কুফরের বিধান আরোপ করি না। বরং আল্লাহ তাআলা যাকে অপারগ গণ্য করেছেন, যার উজর গ্রহণ করেছেন, যার অজ্ঞতা ও ভুল ক্ষমা করেছেন, যার ইজতিহাদের কারণে সওয়াব দান করেছেন; যদিও সে ভুল করে, আল্লাহ তাআলা যার প্রতি ইসলাম ও ঈমানের বিধান আরোপ করেছেন; যদিও সে অজ্ঞ হয় বা ভুল করে, আমরাও তার প্রতি ইসলাম ও ঈমানের বিধান আরোপ করবো এবং আমরা তার ব্যাপারে আল্লাহর বিধান কার্যকর হওয়ার কথাই বলবো।
বিপরীতে যাকে তার রব অপারগ গণ্য করেননি; বরং আল্লাহ তাআলা বিধান দিয়েছেন যে, তার প্রতি দলিল চূড়ান্ত হয়েছে, যাতে উজর—আপত্তি, অজ্ঞতা বা ভুলের কোনো অবকাশ নেই এবং আল্লাহ তাআলা যার প্রতি ফয়সালা করেছেন যে, সে কাফের ও মুশরিকÑ আমরাও তাকে কাফের ও মুশরিক গণ্য করবো এবং তার ওপর আল্লাহর বিধান কার্যকর হওয়ার কথাই বলবো। কারণ, কোনো ব্যক্তি কাউকে জান্নাতে বা জাহান্নামে প্রবেশ করাতে পারবে না; বরং আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা জান্নাতে বা জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।
এ বিষয়ে পৃথিবীর কেউ দ্বিমত করবে না, আমরা বলবো না যে, শুধু মুসলিমরা করবে না, বরং সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্য হতে কেউই দ্বিমত করবে না যে, রাসূল সা. ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্মের অনুসারীদের নিশ্চিতরূপে কাফের আখ্যা দিয়েছেন। অতএব, মুসলিম কেবল তারাই যারা ইসলামের অনুসরণ করবে এবং রাসূল সা. আনীত দীন ব্যতীত অন্য সকল দীন থেকে পবিত্রতা ঘোষণা করবে। আমরা নবী সা.—এর এ সিদ্ধান্তের ওপরই থেমে যাবো, এ কথাই বলবো এবং এ বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করবো।
যেকোনো দুইজন ব্যক্তিও এ বিষয়ে দ্বিমত করবে না যে, রাসূল সা. ঐ ব্যক্তিকে নিশ্চিতরূপে মুমিন হিসেবে গণ্য করেছেন যে তাঁর অনুসরণ করবে, তাঁর আনীত দীনকে সত্য বলে স্বীকার করবে এবং অন্য সকল দীন থেকে পবিত্রতা ঘোষণা করবে। আমরাও এখানেই থেমে যাবো এবং এর চেয়ে বেশি কিছু বলবো না।
সুতরাং যাকে মুসলিম হওয়ার পরও ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারে কোনো নস (শরিয়ার বক্তব্য) বর্ণিত হয়েছে আমরা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দিব, তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়ার ওপর উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক। এমনিভাবে যার ইসলাম থেকে বহিষ্কার হওয়ার ওপর উম্মাহর মধ্যে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই ইজমার অনুসরণ করাটাও ওয়াজিব।
কিন্তু যার ওপর ইসলামের নাম লাগার পর তার ইসলাম থেকে বহিষ্কার হওয়ার ওপর কোন নস বর্ণিত হয়নি এবং ইজমাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি তার নিশ্চিতরূপে মুসলিম হওয়ার পর উপযুক্ত দলিল ব্যতীত শুধু ধারণা বা দাবির কারণে ইসলাম থেকে বের করে দেওয়া জায়েয হবে না।
এ যাবৎ আমরা যে আলোচনা করেছি, তার সারকথা হিসেবে আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো,
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا .
আর আমি রাসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেই না। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১৫)
لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ.
যাতে আমি এর দ্বারা সতর্ক করি তোমাদেরকে এবং যাদের নিকট তা পেঁীছবে। (সূরা আনআম : ১৯)
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্মাদের বিচার ভার তোমার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমাদের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫)
পবিত্র কুরআনের এসকল আয়াত আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনাকে সমর্থন করে। অতএব, প্রমাণিত হলো, যার কাছে নবী সা.—এর বার্তা পৌঁছা সত্ত্বেও সে তাঁর প্রতি ঈমান আনল না, সে কাফের।
যদি সে ঈমান আনে, এরপর সে দীনের আকিদা ও ফাতওয়ার ব্যাপারে যেমনটি ইচ্ছা বিশ^াস পোষণ করে অথবা তার ইচ্ছামাফিক কাজ করে; কিন্তু তার কাছে তার বিশ^াস ও কাজের বিপরীত নবী সা.—এর কোনো বার্তা বা আদেশ না পৌঁছে তাহলে এ বার্তা বা আদেশ পৌঁাছার আগ পর্যন্ত তার ওপর কোনো দায় নেই। কিন্তু যদি তার কাছে নবী সা.—এর বার্তা ও আদেশ পৌঁছে এবং তার নিকট বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত হয়ও বটে, এরপর সে ইজতিহাদ করে তার বিরোধিতা করে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত তার সামনে সঠিক দিকটি উন্মোচিত না হবে সে অপারগ ভুলকারী হিসেবে গণ্য হবে এবং এ ইজতিহাদের কারণে সে একটি নেকি পাবে। কারণ, নবী সা. বলেছেন,
إذا اجتهد الحاكم فأخطأ فله أجر وإن أصاب فله أجران.
যদি বিচারক ইজতিহাদ করে (সিদ্ধান্ত প্রদানে) ভুল করে তাহলে সে একটি নেকি পায়। আর যদি ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করে তাহলে সে দুটি নেকি পায়। (আল—ইহকাম ফি উসূলিল আহকাম : খ. ৮, পৃ. ১৩৭) প্রত্যেক আকিদা পোষণকারী, প্রবক্তা বা আমলকারী এক্ষেত্রে হাকিম (বিচারক) হিসেবে গণ্য হবে।
যদি সে হকের বিরোধী কাজ করে; কিন্তু তার কাজের প্রতি সে বিশ^াস না করে তাহলে সে ফাসিক মুমিন; কিন্তু যদি সে মুখে বা অন্তরে হকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে। কারণ, সে রাসূল সা.—কে বিচারক হিসেবে মেনে নেয়নি এবং তাঁর সিদ্ধান্তকেও সমর্থন করেনি। আকিদা, বিধি—বিধান, ইবাদত ও ফাতওয়াÑ সকল ক্ষেত্রে একই বিধান প্রযোজ্য।
এ পরিচ্ছেদের শেষে আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, যে ব্যক্তি কিতাবুল্লাহর এসকল সুষ্পষ্ট আয়াত এবং রাসূল সা.—এর সহিহ হাদিস সম্পর্কে অবগত হবে এবং তার সামনে সত্য স্পষ্ট হবে, অতঃপর সে রাসূল সা.—এর এ হাদিসও জানবে, “যে ব্যক্তি তার ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, হে কাফের! তাহলে তাদের দুইজনের কোনো একজন কুফর সাথে করে প্রত্যাবর্তন করবে।” এবং সে আল্লাহ তাআলার এ বাণীও স্মরণ করবেÑ
[وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ ]
যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। (সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৬)
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا.
আর সত্যের মোকাবেলায় ধারণার কোনো মূল্য নেই। (সূরা নাজম : ২৮)
সে আরও জানবে রাসূল সা.—এর বাণী : إياكم والظن، فإن الظن أكذب الحديث : “তোমরা ধারণা থেকে বিরত থাক। কারণ, ধারণা হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা।” তাহলে সেই ব্যক্তি অন্যের ব্যাপারে শরিয়াহর অকাট্য ও নিশ্চিত দলিল ব্যতীত [যেখানে সন্দেহ ও ধারণার কোনো অবকাশ নেই] সবচেয়ে ঘৃণ্য, জঘন্য ও কদর্যপূর্ণ অভিযোগ তথা কুফর ও শিরকের অপবাদ আরোপ করা থেকে নিজের ভাষাকে সংযত রাখবে। কিংবা সে ধারণার বশবর্তী হয়ে অন্যের ব্যাপারে কুফরের ফয়সালা করবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি ইসলামের বিধান আরোপের আদেশ করেছেন।
ইবনু হাযম ‘জাওয়ামিউস সিরাহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন আব্বাস রা. আবু সুফিয়ানকে নিয়ে রাসূল সা.—এর নিকট এলেন। তখন রাসূল সা. আবু সুফিয়ানকে বললেন, এখনও কি তোমার সময় হয়নি? তুমি কি বিশ^াস কর না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই? আবু সুফিয়ান বললো, আপনার প্রতি আমার পিতা—মাতা উৎসর্গ হোক, আপনি কতইনা সহনশীল, দয়ালু ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী! আমি বিশ^াস করেছি, যদি আল্লাহর সাথে আরও কোনো ইলাহ থাকতো তাহলে আজ তারা আমার কোনো উপকার করতো। অতঃপর রাসূল সা. তাকে বললেন, দুর্ভোগ তোমার জন্য হে আবু সুফিয়ান! এখনও কি তোমার এ কথা বিশ^াস করার সময় হয়নি যে, আমি আল্লাহর রাসূল? আবু সুফিয়ান বললো, আপনার প্রতি আমার পিতা—মাতা উৎসর্গ হোক, আপনি কতইনা সহনশীল, দয়ালু ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী! তবে এ বিষয়টাতে আমার অন্তরে এখনও কিছু খটকা রয়েছে। তখন আব্বাস রা. তাকে বললেন, দুর্ভোগ তোমার! তোমার গর্দান কাটা যাওয়ার পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ কর। ফলে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর আব্বাস রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আবু সুফিয়ান গৌরব পছন্দ করে, কাজেই তাকে কিছু বিশেষত্ব প্রদান করুন। তখন রাসূল সা. বললেন, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ, সে নিজ ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখবে সে নিরাপদ, যে মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ। (জাওয়ামিউ সিরাহ : পৃ. ২২৯)
এটিই হচ্ছে বাহ্যত ইসলামের বিধান, রাসূলুল্লাহ সা. যার ফয়সালার করেছেন।
এখন আমরা ঐসকল লোকের উদ্দেশ্যে বলবো যারা বলে, বায়আত প্রদান করা ও জামাআতকে আকড়ে ধরা ঈমানের জন্য শর্ত :
যে কেউ কালিমার সাক্ষ্য প্রদান করবে সে মুসলিম; যদিও বায়আত প্রদান করা এবং জামাআতকে আকড়ে থাকার আবশ্যিকতা সম্পর্কে সে অজ্ঞ হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কাছে এ বিষয়ক বার্তা পেঁৗছে এবং এর সমর্থনে উপযুক্ত দলিল প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর যদি সে বায়আত, জামাআত ও সঠিক ইমামতের অর্থ সম্পর্কে অন্যদের থেকে ভিন্ন মত পোষণ করে এবং এক্ষেত্রে সে নিজ সামর্থ্যানুযায়ী ইজতিহাদ করে কিংবা ইলম ও তাকওয়ায় নির্ভরযোগ্য ফকিহগণের মতামতের অনুসরণ করে, [যেহেতু এ বিষয়ে তাদের মধ্যেও অনেক মাযহাব ও মতভিন্নতা রয়েছে] এমতাবস্থায় যদিও সে ভুল করে এবং আমরা তার ব্যাপারে ভুলের বিশ^াস করি, তা সত্ত্বেও সে অপারগ বিবেচিত হবে। তার নিয়তের কারণে সে নেকি পাবে এবং তার প্রতি ঈমান ও ইসলামের বিধান আরোপ করা হবে।
আমরা জানিÑ রাসূল সা.—এর ওফাতের পর মুসলিমরা আবু বকর সিদ্দিক রা.—এর বায়আতের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেন। তবে দুজন ব্যক্তি ছিলেন এর ব্যতিক্রম। একজন যুবায়ের ইবনুল আওয়াম, অপরজন আলী ইবনে আবু তালেব রা.। যুবায়ের ইবনুল আওয়াম রা.—এর সামনে সত্য প্রকাশিত হলে তিনি দ্রুতই ফিরে এসে বায়আত প্রদান করেন। আর আলী রা. ছয় মাস অপেক্ষা করেন। অতঃপর তার সামনে সত্য উন্মোচিত হলে তিনিও ফিরে এসে বায়আত প্রদান করেন। এ ছয় মাসের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন। অর্থাৎ, তখন তার ওপর নজরদারি ও মানুষের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে কোনো বিধি—নিষেধ ছিল না। সেসময় কেউ এমনটি ধারণা করেনি যে, তিনি কাফের হয়ে গেছেন। এমনকি কেউ তাঁর ইসলামের ব্যাপারে কোনো সন্দেহও পোষণ করেননি।
আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে সত্যকে সত্যরূপে দেখান এবং আমাদেরকে তার অনুসরণের তাওফিক দান করেন, এমনিভাবে বাতিলকে বাতিলরূপে দেখান এবং আমাদেরকে তার থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পূর্ববর্তী মূলনীতিসমূহ প্রত্যাখ্যানকারীর খণ্ডন
আমরা ইতঃপূর্বে যে সামগ্রিক মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা করেছি, কেউ কেউ সেগুলোকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হলো,
(এক) কখনও কখনও এমনও হয় যে, এক ব্যক্তি মুশরিক ও চিরস্থায়ী জাহান্নামিদের অন্তভুর্ক্ত, আমাদেরকে যাদের সাথে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলা যাদের জীবন ও সম্পদকে আমাদের জন্য বৈধ করেছেন; অথচ সে জানে না যে, সে মুশরিক। আর তার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, যে মুসলিম কালিমার সাক্ষ্যদান করে সেও কখনও কোনো প্রকার শিরকি কাজে লিপ্ত হলে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে; যদিও সে নিজের কুফর ও শিরক সম্পর্কে জানে না, তার অন্তরে কুফরির ইচ্ছা থাকে না, অথবা এ ব্যাপারে অজ্ঞ হয় কিংবা ভুল ব্যাখ্যাকারী হয়।
এ দাবির সমর্থনে তাদের দলিল হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ.
মুশরিকদের মধ্য হতে কেউ আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আপনি তাকে আশ্রয় দিবেন, যাতে করে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়, অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পেঁৗছিয়ে দিবেন; আর তা এ কারণে যে, তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়। (সূরা তাওবা : ৬)
তারা বলতে চায়, [ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ] এর অর্থ হলো, তারা জানেই না যে, তারা মুশরিক।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, যারা এ মতের প্রবক্তা তারা তাদের অভিনব দাবি শুরুই করেছিল এ বলে যে,
“কুরআনে কারিম নাযিল হয়েছে আরবে, আরবি ভাষাভাষীদের ওপর, যাদের প্রত্যেকেই ইলাহ ও রব এ দুটি শব্দের অর্থ ও উদ্দেশ্য ভালো করে জানতো। এ কারণে যখন তাদেরকে বলা হতো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি ছাড়া কোনো রব নেই, তার উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) ও রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) এর ক্ষেত্রে কোনো শরিক নেই, তখন তারা এ আহ্বানের আদ্যোপান্ত অনুধাবন করতে পারতো। এ কথায় তাদের মধ্যে কোনোরূপ সংশয় ও অস্পষ্টতা থাকতো না যে, বক্তা তাদেরকে কি বুঝাতে চেয়েছে? কোনো বিষয়কে নাকচ করেছে? তারা বুঝতে পারতোÑ আল্লাহ তাআলার বৈশিষ্ট্যাবলি কেবলই তাঁর সাথে নির্দিষ্ট। তিনি ব্যতীত আর কারও সাথে সেগুলো যুক্ত হতে পারে না। তখন তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার সমীপে আত্মসমর্পণ করতো। আর যারা কুফরি করতো তারা ইলাহ ও রব—এর অর্থ ভালো করে বুঝে শুনেই কুফরি করতো এবং গায়রুল্লাহর জন্য উলুহিয়্যাত (উপাস্যত্ব) ও রুবুবিয়্যাত (প্রভুত্ব) সাব্যস্ত করতো।”
কিন্তু পরক্ষণেই তারা তাদের এ কথা ভুলে যায় এবং দাবি করে যে, আরবরা শিরকের সেই নির্দিষ্ট অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল, যাতে কোনো দ্বিমত নেই এবং আরও ভুলে যায়, রাসূল সা. নেতৃত্ব, রাজত্ব বা ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে কারও সাথে যুদ্ধ করতেন না। তাঁর মধ্যে এবং অন্যদের মধ্যে যুদ্ধ কেবল এ জন্যই সংঘটিত হয়েছিল যে, তিনি তাদের থেকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর সাক্ষ্যদান কামনা করেছিলেন; কিন্তু তারা তা স্বীকার করেনি; বরং উল্টো বলেছে :
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ.
সে কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। (সূরা সা—দ : ৫)
এরপর আসে ঐ ব্যক্তির কথা যে বলে, “যারা হুবাল, লাত, উয্যা ও মানাতকে সিজদা করতো, যারা বলতোÑ উযাইর আ. আল্লাহর পুত্র, ঈসা আ. আল্লাহর পুত্র এবং মুহাম্মাদ সা.—এর সাথে যুদ্ধ করতো তারা কেবল এ জন্য এসব করতো যে, তিনি ঐসকল দেবতাকে উপাস্য হিসেবে মানতে অস্বীকার করেছিলেন” এমন ব্যক্তিও কি জানতো না যে, সে বিশ^জগতের বাদশাহর সাথে শির্ক করছে এবং তাঁর সাথে কোনো শরিক ও ইলাহ নেই!!
আর আল্লাহ তাআলা বাণী : [ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ ] “আর তা এ কারণে যে, তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়।” উক্ত আয়াতের এ অর্থ করা যে, Ñতারা জানতোই না যে, তারা মুশরিকÑ এটি আয়াতে মধ্যে একটি বাড়তি সংযোজন।
তারা জানতো না, এ কথা সত্য। মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেন। আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম্য, মহিমা এবং শরিক ও তুলনা থেকে যে আল্লাহ তাআলাকে পবিত্র মনে করতে হবে, এ বিষয়গুলো তারা জানতো না।
আর এ মুশরিক যোদ্ধাদের মধ্য থেকে যে নিরাপত্তা কামনা করে, যাতে করে সে ইসলামের দাওয়াতের লক্ষ্য—উদ্দেশ্য ও রাসূল সা. আনীত দীন সম্পর্কে জানতে পারে, বাহ্যত ঐ ব্যক্তি অজ্ঞ, সে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষী ও অহংকারী নয়। এমন ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে জানার ও বোঝার দাবি রাখে। তার প্রতি প্রমাণ পূর্ণ করতে হবে এবং দীনের বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দিতে হবে, যাতে করে সে তার অজনা বিষয়টি জেনে নিতে পারে।
ইবনু কাসির র. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূল সা.—কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, “যদি মুশরিকদের মধ্যে হতে কেউ”, অর্থাৎ যাদের সাথে যুদ্ধ করতে আমি আপনাকে আদেশ করেছি, ফলে আমি আপনার জন্য তাদের জীবন ও সম্পদকে বৈধ করেছি, “আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে” অর্থাৎ নিরাপত্তা কামনা করে তাহলে আপনি তাকে নিরাপত্তা দান করুন। “যাতে করে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়” অর্থাৎ, পবিত্র কুরআন শুনতে পায়। অতএব, আপনি তার কাছে কুরআন পাঠ করুন এবং তার কাছে দীন সম্পর্কে আলোচনা করুন, যেন তার কাছে আল্লাহর প্রমাণ পূর্ণ হয়। “অতঃপর তাকে তার নিরাপদ স্থানে পেঁৗছিয়ে দিন” অর্থাৎ, সে নিরাপত্তা লাভ করবে এবং নিজ দেশ ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার নিরাপত্তা বহাল থাকবে। “আর তা এ কারণে যে, তারা অজ্ঞ সম্প্রদায়।” অর্থাৎ, আমি এ জাতীয় লোকদের জন্য নিরাপত্তার বিধান দিয়েছি, যেন তারা আল্লাহর দীন সম্পর্কে জানতে পারে এবং বান্দাদের মধ্যে আল্লাহর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : খ. ২, পৃ. ৩৩৭)
সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা তারা যে বিষয়ে দলিল দিতে চেয়েছেন উপর্যুক্ত ব্যাখ্যার দ্বারা তাদের সেই দলিল খণ্ডিত হয়ে যায়।
আল্লাহর কৃপায় আমরা বলবো, বিধান কেবলই আল্লাহর। কাজেই আল্লাহ তাআলা যে বিষয়টিকে কুফর ও শিরক বলে নামকরণ করেছেন তা সকল ক্ষেত্রে কার্যকর হবে।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রমাণিত, যাতে কোনো সন্দেহ নেইÑ মানুষের মধ্যে কেবল দুটি শ্রেণি রয়েছে : (এক) মুসলিম (দুই) কাফের ও মুশরিক। দুনিয়ার বিধানে এ দুই শ্রেণির বাইরে তৃতীয় কোনো শ্রেণি বিভাগ নেই।
মুমিন ও মুসলিম কখনও ফাসেক ও পাপাচারী হয় এবং তার থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত ধর্মত্যাগের আলামত প্রকাশ না পাবে, সে দুনিয়ার বিধানে মুমিন ও মুসলিম হিসেবেই বাকি থাকবে।
শরিয়ার বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত বক্তব্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেইÑ যে ব্যক্তি কালিমার সাক্ষ্যপ্রদান করবে না, সে মুসলিম হবে না, বরং দুনিয়ার বিধানে সে কাফের ও মুশরিকদের মধ্যেই গণ্য হবে। এমনি একটি বক্তব্য হলো, أمرت أن أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِهِ….
আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি এবং আমার আনীত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করে…
অর্থাৎ, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে কালিমার সাক্ষ্য প্রদান করে এবং রাসূল সা. আনীত সমগ্র দীনের ওপর ও গায়েবের বিষয়ের ওপর ঈমান আনার কথা স্বীকার করে এবং ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম থেকে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করে সেই মুসলিম। অতঃপর মুসলিম দুই প্রকার : (এক) দায়িত্বপ্রাপ্ত [مكلف]; (দুই) দায়িত্বের অনুপযুক্ত [غير مكلف]।
দায়িত্বের অনুপযুক্তÑ এ শ্রেণির মধ্যে আছে পাগল, নাবালেগ, যাদের থেকে দীনের বিধান উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে।
আর দায়িত্বপ্রাপ্ত হলো বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি। আর বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়ার জন্য তার মধ্যে সামান্য পরিমাণে হলেও বিচার—বিবেচনা ও জ্ঞান—বুদ্ধি থাকতে হবে। সেই বিচার—বিবেচনা ও জ্ঞান—বুদ্ধি অনুপাতে সে কালিমার অর্থ ও মর্ম বুঝতে সক্ষম হবে। আর কালিমার অর্থ ও মর্ম অনুধাবনে ত্রুটি তার ইসলাম এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা আবশ্যক হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। যারা সেই অর্থ ও মর্ম বুঝতে সক্ষম তাদের কর্তব্য তা শিক্ষা দেওয়া।
অতএব, যে সত্যে সে উপনীত হবে এবং তার ওপর দলিল প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হবে তা বিশ^াস করা তার জন্য আবশ্যক হবে। এরপরও যদি সে বিরোধিতা ও একগুঁয়েমি করে তাহলে সে কাফের, মুশরিক ও মুরতাদ হয়ে যাবে। এর পূর্বে সে মুসলিম থাকবে এবং তার জীবন ও সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে; যদিও কালিমার অর্থ ও মর্ম অনুধাবনে তার মধ্যে ত্রুটি থাকে, হোক তা তার অজ্ঞতার কারণে, কিংবা শরিয়ার বক্তব্য অনুধাবনে তার ভুলের কারণে। কিন্তু এ ভুল ও অজ্ঞতার কারণে সে অপারগ বলে গণ্য হবে। ইতঃপূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অতিবাহিত হয়েছে।
(দুই) তারা বলেন, আল্লাহ তাআলা ঐ সকল লোকদের নিন্দা করেছেন যারা রাসূল সা.—এর অনুসরণ করে না এ ভয়ে যে, ‘মানুষ তাদের ওপর চড়াও হবে, তাদেরদেরকে দেশ থেকে উৎখাত করে দিবে’। আল্লাহ তাআলা এ শ্রেণির লোকদের ওপর কুফরের বিধান দিয়েছেন; যদিও তারা স্বীকার করে নিয়েছিল যে, নবী মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল এবং তিনি যে দীন নিয়ে এসেছেন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, রাসূল সা.—এর অনুসরণের অর্থ হলো, তিনি যে দীন নিয়ে এসেছেন তা আমলে বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে কাউকে এ জন্য অপারগ ধরা হবে না যে, সে ক্ষমতাশীল ব্যক্তির ভয় করে। অর্থাৎ, রাসূলের দীনের অনুসরণ ও তার ওপর আমল করলে কখন ক্ষমতাশীল ব্যক্তি তার ওপর চড়াও হয়, তাঁকে কঠিন শাস্তি দেয়! আল্লাহ তাআলা বলেন,
{ وَقَالُوا إِنْ نَتَّبِعِ الْهُدَى مَعَكَ نُتَخَطَّفْ مِنْ أَرْضِنَا أَوَلَمْ نُمَكِّنْ لَهُمْ حَرَمًا آمِنًا يُجْبَى إِلَيْهِ ثَمَرَاتُ كُلِّ شَيْءٍ رِزْقًا مِنْ لَدُنَّا وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ } [القصص: ৫৭]
তারা বলে, আমরা যদি তোমার সাথে সৎপথ অনুসরণ করি তাহলে আমাদেরকে দেশ থেকে উৎখাত করা হবে। আমি কি তাদেরকে এক নিরাপদ হারামে প্রতিষ্ঠিত করিনি, যেখানে আমার প্রদত্ত রিযিক স্বরূপ সর্বপ্রকার ফলমূল আমদানি করা হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। (সূরা কাসাস : ৫৭)
তারা আরও বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সংবাদ দিয়েছেনÑ ঐ সকল দুর্বল শ্রেণির লোক যারা তাদের নেতাদের অনুসরণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করে না, তারা কাফের ও মুশরিকদের অন্তভুর্ক্ত, যারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদের থেকে ঈমানকে নাকচ করে দিয়েছেন; যদিও তারা ছিল ভীত ও দুর্বল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ (১৬৫) إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ (১৬৬) وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّأَ مِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا كَذَلِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ (১৬৭)} [البقرة: ১৬৫ — ১৬৭]
মানুষের মধ্য হতে কিছু লোক আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকে সবার্ধিক ভালোবাসে। আর যারা জুলুম করেছে শাস্তি প্রত্যক্ষ করলে যেমন বুঝবে, হায়! এখন যদি তারা তেমন বুঝত যে, সমস্ত শক্তি কেবল আল্লাহর এবং আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর। যখন অনুসৃতগণ অনুসরণকারীদের দায়িত্ব অস্বীকার করবে এবং তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে আর তাদের মধ্যকার সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, হায়! যদি একবার আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটতো তবে আমরাও সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন তারা আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এভাবেই আল্লাহ তাদের কাযার্বলি তাদেরকে পরিতাপরূপে দেখাবেন, আর তারা কখনও আগুন থেকে বের হতে পারবে না। (সূরা বাকারা : ১৬৫—১৬৭)
{ وَبَرَزُوا لِلَّهِ جَمِيعًا فَقَالَ الضُّعَفَاءُ لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا إِنَّا كُنَّا لَكُمْ تَبَعًا فَهَلْ أَنْتُمْ مُغْنُونَ عَنَّا مِنْ عَذَابِ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ قَالُوا لَوْ هَدَانَا اللَّهُ لَهَدَيْنَاكُمْ سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَجَزِعْنَا أَمْ صَبَرْنَا مَا لَنَا مِنْ مَحِيصٍ}
সকলে আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবে। যারা অহংকার করতো তখন দুর্বলরা তাদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম, এখন তোমরা আল্লাহর শাস্তি থেকে আমাদেরকে কিছুমাত্র রক্ষা করতে পারবে কি? তারা বলবে, আল্লাহ আমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করলে আমরাও তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করতাম। এখন আমরা ধৈর্যচ্যুত হই বা ধৈর্যশীল হই, একই কথা; আমাদের কোনো নিস্তার নাই। (সূরা ইবরাহিম : ২১)
يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا (৬৬) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا.
যেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে উলট—পালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়, আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম এবং রাসূলের অনুসরণ করতাম! তারা আরও বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম আর তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। (সূরা আহযাব : ৬৭—৬৮)
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ مَوْقُوفُونَ عِنْدَ رَبِّهِمْ يَرْجِعُ بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ الْقَوْلَ يَقُولُ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لَوْلَا أَنْتُمْ لَكُنَّا مُؤْمِنِينَ (৩১) {قَالَ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا لِلَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا أَنَحْنُ صَدَدْنَاكُمْ عَنِ الْهُدَى بَعْدَ إِذْ جَاءَكُمْ بَلْ كُنْتُمْ مُجْرِمِينَ (৩২) وَقَالَ الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا لِلَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا بَلْ مَكْرُ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ إِذْ تَأْمُرُونَنَا أَنْ نَكْفُرَ بِاللَّهِ وَنَجْعَلَ لَهُ أَنْدَادًا وَأَسَرُّوا النَّدَامَةَ لَمَّا رَأَوُا الْعَذَابَ وَجَعَلْنَا الْأَغْلَالَ فِي أَعْنَاقِ الَّذِينَ كَفَرُوا هَلْ يُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ.
হায়! যদি তুমি দেখতে জালিমদেরকে যখন তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান করা হবে তখন তারা পরস্পর বাদানুবাদ করতে থাকবে। যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, তারা অহংকারীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশই মুমিন হতাম। আর যারা অহংকারী ছিল তারা যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদেরকে বলবে, তোমাদের নিকট সৎপথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে তা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম? বস্তুত তোমরাই তো অপরাধী ছিলে। যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তারা যারা অহংকার করেছিল তাদেরকে বলবে, প্রকৃতপক্ষে তোমরা তো দিনরাত চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, যখন তোমরা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে, যেন আমরা আল্লাহর সাথে কুফরি করি এবং তার জন্য সমকক্ষ স্থাপন করি। আর যখন তারা শাস্তি দেখতে পাবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং যারা কুফরি করেছে আমি তাদের গলায় শৃঙ্খল পরাব। তারা যা করতো তাদেরকে কেবল তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। (সূরা সাবা : ৩১—৩৩)
{قَالُوا إِنَّكُمْ كُنْتُمْ تَأْتُونَنَا عَنِ الْيَمِينِ (২৮) قَالُوا بَلْ لَمْ تَكُونُوا مُؤْمِنِينَ (২৯)
তারা (দুর্বলরা) বলবে, তোমরা তোমাদের শক্তি ও প্রভাব নিয়ে আমাদের কাছে আসতে। তারা (নেতৃস্থানীয় কাফেররা) বলবে, বরং তোমরা তো মুমিন ছিলে না। (সূরা সাফ্ফাত : ২৮—২৯)
মুফাসসিরগণ বলেন, উক্ত আয়াতে বর্ণিত الْيَمِينِ শব্দের অর্থ হচ্ছেÑ শক্তি, প্রভাব ও দাপট। এ প্রসঙ্গে আরও অনেক আয়াত রয়েছে।
তারা আরও বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এমন বিধান রেখেছেন যে, প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ অবশ্যই কোনো না কোনো বিপদে ও পরীক্ষায় আক্রান্ত করবেন, আর তাকে সেই বিপদ ও পরীক্ষায় ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যদি এ পরীক্ষা না থাকত তাহলে মানুষ মুনাফিক হয়ে যেতো এবং ঈমান ও ইসলামের দাবিতে মিথ্যাবাদী হয়ে যেতো। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
{الم (১) أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ (২) وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ.
আলিফ লাম মীম, মানুষ কি মনে করেছে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ এ কথা বললেই তাদেরকে পরীক্ষা না করে অব্যাহতি দেওয়া হবে? আর অবশ্যই আমি এদের পূর্ববর্তীদেরও পরীক্ষা করেছিলাম, অতঃপর আল্লাহ অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেনÑ কারা সত্যবাদী এবং তিনি অবশ্যই প্রকাশ করে দেবেনÑ কারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আনকাবুত : ১—৩)
{ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ فَإِذَا أُوذِيَ فِي اللَّهِ جَعَلَ فِتْنَةَ النَّاسِ كَعَذَابِ اللَّهِ وَلَئِنْ جَاءَ نَصْرٌ مِنْ رَبِّكَ لَيَقُولُنَّ إِنَّا كُنَّا مَعَكُمْ أَوَلَيْسَ اللَّهُ بِأَعْلَمَ بِمَا فِي صُدُورِ الْعَالَمِينَ.
মানুষের মধ্য হতে কেউ কেউ বলে, আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি, কিন্তু যখন তারা আল্লাহর পথে নিগৃহীত হয় তখন তারা মানুষের পীড়নকে আল্লাহর শাস্তির মত গণ্য করে। আর আপনার রবের নিকট থেকে কোনো সাহায্য আসলে তারা বলতে থাকে, আমরা তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম। বিশ^বাসীর অন্তঃকরণে যা আছে, আল্লাহ কি সে বিষয়ে সম্যক অবগত নন? (সূরা আনকাবুত : ১০)
আল্লাহর কৃপায় আমরা বলবো, আল্লাহর কালাম সত্য, কুরআনে কারিম সত্য, রাসূল সা. থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত সকল হাদিস সত্য। এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে তার রাসূলের প্রতি ওহি। এসব কিছুর ভাষা ও বক্তব্য এক, যার একটি অপরটিকে ব্যাখ্যা করে। এগুলোর প্রত্যেকটি অবশিষ্টটুকুর উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। কোনো আয়াত কিংবা সহিহ হাদিসের এমন কোনো অংশ পাওয়া যাবে না, যা অন্যান্য আয়াত ও সহিহ হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক বা সেগুলোর মধ্যে পরস্পর মধ্যে বৈপরীত্ব ও সাংঘর্ষিকতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا .
এ কুরআন যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট থেকে আসত তাহলে তারা তাতে অনেক অসংগতি পেত। (সূরা নিসা : ৮২)
কুরআনে কারিমের প্রতিটি আয়াত এবং রাসূল সা.—এর হাদিসসমূহ সত্য এবং তার প্রতি বিশ^াস স্থাপন করা ও কাজে বাস্তবায়ন করা আবশ্যক। তাই কোনো আয়াতকে অন্য আয়াতের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না এবং এক আয়াতকে অন্য আয়াতের কারণে কিংবা এক হাদিসকে অন্য হাদিস বা আয়াতের কারণে বর্জন করা যাবে না; কিন্তু যদি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বের আয়াত ও হাদিসটি রহিত হয়ে গেছে তাহলে তা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَفْعَلُ ذَلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ.
তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশে বিশ^াস কর এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান কর? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা, আর কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তির দিকে নিক্ষিপ্ত হবে। (সূরা বাকারা : ৮৫)
ঈমানের আভিধানিক অর্থ শুধু জ্ঞান নয়। অর্থাৎ, কোনো বস্তুকে তার বাস্তবরূপে জানা, বা অন্য ভাষায় বলতে গেলেÑ শুধু সত্যায়ন করার নাম ঈমান নয়। বরং ঈমান হচ্ছে, অন্তর দ্বারা বিশ^াস করা এবং মুখে বিশ^াসের স্বীকারোক্তি দেওয়া। কাজেই ঐ ব্যক্তি মুমিন হবে না, যে মুখে স্বীকার করে; কিন্তু অন্তরে বিশ^াস করে না, যেমনিভাবে ঐ ব্যক্তি মুমিন নয়, যে অন্তরে বিশ^াস করে ঠিক; কিন্তু মুখে তা স্বীকার করে না।
ঈমানের আভিধানিক অর্থ সম্পর্কে মতভিন্নতা যাই থাকুক, পূর্বে যে অর্থ আমরা বর্ণনা করেছি তা হলো তার শরয়ি বা পারিভাষিক অর্থ। এমনিভাবে ঈমানের পারিভাষিক অর্থের মধ্যে আমল বা কর্ম অন্তভুর্ক্ত কি না, সেসম্পর্কেও মতভিন্নতা রয়েছে, যেমনটি আমরা সেদিকে ইঙ্গিত করেছি এবং সামনে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশা আল্লাহ।
অতএব, মুমিন হতে হলে বান্দাকে অন্তরের বিশ^াসের সাথে এ কথা স্বীকার করতে হবে এবং ঘোষণা করতে হবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল, আর রাসূল সা. আল্লাহর নিকট থেকে যে দীন নিয়ে এসেছেন তা সত্য।
যদি শুধু জ্ঞান ও অন্তরের বিশ^াসকে ঈমান বলা যেতো তাহলে ফিরআউন ও তার পরিষদরা মুমিন হতো। কারণ, তারা ভালো করে জানত এবং বিশ^াস করতো যে, মূসা আ. আল্লাহর পক্ষ হতে সত্য রাসূল; তবে তারা এ কথার মৌখিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا.
তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। (সূরা নামল : ১৪)
একইভাবে ইহদি ও খ্রিষ্টানরাও মুমিন হয়ে যেত। কারণ, তারাও নবী সা.—কে চিনত এবং তাঁকে নবি বলে বিশ^াস করতো। এমনকি তাদের কেউ কেউ মুখে একথা স্বীকারও করেছে; তবে তাদের সেই স্বীকারোক্তি সমর্পণ ও সমর্থনের জন্য ছিল না; বরং তা ছিল নিছক বর্ণনামূলক। যেমন আল্লাহর তাআলা বলেন,
{الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ .
আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাঁকে তেমনি চিনে যেমন তারা নিজেদের সন্তানদেরকে চিনে। আর তাদের একদল জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে। (সূরা বাকারা : ১৪৬)
এ সকল লোকেরা যেহেতু তাদের জ্ঞান ও বিশ^াসকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তাদের মুখে সত্যকে স্বীকার করতে এবং আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছে, এ কারণে তারা মুমিনদের অন্তভুর্ক্ত না হয়ে কাফের রয়ে গেছে। কারণ, কুফর শব্দের আভিধানিক অর্থ ঢেকে রাখা, গোপন রাখা। আর এসকল লোকেরা সত্যকে চেনা সত্ত্বেও এর প্রতি তাদের অন্তর সংকীর্ণ হয়েছে এবং যে সত্যকে তারা বিশ^াস করেছে তা স্বীকার করতে এবং এর প্রতি আত্মসমর্পণ করতে বিমুখ হয়েছে। ফলে তারা সেই সত্যকে নিজেদের থেকে এবং অন্যদের থেকেও গোপন করেছে এবং তাদের ঢেকে রেখেছে, সেই সত্যকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং মৌখিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছে। অতএব, তারা ঐ সকল লোক যারা কুফরের জন্য নিজেদের বক্ষকে উন্মুক্ত করেছে। আল্লাহর কাছে আমরা অশুভ পরিণতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
এটা নিশ্চিত যে, পূর্বোল্লিখিত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা ঐ সকল দুর্বল লোককে কাফের আখ্যা দিয়েছেন যারা কুফর ও শিরকের ক্ষেত্রে তাদের সর্দার ও নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করেছে। কারণ, কারও ওপর বলপ্রয়োগ বা বাধ্যকরণ যত বড় ও গুরুতরই হোক না কেন, সে অন্তরে সত্যকে বিশ^াস করা এবং তার মহান রবের কাছে মনে মনে কালিমার সাক্ষ্যদানের মাধ্যমে তার অন্তরে যে সত্যের উদয় হয়েছে তা স্বীকার করতে অক্ষম নয়। কারণ, মানুষের অন্তরের ওপর দুনিয়াতে কখনও কারও কোনো কতৃর্ত্ব চলে না। কোনো ব্যক্তি কখনও এতটুকু সামান্য সময় পেতে অক্ষম হয় না, যেখানে সে সত্যকে স্বীকার করে কেবল সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহকে শুনিয়ে বিড়বিড় করে কালিমা পাঠ করবে, যখন তার কথা আল্লাহর ব্যতীত দুনিয়ার আর কেউ শুনবে না। এ কাজ থেকে অক্ষম কেবল ঐ ব্যক্তিই হয় যে মিথ্যা দাবিদার, সত্য থেকে বিমুখ এবং কুফরের জন্য বক্ষকে উন্মুক্ত রেখেছে, ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়াত দানের ইচ্ছা করেননি।
এ বিষয়টি সুনিশ্চিত। এটি প্রত্যেক ঐ দুর্বলের অবস্থা যে কুফর ও শিরকের ক্ষেত্রে তার নেতৃবৃন্দের অনুসরণ করেছে, ফলে সে অন্তরে বিশ^াস করেনি এবং মুখে সত্যের কালিমা পাঠ করেনি, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, পৃথিবীর কোনো শক্তি তার মধ্যে ও সেই সত্যের মধ্যে ব্যবধান হিসেবে কাজ করবে। আল্লাহ আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন :
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ.
হে আমাদের রব, আপনি হেদায়াত দান করার পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র করবেন না এবং আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দাতা। (সূরা আলে ইমরান : ৮)
এছাড়া অন্তরের বিশ^াস এবং স্বীকারোক্তি ও আত্মসমর্পণ হিসেবে মুখে সত্যের কালিমা উচ্চারণ করতে হবে, এ ব্যাপারে শরিয়াহর সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার এতেও কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির জন্য অপারগ অবস্থায় মুখে যেকোনো কালিমা উচ্চারণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, হোক তা এমন কথা যা বলপ্রয়োগ ব্যতীত স্বাভাবিক অবস্থায় বললে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়। তবে সেই কালিমা উচ্চারণের জন্যও শর্ত হলো, তার অন্তর ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে হবে এবং এর দ্বারা অন্যের ওপর জুলুম বা অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছা করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{ إِنَّمَا يَفْتَرِي الْكَذِبَ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْكَاذِبُونَ (১০৫) مَنْ كَفَرَ بِاللَّهِ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ وَلَكِنْ مَنْ شَرَحَ بِالْكُفْرِ صَدْرًا فَعَلَيْهِمْ غَضَبٌ مِنَ اللَّهِ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ (১০৬) ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ.
একমাত্র তারাই মিথ্যা রটনা করে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে বিশ^াস করে না, আর তারাই মিথাবাদী। যারা ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরি করেছে এবং কুফরির জন্য হৃদয়কে উন্মুক্ত রেখেছে তাদের ওপর আপতিত হবে আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি; তবে ঐ ব্যক্তির জন্য নয় যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয়; কিন্তু তার অন্তর ঈমানে অবিচল থাকে। এটা এ জন্য যে, তারা দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে, আর নিশ্চয় আল্লাহর কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।
এমনিভাবে এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির জন্য নিরুপায় অবস্থায় এমন কাজের অনুমতি দিয়েছে, যা বলপ্রয়োগ ব্যতীত সাধারণ অবস্থায় করলে ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়; তবে সেক্ষেত্রেও শর্ত হলোÑ তার অন্তর ঈমানে অবিচল থাকতে হবে। এমন নিরুপায় ব্যক্তির জন্য অনুমোদিত কাজ থেকে মহান আল্লাহ ব্যতিক্রম রেখেছেন কেবল এমন কাজকে, যার দ্বারা মানুষের হক নষ্ট করা হয়, যেমনটি এ জাতীয় নসের (শরিয়ার বক্তব্য) ব্যাখ্যা পূর্বে করা হয়েছে।
পূর্বে আমরা হযরত আম্মার বিন ইয়াসির রা. সম্পর্কিত হাদিস আলোচনা করেছি, যখন মুশরিকরা তাকে শাস্তি দিচ্ছিল তখন তিনি মুখে এমন কথা উচ্চারণ করেন, যা বলপ্রয়োগ ব্যতীত স্বাভাবিক অবস্থায় কুফরি কালিমা হওয়ার মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। অর্থাৎ, এর দ্বারা মানুষ কাফের ও মুশরিক হয়ে যায়। আর রাসূল সা. হযরত আম্মারের কথা সম্পর্কে শুধু যে জেনেছেন, বিষয়টি এমন নয়; বরং আম্মার রা. নিজেই রাসূল সা.—কে গিয়ে এ ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছেন। তখন তাঁকে তাঁর অন্তরের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছেন মাত্র, এর চেয়ে বেশি কিছু করেননি। যখন তিনি উত্তর দিলেন যে, তার অন্তর ঈমানে অবিচল তখন নবী সা. বললেন, “ঠিক আছে, যদি তারা আবার এমন করে তাহলে তুমিও তাদের সাথে অনুরূপ করবে।” সুতরাং নবী সা.—এর পবিত্র বাণী দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো যে, বলপ্রয়োগ কুফরি কালিমার উচ্চারণকে বৈধ করে দেয়।
আমরা পূর্বে আরও উল্লেখ করেছি, ইমাম কুরতুবি র. বর্ণনা করেছেন, ‘মুসায়লামা কাযযাবের গুপ্তচররা দুই ব্যক্তিকে আটক করে মুসায়লামার কাছে উপস্থিত করে। তখন তাদের প্রথমজনকে জিজ্ঞেস করেÑ তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, আমি আল্লাহর রাসূল? তিনি জবাবে হাঁ সূচক উত্তর প্রদান করেন।’ নিঃসন্দেহে এটি সুস্পষ্ট কুফরি, নিরুপায় অবস্থা ব্যতীত স্বাভাবিক অবস্থায় বললে উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে ব্যক্তি কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায়। রাসূল সা. তার এ উত্তর সম্পর্কে জানতেন, আর এর সংবাদ প্রদানকারী সে নিজেই ছিল, যে এ কথা উচ্চারণ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাসূল সা. তাকে কাফের ও মুরতাদ গণ্য করেননি। বরং তাকে বুঝিয়েছেনÑ শর্ত হলো, অন্তর ঈমানের ওপর অবিচল থাকতে হবে।
একই বিষয়ের সকল আয়াত ও হাদিসের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং প্রত্যেকটিকে কার্যকরী বিবেচনা করা ওয়াজিব। বিপরীতে কতক আয়াতকে কার্যকরী বিবেচনা করা এবং কতককে অকার্যকর মনে করা শরিয়াহর দৃষ্টিতে নাজায়েয এবং এর আবশ্যিক ফলাফল নিম্নে বর্ণিত দুটির যেকোনো একটি হবে, যার মধ্যে তৃতীয় কোনো সম্ভাবনা নেই :
(এক) এটিই আমাদের মত। পূর্বোল্লিখিত আয়াতসমূহে যেসকল দুর্বল ও বিপদাক্রান্ত লোকের আলোচনা করা হয়েছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বিশেষভাবে কুফরির বিধান দিয়েছেন, তাদের অন্তর কুফরির জন্য উন্মুক্ত ছিল, ফলে তারা সত্য জানা ও বিশ^াসের পরও অস্বীকার করেছে। সেই সত্যকে নিজেদের থেকে গোপন করেছে এবং তাদের অন্তর থেকে আড়াল করেছে, যেকারণে তাদের অন্তর তার ওপর স্থিত হয়নি এবং তারা মুখে এর স্বীকারোক্তি প্রদান করেনি। অথবা তারা ঐ সকল লোক যাদের হৃদয়ে ঈমান প্রবেশ করা এবং মুখে তার স্বীকারোক্তির প্রদানের পরও তাদের অন্তর ঈমান থেকে বিমুখ হয়েছে এবং হৃদয়ের বন্ধন খুলে গিয়েছে, ফলে তারা দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতি সাথে নিয়ে উল্টো মুখে ফিরে গিয়েছে। [ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ] এটাই হচ্ছে সুস্পষ্ট ক্ষতি। (সূরা হাজ্জ : ১১)
দুই. উল্লেখিত আয়াতসমূহ যেখানে সেই দুর্বল ও বিপদাক্রান্ত লোকদের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে, যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা কুফরের ফয়সালা দিয়েছেনÑ সেই আয়াতগুলো বলপ্রয়োগ ও বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির বিধান সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসসমূহকে রহিত করে দিয়েছে। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন, যার সমর্থনে কোনো দলিল নেই। কারণ, কোনো বিধান রহিত করতে গেলে অবশ্যই সুস্পষ্ট কোনো আয়াত বা হাদিস থাকতে হবে, অথবা এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে হবে যেখানে সকল নসকে একই সময়ে কার্যকর ধরা যায় না, বরং একটির ওপর আমল করলে অপরটিকে পরিত্যাগ করতে হয়। তা এ কারণে যে, আমরা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর আনুগত্য করতে আদিষ্ট। আর তার পদ্ধতি হলো, মহান আল্লাহর সকল আদেশ, নিষেধ ও বিধানকে মেনে চলা। অতএব, কোনো নসের ওপর আমল সম্ভব হওয়া সত্তে¦ও তার ওপর আমল না করে অকার্যকর হিসেবে বর্জন করা বড় অন্যায়। তাছাড়া উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তি সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসসমূহ রহিত হয়নি।
যেসকল আয়াতের মাধ্যমে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম সেসকল আয়াত সম্পূর্ণরূপে ঐ সকল দুর্বল ও বিপদাক্রান্ত লোকদেরকে কাফের আখ্যা দেয় না যাদেরকে আল্লাহ শাস্তির ওয়াদা করেছেন। এ কথাও সুবিদিত যে, মুসলিমকেও জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে, তার গোনাহের পাল্লা ভারি হলে আল্লাহ তাকে ইনসাফ অনুযায়ী বদলা দান করবেন, অতঃপর তাকে স্বীয় অনুগ্রহ, দয়া ও সুপারিশকারীদের সুপারিশে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।
আমরা আরও জানি, প্রত্যেক দুর্বল ব্যক্তি তার ওপর বলপ্রয়োগ কারণে তার নেতা ও লিডারের অনুসরণ করে না। আমাদের সময়ে এ বিষয়টি একেবারেই বাস্তব ও ঘটমান। বরং অনেক দুর্বল ব্যক্তি এমন আছে, যারা ক্ষমতা ও প্রভাব—প্রতিপত্তির অধিকারীর অনুসরণ করে নিছক নিজেদের মানসিক দুর্বলতার কারণে। ফলে তারা পোশাক—পরিচ্ছদ, স্বভাব—রীতি, উৎসব—অনুষ্ঠান ও সভা—সমাবেশ ইত্যাতি ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করে; যদিও এতে আল্লাহর নাফরমানি হয়, পবিত্র শরিয়াহর বিধান লঙ্ঘিত হয়। তারা এসব কিছু করে কোনো বলপ্রয়োগ ও বাধ্য হওয়া ব্যতীত কেবল দুনিয়ার মহব্বত ও রিপুর তাড়নায়।
বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তি নিরুপায় হওয়ার কারণে বিপদাক্রান্ত বিবেচিত হয়, কিন্তু বলপ্রয়োগই বিপদাক্রান্ত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম নয়। অনুরূপ প্রত্যেক বিপদকে বলপ্রয়োগের মত গণ্য করা যাবে না। বরং কখনও কখনও মানুষ এমন বিপদে আক্রান্ত হয়, যা দুঃখ—কষ্ট ও দুশ্চিন্তায় নিপতিত করে, যেমন সম্পদ হারানো, প্রভাব—প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা চলে যাওয়া, জীবনোপকরণ সংকীর্ণ হওয়া, বন্ধু ও সহযোগীদের বিচ্ছেদ ইত্যাদি। এসব কিছু আভিধানিক অর্থে ‘নিরুপায় বা বাধ্য হওয়া’—এর অন্তভুর্ক্ত নয়, বরং এসব কিছু হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ.
আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভালো দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি, আর আমার নিকট তোমরা প্রত্যানীত হবে। (সূরা আম্বিয়া : ৩৫)
{ عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ.
শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করবেন এবং তোমাদেরকে যমিনে স্থলাভিষিক্ত করবেন, অতঃপর তিনি লক্ষ্য করবেনÑ তোমরা কী কর? (সূরা আরাফ : ১২৯)
এখন আমরা আমাদের থেকে ছুটে যাওয়া কথাগুলো আলোচনা করবো। আল্লাহর কৃপায় আমরা বলবো, নিশ্চয় আল্লাহ দুর্বল শ্রেণির ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে নিশ্চিত ফয়সালা ও বিধান দিয়েছেন যে, যে দুর্বল ব্যক্তির অন্তর ঈমানে অবিচল থাকবে সে মাজুর বা অপারগ বলে গণ্য হবে, তাকে কাফের ও পাপী বলা যাবে না; বরং তাকে ক্ষমা করা হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ تَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ ظَالِمِي أَنْفُسِهِمْ قَالُوا فِيمَ كُنْتُمْ قَالُوا كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِي الْأَرْضِ قَالُوا أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوا فِيهَا فَأُولَئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَسَاءَتْ مَصِيرًا.
নিশ্চয় যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের জান কবজ করার সময় ফিরিশতারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা দুনিয়ায় দুর্বল ছিলাম। ফেরেশতারা বলে, আল্লাহর যমিন কি প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম, আর তা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল! (সূরা নিসা : ৯৭)
অতঃপর আল্লাহ তাআলা এ সকল দুর্বল লোকদের থেকে কিছু লোককে ব্যতিক্রম গণ্য করেছেন, যারা বাস্তবেই নিরুপায় ছিল, তাদের অন্তর ঈমানের ওপর অবিচল ছিল। সুতরাং আল্লাহ তাআলা বলেন,
{إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا (৯৮) فَأُولَئِكَ عَسَى اللَّهُ أَنْ يَعْفُوَ عَنْهُمْ وَكَانَ اللَّهُ عَفُوًّا غَفُورًا.
তবে যেসকল অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোনো উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোনো পথও খুঁজে পায় না; আল্লাহ অচিরেই তাদেরকে ক্ষমা করবেন। কারণ, আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল। (সূরা নিসা : ৯৮—৯৯)
এ পবিত্র আয়াত দুর্বল ও অসহায়দের সম্পর্কে অন্যান্য আয়াতসমূহের ব্যাখ্যাকারী। সুতরাং আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহে আমাদের পূর্বের আলোচনার বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হলো।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আনুগত্য ও অনুসরণ
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন,
অচিরেই এমন এক কওমের আগমন হবে যারা কুরআনের সাদৃশ্যপূর্ণ (অস্পষ্ট) বিষয়গুলো নিয়ে তোমাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হবে। তখন তোমরা সুন্নাহ দ্বারা তাদের মোকাবেলা করবে। কারণ, সুন্নাহর জ্ঞান যাদের আছে তারাই কিতাবুল্লাহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত। (আল—ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম, ইবনু হাযম : খ. ২, পৃ. ১৪০)
কিছু লোক মনে করে, ‘কোনো মুসলিম যদি এমন ব্যক্তির আনুগত্য ও অনুসরণ করে যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা করে না, সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যায়।’
এ আনুগত্য ও অনুসরণ তাদের মতে নিয়ত ও বিশ^াসের বিবেচনা ব্যতীত শুধু আমল ও কাজের মাধ্যমেই হয়।
তারা আরও বলে, কেউ যদি আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত কোনো কাজের দিকে আহ্বান করে, অতঃপর কোনো ব্যক্তি সে অনুযায়ী কাজ করে তাহলে সে ঐ আহ্বানকারীর আনুগত্যকারী, অনুসারী এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাকে রব হিসেবে গ্রহণকারীর হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে তার বিশ^াস নিম্নে বর্ণিত তিন প্রকারের যেকোনোটি হতে পারে :
১. আমলকারী এ বিশ^াসের সাথে আমল করে যে, আদেশদাতা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী আদেশ করছে, অথবা আল্লাহ তাআলা তার জন্য ঐ কাজের আদেশ করার বৈধতা দিয়ে রেখেছেন।
২. অথবা এ বিশ^াসের সাথে আমল করে যে, আদেশদাতা আল্লাহর হুকুমের বিপরীত আদেশ করছে, সেই সাথে সে এ বিশ^াসও করে যে, আদেশদাতা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে না, আর তার আদেশ মান্য করলে তা হবে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচারণ।
৩. কিংবা এ বিশ^াসের সাথে আদেশ পালন করুক যে, আদেশদাতা আল্লাহর বিধানের বিপরীত আদেশ করছে; কিন্তু সে এ বিশ^াস করে যে, সেই আদেশদাতার নিজের পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে এমন ক্ষমতা রয়েছে যে, এখন সে আল্লাহর হারামকৃত কাজকে হালাম করতে পারে কিংবা আল্লাহর হালালকৃত কাজকে হারাম করতে পারে। এমনিভাবে সে আল্লাহর বিধানের বিপরীত আদেশ করারও ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমের দিকে ভ্রƒক্ষেপ করা ব্যতীত তার আদেশ মান্য করা ও তার অনুসরণ করা ওয়াজিব।
এক্ষেত্রে তারা একটি দৃষ্টান্তও পেশ করেন, আর তা হচ্ছে, কোনো মুসলিম যদি এ বিশ^াস করে যে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা নিজ সত্তা ব্যতীত সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনিই বিধানদাতা, তিনি ব্যতীত আর কোনো বিধানদাতা নেই। সেই মুসলিম ব্যক্তি যদি আল্লাহর আদেশের অনুসরণ ও নিষিদ্ধ কাজসমূহ বর্জনেও আগ্রহী হয়, নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয বিধানসমূহ পালন করে; কিন্তু পরে তার সামনে এমন উদ্ভূত পরিস্থিতি আসে যেখানে সে আল্লাহর বিধান জানে না এবং সে দলিল—প্রমাণের মধ্যে চিন্তা—গবেষণা করে বিধান আহরণেও সক্ষম না, ফলে সে একজন বিজ্ঞ আলেমের কাছে Ñযার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও তাকওয়া সম্পর্কে মানুষের আস্থা আছেÑ আল্লাহর বিধান জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু সেই আলেম ভুল ফাতওয়া প্রদান করে এবং আল্লাহর প্রকৃত বিধানে উপনীত হতে না পারে, অতঃপর সেই মাসআলা জিজ্ঞাসাকারী বিশ^াস করে যে, উক্ত আলেম যে ফাতওয়া প্রদান করেছেন তাই বুঝি আল্লাহর বিধান এবং এ বিশ^াসের সাথে সে আমল করে যে, সে আল্লাহর বিধানই পালন করছে, এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য হলো, এ কাজের দ্বারা সে আল্লাহর সাথে শিরক করছে এবং ঐ মুফতি সাহেবকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করছে।
এ দাবির স্বপক্ষে দলিল হিসেবে তারা উল্লেখ করে, আল্লাহ তাআলার বাণী :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ.
তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারয়াম তনয় মাসিহকেও। (সূরা তাওবা : ৩১)
আরেকটি দলিলÑ হযরত আদি ইবনে হাতেম রা. থেকে বর্ণিত হাদিস, তিনি বলেন, যখন তিনি রাসূল সা.—কে বললেন, তারা তো তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের উপাসনা করতো না! ইবনু কাছিরের স্বীয় তাফসিরে কৃত ভাষ্যমতে জবাবে নবী কারিম সা. বলেন, “হাঁ, তারা তাদের অনুসারীদের জন্য হালাম কাজকে হারাম করতো, আর হারাম কাজকে হালাল করতো, অতঃপর অনুসারীরা তাই মান্য করতো। এটিই হচ্ছে তাদের ইবাদত।”
পবিত্র আয়াতে পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদের আদেশ পালনের মাধ্যমে তাদের রুবুবিয়্যাতকে স্বীকার করা এবং রুবুবিয়্যাতের বিশ^াসের সাথে মারয়াম তনয় ঈসাকে আল্লাহর পুত্র মনে করা, এসবের মধ্যে সমতা বিধান করা হয়েছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, শরিয়াহর দৃষ্টিতে কর্ম ও বিশ^াসের বিধান এক এবং প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে শিরকে নিপতিত করে।
পবিত্র আয়াত দ্বারা আরও প্রতীয়মান হয়, সেখানে সকল ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যে, তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখানে তাদের কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি, এমনিভাবে ভুলকারী বা ভুলকারী নয়, কিংবা বিশ^াসী ও অবিশ^াসী, এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি।
তারা আরও দলিল গ্রহণ করেন নিন্মোক্ত আয়াত দ্বারা। আল্লাহ তাআলা বলেন :
{إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْر.
নিশ্চয় কোনো মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কুফরি বৃদ্ধি করে। (সূরা তাওবা : ৩৭) তারা বলেন, মাসকে পিছিয়ে দেওয়া একটি কাজ, আল্লাহ তাআলা এর সাথে জড়িত ব্যক্তিকে কাফের আখ্যা দিয়েছেন।
তারা আরও দলিল গ্রহণ করে নিন্মোক্ত আয়াত দ্বারা :
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৩১) قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ.
বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না। (সূরা আলে ইমরান : ৩১—৩২)
তারা বলেন, আয়াতে বর্ণিত অনুসরণের অর্থ হলো, রাসূল সা. আনীত দীনের ওপর আমল করা, আর যে ব্যক্তি রাসূল সা. আনীত দীনের ওপর আমল করে না, সে তাঁর অনুসারী নয়; বরং সে হচ্ছে দীন হতে বিমুখ ও কাফেরদের অন্তভুর্ক্ত।
এমনিভাবে তারা আরও দলিল গ্রহণ করেন নিন্মোক্ত আয়াত দ্বারা :
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ.
যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তার কিছুই তোমরা আহার করো না, নিশ্চয় তা পাপ। নিশ্চয় শয়তানেরা তার বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররেচনা দেয়। যদি তোমরা তাদের অনুসরণ কর তাহলে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে। (সূরা আনআম : ১২১)
তারা বলেন, আয়াতে বর্ণিত অনুসরণ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ কৃর্তক নিষিদ্ধ খাবার খাওয়া। এখানে আহারকারীর বিশ^াস ও আকিদা ধর্তব্য নয়। অতএব, একজন মুসলিম যদি এক টুকরা গোশত খাওয়ায় আনুগত্যের কারণে মুশরিক হয়ে যায়, যা না তাদের পুষ্ট করে, আর না ক্ষুধা নিবারণ করে, অতএব এর চেয়ে আরও অধিক গুরুতর বিষয়ে আনুগত্য করলে এর পরিণতি কী হতে পারে!
তারা যেসকল আয়াত ও হাদিস দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন, আসলে এগুলোর কোনোটি দলিল হয় না।
আল্লাহ তাআলার বাণী :
{وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُمْ بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ (৩০) اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُون.
ইহুদিরা বলে, উযায়ের আল্লাহর পুত্র, আর খ্রিষ্টানরা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা। পূর্বে যারা কুফরি করেছিল তারা তাদের মত কথা বলে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। এদেরকে কোথায় ফেরানো হচ্ছে? তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারয়াম তনয় মাসিহকেও, অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তারা যে শরিক করে তিনি তা থেকে পবিত্র। (সূরা তাওবা : ৩০—৩১)
উক্ত আয়াতে কারিমা নিন্মোক্ত আয়াতের বিপরীত :
{الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِهِ هُمْ بِهِ يُؤْمِنُونَ (৫২) وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوا آمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّنَا إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ.
এর পূর্বে আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছিলাম তারা এর প্রতি ঈমান আনে। আর যখন তাদের নিকট তা তিলাওয়াত করা হয় তখন তারা বলে, আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি, নিশ্চয় তা আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য। আমরা তো পূর্বেও আত্মসমর্পণকারী ছিলাম। (সূরা কাসাস : ৫২—৫৩)
প্রকাশ থাকে যে, ওপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি আয়াত সকল ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। কারণ, আল্লাহ তাদের প্রতি লানত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে এবং মারয়াম তনয় মাসিহকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।” এটি হচ্ছে একটি দল। নিশ্চয় এ দলটি ছাড়াও আরেকটি দল আছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা নবী সা.—এর নবুওয়ত লাভ ও কুরআন নাযিলের পূর্বেই মুসলিম ছিল। এর সমর্থন হয় নিন্মোক্ত আয়াতে কারিমার মাধ্যমে :
مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ أُمَّةٌ قَائِمَةٌ يَتْلُونَ آيَاتِ اللَّهِ آنَاءَ اللَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُونَ (১১৩) يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَأُولَئِكَ مِنَ الصَّالِحِينَ (১১৪) وَمَا يَفْعَلُوا مِنْ خَيْرٍ فَلَنْ يُكْفَرُوهُ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالْمُتَّقِينَ.
আহলে কিতাবের মধ্যে একদল ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে, তারা রাত্রিকালে আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে এবং তারা সিজদা করে। তারা আল্লাহ এবং পরকালে বিশ^াস করে, ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে এবং তারা কল্যাণকর কাজে প্রতিযোগিতা করে, আর তারা নেককারদের অন্তভুর্ক্ত। তারা যে ভালো কাজ করে তা থেকে কখনও তাদেরক বঞ্চিত করা হবে না। আল্লাহ মুত্তাকিদের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।
সুতরাং যাদের ব্যাপারে আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, তারা সৎকারদের অন্তভুর্ক্ত, নিঃসন্দেহে তারা ঐ দলের অন্তভুর্ক্ত নয় আল্লাহ যাদের প্রতি লানত করেছেন এবং ফয়সালা দিয়েছেন যে, তারা শিরক করেছে এবং তারা তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে ও মারয়াম তনয় মাসিহকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।
সুতরাং এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, সূরা তাওবার আয়াতটি সকল ইহুদি ও খ্রিষ্টানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না; বরং তাদের মধ্য হতে মুশরিক দলটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ইত্তিবা’ (الاتباع) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, অনুসরণ করা, আর তা‘আত (الطاعة) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, নির্দেশ পালন করা।
আর তার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, নিয়ত ও বিশ^াসের সাথে কর্মের মাধ্যম কারও নির্দেশ পালন করা। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা.—এর সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তও তাই। সেই হাদিসে নবীজি সা. বলেন,
إنما الأعمال بالنية، وإنما لكل امرئ ما نوى، فمن كانت هجرته إلى الله ورسوله، فهجرته إلى الله ورسوله، ومن كانت هجرته إلى دنيا يصيبها أو امرأة يتزوجها، فهجرته إلى ما هاجر إليه
মানুষের কাজসমূহ তাদের নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে। অতএব, কেউ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজতর করে তাহলে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যেই হবে। আর যে দুনিয়াবি উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য হিজরত করবে অথবা কোনো নারীকে বিবাহ করার জন্য, তাহলে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই হবে যার জন্য সে হিজরত করেছে। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, রিয়াযুস সালেহিন)
এ হাদিসটি সর্বসম্মতিক্রমে সহিহ এবং তা অর্থের বিবেচনায় মুতাওয়াতির। কারণ, তা বহু সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তার শব্দের মধ্যে কিছুটা বৈচিত্র থাকলেও অর্থের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।
সুতরাং হাদিসের স্পষ্ট ভাষ্য অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি শরিয়তে আদিষ্ট অথবা নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে তাহলে এর বিধান তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল হবে। কারণ, হাদিসে বলা হয়েছে : “প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে।”
অতএব, কোনো ব্যক্তি যদি আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর বিধান পালনের উদ্দেশ্যে কারও কথা মনে চলে তাহলে সে কখনও উক্ত বিধান বর্ণনাকারী, আদেশদাতা বা মুফতির অনুসারী ও আনুগত্যকারী হবে না; এক্ষেত্রে সেই বিধান বর্ণনাকারী, আদেশদাতা বা মুফতি আল্লাহর বিধান বর্ণনায় কার্যত সঠিক করুক বা ভুল করুক।
আর যে ব্যক্তি কোনো ব্যক্তির আনুগত্য ও তার প্রণীত বিধান বাস্তবায়নের ইচ্ছা করবে; যদিও তা আল্লাহর বিধানের বিপরীত হয়, এর মাধ্যমে সে শরয়ি অর্থে তার অনুসারী বলে গণ্য হবে। সেই ব্যক্তির আদেশ ও বিধান আল্লাহর বিধানের অনুকূল হোক বা প্রতিকূল, এতে কোনো পার্থক্য হবে না।
আর যে ব্যক্তি এ বিশ^াস রাখবে যে, আদেশদাতা আল্লাহর শরিয়তে পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা রাখে না, আর আল্লাহ কতৃর্ক প্রদত্ত শরিয়াহর খেলাফ যে আদেশ করবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে, যা আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত জিনিসকে হারাম ও আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত জিনিসকে হালাল করতে পারে না, এ বিশ^াসের সাথে যদি কেউ সেই আদেশদাতার আদেশ অনুযায়ী কাজ করে তাহলে এর মাধ্যমে সে আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্যকারী হবে; কিন্তু সেই আদেশদাতা ও মুফতি সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী আমল করার কারণে সে শরয়ি অর্থে তার অনুসারী হবে না এবং আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে তাকে রব হিসেবে গ্রহণকারীও হবে না। তবে কিছু কাজ এর ব্যতিক্রম, যে ব্যাপারে সুস্পষ্ট নস (শরিয়ার বক্তব্য) রয়েছে যে, এ কাজের কর্তা থেকে ঈমান চলে যায় এবং এক্ষেত্রে তার নিয়ত ও বিশ^াসের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করা হয় না, যদিও সে কালিমা পাঠ করে।
উপর্যুক্ত হাদিসে রাসূল সা. স্পষ্ট বলেছেন, যে ব্যক্তি তাঁর হিজরতের আদেশ শুনে হিজরত করল; কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়াবি স্বার্থ অর্জন কিংবা কোনো নারীকে বিবাহ করা তাহলে তার হিজরত সে জন্যই হবে যে উদ্দেশ্যে সে হিজরত করেছে। অর্থাৎ, তার হিজরতটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণের জন্য হলো না।
এ ব্যাপারে যেকোনো দুজন মুসলিমও দ্বিমত করবে না যে, কোনো ব্যক্তি যদি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে সফরের সমূহ কষ্ট সহ্য করে ইহরামের কাপড় পরিধান করে আসে এবং তাওয়াফ, সায়ি এবং জিলহজ্জের নয় তারিখে উকুফে আরাফা করে, অতঃপর মুযদালিফায় গমন করে, এরপর মিনায় গিয়ে নির্দিষ্ট স্তম্ভসমূহে কঙ্কর নিক্ষেপ করে এবং সেখানে দুই দিন অবস্থান করে, অতঃপর বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করে, এসব কাজ যদি কেউ এ বিশ^াসের সাথে করে যে, হজ্জের বিধানটি অযথা, এর কোনো যৌক্তিকতা নেইÑ তাহলে এতসব কাজের পরও সে শরয়ি অর্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারী ও অনুসারী হবে না।
সূরা তাওবার উল্লেখিত আয়াত :
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
“তারা আল্লাহর পরিবর্তে তাদের পণ্ডিত ও সংসার বিরাগীদেরকে তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে।” (আয়াত : ৩১)
এখানে কোনো কাজের কথা বলা হয়নি, এমনকি তার দিকে ইশারাও করা হয়নি। বরং সেখানে বানানো বা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। এ গ্রহণ করা কর্ম ব্যতীত শুধু নিয়ত ও বিশ^াসের দ্বারাই হতে পারে। সুতরাং কেউ যদি শুধু এ বিশ^াস করে যে, অমুক ব্যক্তি কোনো আদেশ করলে তা পালন করা ওয়াজিব; যদিও তা আল্লাহর নির্দেশের খেলাফ হয়Ñ তাহলে এ বিশ^াসটুকুই আল্লাহর পরিবর্তে তাকে রব হিসেবে গ্রহণের জন্য যথেষ্ট।
আর আদি ইবনে হাতেম রা.—এর সূত্রে তাফসিরে ইবনে কাছিরের যে বর্ণনাটি আছে, “হাঁ, তারা তাদের অনুসারীদের জন্য হালাম কাজকে হারাম করতো, আর হারাম কাজকে হালাল করতো, অতঃপর অনুসারীরা তাÑই মান্য করতো।” এ হাদিসেও কাজের কথা নেই; বরং সেখানে অনুসরণ করা বা মান্য করার কথা আছে। আর শরিয়তে যে অনুসরণ ধর্তব্য সেখানে নিয়ত ও বিশ^াস জরুরি।
বিশ^াস হচ্ছে শুধুই অন্তরের কাজ। সেখানে দেহের কোনো অংশিদারিত্ব নেই। আর আমল বা কর্ম হচ্ছে দৈহিক নাড়াচাড়ার মাধ্যমে অন্তরের কাজ। এটি বিশ^াস থেকে ভিন্ন। রাসূল সা. এ দুটির মধ্যে পার্থক্য করেছেন : “নিশ্চয় আমলসমূহ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল”। এ হাদিসের মধ্যে রাসূল সা. নিয়ত তথা বিশ^াসকে আমল থেকে ভিন্ন ঘোষণা করেছেন।
ইবনু কাছির যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন তা রাসূল সা. পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সনদে উল্লেখ করেননি। হাদিসটি ইবনু হাযম, তিরমিযি ও তাহহান আল—কুফি থেকে বর্ণনা করেছেন, আর ইবনু জারির তাবারি রাসূল সা. পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য রাবির সূত্রে যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তার শব্দ হলো এরূপ :
أليس يحرمون ما أحل الله فتحرمونه، ويحلون ما حرم الله فتحلونه؟গ্ধ قال: قلت: بلى. قال: فتلك عبادتهم.
তারা কি তোমাদের জন্য হারামকে হালাল করতো না? অতঃপর তোমরা তাকে হালাল মনে করতে এবং তারা কি তোমাদের জন্য হালালকে হারাম করতো না? অতঃপর তোমরা তাকে হারাম মনে করতে। আমি বললাম, হাঁ। নবীজি সা. বললেন, এটিই হচ্ছে তাদের ইবাদত।” (তাফসিরে তাবারি : খ. ১১, পৃ. ৪১৭)
এ হালাল মনে করা বা হারাম মনে করা শুধু বিশ^াসের দ্বারাই পূর্ণতা পায়। সেখানে কর্মের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং কেউ যদি বিশ^াস করেÑ মদপান করা হালাল, তাহলে সে এ বিশ^াসের দ্বারাই তাকে হালাল মনে করল; যদিও সে এক ফেঁাটা মদ পান না করে। এমনিভাবে যে তালাককে হারাম বিশ^াস করলো সে তাকে হারাম মনে করল; যদিও সে বিবাহিত না হয় এবং তালাক প্রদানের জন্য তার কোনো স্ত্রী না থাকে। সুতরাং উভয় বর্ণনার ভাষ্য অনুযাী, হারাম মনে করার মধ্যে কখনও কোনো কর্ম পাওয়া যায় না। কারণ, হারাম মনে করার অর্থ হলো, নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকা। অতএব, এ কথা কীভাবে যথার্থ হবে যে, “বিশ^াস ধর্তব্য নয়, বরং কাজই ধর্তব্য”? এবং পাদরি, পণ্ডিত ও সংসারবিরাগীদেরকে তাদের হারামকৃত কাজের অনুসরণ, তাদের প্রতি বিশ^াস ও কর্ম ব্যতীত কী করে হবে..!?
প্রকৃত কথা হচ্ছে, উল্লেখিত আয়াত কর্ম ও বিশ^াসের মধ্যে সমতা বিধান করেনি; বরং দুটি বিশ^াসের মধ্যে সমতা বিধান করেছে, যার মূল ধাতু এক, আর তা হচ্ছেÑ এ কথা ও বিশ^াস যে, উযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং মাসিহ আল্লাহর পুত্র, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছেÑ এ কথার বিশ^াস যে, সেই পাদরি ও সংসার বিরাগীদের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধি এত বেশি যে, তাদের আনুগত্য ও অনুরসণ করা ওয়াজিব; যদিও তাদের কথা আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর খেলাফ হয়।
এটাই হচ্ছে প্রকৃত বাস্তবতা। কারণ, তারা নিজেদের পোপকে ‘পবিত্র পোপ’ বলে নামকরণ করে থাকে। অর্থাৎ, তারা বুঝাতে চায়Ñ পোপ স্বয়ং পবিত্র ও নিষ্পাপ। তাদের বিশ^াস অনুযায়ী পোপ কোনো ভুল করতে পারে না। নিকট অতীতে পোপ গর্ভ নিরোধক উপকরণসমূহকে হারাম ঘোষণা করেন। এ সিদ্ধান্ত জারির সাথে সাথে তার সকল অনুসারীরা এটিকে হারাম বিশ^াস করতে থাকে। আর এ বিষয়টি প্রসিদ্ধ ও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, ঈসায়িদের নিকট তালাক বৈধ ছিল এবং তাদের বাইবেলে তালাক হারাম হওয়া সম্পর্কিত কোনো বাণী নেই। এরপর চার্চ কাউন্সিলের সদস্যরা বসে তালাককে হারাম ঘোষণা করে, ফলে এটি তাদের বিশ^াসে পরিণত হয়।
যারা বলে, আনুগত্য দ্বারা কর্ম ধর্তব্য; বিশ^াস নয়, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের প্রশ্ন : কোনো মুসলিমকে যদি একজন মুফতি সাহেব ফাতওয়া প্রদান করেÑ তালাক প্রদান করা হারাম, অথবা কোনো বিচারক আদেশ করেÑ যেন সে তার স্ত্রীকে তালাক না দেয়, তাহলে তার জন্য কি তালাক প্রদান করা আবশ্যক হয়ে যাবে? তালাক প্রদান না করলে কি সে আল্লাহর পরিবর্তে তার আনুগত্যকারী ও আল্লাহর পরিবর্তে তাকে রব হিসেবে গ্রহণকারী হবে? নাকি যখন সে উক্ত ফাতওয়া ভুল হওয়া বা নির্দেশটি বাতিল হওয়ার বিশ্বাস করবে তখন সে তাকে রব হিসেবে গ্রহণকারী হবে না; যদিও সে তার স্ত্রীকে তালাক না দেয়?
আমরা তাদেরকে আরও জিজ্ঞেস করবো, যদি কোনো মুফতি সাহেব ফাতওয়া প্রদান করে অথবা কোনো বিচারক ফয়সালা প্রদান করে যে, মদপান করা হালাল, অতঃপর কোনো ব্যক্তি তাই বিশ^াস করলো তাহলে কি তার জন্য মদপান করা হালাল হয়ে যাবে; যদিও সে জানে যে, আল্লাহ একাজকে হারাম করেছেন? এতে করে কি সেই ব্যক্তি ঐ মুফতি সাহেব বা বিচারককে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণকারী হয়ে যাবে? চাই সে মদ পান করুক না করুক..?
আমরা মনে করি না যে, কেউ ধারণা করবেÑ সেই ব্যক্তি মদপানের মাধ্যমে উক্ত নির্দেশ ও ফাতওয়া বাস্তবায়ন না করলে সে তার আনুগত্যকারী হবে না। বরং যদি সে মদপানকে হালাম মনে করে তাহলে এর দ্বারাই সে নিশ্চিতরূপে আল্লাহর বিপরীতে ঐ মুফতি বা বিচারকের আনুগত্য করলো এবং আল্লাহর পরিবর্তে তাকে রব হিসেবে গ্রহণ করল, চাই সে ফাতওয়া ও নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য মদ পান করুক না করুক।
সুতরাং ভিত্তি হলো নিয়ত ও বিশ^াসের ওপর। নিয়ত ও বিশ^াস ব্যতীত শুধু কর্মের ওপর নয়।
তাদের কাছে আমাদের আরও প্রশ্ন : একজন মুসলিম যে কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করে, যেখানে ইসলামি শরিয়াহর বিধান কার্যকর রয়েছে, সে যদি মদপানকে হারাম মনে করে তা পান করে এবং অপর একজন মুসলিম কোনো সেক্যুলার রাষ্ট্রে মদপান করে, যেখানে হালাল, হারামের কোনো তোয়াক্কা করা হয় না, কিন্তু সে মদপানকে হারাম এবং সেই দেশের আইনকে বাতিল বলে বিশ^াস করে, এ দুই প্রকার ব্যক্তির মধ্যে পার্থক্য কী? কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের কোন দলিলের সাহায্যে আপনারা এ দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করবেন এবং এ কথার বৈধতা দিবেন যে, সে সেক্যুলার রাষ্ট্রে তার আইন মান্য করার কারণে তার আইন প্রণেতাদের আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে?
যদি আপনারা বলেন, যে দেশে ইসলামি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন হয় সেখানে সে সেই আইনের অধীন থাকে এবং তার ওপর শরয়ি দণ্ডবিধি প্রয়োগ হয়, তাহলে এর জবাবে আমরা বলবো, আমাদের কথা হচ্ছেÑ মদ পান করার সময় ঐ ব্যক্তির বিধান কী? এ সম্পর্কে, আর শাস্তি প্রয়োগ করাÑ এটি ভিন্ন বিষয়, এখানে তার ইচ্ছা বা কাজের কোনো দখল নেই; রবং এর দায়িত্বশীল অন্যজন। একজন ব্যক্তির ওপর বিধান আরোপিত হয় তার কর্ম সম্পদানের সময়; অতএব, পরবর্তীতে অন্যজনের কাজের কারণে তার বিধানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হবে না; উপরন্তু সেখানে তার ইচ্ছারও কোনো দখল নেই।
আমরা আরও বলবো, কখনও কখনও মুসলিম ব্যক্তি এমন দেশে মদপান করে যেখানে ইসলামি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন হয়, কিন্তু তার কাজটি প্রকাশ না পাওয়ার কারণে তার ওপর দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হয় না। রাসূলুল্লাহ সা. এমন অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন, যেমন উবাদা ইবনুস সামেত রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, যেখানে বলা হয়েছে :
ومن أتى حدا فأقيم عليه فهو كفارة له، ومن ستره الله عليه فأمره إلى الله، إن شاء عذبه وإن شاء غفر له.
যে ব্যক্তি কোনো হদ্দযোগ্য অপরাধে লিপ্ত হলো, অতঃপর তার ওপর হদ্দ কায়েম করা হলো তাহলে এটি তার জন্য কাফ্ফারা হয়ে গেল। আর যার অপরাধকে আল্লাহ গোপন করলেন তার বিষয়টি আল্লাহর নিকট ন্যস্ত হবে। তিনি চাইলে তাকে শাস্তি দিবেন, অথবা চাইলে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। (সহিহ মুসলিম : ১৭০৯)
এ বিষয়টি একেবারে সুনিশ্চিত, যাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, রাসূল সা. আমাদেরকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়েছেন যে, মানুষের কাজসমূহের বিধান তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, অন্যের নিয়তের ওপর নয়; নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল, অন্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ওপর নয়; নিজের আকিদা—বিশ^াসের ওপর নির্ভরশীল, অন্যের আকিাদা—বিশ^াসের ওপর নয়।
যদি কেউ প্রশ্ন করে, আমরা দুনিয়াতে মানুষের কাজের ওপর বিধান আরোপ করব কী করে, যখন আপনারা বলছেন, নিয়ত হচ্ছে শুধুই অন্তরের কাজ, যে সম্পর্কে সকল গোপন রহস্যের পরিজ্ঞাত মহান সত্তা ছাড়া আর কেউ অবগত হতে পারে না?
এর জবাবে আমরা বলবো, রাসূল সা. আমাদেরকে হুকুম করেছেন, যেন আমরা দুনিয়াতে মানুষের বাহ্যিক অবস্থা ও তার মুখের কথা অনুযায়ী বিধান আরোপ করি। একদিন সাহাবি খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. রাসূলুল্লাহ সা.—কে বললেন, কত মুসল্লি এমন আছে যারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই! তখন রাসূল সা. বললেন,
إنِّي لَمْ أُؤْمَرْ أَنْ أَنْقُبَ عَنْ قُلُوبِ النَّاسِ، وَلَا أَشُقَّ بُطُونَهُمْ.
আমি মানুষের অন্তরের তদন্ত করা এবং তাদের পেট বিদীর্ণ করতে আদিষ্ট হয়নি। (আল—মুহাল্লাহ বিল আছার : খ. ১১, পৃ. ২২০)
পূর্বে আমরা রাসূলুল্লাহ সা.—এর পবিত্র কর্ম দ্বারা দলিল পেশ করেছিÑ যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) সাক্ষ্য প্রদান করে, পরে যদি তার কাজ কথার বিপরীত হয় তাহলে সে গোনাহগার হবে এবং ধরা হবে, সে তার বক্তব্যের বিপরীত করাকে বৈধ মনে করেনি এবং তাকে অস্বীকারও করেনি। কিন্তু যদি সে মুখে এমন কথা বলে যা সরাসরি তার অস্বীকার এবং বক্তব্যের বিপরীত কাজকে বৈধ জ্ঞান করা বুঝায় তবে বিষয়টি এর ব্যতিক্রম।
সুতরাং যখন আমাদের আলোচনা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের সা.—এর মাধ্যমে বিশুদ্ধ প্রমাণিত হলো, তখন এ কথাও নিশ্চিতরূপে সাব্যস্ত হলো যে, আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের যে দলের ওপর লানত করেছেন, যেহেতু তারা উযায়ের ও মাসিহকে আল্লাহর পরিবর্তে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা ছিল ঐ দলভুক্ত যারা উযায়ের আ.—কে আল্লাহর পুত্র এবং মাসিহ আ.—কে আল্লাহর পুত্র বলে জ্ঞান করেছিল অথবা তাদের ধর্মযাজক ও সংসার বিরাগীদের অনুসরণ ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য করাকে ওয়াজিব মনে করতো; যদিও তা আল্লাহ তাআলা আদেশের খেলাফ হোক না কেন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়া তাঁর রচিত ‘কিতাবুল ঈমানে’ বলেন, রবি’ বিন আনাস বলেন, আমি আবুল আলিয়াকে বললাম, বনি ইসরাঈলের মধ্যে সেই রুবুবিয়াতের ধরন কী ছিল? তিনি বললেন, সেই রুবুবিয়াতের ধরন ছিল, তারা যদি কিতাবুল্লাহয় কোনো কাজের আদেশ ও নিষেধ পেত তাহলে তারা বলত, আমরা আমাদের পণ্ডিতদের চেয়ে আগে বেড়ে কিছু করব না। তারা যা আদেশ করেন আমরা তাই করব, তারা যা নিষেধ করেন আমরা তাদের কথা অনুযায়ী তা পরিহার করব। এভাবে তারা কিতাবুল্লাহকে তাদের পিছনে ফেলে মানুষকে তাদের কল্যাণকামী মনে করতো।
তিনি আরও বলেন, এসকল লোকেরা তাদের পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদেরকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে, যেহেতু তারা আল্লাহ কর্তৃক হারামকৃত জিনিসকে হারাম করতো এবং আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত জিনিসকে হারাম করতো, অতঃপর তারা তার আনুগত্য করতো। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দুটি শ্রেণি ছিল :
(এক) তারা জানত যে, পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীরা আল্লাহর দীনে পরিবর্তন করেছে। এ কথা জানা সত্ত্বেও তারা তাদের অনুসরণ করতো। এভাবে সাধারণ পাবলিক তাদের নেতারা রাসূলের আনীত দীনের বিরোধিতা করছে জেনেও তাদের অনুসরণ করতো এবং আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত জিনিসকে হালাল এবং আল্লাহ কতৃর্ক হালালকৃত জিনিসকে হারাম বলে বিশ^াস করতো। এটি হচ্ছে কুফর। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এটিকে শিরক বলেও অভিহিত করেছেন; যদিও তারা তাদের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করতো না, তাদেরকে সিজদা করতো না। অতএব, কেউ যদি দীনের বিরোধী কাজে অন্যের অনুসরণ করে এ কথা জানা সত্ত্বেও যে, সে দীনের বিরোধিতা করছে এবং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বক্তব্যকে পরিহার করে তার বক্তব্যকে বিশ^াস করে তাহলে এর দ্বারা সে ঐ সকল লোকদের ন্যায় মুশরিক হয়ে যাবে।
(দুই) তারা হালালকে হালাল ও হারামকে হারামই বিশ^াস করতো; কিন্তু তারা আল্লাহর নাফরমানি হয় এমন কাজে তাদের অনুসরণ করতো, যেমন বর্তমানে অনেক মুসলিম পাপ কাজকে পাপ মনে করেই তাতে লিপ্ত হয়, তাদের বিধান বর্তমান কালের পাপী মুসলিমদের মতই। ”
আর আল্লাহ তাআলার বাণী :
{إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ يُضَلُّ بِهِ الَّذِينَ كَفَرُوا يُحِلُّونَهُ عَامًا وَيُحَرِّمُونَهُ عَامًا لِيُوَاطِئُوا عِدَّةَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَيُحِلُّوا مَا حَرَّمَ اللَّهُ زُيِّنَ لَهُمْ سُوءُ أَعْمَالِهِمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ.
আর মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কেবল কুফরি বৃদ্ধি করে, যা দ্বারা কাফেরদেরকে পথভ্রষ্ট করা হয়। তারা এটাকে এক বছর হালাল করে এবং আরেক বছর হারাম করে, যাতে তারা আল্লাহ যা হারাম করেছেন তার সংখ্যা ঠিক রাখে, ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা তারা হালাল করে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে। আর আল্লাহ কাফের কওমকে হেদায়াত দান করেন না। (সূরা তাওবা : ৩৭)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে কাছির বলেন, “এখানে আল্লাহ ঐ সকল মুশরিকদের নিন্দা করেছেন যারা আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর মধ্যে নিজেদের ভ্রান্ত মত অনুযায়ী হস্তক্ষেপ করে এবং কুপ্রবৃত্তি দ্বারা আল্লাহর বিধানসমূহকে পরিবর্তন করে। আল্লাহ যে বিষয়কে হারাম করেছেন তারা তাকে হালাল করে এবং আল্লাহ যে বিষয়কে হালাল করেছেন তারা তাকে হারাম করে। কারণ, তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতার দাপট, গোত্রপ্রীতি, দুঃসাহস ও গেঁাড়ামি।
তাদের প্রয়োজন পূরণে যে লাগাতার তিন মাসের নিষিদ্ধতা আরোপ করা হয়েছিল তারা এ সময়কে দীর্ঘ জ্ঞান করেছিল। ফলে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তারা হারাম মাসকে হালাল করার পন্থা আবিষ্কা করেছিল। যেমনÑ তারা মুহাররম মাসের পরিবর্তে সফর মাসকে হারাম বানিয়ে নিয়েছিল। এভাবে তারা হারাম মাসকে হালাল করতো এবং হালাল মাসকে হারাম করতো, যাতে করে এর দ্বারা আল্লাহর দেওয়া চার মাস পূর্ণ হয়। যেমনÑ তাদের একজন কবি উমায়ের ইবনে কায়েস [যিনি জাযলুত তা’আন নামে পরিচিত] বলেন,
لقد علمت معد أن قومي … كرام الناس أن لهم كراما
ألسنا الناسئين على معد … شهور الحل نجعلها حراما
মা’দ গোত্র জানেÑ আমার কওম মানুষের মধ্যে মর্যাদাশীল; কারণ, তাদের মধ্যে রয়েছে মযাদাশীল ব্যক্তিবর্গ।
আমরা কি মা’দের জন্য হালাল মাসসমূহকে বিলম্বিত করিনি, ফলে সেগুলোকে আমরা হারাম করে দিতাম।
আলী ইবনে আবি তালহা ইবনে আব্বাস রা. থেকে নিম্নোক্ত আয়াত সম্পর্কে বর্ণনা করেন, إِنَّمَا النَّسِيءُ زِيَادَةٌ فِي الْكُفْرِ (আর মাসকে পিছিয়ে দেওয়া কেবল কুফরি বৃদ্ধি করে), এ বিলম্বিতকারী হলো জুনাদা ইবনে আওফ ইবনে উমাইয়া আল—কিনানি। সে প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে উপস্থিত হতো [তার উপনাম ছিল আবু ছুমাম], অতঃপর সে ঘোষণা করতো,
“হে লোক সকল! আবু ছুমামাকে কোনো জবাব প্রদান করা হয় না এবং তাকে নিন্দাও করা হয় না। জেনে রাখ, আগামী বছরের সফর মাসটি হালাল।” এভাবে সে সফর মাসকে এক বছর মানুষের জন্য হালাল করে দিত, আবার আরেক বছর তাকে হারাম করে মুহাররম মাসকে হারামের তালিকা থেকে বাদ দিত। (তাফসিরে ইবনে কাছির : খ. ২, পৃ. ৩৫৬)
এখানেও স্পষ্টত কাজ পাওয়া যায়নি, বরং তার মুখের কথা এবং আল্লাহ প্রদত্ত সুপরিচিত ও সুস্পষ্ট শরিয়াহর মধ্যে পরিবর্তনের ওপর ঐকমত্য পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত মাসকে হালাল মনে করা এবং আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত মাসকে হালাল মনে করার বিষয়টি পাওয়া গিয়েছে।
এছাড়া হারাম মাসসমূহে যারা যুদ্ধ করতো তারা বিলম্বিতকারী নয়, এমনিভাবে যারা অন্য মাসসমূহে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকত তারাও বিলম্বিতকারী নয়; বরং বিলম্বিতকারী সেই যে এ কথার ঘোষণার করবে, ঐকমত্য পোষণ করবে, অথবা হারাম মাসসমূহের যেকোনো একটিতে যুদ্ধ করাকে বৈধ মনে করবে এবং এর পরিবর্তে অন্য একটি হালাল মাসে যুদ্ধ করাকে হারাম মনে করবে।
যেমনটি আপনি দেখেছেন যে, কবি গর্ব করে [আল্লাহ আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন] বলছে, তার কওম আল্লাহর শরিয়াহকে পরিবর্তন করে নতুন শরিয়াহ প্রণয়ন করেছিল। কবির ভাষ্যের প্রতি খেয়াল করুন :
ألسنا الناسئين على معد … شهور الحل نجعلها حراما
আমরা কি মা’দের জন্য হালাল মাসসমূহকে বিলম্বিত করিনি, ফলে সেগুলোকে আমরা হারাম করে দিতাম।
এক্ষেত্রে আমাদের মাযহাব হলো [যা আমরা আল্লাহর দীন হিসেবে পালন করি], যে ব্যক্তি তার কাছে আল্লাহর শরিয়াহর বিধান পেঁৗছার পরও জোর—জবরদস্তি ব্যতীত স্বেচ্ছায় তার খেলাফ করাকে অথবা শরিয়াহর কোনো বিধানে পরিবর্তন করাকে বৈধ মনে করবে, তার জানা মতে আল্লাহ যে বিষয়কে হারাম করেছেন তাকে হালাল করা কিংবা আল্লাহ যে বিষয়কে হালাল করেছেন তাকে হারাম করার ইচ্ছা করবে সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
আর সূরা আলে ইমরানের নিম্নোক্ত আয়াত :
{قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ (৩১) قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ.
বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান : ৩১—৩২)
এর জবাব হলো, কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশের দাবি অনুযায়ী কাজ করলেই সে আনুগত্যকারী ও অনুসরণকারী হবে না, যদি তার অন্তরে এ কাজের দ্বারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আদেশ পালনের নিয়ত না থাকে। যেমনÑ রাসূল সা. বলেছেন, মানুষের কর্ম নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে।
এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ ও নিষেধের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে আদিষ্ট। সে ছোট গোনাহকে সহজ মনে করবে না এবং বড় গোনাহেরও দুঃসাহস করবে না। কেউ যদি আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ ও নিষেধের ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণকে ওয়াজিব বলে বিশ^াস না করে তাহলে সে অস্বীকারকারী কাফের ও মুশরিক। রাসূল সা.—এর নিম্নোক্ত ভাষ্য অনুযায়ী তার ঈমান চলে যাবে :
أمرت أن أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَيُؤْمِنُوا بِي، وَبِمَا جِئْتُ بِهِ.
আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমার প্রতি এবং আমার আনীত বিষয়ের প্রতি ঈমান আনয়ন করে।
মহান আল্লাহ, যিনি স্বীয় বান্দাদের ওপর বিশাল দয়া ও অনুগ্রহ করে এ বিধান দিয়েছেন তিনি নিয়ত ও কর্মের মধ্যে পার্থক্য করে দিয়েছেন। আর যে ব্যক্তি তাঁর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং তিনি আপন প্রতিপালকের নিকট থেকে ওহি স্বরূপ যে দীন আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন তার প্রতি ঈমান আনবে; কিন্তু তার কোনো কাজ রবের নির্দেশের খেলাফ হবে, মহান আল্লাহ তাকে কাফের ও মুশরিক আখ্যা দেননি। তবে ঐ ব্যক্তি এর ব্যতিক্রম, যার কাজের ব্যাপারে শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য আছে যে, এর কর্তা কালিমার সাক্ষ্যদান সত্ত্বেও তার ঈমান চলে যাবে।
পূর্বে আমরা কুফর ও নাফরমানির মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করেছি এবং কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সা. থেকে এর স্বপক্ষে দলিল বর্ণনা করেছি। এখন আর নতুন করে বাড়তি আলোচনার প্রয়োজন নেই। অতএব, এ কথা নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হলো যে, আল্লাহ তাআলার বাণী :
قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ.
“আপনি বলুন, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন, আল্লাহ কাফেরদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আলে ইমরান : ৩২) এখানে কাফের দ্বারা ঐ সকল লোক উদ্দেশ্য যারা ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও অন্তরের বিশ^াসের সাথে মুখে কালিমা উচ্চারণ করতে অস্বীকার করেছে, অথবা ইসলাম গ্রহণের পর সে প্রতিশ্রম্নতি ভঙ্গ করেছে এবং ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছে।
আর সূরা আনআমের আয়াত :
وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَى أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ.
যে জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তার কিছুই তোমরা আহার করো না, নিশ্চয় তা পাপ। নিশ্চয় শয়তানেরা তার বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়। যদি তোমরা তাদের অনুসরণ কর তাহলে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে। (সূরা আনআম : ১২১)
আমরা আনুগত্যের (الطاعة) যে শরয়ি অর্থ বর্ণনা করেছি তা এবং “প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করবে” এ সংক্রান্ত হাদিসটি সামনে রাখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উক্ত আয়াত দ্বারা দলিল প্রদান সঠিক নয়। আরও স্পষ্ট যে, শয়তানের বন্ধুরা হারামের যুক্তি নিয়ে তর্ক করতো। বিভিন্ন বর্ণনায় এ কথাই উল্লেখ আছে। যেমন ইবনে কাছির ও কুরতুবি র. বলেন, “মুশরিকরা মুসলিমদের সাথে তর্ক করে বলতো, আল্লাহ যে প্রাণীকে হত্যা করেছেন তোমরা তা খাও না, অথচ তোমরা নিজেরা যা হত্যা কর তা খাও!”
আয়াতে বর্ণিত মুজাদালা (المجادلة) শব্দের অর্থ হচ্ছে, অন্যের কথাকে মজবুত দলিলের সাথে প্রত্যাখ্যান করা। (আল—জামে লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবি : খ. ৭, পৃ. ৭৭)
আয়াতের শাব্দিক গঠন ও পূর্বাপর আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয়, আল্লাহ তাআলার বাণী : وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ : যদি তোমরা তাদের অনুসরণ কর তাহলে তোমরা অবশ্যই মুশরিক হবে। (সূরা আনআম : ১২১) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তারা যে বিতর্ক করেছে তার প্রতি নিজেদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করা। এ কারণে ইমাম কুরতুবি বলেন, “যদি তোমরা তাদের অনুসরণ কর” অর্থাৎ, মৃত জন্তুকে হালাল মনে করার ক্ষেত্রে।
আমাদের বক্তব্যও তাই। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহ কতৃর্ক হারামকৃত জিনিসকে হালাল করার বিষয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও আনুগত্য করলো যেন তার রবকে মিথ্যারোপ করলো এবং এ সম্পর্কে তার যে শরিয়ার বক্তব্য জানা আছে তাকে অস্বীকার করলো। অতএব, সে নির্দ্বিধায় কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
ইবনুল আরাবি বলেন, “মুমিন মুশরিকের আনুগত্য করলে সেও মুশরিক হয়ে যায়, যখন তার এ আনুগত্য হবে বিশ^াসের ক্ষেত্রে। যদি সে কর্মের ক্ষেত্রে আনগত্য করে; যখন সে সুস্থ বিবেকের অধিকারী হয়, একত্ববাদের ওপর অটল থাকে এবং তার সত্যায়ন করে তাহলে সে গোনাহগার হবে। বিষয়টি খুব ভালো করে বুঝতে হবে।” (আল—জামে লিআহকামিল কুরআন, কুরতুবি : খ. ৭, পৃ. ৭৭, ৭৮)
ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যও এর অনুরূপ, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ইসলামি হুকুমাত, সত্যনিষ্ঠ ইমাম, শ্রবণ, আনুগত্য, শাসন ও বিচারক নির্ধারণ এবং দীনের আবশ্যিক জ্ঞানের অর্থ
আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ.
আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন। (সূরা হাজ্জ : ৪১)
ইসলামি হুকুমাত
ইসলামি হুকুমাত এর সংজ্ঞা : ইতঃপূর্বে আমরা বলে এসেছি, দীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এখন কারও জন্য তার মধ্যে সংযোজন বা বিয়োজনের কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহর শরিয়াহ পূরিপূর্ণ হয়েছে। মানুষের ওপর আল্লাহর নিয়ামত পরিপূর্ণ হওয়া এবং শরিয়াহ পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পর তাদের জন্য বাড়তি শরিয়াহর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا.
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা : ৩)
আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর মধ্যে পরিবর্তন করার সাধ্য কারও নেই :
وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا.
সত্য ও ন্যায়ের দিক থেকে আপনার প্রতিপালকের বাণী পরিপূর্ণ। (সূরা আনআম : ১১৫)
আমরা পূর্বে আরও বলেছি, আল্লাহ যে বিষয়কে হালাল করেছেন এবং ওহির দরজা বন্ধ হওয়া ও রাসূল সা.—এর ওফাতের মাধ্যমে তার হালাল হওয়ার বিষয়টি চিরন্তনভাবে সাব্যস্ত হয়েছে তা কিয়ামত অবধি হালালই থাকবে। কোনো সৃষ্টি Ñসেই যেই হোক না কেনÑ তাকে হারাম করতে পারবে না। আর ওহির দরজা বন্ধ হওয়া এবং রাসূল সা.—এর ওফাতের মাধ্যমে যে জিনিসের চিরন্তন হারাম হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে তা কিয়ামত অবধি হারামই থাকবে। কোনো সৃষ্টি Ñসেই যেই হোক না কেনÑ তাকে হালাল করতে পারবে না। এমনিভাবে আল্লাহ যেসকল কাজকে ফরয করেছেন, যেসব কাজকে নিষিদ্ধ করেছেন কোনো সৃষ্টি তাতে কোনো ধরনের পরিবর্তন—পরিবর্ধন করতে পারবে না।
আমরা পূর্বে আরও আলোচনা করেছিÑ আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর জন্য তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বহু বিষয় এমন রেখেছেন, যেগুলোর শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনার জন্য তারা ইজহিতাদ ও গবেষণা করে নীতিমালা প্রণয়ন করবে। এটাকে আইন, বিধান বা সিদ্ধান্ত বা অন্য যে নামেই নামকরণ করা হোক না কেন। আমরা স্পষ্ট উল্লেখ করেছি, এসব ক্ষেত্রে শর্ত হলো, কোনো হারামকে হালাল অথবা কোনো হালালকে হারাম করা যাবে না। আমরা আরও আলোচনা করেছিÑ আমাদের এ আইন প্রণয়ন কেবল কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নের জন্য, আল্লাহ তাআলা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং আমাদেরকে তা বাস্তবায়নের আদেশ করেছেন। সুতরাং এগুলো মূলত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপকরণ ও মাধ্যম, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যার আদেশ করেছেন, ফলে তা মূলত আল্লাহ তাআলার আদেশেরই বাস্তবায়ন।
আমরা আরও বলেছি, আমাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা শুধু এটা নয় যে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের স্বীকৃতি দেবো; কিন্তু তাঁর আদেশ ও নিষেধগুলো মেনে চলবো না। বরং আমরা আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্য ওয়াজিবÑ এ বিশ^াসের সাথে কার্যত আনুগত্য প্রদর্শন করতে। আর তার পদ্ধতি হলো, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়তে যেসকল আদেশ, নিষেধ, ফরয, বৈধ ইত্যাদি বিষয় রয়েছে, সেসবের বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো এবং এসব বিষয়কে ভূ—পৃষ্ঠে বাস্তব রূপদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা।
যখন প্রকৃত বিষয়টি এরকমই, কাজেই তার দাবি হলো, ইসলামি হুকুমাত নতুন শরিয়াহ প্রবর্তন কিংবা মানুষের কল্যাণে নিজে থেকে নতুন করে লক্ষ্য—উদ্দেশ্য নির্ধারণে বাধ্য নয়। শুধু বাধ্য নয়, তা নয়; বরং এটি নিষিদ্ধ কাজ। কারণ, এমনটি করতে গেলে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর বিধান লঙ্ঘিত হবে এবং তার মধ্যে পরিবর্তন—পরিবর্ধন সাধিত হবে।
এ কারণে ইসলামি হুকুমাত বা সত্যনিষ্ঠ ইমাম ঐ হুকুমাতকেই বলা হবে, যার ভিত্তি হলো দীনে ইসলাম এবং তা শরিয়াহর বিধি—বিধান বাস্তবায়ন ও দীন সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে।
আবুল হাসান মাওয়ারদি তাঁর ‘আল—আহকামুস সুলতানিয়া’ গ্রন্থে বলেন,
“ইমামতের লক্ষ্য—উদ্দেশ্য হলোÑ দীনের হেফাজত ও দুনিয়ার শাসনের ক্ষেত্রে নবুওয়াতের প্রতিনিধিত্ব করা।”
আল্লামা তাফতাযানি ইমামতের সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইমামত হলোÑ নবীজি সা.—এর প্রতিনিধি হিসেবে দীন ও দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়ে ব্যাপক নেতৃত্ব।
ড. মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রঈস মাওয়ারদি কতৃর্ক প্রদত্ত সংজ্ঞার টীকায় বলেন, এ সংজ্ঞার অধীনে তিনটি উপাদান রয়েছে : ১. ইমামত হলো নবুওয়াতের প্রতিনিধিত্ব। ২. ও ৩. এ প্রতিনিধিত্বের উদ্দেশ্য হলো, প্রথমত দীনের হেফাজত করা এবং দ্বিতীয়ত দুনিয়া শাসন করা। আরও লক্ষণীয়Ñ শেষ উপাদানের উল্লেখ এ কথা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, ইমাম মাওয়ারদি [যিনি ছিলেন বাগদাদের প্রধান বিচারপতি এবং শাফেয়ি মাযহাবের অন্যতম ফকিহ] মনে করতেন, নবুওয়াতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দুনিয়া শাসন করা। এ কারণে এ ক্ষেত্রে রাসূল সা.—এর প্রতিনিধি থাকা আবশ্যক। আর মাওয়ারদির সংজ্ঞায় যে ‘দীনের হেফাজত’ কথাটি আছে, এর দ্বারা বুঝা যায়Ñ ইমামের দায়িত্ব হলো, দীনের হেফাজত ও সংরক্ষণ করা এবং তার থেকে সকল আক্রমণকে প্রতিহত করা। অর্থাৎ, দীনের মধ্যে নতুন করে ব্যাখ্যা করা অথবা পরিবর্তন তার দায়িত্বের অন্তভুর্ক্ত নয়। এ বিষয়টিও এ হেফাজতের অন্তভুর্ক্ত যে, ইমাম তার সকল কাজ ও তৎপরতা দ্বারা প্রমাণ করবেন, তিনি দীনের হেফাজতকারী এবং বিধানসমূহ পালনকারী।
ইমাম ইবনে খালদুন শাসন ব্যবস্থার পরিচিতি অলোচনা করতে গিয়ে বলেন, শাসন ব্যবস্থা তিন প্রকার :
(এক) স্বভাবগত শাসন বা রাজত্ব। আর তা হলো, রাজার মনোবাঞ্ছা ও প্রবৃত্তির দাবি অনুযায়ী রাজ্যের সকল মানুষকে পরিচালিত করা।
(দুই) গণতান্ত্রিক শাসন বা রাজত্ব। আর তা হলো, জাগতিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ ও ক্ষতি দূরীকরণে সকল মানুষকে বিবেক ও যুক্তির দাবি অনুযায়ী পরিচালিত করা।
(তিন) ইসলামি খিলাফত বা সত্যনিষ্ঠ ইমামত। আর তা হলো, ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিতকরণে সকল মানুষকে শরিয়ার বিধান অনুযায়ী চালিত করা। কারণ, শরিয়াহ প্রণেতার নিকট পরকালীন কল্যাণ বিবেচনায় দুনিয়ার অবস্থা ধর্তব্য হয়। কাজেই মূলত ইসলামি খিলাফত হচ্ছে, শরিয়াহ প্রণেতার পক্ষ থেকে দীনের হেফাজত ও দুনিয়ার শাসন।
এরপর ইবনে খালদুন আরও বলেন, এ সকল শাসন ব্যবস্থা থেকে যেটি জোরজবরদস্তি, বলপ্রয়োগ ও আগ্রাসী নীতিতে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তা পাপ ও সীমালঙ্ঘন। আর যেখানে গণতান্ত্রিক আইন ও শাসন প্রয়োগ করা হয় তাও নিন্দনীয়। কারণ, তা আল্লাহর নূর ব্যতীত দর্শন :
{وَمَنْ لَمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِنْ نُورٍ } [النور: ৪০]
“আর আল্লাহ যাকে জ্যোতি দান করেন না, তার জন্য কেনো জ্যোতি নেই।” (সূরা নূর : ৪০) কারণ, শরিয়াহপ্রণেতা সকল মানুষের আখেরাতের কল্যাণ সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত, যা তাদের থেকে অদৃশ্য। আর মানুষের সকল কর্ম পরিণতিতে তাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করেÑ তা রাজত্ব ও শাসন বিষয়ক হোক বা অন্য কিছু। রাসূল সা. বলেছেন :
إنما هى أعمالكم ترد عليكم
“এসব তোমাদেরই কর্ম, যা তোমাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করে।” (দ্র. মুকাদ্দামা ইবনে খালদুন, আন—নাযরিয়্যাতুস সিয়াসিয়্যাহ হতে উদ্ধৃত)
‘আন—নাযরিয়্যাতুস সিয়াসিয়্যাতুল ইসলামিয়্যা’ প্রণেতা ড. মুহাম্মাদ জিয়াউদ্দিন রঈস ফকিহগণের বিভিন্ন মত উল্লেখ করার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ইমামত এর প্রকৃত সংজ্ঞা হলো, “শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি শাসন।” অর্থাৎ, ঐ হুকুমাত যার আইন হলো ইসলামি শরিয়াহ, তথা তার সংবিধান বা আইনের প্রধান উৎস হলো, ইসলামি শরিয়াহ। আর তার শাখাগত আইন হলো, শরয়ি বিধিবিধানের সমষ্টি, যা দ্বারা উম্মাহর জীবনাচারে শৃঙ্খলা বিধান করা হয়। সেই বিধানগুলো আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত হোক বা ব্যক্তিগত অবস্থা সম্পর্কিত অথবা ফৌজদারি অপরাধ কিংবা অন্য কোনো বিষয় সংক্রান্ত। এ সংবিধানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা।
অতএব, ইসলামি হুকুমাত কোনো স্বভাবগত আইন ও শাসন নয়, যেখানে এক ব্যক্তির স্বভাব ও চাহিদাকে আইন মনে করা হয়, যা তার প্রবৃত্তির তাড়না ও ব্যক্তিগত প্রবণতা হতে উৎসারিত। যা স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আইন এবং কাক্সিক্ষত সম্মান, সম্পদ অথবা ক্ষমতা লাভের জন্য মানুষের ওপর দমন—পীড়নের সাতকাহন। আরও সহজে বলতে গেলে বলা হবে, ঐ শাসন যার ঝেঁাক হলো প্রবৃত্তি ও কামনা বাসনা।
এমনিভাবে ইসলামি হুকুমাত কোনো গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও নয়। কারণ, গণতান্ত্রিক শাসন হচ্ছে এমন কিছু বিধান ও আইনের সমষ্টি যা প্রণয়ন করে এবং তার ওপর ঐকমত্য পোষণ করে দেশের শাসকবর্গ, বিচারকগণসহ অন্যান্য জ্ঞানী ও শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, যা দ্বারা কেবল জাগতিক কল্যাণ সাধনই উদ্দেশ্য হয়। অথবা অন্য ভাষায় বলতে গেলে যাকে ‘বস্তুবাদ’ বলা যেতে পারে, যেখানে দৃষ্টি থাকে কেবল পার্থিব জগত ও তার সৃষ্টির সীমানার মধ্যেই, আর সেই বিধান প্রণয়নের মানদণ্ড হলো, মানুষের কল্যাণ ও উপকার। বিপরীতে ইসলামি হুকুমাত হচ্ছে, ঐ শাসন ব্যবস্থা যার আইন হচ্ছে ইসলামি শরিয়া, যা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ হতে গৃহীত।
আমরা মনে করি, পূর্বে আমরা ইসলামি হুকুমাত বা সত্যনিষ্ঠ ইমামত সম্পর্কে যে আলোচনা করেছি, তা ইসলামি হুকুমাতের এসব সংজ্ঞাকে অন্তর্ভুক্ত করে। অর্থাৎ, “ঐ হুকুমাত যার ভিত্তি হলো দীনে ইসলাম এবং তা শরিয়াহর বিধি—বিধান বাস্তবায়ন ও দীন সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে।”
সুতরাং শরিয়ার বিধানসমূহই আমাদেরকে দীনের হেফাজত ও তার প্রতিরক্ষা, ভূ—পৃষ্ঠে মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিতকরণ, তাদের ওপর কৃত বৈরিতা প্রতিহত করা, আল্লাহর দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়া এবং আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে আদেশ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ.
তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাক, যতক্ষণ না ফিতনা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দীন সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা আনফাল : ৩৯)
ইসলামি শরিয়া আমাদের জন্য শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্কের ধরন নির্ধারণ এবং ব্যক্তি ও সমাজের অধিকার নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তা পালন করতে আদেশ করে। ইসলামি শরিয়া আমাদের জন্য সমাজ জীবন ও অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনা এবং মুসলিম উম্মাহর অন্যান্য জাতি—গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক কেমন হবে, এর জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রদান করেছে। এছাড়াও ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে অন্য সকল বিষয়ে যে বিধান প্রদান করেছে তার অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে আদেশ করে। কারণ, ইসলামি শরিয়া এসব কিছুর মধ্যে অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে এবং ব্যক্তি ও জাতির ইহকালীন জীবন ও পরকালীন গন্তব্যের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে।
ইসলামি শরিয়া এসব বিষয়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। কাজেই এসবের প্রতি বিশ^াস করতে হবে, সে অনুযায়ী আমল করতে হবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর নির্দেশ পালনার্থে এসবের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। একাগ্রচিত্তে তাঁর সামনে নত হতে হবে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করতে হবে। কারণ, কোনো ব্যক্তির কাজ তার ও মানুষের জন্য যতই উপকারী হোক না কেন, সেই আমলকে আল্লাহ কেবল তখনই কবুল করবেন, যখন তা আল্লাহর বিধান মত এবং কেবল তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে করা হবে।
এসব কিছুই নিম্নে বর্ণিত সারগর্ভমূলক পবিত্র আয়াতে সন্নিবেশিত আছে :
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ.
আমি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে থেকে নিষেধ করবে, আর সকল কাজের পরিণাম আল্লাহর ইচ্ছাধীন। (সূরা হাজ্জ ৪১)
আমরা যে আলোচনা করেছি তা ইসলামি হুকুমাত ও সত্যনিষ্ঠ ইমামতের সারমর্ম এবং এ ব্যাপারে সকল ফকিহ একমত। তাছাড়া এর সমর্থনে রয়েছে অকাট্য দলিলসমূহ।
ইমাম মুসলিম হওয়া শর্ত, তার দলিল আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَلَنْ يَجْعَلَ اللَّهُ لِلْكَافِرِينَ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا.
আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোনো পথ রাখবেন না। (সূরা নিসা : ১৪১) আর তার সবচেয়ে বড় পথ হলো, কোনো কাফের মুসলিমদের ইমাম হয়ে তাদের বিষয়াশয় পরিচালনা করা। যেহেতু ইমাম দীনের হেফাজত এবং শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল, তাই ইমামকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।
এমনিভাবে ইমামকে প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। কারণ, যে শিশু এখনও বালেগ হয়নি, তার নিজের ওপরই শরিয়ার বিধান নেই, অথচ ইমাম হলো শরিয়াহর বিধান বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল। কাজেই ইমাম হওয়ার জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক ও জ্ঞানী হবে।
এমনিভাবে ইমামুল মুসলিমিন পুরুষ হতে হবে। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন :
لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ أَسْنَدُوا أَمْرَهُمْ إلَى امْرَأَةٍ.
ঐ সম্প্রদায় কখনও সফল হবে না, যারা কোনো নারীর প্রতি তাদের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। (আল—মুহাল্লা, ইবনে হাযম : খ. ৯, পৃ. ৩৬০)
এছাড়াও আরও কিছু শর্ত আছে, যেগুলো সম্পর্কে ফকিহগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমনÑ ইমাম কুরাইশ বংশের হওয়া, তার মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা থাকা, শরিয়াহর জ্ঞান থাকা এবং ইজতিহাদের যোগ্য হওয়া। আরও শর্ত হলো, প্রকাশ্য গোনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত না হওয়া। অনুরূপভ ইমাম নির্বাচণের পদ্ধতি ও বায়আতের শর্ত সম্পর্কেও ইমামগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
ইসলামি হুকুমাতের আবশ্যিকতা
ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা ও ইমামুল মুসলিমিন নিয়োগ করা ফরয। কারণ, ইমামুল মুসলিমিন আল্লাহর বিধানাবলি পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করবেন, রাসূল সা. আনীত শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী উম্মাহকে পরিচালিত করবেন। এটি ফরয হওয়ার বিষয়টি শরিয়াহর সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত এবং এর ওপর মুসলিমদের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রাসূল সা.—এর ওফাতের পর সকল সাহাবি এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, দীনের হেফাজত ও শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়নের জন্য রাসূল সা.—এর খলিফা হিসেবে একজন ইমামুল মুসলিমিন থাকতে হবে। যদিও শুরুতে ব্যক্তি নির্ধারণে মতভেদ হয়েছিল; কিন্তু কেউ এমন বলেননি যে, খলিফা নিয়োগের প্রয়োজন নেই। পরবর্তীতে রাসূল সা.—এর খলিফা এবং ইমামুল মুসলিমিন হিসেবে আবু বকর সিদ্দিক রা.—কে মনোনীত করার ব্যাপারে সকলে একমত হয়।
যেহেতু বনু সায়িদার সভাগৃহে কিছু সংখ্যক মুহাজির ও আনসার সাহাবির উপস্থিতিতে আবু বকর রা.—কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করা হয়, যেমনটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে এবং সেই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন এবং খলিফা মনোনয়ের দায়িত্ব পালন করেন তারা ছিলেন মুহাজির ও আনসার সাহাবিগণের মধ্যে প্রভাবশালী, মান্যবর এবং তাদের কওম ও গোত্রের সঠিক প্রতিনিধিত্বকারী; কিন্তু বিষয়টি এখানেই সীমিত ছিল না; বরং আবু বকর সিদ্দিক রা. মসজিদের নববিতে সকল সাহাবির উপস্থিতিতে খেলাফতের বিষয়টি উপস্থাপন করেন এবং সেখানে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তার ভাষ্য মোটামুটি এরূপÑ
“নিশ্চয় মুহাম্মাদ সা. সুপথ রচনা করে গেছেন, এখন সেই গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়ার জন্য একজন দায়িত্বশীল থাকা জরুরি। কাজেই বিষয়টি আপনারা চিন্তা করুন এবং নিজেদের মতামত প্রদান করুন।”
তখন মসজিদের সকল প্রান্ত থেকে লোকজন বলে উঠল, হে আবু বকর আপনি সত্য বলেছেন। সেদিন এমন একজন ব্যক্তিও পাওয়া যায়নি যে বলবে, উম্মত নিজে থেকেই শুধরে যাবে, তার জন্য দায়িত্বশীল ইমাম নিয়োগের প্রয়োজন নেই, অথবা দীনের হেফাজতের জন্য কোনো দায়িত্বশীল থাকার প্রয়োজন নেই। [আন—নাযরিয়্যাতুস সিয়াসিয়্যা]
অতএব, মুসলিম জাতির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শ্রেণি [সাহাবায়ে কেরাম]—এর মধ্যে এ বিষয়ে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ইমামত ও ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা ওয়াজিব।
অতঃপর উমর ইবনুল খাত্তাব ও উসমান ইবনু আফ্ফান রা.—এর হাতে বায়আতের সময় পুনরায় এ ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর উসমান রা.—এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী ইবনে আবু তালেব রা. ও মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান রা.—এর মধ্যে যে বিরোধ সংঘটিত হয়েছিল তা ইমাম নির্ধারণের আবশ্যিকতার বিষয়ে ছিল না। বরং দুই দলের কেউই এর আবশ্যিকতা এবং দীনের হেফাজত ও বিধানাবলি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দ্বিমত করতো না। বরং তাদের দ্বিমত ছিলÑ উসমান রা.—এর হত্যাকারীদের বিচার এবং আলী রা.—এর বায়আতের শুদ্ধতার ব্যাপারে।
অতঃপর আলী রা.—এর খেলাফত পরবর্তী বিভিন্ন ইসলামি দলের আত্মপ্রকাশের পরও মুসলিমগণ ইমামুল মুসলিমিন নিয়োগের আবশ্যিকতার ওপর একমত পোষণ করেছেন। যেমনÑ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকলে এ ব্যাপারে একমত, এমনিভাবে শিয়া, মুতাযিলা, মুরজিয়া ও খারেজি। তবে খারেজিদের মধ্য হতে নজদিরা এর ব্যতিক্রম, যারা মনে করেÑ মানুষের দায়িত্ব হলো, তারা নিজেরা পরস্পরের অধিকার রক্ষা করবে। তারা ইমাম নিয়োগ করাকেও বৈধ মনে করে; কিন্তু এটাকে তারা ফরয মনে করে না। তবে আল্লাহর মেহেরবানি যে, এ দলটি বর্তমানে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সেই ইজমা শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তেমনি একটি বক্তব্য হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
{يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ.
হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য হতে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের। (সূরা নিসা : ৫৯)
সুতরাং এ আয়াতে ক্ষমতাশীলদের আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মুসলিমদের মধ্যে কিছু ক্ষমতাশীল ব্যক্তি থাকতে হবে, যাদের আনুগত্য ওয়াজিব হবে।
আরেকটি দলিল হলো, হাদিস শরিফ :
وإنه لا نبي بعدي، وستكون خلفاء فتكثرগ্ধ، قالوا: فما تأمرنا؟ قال: ্রفوا ببيعة الأول، فالأول، وأعطوهم حقهم، فإن الله سائلهم عما استرعاهم.
রাসূল সা. বলেন, নিশ্চয় আমার পরে আর কোনো নবী নেই; তবে খলিফা হবে এবং তারা সংখ্যায় অধিক হবে। সাহাবায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এমতাবস্থায় আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কী? নবীজি সা. বললেন, প্রথমজনের বায়আতকে পূর্ণ করবে, অতঃপর যে পর্যায়ক্রমে প্রথম হবে তার বায়আত এবং তাদের হক আদায় করবে। কারণ, আল্লাহ তাদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।
উক্ত হাদিসে খলিফাদের কথা উল্লেখ আছে এবং তাতে বলা হয়েছে, তাদের কিছু হক রয়েছে এবং আমাদেরকে তাদের সেই হক আদায় করতে বলা হয়েছে। এমনিভাবে রাসূল সা.—এর কর্মনীতি প্রমাণ করে, মুসলিমদের মধ্যে একজন ইমাম থাকতে হবে, যিনি শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়ন করবেন।
রাসূল সা. নিজেই মানুষের মধ্যে বিচার—ফয়সালা করতেন, সালাত ও হজ্জ প্রতিষ্ঠা করতেন, যাকাত সংগ্রহ করাতেন এবং তার হকদারদেরকে তা প্রদান করতেন, প্রতিরক্ষামূলক ও আক্রমণাত্মক যুদ্ধের জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করতেন।
এমনিভাবে রাসূল সা. তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামের অনুগত বিভিন্ন অঞ্চলে শাসক নিয়োগ করতেন। যেমনÑ তিনি বাজান ফারসিকে ইয়েমেনের আমির নিযুক্ত করেন, অতঃপর তার মৃত্যু হলো তারই পুত্র শাহরকে সানআ ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোর দায়িত্ব প্রদান করেন। মুহাজির বিন আবু উমাইয়াকে কিন্দা ও সাদাফের গভর্নর করেন। যিয়াদ বিন লাবিদকে হাযরামাওতের গর্ভনর করেন। আবু মূসা আশআরি রা.—কে যাবিদ, আদন, রুম্হ ও সাহেলের গর্ভনর করেন। মুআজ বিন জাবাল রা.—কে সেনাবাহিনীর প্রধান করেন। আত্তাব বিন উসাইদ রা.—কে অষ্টম হিজরিতে মক্কার গভর্নর করেন এবং তাকে হজ্জ প্রতিষ্ঠা ও মুসলিমদেরকে নিয়ে হজ্জ সম্পন্ন করার দায়িত্ব প্রদান করেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব রা.—কে নাজরানের গর্ভনর করেন। আলী ইবনে আবু তালেব রা.—কে ইয়েমেনে গনিমতের এক পঞ্চমাংশ উসুল ও বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করেন। এমনিভাবে নবী সা.—এর যুগে প্রত্যেক গোত্র থেকে যাকাত উসুলের জন্য দায়িত্বশীল নিযুক্ত ছিল। (জাওয়ামিউস সিরাহ : পৃ. ২৩—২৫ ও অন্যান্য)
এমনিভাবে ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা একটি আবশ্যিক প্রয়োজন, যা পবিত্র কুরআন ও হাদিসের দাবি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا.
আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না। (সূরা বাকারা : ২৮৬)
অতএব, এ কথা নিশ্চিতরূপে বিশ^াস করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের ওপর এমন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা বহন করার মত সাধ্য তাদের নেই এবং বিষয়টি তাদের প্রকৃতি বিরোধী। আমরা বিবেকের স্বাভাবিক দাবি অনুযায়ী বুঝতে পারিÑ আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবন, সম্পদ, বিবাহ—তালাক, অন্যায়—অপরাধ এবং অন্য সকল কাজে যে বিধান দান করেছেন এবং জালেমকে প্রতিহত করা, মাজলুমের প্রতি ইনসাফ করা, তার পক্ষ থেকে কিসাস ও বদলা নেওয়া, ইত্যাদি বিষয়গুলোর দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা ব্যতীত সাধারণ মানুষের পক্ষে Ñভৌগলিক দূরত্ব ও নানা রকম ব্যস্ততার মধ্যেওÑ সম্পন্ন করা একোবেরই অসম্ভব।
কারণ, সাধারণ অবস্থায় নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি কিংবা দল চাইবেÑ অমুক আমাদের বিচার করবে, আবার অন্য দল তাকে বিচারক হিসেবে চাইবে না। যেহেতু তারা সেই ব্যক্তির ইজতিহাদ ও গবেষণার সাথে একাত্মতা পোষণা করে না, অথবা তার সাথে অন্য কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য ও বিরোধ রয়েছে।
এটি একটি বাস্তবসম্মত বিষয়। যেমন অনেক রাষ্ট্রেই দেখা যায়Ñ যেখানে কোনো ইমামুল মুসলিমিন বা রাষ্ট্রপ্রধান নেই, ফলে সেখানে হদ্দ, কিসাস কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠা করা হয় না; বরং অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রেই দেখা যায়Ñ সেখানে দীন ও শরিয়া আইনের পরোয়া করা হয় না। অতএব, দায়িত্বশীল ও ইমাম নিযুক্ত করা ব্যতীত দীন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। (আল—ফিসাল ফিল মিলাল : খ. ৪, পৃ. ১০৬)
সাধারণত মানুষ তাদের পারস্পরিক মতভিন্নতা, চাহিদার বৈচিত্র্য এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণে একে অপরকে অতি অল্পই মান্য করতে চায়। আর এ অবস্থার দাবি হলো, তাদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাত কেবল বৃদ্ধিই পাবে; বরং এক পর্যায়ে এটি তাদের সকলের ধ্বংস ও বিনাসের কারণ হবে। একজন গভর্নরের মৃত্যুর পর আরেকজনকে নিযুক্ত করা পর্যন্ত যেসকল ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সংঘটিত হতে দেখা গেছে, এটিই তার বাস্তব প্রমাণ। এমনকি এ অবস্থা দীর্ঘায়ত হলে জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে এবং প্রত্যেকে তার তরবারি ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন ও সম্পদ সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, আর তার ফলশ্রম্নতিতে মানুষের থেকে দীন ওঠে যাবে এবং সকল মুসলিম ধ্বংসে উপনীত হবে। [আল—মাওয়াকিফ, আদোদুদ্দিন আল—এজি]
এ সকল গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়গুলোর নিরাপত্তা বিধান করা ব্যতীত দীনে শৃঙ্খলা আসতে পারে না। কারণ, কোনো ব্যক্তি যদি সারাক্ষণ তরবারি হাতে করে নিজের জীবনের সুরক্ষা এবং ক্ষমতাবলে অন্যের ওপর বিজয়ী হওয়ার আকাক্সক্ষায় মত্ত থাকে তাহলে সে কখন ইলম ও আমল অর্জনের জন্য ব্রতী হবে? অথচ এদুটি বিষয় হচ্ছে পরকালে সৌভাগ্যের সোপান!
তাছাড়া দীন, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করা কোনো মান্যবর সুলতান বা রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতি ব্যতীত সম্ভব নয়। বিভিন্ন সুলতান ও রাষ্ট্রপ্রধানদের মৃত্যুর পর যে ফিতনা ও অরাজকতার ইতিহাস রয়েছে, এটিই তার বাস্তব প্রমাণ। এ অবস্থা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং সকলের নিকট মান্যবর কোনো সুলতান বা রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত করা না হয় তাহলে বিশৃঙ্খলা স্থায়ী হবে এবং তরবারি ও অস্ত্রের ব্যবহার ব্যাপক হয়ে যাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, জন্তু জানোয়ান মরতে শুরু করবে, শিল্প ও পেশা নষ্ট হবে এবং প্রত্যেক ক্ষমতাশীল ও প্রভাবশালী ব্যক্তি লুটেরা হয়ে যাবে। তখন কেউ জীবদ্দশায় ইবাদত ও ইলম চর্চার জন্য অবসর হতে পারবে না। বরং বহু লোকের প্রাণ তরবারির নিচেই শেষ হয়ে যাবে। এ কারণে শ্রম্নতি আছে :
الدين والسلطان توأمان : দীন ও সুলতান পরস্পর জমজ ভাই। [আল—ইকতিসাদ ওয়াল ই’তিকাদ, গাযালি]
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর ওপর কিছু আবশ্যিক দায়িত্ব প্রদান করেছেন, যা কিছু লোক পালন করলে সকলের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। এটিকে পরিভাষায় ফরযে কিফায়া বলে। এ জাতীয় কিছু দায়িত্ব হচ্ছেÑ জিহাদ করা, সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করা, ফকির—মিসকিনদের প্রয়োজন পূরণ করা এবং পরামর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়া ইত্যাদি।
এ দায়িত্বগুলো এক বা একাধিক ব্যক্তি কেবল ব্যক্তিগত উদ্যোগে আঞ্জাম দিতে পারে না, সে যেই হোক না কেন। এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুব্যবস্থাপনা। আর তা ব্যাপক কতৃর্ত্ব ব্যতীত সম্ভব নয়। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত ইচ্ছাগুলো যার ইচ্ছার অধীন থাকবে, সকলে যে ইচ্ছাকে মেনে নেবে, যে আদেশ, নিষেধ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এটিকেই বলা হয় ইমামের কতৃর্ত্ব। কাজেই উল্লেখিত দায়িত্বগুলো আদায় করার জন্য ইমামত থাকা ওয়াজিব। এ কারণে শাহরাস্তানি বলেন,
সকল মুসলিমের জন্য জরুরি হলো, তাদের জন্য একজন ইমাম থাকবে, যে তাদের মধ্যে শরিয়ার বিধানাবলি বাস্তবায়ন করবে, হদ্দ (দণ্ডবিধি) কায়েম করবে এবং তাদের সারভৌমত্ব রক্ষা করবে, তাদের ভূখণ্ডের নিরাপত্তা বিধান করবে, তাদের মধ্য হতে সেনাবাহিনী প্রস্তুত করবে, তাদের মধ্যে গনিমত ও যাকাতের সম্পদ বণ্টন করবে। তারা যার কাছে নিজেদের বিবাদ ও মামলার বিচার কামনা করবে। যিনি তাদের সভা—সমাবেশ এবং ঈদ ও অন্যান্য উৎসবের বিষয়গুলো তদারকি করবেন, মাজলুমের প্রতি ইনসাফ করবেন, জালেম থেকে তার হক বুঝে নিবেন, প্রত্যেক অঞ্চলে বিচারক ও গভর্নর নিযুক্ত করবেন এবং সকল অঞ্চলে কুরআন বিশুদ্ধকরণের জন্য ক্বারি ও দীনের দাওয়াত প্রচারকারী প্রেরণ করবেন।” [নিহায়াতুল আকদান ফি ইলমিল কালাম, শাহরস্তানি]
পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, ইসলামি হুকুমাত বা ইমামুল মুসলিমিন না থাকার আবশ্যিক পরিণতি হলো, শরিয়ার বহু বিধানকে অকেজো করা এবং আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদেরকে যেসব অধিকার দিয়েছেন সেগুলো নষ্ট করা। এছাড়াও এর দ্বারা মুসলিমদের ঐক্য নষ্ট হয়, তাদের মধ্যে দুর্বলতার অনুপ্রবেশ ঘটে, তারা বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়, তাদের মধ্যে জুলুম ও ফিতনা—ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান সময়ে বিশে^র মুসলিমদের অবস্থা এর সত্যতার বাস্তব প্রমাণ।
কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কল্যাণ ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করতে আদেশ করেছেন এবং গোনাহ ও অন্যায় কাজে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন। আর প্রত্যেক হকদারকে তার হক বুঝিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় কোনো পুণ্যের কাজ নেই।
হক সেটাই আল্লাহ তাআলা যাকে হক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন এবং হক হওয়ার বিধান দিয়েছেন এবং রাসূল সা.—ও তাকে হক হওয়ার ফয়সালা দিয়েছেন। আর হক প্রদানের অর্থই হলো, হককে বাস্তবায়ন করা এবং তার প্রাপককে তা বুঝিয়ে দেওয়া।
আর স্পষ্ট জুলুম হলো, আল্লাহ মানুষের জন্য যে হক নির্ধারণ করেছেন তাদেরকে তা থেকে বঞ্চিত করা এবং আল্লাহ তাআলা যে বিষয়কে গোনাহ ও অন্যায় হিসেবে ফয়সালা করেছেন তাদের মধ্যে সে অনুযায়ী বিচার—ফয়সালা করা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন কাজ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
অতীতের মনীষীগণ বলেছেন : “দীন হলো শিকড় বা মূল এবং সুলতান হলো তার সংরক্ষণকারী। যার মূলই নেই তা যেমন ধ্বংসে নিপতিত হবে, তেমনি যার সংরক্ষণকারী নেই তাও নষ্ট হবে।”
অতএব, আমরা পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করে বলবো, ইমামত ও ইসলামি খেলাফত বা ইসলামি হুকুমাত হলো ইসলামি ঐক্যের প্রতীক। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। এটি হচ্ছে ইসলামের অন্যতম নিদর্শন, মুসলিমদের এ বিষয়ে চিন্তা করা এবং গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা আবশ্যক।
ইমাম নিযুক্তকরণ এবং ইমামত তথা খেলাফত ও ইসলামি হুকুমাতের বিধানাবলির বর্ণনা সম্পর্কিত যেসকল হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা এবং এতদসংক্রান্ত ব্যাখ্যা—বিশ্লেষণের আলোকে এ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত যে, মুসলিমদের কর্তব্য হচ্ছেÑ খেলাফতের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাÑ বিশেষ করে যখন থেকে তাকে বিকৃত করা হয়েছে এবং তাকে কার্যত অকেজো করা হয়েছে।
এজন্য আমরা মনে করি, এখন খেলাফতের বিষয়ে চিন্তা—ভাবনা করা এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করা একটি জরুরি কাজ, আমরা যে বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ কর
ছি। সেই সাথে আমরা বিশ^াস করিÑ তার জন্য অনেক পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এমনকি খেলাফত পুনরুদ্ধারের জন্য যে সরাসরি পদক্ষেপসমূহ রয়েছে তার পূর্বে আরও অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
শ্রবণ ও আনুগত্য
এতে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, মুসলিম উম্মাহ এমন একজন ইমামুল মুসলিমিনের আনুগত্য করতে আদিষ্ট, যিনি তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করবেন, শরিয়াহর বিধান অনুযায়ী তাদেরকে শাসন করবেন। মনে রাখতে হবেÑ সকল মুসলিম এক কাতারে থাকা, উম্মাহর সদস্যদের মধ্যকার পারস্পরিক সুসম্পর্ক ধরে রাখা, মুসলিমদের মধ্যকার ঐক্য বজায় রাখতে প্রচণ্ড রকম আগ্রহী হওয়া এবং ফিতনাকে প্রতিহত করা ইত্যাদি মুমিনের অন্যতম গুণাবলি। এমনকি রাসূল সা. বলেছেন :
من أتاكم وأمركم جميع على رجل واحد، يريد أن يشق عصاكم، أو يفرق جماعتكم، فاقتلوه.
তোমাদের মধ্যে যদি এমন ব্যক্তির আগমন হয়, যখন তোমাদের শাসন এক ব্যক্তির হাতে পরিচালিত হচ্ছেÑ যে তোমাদের লাঠিকে ভেঙ্গে দিতে চায় অথবা তোমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাতে চায়, তাহলে তাকে হত্যা কর। [সহিহ মুসলিম : ১৮৫২; আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ৯, পৃ. ৩৬০]
অপর এক হাদিসে নবীজি সা. বলেন,
ومن بايع إماما فأعطاه صفقة يده، وثمرة قلبه، فليطعه إن استطاع، فإن جاء آخر ينازعه فاضربوا عنق الآخر.
যে ব্যক্তি কোনো ইমামের হাতে বায়আত হলো, তার হাতে হাত রেখে শপথ করলো এবং মন থেকে বিশ^াস করলো সে যেন যথাসম্ভব তার আনুগত্য করে, অতঃপর যদি কোনো ব্যক্তি নিজেকে শাসক বলে দাবি করে প্রথম ইমামের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাহলে তোমরা শেষোক্ত দাবিদারকে হত্যা কর। (সহিহ মুসলিম : ১৮৪৪; আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ৯, পৃ. ৩৬০)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ.
তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আলে ইমরান : ১০৫)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ.
তোমরা বিবাদ কর না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে। (সূরা আনফাল : ৪৬)
যদি মুসলিমদের মধ্যে শ্রবণ ও আনুগত্য না থাকে তাহলে কখনও কাক্সিক্ষত ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে না এবং সকলে এক কাতারে সমবেত হতে পারবে না।
শ্রবণ ও আনুগত্যের আবশ্যিকতা সম্পর্কে অনেক নস (শরিয়ার বক্তব্য) বর্ণিত হয়েছে, যার প্রামাণিকতা, বিশুদ্ধতা, তার অর্থও উদ্দেশ্যের স্পষ্টতার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদেরকে এক্ষেত্রে শ্রবণ ও আনুগত্যের অর্থ ভালো করে বুঝতে হবে।
যেহেতু ইমামের গুরু দায়িত্ব কেবল পবিত্র শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়ন করা এবং আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যেসকল লক্ষ্য—উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টার আদেশ করেছেন সেসকল লক্ষ্য—উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা, আর যেহেতু ইমাম পরামর্শের ভিত্তিতেই কাজ করবেন, অতএব ইমামের শ্রবণ ও আনুগত্য মূলত আল্লাহর আদেশেরই আনুগত্য। আল্লাহ তাআলা যে বিনয়, একাগ্রতা ও আত্মসমর্পণের আদেশ করেছেন তারই আনুগত্য।
যেহেতু মুসলিমরা পবিত্র কুরআনে রাসূলে আকরাম সা.—কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী তিলাওয়াত করে :
لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ.
এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছু নেই। (সূরা আলে ইমরান : ১২৮)
অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ.
বলুন, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ। (সূরা কাহফ : ১১০)
এ জাতীয় আয়াত তিলাওয়াত করার পর এ ব্যাপারে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো অবকাশ থাকবে না। অতএব, কেউ এমন ধারণা করবে না যে, ইমামুল মুসলিমিন মানব জাতি থেকে ভিন্ন কোনো জাতির হবে; বরং বাস্তবতা হচ্ছে, ইমামুল মুসলিমিন তাদের মতই মানুষ। আল্লাহর অন্য সকল মাখলুকের ন্যায় সাধারণ মাখলুক। আল্লাহ তাআলা সকল বান্দাকে যেসব কাজের আদেশ করেছেন তারাও সেসব কাজে আদিষ্ট। আল্লাহ তাআলা সকল বান্দাকে তাঁর অবাধ্য হলে যেসব শাস্তির হুমকি দিয়েছেন তিনিও সেই হুমকির অন্তভুর্ক্ত। আল্লাহ তাআলা সকল বান্দাকে তাঁর অনুগত হলে যে পুরস্কারের ওয়াদা করেছেন তিনিও সেই ওয়াদার অন্তভুর্ক্ত। জাতি—পরিচয় ভিন্ন হলেও তিনি অন্য সকল মানুষ থেকে মোটেও ভিন্ন নন। তবে অন্য সকল মানুষ থেকে তার বৈশিষ্ট্য হতে পারেÑ মহান আল্লাহর নিকট বিশেষ সম্মান, যদি তিনি আল্লাহর অনুগত ও কৃতজ্ঞ বান্দা হন; কিন্তু সাধারণ মানুষের ওপর তার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ.
নিশ্চয় তোমাদের মধ্য হতে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত ঐ ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকি। (সূর হুজুরাত : ১৩)
এটি হচ্ছে ইমামুল মুসলিমিনের বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ, তিনি অন্য সকল মানুষের মতই সাধারণ মানুষ। কারণ, রাসূল সা.—এর পর মাসুম বা নিষ্পাপ কেউ নেই। আর ইমামুল মুসলিমিনের যেমন সরল সঠিক পথে অবিচল থাকার সম্ভাবনা আছে, তেমনি তার বিচ্যুত হওয়াও আশঙ্কা আছে।
যেহেতু ইমাম নিযুক্ত করার উদ্দেশ্য কেবল দীনের সংরক্ষণ ও শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়ন, অতএব এতে অবাক হবার কিছু নেই যে, যেসব নস—এ শ্রবণ ও আনুগতের কথা এসেছে সেখানে সুস্পষ্টরূপে এ কথাও উল্লেখ আছে Ñযাতে কোনো সন্দেহ ও আপত্তির অবকাশ নেইÑ যে, সেই শ্রবণ ও আনুগত্য হতে হবে ভালো কাজের ক্ষেত্রে। মন্দ বা অন্যায় কাজের ক্ষেত্রে কোনো আনুগত্য চলবে না।
যদি কখনও ইমাম ও সাধারণ নাগরিকের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় তাহলে সর্বদা তাদের কর্তব্য হচ্ছে, তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সা.—এর সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্পণ করবে এবং সেই সিদ্ধান্ত নত শিরে মেনে নিবে। কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা এবং সেই আদেশ বাস্তবায়ন করা শাসক ও শাসিত সকলের জন্য জরুরি; এখানে কোনো তফাৎ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ.
হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য হতে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের। (সূরা নিসা : ৫৯) এর সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ.
কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াসী হও। (সূরা নিসা : ৫৯)
রাসূল সা. যেমন আমাদেরকে ইমামের আনুগত্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া হতে সতর্ক করেছেন, তেমনি অন্যায় কাজে আনুগত্য করা থেকেও সতর্ক করেছেন। নবীজি সা. বলেন,
لا طاعة في معصية الله، إنما الطاعة في المعروف.
আল্লাহর নাফরমানিতে কোনো আনুগত্য নেই। আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে। (সহিহ মুসলিম : ১৮৪০)
অপর এক হাদিসে নবীজি সা. বলেন,
من خرج من الطاعة، وفارق الجماعة فمات، مات ميتة جاهلية،
যে ব্যক্তি (ইমামের) আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গেল এবং জামাআতকে বর্জন করলো এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো, তাহলে সে যেন জাহেলিয়াতের ওপর মৃত্যুবরণ করল। (সহিহ মুসলিম : ১৮৪৮)
অন্যত্র নবীজি সা. বলেন,
السمع والطاعة على المرء المسلم فيما أحب وكره ما لم يؤمر بمعصية، فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة.
মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় সকল কাজে আনুগত্য করতে হবে, যতক্ষণ না তাকে পাপ কাজের আদেশ করা হয়। অতএব, যদি পাপ কাজের আদেশ করা হয় তাহলে শ্রবণ ও আনুগত্য করা চলবে না। (সহিহ বুখারি : ৭১৪৪; সুনানে আবু দাউদ : ২৬২৬)
অপর এক বর্ণনামতে নবীজি সা. বলেন,
السمع والطاعة حق ما لم يؤمر بالمعصية، فإذا أمر بمعصية، فلا سمع ولا طاعة.
শ্রবণ ও আনুগত্য করা আবশ্যক, যতক্ষণ না পাপ কাজের আদেশ করা হয়। অতএব, যদি পাপ কাজের আদেশ করা হয় তাহলে শ্রবণ ও আনুগত্য করা চলবে না। (সহিহ বুখারি : ২৯৫৫)
উপরন্তু পাপ কাজে শ্রবণ ও আনুগত্য না করার বিষয়টি না সূচক অবস্থান থেকে সামনে বেড়ে হাঁ সূচক নির্দেশে পরিণত হবে। কারণ, পাপ কাজে বাধা দেওয়া, জুলুম ও অন্যায়কে প্রতিহত ও তাকে দূরীভূত করা একটি আবশ্যিক কাজ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ .
যদি মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে, আর তাদের একদল অপর দলের ওপর সীমালঙ্ঘন করলে যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। (সূরা হুজুরাত : ৯)
উক্ত আয়াতে সীমালঙ্ঘনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করে। সীমালঙ্ঘনকারী দল কখনও তার ইজতিহাদের কারণে নেকি পায়; যদিও তারা ভুল করে এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারে; তারপরও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ওয়াজিব, যখন তারা অন্যের অধিকার নষ্ট করবে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
ما من نبي بعثه الله في أمة قبلي إلا كان له من أمته حواريون وأصحاب يأخذون بسنته ويقتدون بأمره، ثم إنها تخلف من بعدهم خلوف يقولون ما لا يفعلون، ويفعلون ما لا يؤمرون، فمن جاهدهم بيده فهو مؤمن، ومن جاهدهم بلسانه فهو مؤمن، ومن جاهدهم بقلبه، فهو مؤمن، وليس وراء ذلك من الإيمان حبة خردل.
আল্লাহ আমার পূর্বে যত নবীকেই তার উম্মতের কাছে প্রেরণ করেছেন, উম্মতের মধ্য থেকে সেই নবীর কিছু অনুসারী ও সহচর তৈরি হয়েছে। যারা তার সুন্নাতকে আকড়ে ধরতো এবং তার আদেশের অনুসরণ করতো। অতঃপর তাদের পরে এমন এক প্রজন্মের আগমন হতো যারা এমন কথা বলতো, যা তারা করতো না এবং এমন কাজ করতো তাদেরকে যার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় হাত দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সে মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বা দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তর দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। এরপর ঈমানের সরিষা পরিমাণ দানাও অবশিষ্ট নেই। (আল—মুহাল্লা : খ. ৬, পৃ. ৩৬০)
উক্ত হাদিসে রাসূল সা. ঐ ব্যক্তির ঈমানকে নাকচ করেছেন যার অন্তর জুলুম, সীমালঙ্ঘন, অন্যায় ও পাপ কাজে সন্তুষ্ট থাকে। এমনকি রাসূল সা. প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির থেকে ঈমানকে নাকচ করেছেন, যে অন্যায় কাজে সম্মতি প্রদান করে। যেমন নবীজি সা. বলেছেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان.
তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় দেখবে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তা যদি না পারে তাহলে তার মুখের ভাষা দ্বারা। তাও যদি না পারে তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে, আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। (সহিহ মুসলিম : ৪৯)
সমগ্র উম্মত এ ব্যাপারে ঐকমত যে, সৎ কাজে আদেশ করা এবং অন্যায় কাজে বাধা দেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই। এর প্রমাণ উপযুর্ক্ত হাদিস সমূহ এবং পবিত্র কুরআনের আয়াত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল যেন এমন থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান : ১০৪ )
অতঃপর এর পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কতক অনুসারীর মত, যাদের মধ্যে আছেন এক দল প্রবীণ সাহাবি রা. এবং তাদের পরবর্তীগণ। এটিই ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র., সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস, উসামা ইবনে যায়েদ, ইবনে উমর, মুহাম্মাদ বিন মাসলামা রা. প্রমুখের মত :
উক্ত হাদিসের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, অন্যায় কাজকে অবশ্যই অন্তর দ্বারা ঘৃণা করা, অথবা সামর্থ্য থাকলে মুখে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। হাতের দ্বারা বা তরবারি কোষমুক্ত করে প্রতিরোধ করা সাধারণ অবস্থায় আবশ্যক নয়। কিন্তু যদি অন্যায়কারী প্রকাশ্যে অন্যায় করে এবং ইমামের আনুগত্য বর্জন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে তরবারি কোষমুক্ত করা আবশ্যক হয়ে যায়।
তবে আহলে সুন্নাতের মধ্য হতে এ মতের প্রবক্তাগণ মনে করেন, এ শর্তটি তখন প্রযোজ্য যখন ইমাম ন্যায়পরায়ণ না হবে। কিন্তু যদি ইমাম ন্যায়পরায়ণ হয় এবং কোনো পাপাচারী তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাহলে তাদের সকলের সম্মিলিত মত হলো, এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়পরায়ণ ইমামের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করা আবশ্যক হয়ে যায়।
আবার আহলে সুন্নাতের অনেকের মত এবং সকল মুতাযিলা, খারেজি ও যাইদিয়া সম্প্রদায়ের মত হলো, সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধে তরবারি কোষমুক্ত করা ঐ সময় ওয়াজিব হবে যখন এটা ছাড়া অন্যায় প্রতিরোধ করা সম্ভব না হবে। তাদের বক্তব্য হলো, যদি হকের অনুসারীরা একটি সংঘবদ্ধ দল হয়, যাদের দ্বারা অন্যায় প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং তারা এ কাজে সফলতার ব্যাপারে নিরাশও নয় তাহলে তাদের ওপর সেই প্রতিবাদ করা ফরয হয়ে যায়। কিন্তু যদি তারা সংখ্যার স্বল্পতা ও দুর্বলতার কারণে সফলতার আশাবাদী না হয় তাহলে তাদের হাত দ্বারা প্রতিবাদ বর্জনের অবকাশ রয়েছে।
এটি আলী ইবনে আবু তালেব রা. এবং তার অনুসারী সকল সাহাবি ও আয়িশা রা.—এর মত। অনুরূপ হযরত তালহা, যুবায়ের এবং তাদের অনুসারী সকল সাহাবির মত। এমনিভাবে মুআবিয়া, আমর, নুমান বিন বশির প্রমুখ এবং তাদের অনুসারী সকল সাহাবি রা.—এর মত। অনুরূপ আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা., মুহাম্মাদ, হাসান বিন আলী এবং হাররার যুদ্ধের দিন তাদের সাথে অবস্থানকারী সকল মুহাজির ও আনসার সাহাবির মত। আরও যারা ফাসেক হাজ্জাজের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তাদের সমর্থনকারী সাহাবায়ে কেরাম, যেমনÑ আনাস বিন মালেক রা. এবং শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ি যেমনÑ আবদুর রহমান ইবনে আবি লায়লা, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, ইবনুল বাহতারি তাঈ, আতা সুলামি আযদি, হাসান বসরি, মালেক বিন দিনার, মুসলিম বিন বাশশার, আতা ইবনুস সায়েব প্রমুখের মত।
শীর্ষস্থানীয় ফকিহগণ থেকেও এ কথাই প্রমাণিত হয়। যেমনÑ ইমাম আবু হানিফা, হাসান বিন হুয়াই, শারিক, ইমাম মালেক, শাফেয়ি, দাউদ এবং তাদের অনুসারীদেরও মত। এখানে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের সকলেই হয়তো স্বীয় ফাতওয়ায় এ কথা উল্লেখ করেছেন অথবা অন্যায় কাজ প্রত্যক্ষ করার পর তরবারি হাতে ধারণ করে এর বাস্তব আমল করে দেখিয়েছেন।
প্রথম দলের সদস্যগণ তাদের মতের স্বপক্ষে কিছু হাদিস দ্বারা দলিল গ্রহণ করেন। যেমনÑ এক হাদিসে বলা হয়েছে, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো? নবীজি সা. বললেনÑ “না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নামায আদায় করবে।” অপর এক বর্ণনায় এসেছেÑ “তবে যদি তোমরা স্পষ্ট কুফরি দেখতে পাও, যে সম্পর্কে তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ হতে দলিল রয়েছে।” কতক বর্ণনায় আছেÑ ধৈর্য ধারণ করতে হবে, যদিও আমাদের পিঠে আঘাত করে অথবা সম্পদ অধিগ্রহণ করে। কতক বর্ণনায় আছেÑ “যদি তুমি ভয় কর যে, তরবারির ঝলকানি তোমার চোখ ধাঁধিয়ে দিবে তাহলে তোমার চেহারার ওপর আবরণ ফেরে দাও এবং বল,
إِنِّي أُرِيدُ أَنْ تَبُوءَ بِإِثْمِي وَإِثْمِكَ فَتَكُونَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ.
আমি চাইÑ তুমি আমার ও তোমার পাপের বোঝা বহন কর এবং জাহান্নামবাসী হও।” (সূরা মায়িদা : ২৯)
কতক বর্ণনায় আছেÑ “তুমি নিহত আল্লাহর বান্দা হও, হত্যাকারী আল্লাহর বান্দা হয়ো না।”
তাদের আরেকটি দলিল হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ.
আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে শোনাও। (সূরা মায়িদা : ২৭)
আমাদের বক্তব্য হলো, এগুলোর কোনোটিই তাদের পক্ষে দলিল হয় না। কারণ, যে হাদিসে সম্পদ অধিগ্রহণ ও পিঠে প্রহার করা সত্ত্বেও ধৈর্য ধারণের কথা আছে, নিঃসন্দেহে এটি তখন প্রযোজ্য যখন ইমাম ন্যায়সঙ্গত কারণে এমনটি করবে। বরং তখন ধৈর্য ধারণ করা আমাদের ওপর ফরয হয়ে যায়। উপরন্তু ইমাম কারও গর্দান কর্তন করা ওয়াজিব হওয়ার পর যদি তা থেকে বিরত থাকে তাহলে সে হবে ফাসিক ও আল্লাহর হুকুম অমান্যকারী। কিন্তু যদি ইমাম অন্যায়ভাবে এমনটি করে তাহলে এটি অসম্ভব যে, রাসূল সা. এ অন্যায়ের ওপর আমাদের ধৈর্য ধারণের আদেশ করবেন। এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী :
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ.
তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না। (সূরা মায়িদা : ২)
আমরা বিশ^াস করিÑ রাসূলুল্লাহর সা.—এর বাণী কখনও আল্লাহর বাণীর বিরোধী হবে না। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى.
তিনি মনগড়া কথা বলেন না। এটা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নাজম : ৩—৪)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلَافًا كَثِيرًا .
এ কুরআন যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও নিকট থেকে হতো তাহলে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেতো। (সূরা নিসা : ৮২)
অতএব, বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত হলো যে, রাসূলুল্লাহ সা. যে কথাই বলেছেন তা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে প্রাপ্ত ওহি, যেখানে কোনো বৈপরীত্ব, সাংঘর্ষিকতা ও বিরোধ নেই। যখন বিষয়টি এমনই, এদিকে প্রত্যেক মুসলিম নিশ্চিতরূপে জানে যে, অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিম বা জিম্মির সম্পদ গ্রহণ করা কিংবা অন্যায়ভাবে কাউকে প্রহার করা পাপ, সীমালঙ্ঘন ও হারাম। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন,
ألا إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام،
নিশ্চয় তোমাদের রক্ত (জীবন), সম্পদ, সম্ভ্রম তোমাদের ওপর হারাম। (মুসনাদে আহমদ : ১৮৯৬৬) অতএব, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং কোনো মুসলিমের পক্ষ থেকে কোনো মতবিরোধ নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে নিজের সম্পদ অর্পণ করবে, অথবা প্রহৃত হওয়ার জন্য পিঠ পেতে দিবে, অথচ সে যেকোনো ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম, তাহলে সে হবে ঐ জালিমকে তার পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ওপর সাহায্যকারী। আর জালিমকে সাহায্য করা পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট ভাষ্য অনুযায়ী হারাম।
আর হযরত আদম আ.—এর পুত্রদ্বয়ের ঘটনাটি আমাদের শরিয়াহ থেকে ভিন্ন ছিল। কাজেই তা আমাদের জন্য দলিল হিসেবে গৃহীত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا.
আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়াহ ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। (সূরা মায়িদা : ৪৮)
আর হাদিস শরিফের ভাণ্ডারে দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ রাসূল সা. বলেছেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان.
তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় দেখবে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তা যদি না পারে তাহলে তার মুখের ভাষা দ্বারা। তাও যদি না পারে তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে, আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। (সহিহ মুসলিম : ৪৯)
অপর একটি সহিস হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ রাসূল সা. বলেছেন,
لا طاعة في معصية الله، إنما الطاعة في المعروف.
আল্লাহর নাফরমানিতে কোনো আনুগত্য নেই। আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে। (সহিহ মুসলিম : ১৮৪০)
অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেন,
السمع والطاعة على المرء المسلم فيما أحب وكره، ما لم يؤمر بمعصية، فإذا أمر بمعصية فلا سمع ولا طاعة.
মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হলোÑ শ্রবণ ও আনুগত্য করা, তার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক; যতক্ষণ পর্যন্ত না পাপ কাজের আদেশ করা হয়। অতএব, যদি পাপ কাজের আদেশ করা হয় তাহলে কোনো শ্রবণ ও আনুগত্য চলবে না। (সহিহ বুখারি : ৭১৪৪; সহিহ মুসলিম : ১৮৩৯)
অপর এক হাদিসে রাসূল সা. বলেন,
من قتل دون ماله فهو شهيد، ومن قتل دون دينه فهو شهيد، ومن قتل دون دمه فهو شهيد، ومن قتل دون أهله فهو شهيد.
যে ব্যক্তি তার সম্পদের খাতিরে নিহত হবে সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার দীনের খাতিরে নিহত হবে সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার রক্তের (জীবনের) খাতিরে নিহত হবে সে শহিদ, আর যে তার পরিবারের খাতিরে নিহত হবে সেও শহিদ। (সহিহ বুখারি : ১৪২১)
অন্যত্র রাসূল সা. বলেন,
والله لتأمرن بالمعروف ولتنهون عن المنكر، أو ليعمنكم الله منه بعقاب.
আল্লাহর শপথ! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে, অন্যথায় আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ব্যাপক শাস্তিতে পাকড়াও করবেন। (তাফসিরে তাবারি : খ. ১১, পৃ. ১৫১; হা. নং : ১২৮৭৭)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য হাদিসমূহের একটি অপরটির সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, দুটির যেকোনো একটি অপরটিকে রহিতকারী। এছাড়া বিকল্প কিছু সম্ভব নয়। তাই আমাদেরকে দেখতে হবে, কোনোটি রহিতকারী এবং কোনোটি রহিত?
আমরা দেখতে পাই, যেসকল হাদিসে হত্যাকারীর সাথে লড়াই করতে নিষেধ করা হয়েছে, তা ইসলামের স্বীকৃত মূলনীতির অনুকূল এবং এটি ইসলামের শুরু যুগের অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল। কারণ, সীমালঙ্ঘনকে প্রতিহত করা এমন একটি নীতি যা শরিয়াহর সুস্পষ্ট বক্তব্য ব্যতীত ওয়াজিব ও বৈধ হয় না। আর বিপরীত হাদিসসমূহে যে হত্যকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদেশ করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা হচ্ছে স্বীকৃত মূলনীতির ওপর একটি বাড়তি সংযোজন, আর তা হলোÑ প্রয়োজনে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া যাবে।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যখন থেকে নবী সা. যুদ্ধের আদেশ প্রদানকারী হাদিসসমূহ উচ্চারণ করেছেন তখন থেকে যুদ্ধ থেকে নিষেধকারী হাদিসমূহের বিধান রহিত হয়ে গেছে। আর রহিতকারীকে ছেড়ে রহিত হাদিসকে গ্রহণ করা অসম্ভব ও হারাম।
কেউ যদি দাবি করে যে, যুদ্ধের আদেশ প্রদানকারী হাদিসসমূহ রহিতকারী হওয়ার পর পুনরায় রহিত হয়ে গেছে, তাহলে আমরা বলবোÑ এ ব্যক্তি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একটি বাতিল দাবি করেছে, যে ব্যাপারে তার কোনো জ্ঞান নেই। আর নিশ্চিত দলিল ছাড়া শরিয়াহর কোনো বিধানকে রহিত করা জায়েয নেই। যদি যুদ্ধের আদেশ প্রদানকারী হাদিসমূহ পূর্ববর্তী হতো এবং নিষেধকারী হাদিসসমূহ দ্বারা সেগুলো রহিত হয়ে যেত তাহলে আল্লাহ তাআলা এ রহিত হওয়ার দলিলটি আমাদের জন্য সংরক্ষণ করতেন। তিনি দলিল—প্রমাণ বর্ণনা ব্যতীত এ বিধানকে শূন্য ও খালি করে রাখতেন না, যার দ্বারা প্রমাণিত হতো যে, রহিত বিধানটি আবার প্রত্যানীত হয়ে রহিতকারী হয়েছে। কারণ, তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ.
আর আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, প্রত্যেক বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ। (সূরা নাহল : ৮৯)
আরেকটি দলিল হলো, আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ.
যদি মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে, আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। (সূরা হুজুরাত : ৯)
যেকোনো দুইজন মুসলিমের মধ্যেও এ বিষয়ে কোনো বিরোধ নেই যে, আলোচ্য আয়াতে যে সীমালঙ্ঘনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিধান দেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিতরূপে কার্যকর এবং তা রহিত হয়নি। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উপযুর্ক্ত আয়াতটি ঐ সকল হাদিসের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। সুতরাং যে হাদিস এ আয়াতের অনুকূল হবে তা প্রতিষ্ঠিত ও রহিতকারী হবে এবং যা এর বিরোধী হবে তা রহিত বলে বিবেচিত হবে।
এক দলের দাবি হলো, এ সকল হাদিস ও উক্ত আয়াতটি ডাকাত দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সুলতান ও মুসলিম শাসকের ক্ষেত্রে নয়।
এ দাবি নিশ্চিতরূপে বাতিল। কারণ, তা দলিল বিহীন কথা। এ সকল হাদিস সম্পর্কে যেকোনো দাবিদার এ দাবি করতে অক্ষম হবে না যে, উক্ত হাদিসগুলো নির্দিষ্ট সম্প্রদায় ও নির্দিষ্ট কালের সাথে সম্পৃক্ত। আর আমরা জানিÑ দলিল বিহীন দাবি কখনও গৃহীত হয় না। তাছাড়া শুধু দাবির দ্বারা শরিয়ার বক্তব্যকে সীমিত করা জায়েয নয়। কারণ, তা আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে জ্ঞানহীন উক্তির শামিল।
এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “এক ব্যক্তি এসে প্রশ্ন করলÑ কেউ যদি আমার সম্পদ অন্যায়ভাবে নিয়ে নিতে চায় তাহলে আমার করণীয় কী? নবীজি সা. বললেন, তাকে তোমার সম্পদ দিবে না। প্রশ্নকারী আবার প্রশ্ন করলা, যদি সে আমার সাথে লড়াই করে? নবীজি সা. বললেন, তুমিও তার সাথে লড়াই করবে। প্রশ্নকারী প্রশ্ন করল, যদি আমি তাকে হত্যা করি? নবীজি সা. বললেন, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে। প্রশ্নকারী বলল, যদি সে আমাকে হত্যা করে? নবীজি সা. বললেন, তাহলে তুমি জান্নাতে প্রবেশ করবে।” হাদিসটি হুবহু এ শব্দে অথবা কাছাকাছি শব্দে বর্ণিত হয়েছে।
অপর এক সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা. বলেছেন,
المسلم أخو المسلم لا يظلمه ولا يسلمه،.
এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে অসহায় ছাড়বে না। (সহিহ বুখারি : ২৫৮০)
অপর একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ নবী সা. যাকাত সম্পর্কে বলেছেন,
فمن سئلها من المسلمين على وجهها، فليعطها ومن سئل فوقها فلا يعط.
“মুসলিমদের মধ্য হতে যার কাছে ন্যায়সঙ্গত ভাবে যাকাত চাওয়া হবে সে যেন তা প্রদান করে, আর যার কাছে এর চেয়ে বেশি চাওয়া হবে সে যেন তা প্রদান না করে।” (সহিহ বুখারি : ১৪৫৪)
এ হাদিসটি বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত, যা নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ আনাস বিন মালেক রা. থেকে এবং তিনি আবু বকর সিদ্দিক রা.—এর সূত্রে রাসূল সা. থেকে বর্ণনা করেছেন।
এ হাদিসের মাধ্যমে ঐ সকল লোকের ব্যাখ্যা ও তাবিল বাতিল হয়ে যায়, যারা সম্পদের জন্য লড়াইয়ের হাদিসসমূহের মধ্যে ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। কারণ, দস্যুদল কখনও যাকাত চায় না; বরং যাকাত তো কেবল সুলতান বা রাষ্ট্রপ্রধানই চেয়ে থাকেন। আর রাসূল সা. সেই সুলতানের ব্যাপারেই বলেছেন, সে যদি আমার নির্দেশনার বাইরে যাকাত চাইতে আসে তাহলে তাকে যাকাত দিবে না। কারণ, হকপন্থীরা সকলে মিলে এক হয়ে গেলে বাতিলপন্থীরা কখনও তাদেরকে পরাভূত করতে পারবে না।
কেউ কেউ মনে করেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে পবিত্র স্থানসমূহের পবিত্রতা লঙ্ঘিত হয়, রক্তপাত ঘটে, সম্পদ লুণ্ঠন হয়, সম্মান ও সম্ভ্রমহানি হয়, বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
এর জবাবে অন্যরা বলেন, এমনটি কিছুতেই হতে পারে না। কারণ, যে ব্যক্তি সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করবে তার জন্য কিছুতেই বৈধ হবে না যে, সে পবিত্র নগরীর পবিত্রতা লঙ্ঘন করবে, অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কেউ তার সাথে লড়াইয়ে না জড়াতে চাইলে তার ওপরও আক্রমণ করবে। যদি সে এসকল কাজে প্রবৃত্ত হয় তাহলে প্রথমে তার কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা Ñতাদের সংখ্যা কম হোক বা বেশিÑ এটি একটি স্বতন্ত্র ফরয। যদি অন্যায়কারীদের হুমকি—ধমকির আশঙ্কা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও সৎ কাজের আদেশের ক্ষেত্রে বাস্তবিক পক্ষে প্রতিবন্ধক হতো তাহলে এ বিষয়টি তো মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত (হারবি) কাফেরদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়ার কথা। সেই হিসেবে তো তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করা উচিত, অথচ কোনো মুসলিম এ মতকে সমর্থন করবে না।
জুলুম ও অন্যায় Ñহোক তা পরিমাণে কমÑ প্রতিহত করে জনগণের জান—মালের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব মূলত ইমামুল মুসলিমিনের। ইমামের নিষেধের কারণে অন্যায়কারী যদি অন্যায় থেকে নিবৃত্ত হয় এবং তার কৃত অঙ্গহানি বা প্রাণহানির কিসাস গ্রহণে অথবা ব্যভিচার, অপবাদ কিংবা মদপানের হদ্দ গ্রহণে নিজে থেকেই সম্মত হয়ে যায় তাহলে তো আল্লাহর বিধান বাস্তবায়িত হলো এবং তাঁর নির্দেশ পালন করা হলো। কিন্তু ইমাম যদি এসকল দায়িত্বের কোনোটি পালন হতে বিরত থাকে তাহলে তাকে পদচ্যুত করে অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে হবে, যে সঠিকভাবে এ সকল দায়িত্ব পালন করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ.
তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না। (সূরা মায়িদা : ২)
অতএব, শরিয়াহর এসকল আবশ্যিক বিধানের কোনোটিকে নষ্ট করা কখনও বৈধ হবে না। আল্লাহ তাআলাই তাওফিক দানকারী।”
বিচারক নির্ধারণ
আল্লাহ তাআলর বলেন :
وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ.
আমার বান্দাদেরকে বলুন, তারা যেন এমন কথাই বলে যা অতি সুন্দর। নিশ্চয় শয়তান তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৩)
কিছু লোকের বক্তব্য হলো, উম্মতের মধ্যে ইসলামি হুকুমাত তথা আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর বিধানাবলি বাস্তবায়নের জন্য মুসলিম শাসক না থাকলে সেই উম্মাহর সদস্যদের থেকে ঈমান চলে যাবে। তারা তাদের এ দাবির স্বপক্ষে দলিল গ্রহণ করেন আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীসমূহ দ্বারা :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদর বিচার ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং তারা সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫ )
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ.
আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! তাওরাত, ইনজিল ও যা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমাদের কোনো ভিত্তি নেই। (সূরা মায়িদা : ৬৮)
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
মুমিনদের কথা তো এই যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে এ মর্মে আহ্বান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার—মীমাংসা করবেন, তখন তারা বলেÑ আমরা শ্রবণ করলাম ও আনুগত্য করলাম। আর তারাই তো সফলকাম। (সূরা নূর : ৫১)
তাদের বক্তব্য হলো, প্রথম আয়াতটিতে রাসূল সা.—এর দিকে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং তাঁর ফয়সালাকে মনে প্রাণে মেনে নেওয়ার আবশ্যিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ বিষয়টি কেবল তখনই অস্তিত্ব লাভ করবে যখন রাষ্ট্রে ইসলামি হুকুমাত থাকবে এবং উম্মতের মধ্যে শরিয়ার আইনের প্রভাব ও তার কার্যত বাস্তবায়ন থাকবে। কারণ, যদি উম্মতের মধ্যে ইসলামি শরিয়াহর প্রভাব না থাকে তাহলে অবশ্যই অন্য কোনো শরিয়াহর প্রভাব থাকবে, যার দিকে মানুষ বিচারপ্রার্থী হবে; যদিও মানুষ তা অপছন্দ করে এবং তাদের জীবনের সামগ্রিক বিষয়াবলিতে তার সামনে নতি স্বীকার করবে। আর তখন আল্লাহ তাআলা যে রাসূল সা.—এর প্রতি বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং তাঁর ফয়সালাকে মনে—প্রাণে গ্রহণের আদেশ করেছেন তা বাস্তবায়িত হবে না।
তারা আরও বলেন, যে জিনিসের উপস্থিতি ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণতা পায় না তাও ওয়াজিব হিসেবে গণ্য হয়। যেহেতু সূরা নিসার উপর্যুক্ত আয়াতের দাবি অনুযায়ী পৃথিবীর বুকে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের বিষয়টি ইসলামি হুকুমাত ছাড়া পূর্ণতা পায় না, আর আয়াতে বলা হয়েছেÑ আল্লাহর বিধান গ্রহণ এবং রাসূল সা.—এর ফয়সালা সর্বান্তকরণে মেনে না নিলে মুমিন হওয়া যায় না, কাজেই আয়াতের দাবি অনুযায়ী ইসলামি হুকুমাত না থাকলে উম্মাহর সদস্যদের মধ্যে ঈমান থাকবে না।
এর জবাবে আমরা বলবো,
উপর্যুক্ত পবিত্র আয়াতে রাসূল সা.—এর ওপর বিচারভার অর্পণ করা এবং তাঁর ফয়সালাকে সর্বান্তকরণে গ্রহণের আবশ্যিকতা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করা এবং আল্লাহ তাআলা হালাল, হারাম, ফরয, বৈধ ও নিষিদ্ধতার যে বিধান দিয়েছেন তা মনে প্রাণে গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ সঠিক, যেখানে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু ইসলামি হুকুমাত না থাকলে বিচারভার অর্পণ করা যাবে না, এ কথাটি সঠিক নয়।
আসল কথা হচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মেনে চলা এবং বান্দাদের ওপর আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন ও শরিয়া আইন প্রয়োগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ মেনে চলার অর্থ হলো, রাসূল সা. আপন প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ওহি স্বরূপ শরিয়ার যে বিবরণ দিয়েছেন তা অনুসন্ধান করা, যেন এর দ্বারা আমরা জানতে পারিÑ কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম? কোনটি ফরয, আর কোনটি নিষিদ্ধ? আমাদের জন্য কী কী অধিকার রয়েছে এবং আমাদের ওপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে? শরিয়ার বক্তব্য অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমরা এসব কিছু জানতে পারবো। এটিই হচ্ছে, রাসূল সা.—এর ওপর বিচারভার অর্পণ করা এবং ইসলামি শরিয়াহ মেনে চলার অর্থ। আর এটিই হচ্ছে, শরিয়াহর কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া ও তার দ্বারস্থ হওয়ার অর্থ।
সুতরাং যখন রাসূল সা.—এর ওপর বিচারভার অর্পণ করা এবং আল্লাহর বিধান জানার বিষয়টি পূর্ণ হলো, তখন এ বিষয়ে অন্তর প্রশান্ত হলো যে, এটিই যথার্থ ও সঠিক, যার প্রতি বিশ^াস পোষণ করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। আর এটিই হচ্ছে, সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়ার অর্থ। কাজেই এসবের সাথে ইসলামি হুকুমাত থাকা বা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই।
অতএব, যখনই আপনি আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর দ্বারস্থ হবেন, আপনি জানতে পারবেনÑ আপনার পানাহার ও পোশাক—পরিচ্ছদ সম্পর্কে আল্লাহর বিধান কী? কোন কোন নারীকে বিবাহ করা আপনার জন্য বৈধ হবে? আপনার কাছে ও অন্যদের কাছে যে সম্পদ রয়েছে তার কতটুকু আপনার জন্য বৈধ হবে? আপনার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে আপনার সম্পর্কের ধরন কী হবে? আপনার প্রতিবেশী ও শহরবাসীদের সাথে কীরূপ আচরণ করবেন এবং মানুষের প্রতি কীরূপ দৃষ্টিভঙ্গি রাখবেন? ইত্যাদি নানা বিষয়, প্রাত্যহিক জীবনে আপনি যার সম্মুখীন হন।
এমনিভাবে যদি আপনার ও অন্যের মধ্যে কোনো বিষয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে আপনাদের দুজনেরই কর্তব্য হচ্ছে, আপনারা রাসূল সা.—এর কাছে বিচারপ্রার্থী হবেন। আর তার পদ্ধতি হচ্ছে, রাসূল সা. শরিয়াহর যেসকল বিধান বর্ণনা করেছেন তার দ্বারস্থ হওয়া। এর দ্বারা বিবদমান বিষটি সম্পর্কে আল্লাহর হুকুম জানা যাবে। ফলে প্রত্যেক হকদার তার হক সম্পর্কে অবগত হবে।
সুতরাং যদি কখনও কোনো নির্দিষ্ট আয়াত বা হাদিস শরিফের মধ্যে আল্লাহর উদ্দেশ্য নির্ণয়ে মতপার্থক্য হয়, অন্য ভাষায় বলতে গেলেÑ বিবদমান ঘটনাটির মধ্যে আল্লাহর হুকুম আসলে কী? এ সম্পর্কে মতবিরোধ হয় তাহলে সেই মতবিরোধ দূর করার একমাত্র উপায় হলো, এক পক্ষ অপর পক্ষের বিপরীতে উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করবে। সুতরাং এক পক্ষ যদি আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে স্পষ্ট ও উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম হয় তাহলে অপর পক্ষের জন্য আবশ্যক হলো, সেই প্রমাণকে সাদরে গ্রহণ করা, তা প্রচার করা এবং তার দ্বারা প্রমাণিত আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে বিশ^াস স্থাপন করা, সেটাকে যথার্থ মনে করা এবং তাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়া। অতঃপর এ বিচারপ্রার্থী হওয়া ও সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়ার পর ব্যক্তি এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য আদিষ্ট।
আমরা পূর্বে বলেছি, ইসলামি হুকুমাত তথা মুসলিম ইমাম বা মুসলিম শাসকের কাজ এটা নয় যে, তিনি নতুন করে বিধান প্রণয়ন করবেন এবং তার বিবেক—জ্ঞান অনুযায়ী কোনো বিষয়কে সুন্দর বা যথার্থ বলে সিদ্ধান্ত দিবেন। বরং তার কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা এবং আল্লাহ যে বিষয়কে হক ও যথার্থ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তার প্রয়োগ ঘটানো।
আর যেহেতু শরয়ি বিধানের ক্ষেত্রে ইজমা সংঘটিত হয়েছে, অতএব তা ইজতিহাদের অবকাশ থেকে বেরিয়ে গেছে এবং সেখানে ভুল ও তাবিলের সম্ভাবনা নাকচ হয়ে গেছে।
আর যদি কোনো মাসআলার সমাধানে একাধিক মতামত থাকে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি চিন্তা করা যায় তাহলে মুসলিম শাসক ও দায়িত্বশীলের সে ব্যাপারে ইজতিহাদ করার এবং সেই ইজতিহাদের আলোকে বিধান বাস্তবায়নের অবকাশ রয়েছে।
অতএব, মুসলিম শাসক ও মুসলিম বিচারক Ñযিনি মুসলিম শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে কতৃর্ত্ব লাভ করেন— এর কর্তব্য হচ্ছে, তিনি স্বীয় ইজতিহাদের আলোকে বিরোধ দূরীকরণার্থে যেটাকে আল্লাহর বিধান হিসেবে জানবেন সেটাকে বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু যেহেতু তিনি ভুল—ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন, তাই আয়াত ও হাদিসের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে তার ভুল হতে পারে। হতে পারেÑ তার ইজতিহাদ আল্লাহর হুকুমের অনুকূল হয়নি। এ কারণে তার সিদ্ধান্ত কোনো হারামকে হালাল করবে না এবং কোনো হালালকে হারাম করবে না। কারণ, হালাল ও হারামের ক্ষেত্রে একমাত্র ধর্তব্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার হুকুম।
অতএব, মুসলিম শাসকের কর্তব্য হচ্ছে, তিনি যে বিষয়কে আল্লাহর হুকুম বলে বিশ^াস করবেন এবং দলিল—প্রমাণ ও বাস্তবতার নিরিখে সত্য বলে অনুধাবন করবেন তা বাস্তবায়ন করবেন। অনেক সময় দেখা যায়Ñ যে ব্যক্তি হকদার নয় তার কাছে এমন পর্যাপ্ত দলিল—প্রমাণের সমাবেশ থাকে যা প্রকৃত হকদারের কাছে থাকে না।
যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসূল সা. বলেছেন,
إنكم تختصمون إلي وإنما أنا بشر ولعل أحدكم أن يكون ألحن بحجته من الآخر فأقضي له على نحو ما أسمع فمن قضيت له بشيء من حق أخيه فلا يأخذه فإنما أقطع له قطعة من النار.
তোমরা আমার কাছে এসে বিবাদ কর। আমি তো তোমাদের মতই মানুষ। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রে তার প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিক বাকপটু হয়, অতঃপর আমি যা শ্রবণ করি সে অনুযায়ী ফয়সালা করি। সুতরাং যদি কারও জন্য আমি তার ভাইয়ের হক থেকে কিছু অংশের ফয়সালা করি তাহলে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ, আমি তার জন্য যে ফয়সালা করেছি তা হলো আগুনের টুকরা। (আল—ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম : খ. ১, পৃ. ৩)
রাসূল সা.—এর উক্ত বাণী থেকে স্পষ্ট যে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বিবাদ হলে তিনি এর ফয়সালা করতেন। এ ফয়সালার অর্থ হলো, তিনি বাহ্যিক অবস্থা এবং প্রত্যেক পক্ষের পেশকৃত দলিল—প্রমাণের আলোকে বিবাদ মীমাংসা করতেন এবং বিধান বাস্তবায়ন করতেন।
রাসূল সা. বলেন, বাদী বিবাদীর এক পক্ষ কখনও অপর পক্ষ থেকে প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রে অধিকতর শক্তিশালী এবং দলিল প্রদানে অধিকতর সক্ষম হয়; যদিও সে প্রকৃত হকদার নয়। অতঃপর যখন রাসূল সা. তার জন্য ফয়সালা করলেন তথা তার কল্যাণে বিধান বাস্তবায়ন করলেন তখন তার অর্থ এ নয় যে, যে হক তার ছিল না তা প্রকৃতই তার হক হয়ে গেছে। বরং প্রদত্ত ফয়সালা ও বিধান বাস্তবায়ন সত্ত্বেও যা পূর্বে হারাম ছিল তা এখনও হারামই থাকবে। এ কারণেই রাসূল সা. তাকে সেই হক গ্রহণে নিষেধ করেছেন এবং তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, হকদার না হওয়া সত্ত্বেও যে হক গ্রহণ করলো সে যেন আগুনের টুকরা গ্রহণ করল।
যেহেতু রাসূল সা.—এর ফয়সালার অবস্থা এই, আর আমরা পূর্বে বলেছি যে, এখানে ফয়সালার অর্থ হলোÑ বিধান বাস্তবায়ন করা, অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের তাৎপর্য অনুধাবন এবং আয়াতের মর্ম উপলব্ধি ও সেই আয়াতে আল্লাহর উদ্দেশ্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
অতএব, তিনি ব্যতীত অন্য সকল লোকজন যারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের তাৎপর্য অনুধাবন এবং আয়াত ও হাদিসের হারকাাত ও উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষেত্রে ভুলের শিকার হয়, যেমনিভাবে শরিয়াহর অনেক বিধান সম্পর্কে অজ্ঞও হয়, এমন ব্যক্তিদের হুকুম ও ফয়সালা কখনও হারামকে হালাল এবং হালালকে হারাম করতে পারে না। বরং বাদী—বিবাদীর প্রত্যেকে রাসূল সা.—এর নিকট বিচারপ্রার্থী হতে, অর্থাৎ শরিয়াহর সিদ্ধান্তের দ্বারস্থ হতে আদিষ্ট। তারা আরও আদিষ্ট এ বিষয়ে যে, এ বিচার—ফয়সালার ফলশ্রম্নতিতে তার অন্তরে যে সত্যের উদয় হয় তার অনুসরণ করবে; যদিও সেই সত্যটি মুসলিম শাসক বা বিচারকের নিকট অস্পষ্ট হয় এবং তিনি এর বিপরীত রায় প্রদান করেন।
ইমাম শাফেয়ি র. তাঁর রচিত ‘আল—উম্ম’ কিতাবে রাসূল সা.—এর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, রাসূল সা. আজলান গোত্রের এক দম্পতির মধ্যে লিআনের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দেন। এ হাদিসের টীকায় তিনি বলেন,
কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সা.—এর মধ্যে লিআনের যে বিধান আলোচনা করা হয়েছে তার মধ্যে অনেক স্পষ্ট দলিল রয়েছে, ইলমচর্চাকারীদের সেগুলো জানতে আগ্রহী হওয়া এবং এ জাতীয় অন্যান্য ঘটনায় রাসূল সা.—এর ফয়সালা প্রদানের নীতিমালা জানতে প্রয়াসী হওয়া উচিত। এর দ্বারা তারা নিজেদের কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে এবং আরবি ভাষা ও সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে যে সংশয় সৃষ্টি হয় তা দূর হয়ে যাবে এবং যে প্রামাণ্য বিষয়গুলো অস্পষ্ট ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। ….তেমনি একটি মূলনীতি হলো, আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.—কে আদেশ করেছেনÑ তিনি যেন বাহ্যিক অবস্থার বিচারে ফয়সালা প্রদান করেন এবং দুই ব্যক্তির মধ্যে দণ্ডবিধি (হদ্দ) কায়েম করার ক্ষেত্রে যেন বাহ্যিক অবস্থারই নির্ভর করেন। কারণ, বাহ্যিক অবস্থা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর অপরাধের স্বীকারোক্তির বা দলিল—প্রমাণের সদৃশ। আর কারও ওপর হদ্দ প্রয়োগ বা তার বিরুদ্ধে হক সাব্যস্ত হওয়ার রায় প্রদানের ক্ষেত্রে তার মিথ্যাবাদী হওয়ার সম্ভাবনা ধর্তব্য হবে না। এমনিভাবে কাউকে তার সত্যবাদী হওয়ার সম্ভাবনার ভিত্তিতেও হক প্রদান করা হবে না; যতক্ষণ না তার বাহ্যিক অবস্থার নির্দেশনাগুলো সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায়; শুধু ব্যক্তি বিশেষের কাছে স্পষ্ট হলে চলবে না।
যখন রাসূল সা.—এর বিধান প্রদানের অবস্থা এই, তাহলে তাঁর পরবর্তী মুসলিম শাসক ও গভর্নরগণ আরও অধিক উপযুক্ত যে, তারা ইঙ্গিত ও সম্ভাবনাকে কখনও কার্যকর বিবেচনা করবে না এবং বাহ্যিক অবস্থার বিবেচনা ব্যতীত কখনও রায় প্রদান করবে না।
কেউ যদি প্রশ্ন করেÑ এর প্রমাণ কী? জবাবে আমরা বলবো, রাসূল সা. দুইজন লিআনকারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেনإنَّ أَحَدَكُمَا كَاذِبٌ : “নিশ্চয় তোমাদের দুজনের একজন মিথ্যাবাদী।” এখানে নবীজি সা. সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন বিধান প্রদান করেছেন এবং তাদেরকে দণ্ডবিধি থেকে মুক্ত করেছেন। তখন রাসূল সা. বলেছিলেন,
إنْ جَاءَتْ بِهِ أُحَيْمِرَ فَلَا أَرَاهُ إلَّا قَدْ كَذَبَ عَلَيْهَا وَإِنْ جَاءَتْ بِهِ أَدْعَج فَلَا أَرَاهُ إلَّا قَدْ صَدَقَ.
যদি তার গর্ভস্থ সন্তানটি লাল বর্ণের হয় তাহলে আমার মতে স্বামী (উওয়াইমির) তার বিরুদ্ধে মিথ্যা বলেছে। আর যদি তার গর্ভস্থ সন্তানটি কালো ও বড় চোখ বিশিষ্ট তাহলে আমার মতে সে সত্য বলেছে।
অতঃপর দেখা গেলÑ তার গর্ভস্থ সন্তানটি সেই অপছন্দনীয় বর্ণ ও আকৃতি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে। তখন রাসূল সা. বললেন,
إنَّ أَمْرَهُ لَبَيِّنٌ لَوْلَا مَا حَكَمَ اللَّهُ.
যদি আল্লাহর পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত তাহলে তার (যে কী শাস্তি হতো সে) বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট।”
উক্ত হাদিসে নবীজি সা. লিআনকারিণী মহিলার ব্যাপারে স্বামীর সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী হওয়ার দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেলÑ তার সত্যবাদী হওয়ার আলামতগুলো বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু নবীজি সা. ঐ নারীর ওপর এসকল আলামতকে কার্যকরী বিবেচনা করেননি। বরং তার ওপর আল্লাহ তাআলার বাহ্যিক বিধান প্রয়োগ করেছেন, ফলে তার ওপর হদ্দ প্রয়োগ করেননি এবং তাকে তার প্রাপ্য মহর প্রদান করেছেন। সেই সাথে এ কথাও বলেছেন, যদি আল্লাহর পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত তাহলে তার (যে কী শাস্তি হতো সে) বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট।”
অনুরূপ নবীজি সা. অপর এক হাদিসে বলেছেন, যেমনটি পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে :
إنكم تختصمون إلي وإنما أنا بشر ولعل أحدكم أن يكون ألحن بحجته من الآخر فأقضي له على نحو ما أسمع فمن قضيت له بشيء من حق أخيه فلا يأخذه فإنما أقطع له قطعة من النار.
তোমরা আমার কাছে এসে বিবাদ কর। আমি তো তোমাদের মতই মানুষ। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রমাণ পেশ করার ক্ষেত্রে তার প্রতিপক্ষের তুলনায় অধিক বাকপটু হয়, অতঃপর আমি যা শ্রবণ করি সে অনুযায়ী ফয়সালা করি। সুতরাং যদি কারও জন্য আমি তার ভাইয়ের হক থেকে কিছু অংশের ফয়সালা করি তাহলে সে যেন তা গ্রহণ না করে। কারণ, আমি তার জন্য যে ফয়সালা করেছি তা হলো আগুনের টুকরা। (আল—ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম : খ. ১, পৃ. ৩)
এর মাধ্যমে নবীজি সা. আমাদেরকে এ সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বাদী—বিবাদীর বাহ্যিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ফয়সালা প্রদান করেন এবং তাদের জন্য কেবল ঐ বিষয়কে হালাল ও হারাম করেন তাদের জ্ঞান অনুসারে যা তাদের মধ্যে ও আল্লাহ তাআলার মধ্যে হারাম। (আল—উম্ম, ইমাম শাফেয়ি : খ. ৫, পৃ. ১২১)
ইমাম ইবনে হাযম র. থেকেও এ জাতীয় বক্তব্য রয়েছে। যেমনÑ তিনি বলেন,
“বিচারকের রায় ঐ বিষয়কে হালাল করবে না, যা তার রায় প্রদানের পূর্বে হারাম ছিল এবং ঐ বিষয়কে হারাম করবে না, যা তার রায় প্রদানের পূর্বে হালাল ছিল। বরং বিচারক তো কেবল ঐ ব্যক্তির ওপর বিধান প্রয়োগকারী যে স্বেচ্ছায় বিধান মানতে চায় না; এছাড়া তার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।”
উপর্যুক্ত হাদিসটি আলোচনার পর তিনি বলেন, “যখন রাসূল সা.—এর ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত কারও জন্য ঐ বিষয়কে হালাল করে না যা তার ওপর হারাম ছিল তাহলে তার পরবর্তী কোনো ব্যক্তির রায় সেটিকে হালাল করবে, এটি কী করে সম্ভব?” (আল—মুহাল্লা বিল আছার : খ. ৯, প.ৃ ৪২২)
রাসূল সা.—এর কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়ার দ্বারা জানা যায়Ñ এ ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত কী ছিল? এটা জানার পর কর্তব্য হলো, তার ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং তা মনে—প্রাণে মেনে নেওয়া। অর্থাৎ, দৃঢ়রূপে একথা বিশ^াস করা যে, এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সত্য সিদ্ধান্ত এবং তার আনুগত্য করা আবশ্যক। এসকল বিষয় পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়, বাস্তবে ইসলামি হুকুমাত বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক। বরং ইসলামি হুকুমাত বিদ্যমান থাকলেই উক্ত আনুগত্য ও সমর্পণের বিষয়টি পাওয়া যাওয়া জরুরি নয়। কারণ, কখনও কখনও এমন হয় যে, ইসলামি হুকুমাত ঠিকই আছে; কিন্তু কোনো ব্যক্তি আল্লাহর হুকুমের খেলাফ বিশ^াস পোষণ করে। কাজেই এর দ্বারা সে রাসূল সা.—এর নিকট বিচারপ্রার্থী হলো না, অথবা রাসূল সা. কোনো মাসআলা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন ঐ ব্যক্তি সে সিদ্ধান্তকে মানল না।
নিম্নোক্ত আয়াতে কারিমা থেকে এ কথা স্পষ্ট নয় যে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়া মুসলিম শাসকের ওপর নির্ভরশীল :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ. فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِر.
হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য হতে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদের। কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ^াসী হও। (সূরা নিসা : ৫৯)
উপযুর্ক্ত আয়াতের মধ্যে সুস্পষ্টরূপে যে বিষয়ের প্রতি দিক নির্দেশ করা হয়েছে তা হলো, বিচারপ্রার্থী হওয়া। যখন তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মুসলিম শাসক ব্যতীত আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর প্রতি বিচারপ্রার্থী হওয়া সম্ভব নয়, তাহলে যখন আমাদের মধ্যে ও মুসলিম শাসকের মতবিরোধ হবে তখন আমাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিচারপ্রার্থী হওয়া কী করে সম্ভব হবে?
পূর্বে আমরা শাসকের আনুগত্য করা যে আবশ্যক, এ সম্পর্কিত হাদিসসমূহ উল্লেখ করেছি এবং আরও উল্লেখ করেছি, পাপ কাজে কোনো শ্রবণ ও আনুগত্য চলবে না। আর শাসকের আদেশ পালন কখন আল্লাহর আবাধ্যচারণ হবে, এ বিষয়টি আমরা কেবল তখনই জানতে পারবো যখন আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দরবারে আমাদের বিষয়টি প্রত্যানীত করবো এবং বিচারপ্রার্থী হবো। অথার্ৎ, শাসকের নির্দেশটিকে যখন কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের সাথে মিলিয়ে দেখব। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারবোÑ শাসকের সেই আদেশ পালন করলে তা হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ এবং গোনাহ।
অতএব, তাদের দাবি অনুযায়ী মুসলিম শাসকের মাধ্যম ব্যতীত রাসূল সা.—এর নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়ার বিষয়টি যদি পূর্ণতা না পেত এবং সম্ভব না হতো তাহলে আমরা শাসকের নির্দেশের বিষয়টি রাসূল সা.—এর নিকট প্রত্যানীত করতে এবং এ কথা শনাক্ত করতে অক্ষম হয়ে পড়তাম যে, শাসকের নির্দেশটি কি আল্লাহ তাআলার অবাধ্যচারণ না তাঁর আনুগত্যের শামিল?
প্রকৃত কথা হচ্ছে, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং শরিয়া আইন জারি করা Ñশুধু বিচারপ্রার্থী হওয়া নয়Ñ এর আবশ্যিক দাবি হচ্ছে, ইসলামি হুকুমাত থাকা। আর মুসলিম ইমাম বা ইসলামি হুকুমাতের কর্তব্য হলো, বান্দাদের ওপর আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং শরিয়া আইন জারি করা।
সুতরাং যখন আমরা রাসূল সা.—এর নিকট বিচারপ্রার্থী হবো তখন আমরা জানতে পারবো যে, চুরি করা হারাম। নারী চোর ও পুরুষ চোর, তাদের ব্যাপারে আল্লাহর বিধান হলো তাদের নির্ধারিত দণ্ড দেওয়া হবে, আর তা হচ্ছেÑ তাদের হাত কেটে দেওয়া।
এ বিচার চাওয়ার বিষয়টি পূর্ণতা পাবে, ইসলামি হুকুমাত বিদ্যমান থাকুক বা না থাকুক। তবে পুরুষ ও নারী চোরের ওপর আল্লাহর বিধান প্রয়োগের জন্য মুসলিম উম্মাহর মধ্যে একটি ব্যাপক কতৃর্ত্বের অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক, যা শরিয়াহ নির্ধারিত সেই শাস্তি প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করবে। সুতরাং আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর কাছে বিচারপ্রার্থী হওয়া এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া একটি বিষয় এবং বিচার চাওয়ার ফলশ্রম্নতিতে আল্লাহর সেই বিধান বাস্তবায়ন করা ভিন্ন বিষয়।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) প্রতিটি সম্বোধন আমাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিধান দান করে। অন্য সম্বোধন সংশ্লিষ্ট বিধান দান করে না। যেমনÑ আল্লাহ তাআলার বাণী :
إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا.
নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। (সূরা নিসা : ১০৩)
উক্ত আয়াত এ বিধান দান করে যে, নামায আদায় করা মুমিনদের ওপর ফরয এবং তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তা হচ্ছেÑ নির্দিষ্ট সময়। উক্ত সম্বোধন আমাদেরকে কেবল এ দুটি বিধান দান করে। কিন্তু এ আয়াতে আলোচ্য বিষয়ের বাইরের যেসকল বিষয় রয়েছে, এখানে সেগুলোর কোনো বিধান নেই। যেমনÑ উক্ত আয়াত নামায ত্যাগকারীর বিধান দান করে না, যেমনিভাবে তা চোর, ব্যভিচারী, মদপানকারীসহ অন্যান্য অপরাধীদের বিধান দান করে না। বরং আমরা এসবের বিধান জানতে পারবো তার সংশ্লিষ্ট সম্বোধন থেকে।
পূর্বে আমাদের আলোচ্য সূরা নিসার আয়াত :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا.
কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদর বিচারভার আপনার ওপর অর্পণ না করে, অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং তারা সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়। (সূরা নিসা : ৬৫ )
উক্ত আয়াত আমাদেরকে এ বিধান দান করে যে, রাসূল সা.—এর ওপর বিচারভার অর্পণ করা এবং তার সিদ্ধান্তকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া জরুরি। এমনিভাবে তা ঐ ব্যক্তির বিধানও দান করে, যে রাসূল সা.—এর ওপর বিচারভার অর্পণ করে না, অথবা তাঁর সিদ্ধান্তকে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করে না। কিন্তু আয়াতে ঐ ব্যক্তির বিধান আলোচনা করা হয়নি, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান বাস্তবায়ন করে না। এ শেষোক্ত বিষয়টি আলোচ্য আয়াতের নির্দেশনার অন্তভুর্ক্ত নয়। তাই এর বিধান ভিন্ন দলিলের ওপর নির্ভরশীল।
এমনিভাবে আলোচ্য আয়াতে আমাদেরকে রাসূল সা.—এর নিকট বিচারপ্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সীমালঙ্ঘনকারী উপকরণগুলো প্রতিহত করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়নি। বরং আমাদের প্রতি আয়াতের নির্দেশনা হলো, রাসূল সা.—এর ওপর বিচার ভার অর্পণ করতে হবে এবং তার সিদ্ধান্তকে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিতে হবে।
আর বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির ওপর থেকে গোনাহ উঠিয়ে নেওয়া হয়, এ সম্পর্কিত আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে আমরা জানতে পারিÑ আমাদের আলোচ্য আয়াতটি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে নয়, যাকে রাসূল সা. ব্যতীত অন্য কারও কাছে বিচার চাইতে বাধ্য করা হয়েছে, এমতাবস্থায় যে, তার অন্তর ঈমানে অবিচল। কারণ, কাউকে কোনো নির্দেশ পালনের দায়িত্ব প্রদান করলে তা আবশ্যিকরূপে সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধক উপকরণগুলো দূরীভূত করার দায়িত্বকে অন্তভুর্ক্ত করে না।
যেমনÑ নামায কায়েম করার নির্দেশ দেওয়া হলো, যেমনটি আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, এর মধ্যে নামায কায়েমের প্রতিবন্ধক উপকরণগুলো দূর করার নির্দেশ সম্বলিত নেই। এমনিভাবে ফরয হজ্জ আদায়ের নির্দেশ হজ্জ পালনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই ও যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ সম্বলিত নয়। কারণ, কাউকে সম্বোধন করে কোনো কাজের দায়িত্ব প্রদান করা একটি বিষয়, আর সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধক উপকরণগুলো দূরীভূত করা একটি ভিন্ন বিষয়, যার জন্য অন্যান্য নস থেকে দলিল প্রদান করা আবশ্যক। যেমনÑ আল্লাহ তাআলার বাণী :
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ.
যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ, তাদের ওপর জুলুম করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম। (সূরা হাজ্জ : ৩৯)
এ জাতীয় আরও অনেক নস রয়েছে যেখানে সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে প্রতিহত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াকে আবশ্যক করা হয়েছে, যাতে করে আল্লাহর কালিমা সমুন্নত হয় এবং অন্যায় প্রতিহত হয়।
আর এ কথা যে, ওয়াজিবের পূর্ণতা যে বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল তাও ওয়াজিবÑ এটি মানব রচিত একটি পরিভাষা বা মূলনীতি, যারা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয় এবং এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের কোনো বক্তব্যও বর্ণিত হয়নি।
যারা এ পরিভাষা রচনা করেছেন এর দ্বারা তারা একটি বিশেষ অর্থকে বুঝাতে চেয়েছেন, যা বিভিন্ন নির্দেশ সম্বলিত নসের মধ্যে তারা অনুধাবন করেছেন। তাদের বক্তব্য হলো, সেই নসগুলো স্বয়ং উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা আরেকটি নির্দেশের বাস্তবায়ন ও পরিপালন উদ্দেশ্য। যেমনÑ অযু করার নির্দেশ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ নামাযের জন্য পবিত্রতা অর্জন করা। পানি তালাশ করার নির্দেশ, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ অযু সম্পন্ন করা। পরনারী থেকে দৃষ্টিকে অবনত করা এবং তাকে স্পর্শ না করার নির্দেশের উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ এর কারণে যেন ব্যভিচারে লিপ্ত হতে না হয়। এসকল তাৎপর্যকে তারা সেই পরিভাষা দ্বারা ব্যক্ত করেছেন।
যেহেতু কোনো কাজের নির্দেশ পালনের বিষয়টি সেই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য জরুরি উপকরণগুলো পূর্ণ করার নির্দেশকে অন্তভুর্ক্ত করে, এ কারণে ফকিহগণ এ জাতীয় কাজকে ওয়াজিবের পূর্ণতা দাকারী হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
কিন্তু প্রকৃত কথা তাই যা অপর পক্ষ বলেছেন যে, এসকল কাজ সেই আদেশের নির্দেশনা এবং সংশ্লিষ্ট কাজটি বাস্তবায়নের আবশ্যিক দাবি। কারণ, সেগুলো ছাড়া উক্ত কাজটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কাজেই তা সেই আদেশেরই একটি অংশ স্বরূপ। যেমনÑ হজ্জ পালনের নির্দেশ। হজ্জ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোনো কাজের ইচ্ছা করা। আর তার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, নির্দিষ্ট নিয়মে বায়তুল্লাহ শরিফে গমন ও নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পন্ন করার ইচ্ছা করা। অতএব হজ্জের ক্ষেত্রে বায়তুল্লাহ শরিফ গমন করা ওয়াজিবের পূর্ণতা স্বরূপ নয়, বরং এটি স্বয়ং উদ্দেশ্য।
কেউ কেউ “ওয়াজিবের পূর্ণতার জন্য যে বিষয়টি জরুরি তাও ওয়াজিব” এটিকে একটি শরয়ি মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। তবে এর প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে।
এমনকি যারা এ পরিভাষাটিকে একটি শরয়ি মূলনীতি বানানোর চেষ্টা করেছেন তারা ধারণা করেছেনÑ ওয়াজিবের পূর্ণতার জন্য যে বিষয়টি জরুরি তার বিধান ও মূল ওয়াজিবের বিধান একই। একারণে তাকে মূল ওয়াজিবের মতই গণ্য করেছেন। অথচ পরনারী থেকে দৃষ্টি অবনত না করা এবং তাদেরকে স্পর্শ করার বিধান ও ব্যভিচারের বিধান এক নয়।
এমনিভাবে মদ মজুদ করা এবং তা বিক্রি করা গোনাহ, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মদ মজুদকারী ও বিক্রেতার বিধান মদ পানকারীর বিধানের মত নয়। এসব ক্ষেত্রে বিধান নির্ণয় করতে হয় প্রতিটি বিষয়ের সংশ্লিষ্ট নস দ্বারা।
এ কারণে যদি ধরে নেওয়া হয় Ñযদিও এ দৃশ্যকল্পটি সঠিক নয়Ñ আয়াতে কারিমা :
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ….
“কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ—বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার ওপর অর্পণ না করে…।” (সূরা নিসা : ৬৫)
উক্ত আয়াতের মধ্যে রাসূল সা.—এর নিকট বিচার কামনার প্রতিবন্ধক বিষয়গুলোকে প্রতিহত করার নির্দেশও নিহিত আছে, তারপরও কিন্তু তার মধ্যে এ দায়িত্ব পালন ও সীমালঙ্ঘন দূরীকরণে অবহেলাকারীর বিধান নিহিত নেই।
এ আলোচনার দ্বারা উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাদের ভুলের কারণটি স্পষ্ট হয়ে যায়। এমনিভাবে ঐ ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে ইসলামি হুকুমাত না থাকলে সকল মানুষ ঈমানহারা হয়ে যাবে, এ ভুলের কারণও স্পষ্ট হয়ে যায়।
সর্বোপরি আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, ইসলামি হুকুমাত না থাকলে সকল মানুষ ঈমানহারা হয়ে যাবে এ কথা এবং কোনো ব্যক্তি ইসলামি হুকুমাত না থাকাকে বৈধ জ্ঞান করলে তার বিধান কী? এ দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য অনুধাবন করা।
অতএব, কেউ যদি ইসলামি হুকুমাতের আবশ্যিকতা সম্পর্কে অকাট্য দলিল জানা সত্ত্বেও ইসলামি হুকুমাত না থাকাকে বৈধ জ্ঞান করে, তার মানে হচ্ছেÑ সে ঐ নসকে অস্বীকার করছে এবং আল্লাহ তাআলার বিরোধিতাকে বৈধ মনে করছে। এ কারণে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি মনে করবেÑ ইসলামি হুকুমাত থাকা আবশ্যক এবং আল্লাহ তাআলা ইসলামি হুকুমাত কায়েমের আদেশ করেছেন, এ বিশ^াসের সাথে সে যদি ইসলামি হুকুমাত কায়েমের প্রচেষ্টা থেকে বসে যায় এবং এ বসে যাওয়া পেছনে তার শরিয়াহ স্বীকৃত কোনো কারণ না থাকে তাহলে সে ফাসেক ও গোনাহগার হবে।
বস্তুত ইসলামি হুকুমাত না থাকলে উম্মাহর সকল সদস্য ঈমানহারা হয়ে যাবে, যদি এ কথা মেনে নেওয়া হয়, তবে এর ফলাফল হবে অত্যন্ত মারাত্মক, যা অকাট্য দলিল—প্রমাণ ও ইজমার বিরোধী হবে। কারণ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, “কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না…” উক্ত আয়াতের সম্বোধন জিন ও ইনসান সকলের প্রতি।
আর যারা বলে যে, কোনো ব্যক্তি মুমিন হতে পারবে না, যদি ইসলামি হুকুমাত না থাকে, যা শাসককে Ñসে যে ভূখণ্ড ও অঞ্চলেরই হোক না কেনÑ আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোনো শরিয়াহর অনুসরণ থেকে বাধা প্রদান করবে। উক্ত বক্তব্যের দাবি অনুযায়ী সকল মুসলিম ও সকল মানুষ ঈমানহারা হয়ে যাবে যখন কোনো ভূখণ্ডে এমন কোনো মুসলিম পাওয়া যাবে, যে ইসলামি শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোনো শরিয়াহর নিকট বিচারপ্রার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। এমনিভাবে যদি কোনো মুসলিম শাসক কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে তাহলে উম্মতের সকল সদস্য ঈমানহারা হয়ে যাবে। কারণ, যখন শাসক কোনো বিষয়ে ইচ্ছাকৃত আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করবে তখন তার থেকে হক ও সত্যনিষ্ঠ ইমামের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাবে, এবং তখনই মুসলিম শাসক ও ইসলামি হুকুমাতের অস্তিত্ব বিলীন হবে। এর মানে হচ্ছে, তার শাসন আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ব্যতীত ভিন্ন কোনো শরিয়াহ বা আইনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর এ কথার অনিবার্য দাবি হচ্ছে, কোনো এক সময় এমন ছিল, যখন পৃথিবীর বুকে রাসূল সা. ব্যতীত আর কোনো মুসলিম ছিল না।
আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা বলবো, পূর্বে উল্লেখিত সূরা নিসার ৬৫ নং আয়াতে প্রত্যেক ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেন সে তার জীবনের যাবতীয় বিষয়ে Ñহোক তা আকিদা, ইবাদত অথবা লেনদেন কিংবা অন্য কিছু সংক্রান্ত বিষয়Ñ রাসূল সা.—কে বিচারক হিসেবে মেনে নেবে এবং সকল কিছুতে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে। এর দ্বারা সে জানতে পারবেÑ রাসূল সা. আপন রবের পক্ষ থেকে ওহি স্বরূপ কী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অতঃপর সে নিশ্চিতরূপে বিশ^াস করবেÑ এটাই হচ্ছে প্রকৃত সত্য, যার অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং তাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করবে। আর যে ব্যক্তি তার অন্তর বা কথা দ্বারা রাসূল সা.—কে বিচারক হিসেবে মানবে না, অথবা তাঁর সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করবে না তার ঈমান চলে যাবে।
ইতঃপূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, অজ্ঞ ব্যক্তিকে তার অজ্ঞতার কারণে, ইজতিহাদকারীকে তার ভুলের কারণে এবং বলপ্রয়োগকৃত ও নিরুপায় ব্যক্তিকে তার ওপর বলপ্রয়োগ করা বা তার নিরুপায় হওয়ার কারণে অপারগ (মাজুর) হিসেবে গণ্য করা হবে।
আর তারা যে সূরা মায়িদার আয়াত দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন, অথার্ৎ
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ.
আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! তাওরাত, ইনজিল ও যা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমাদের কোনো ভিত্তি নেই। (সূরা মায়িদা : ৬৮)
এ জায়গায় উক্ত আয়াত দ্বারা দলিল গ্রহণ যে ভুল তা প্রমাণের জন্য এ কথাই যথেষ্ট যে, এ আয়াতটি নাযিল হয়েছে রাসূল সা. মদিনায় হিজরত করার পর যখন তিনি বিশ^বাসী ও সমগ্র মানুষের প্রতি [যাদের মধ্যে আহলে কিতাবও ছিল] ইসলামের দাওয়াত প্রদান শুরু করলেন। এর দ্বারা তাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা বিশ^াস করবেÑ মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তারা নবীজি সা. আনীত গোটা দীনের ওপর ঈমান আনবে। তিনি যে শাসন ব্যবস্থা ও শরিয়াহ নিয়ে এসেছেন তা মেনে চলবে। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূল সা.—এর শরিয়াহ তাঁর পূর্ববর্তী সকল শরিয়াহকে রহিত করে দিয়েছে।
কাজেই সেখানে এ কথা বলা সঠিক হবে না যে, আহলে কিতাব একই সময়ে তাওরাত, ইনজিল ও তার পরবর্তী শরিয়াহ তথা ইসলামের বিধান বাস্তবায়নের জন্য হুকুমাত বা সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য আদিষ্ট ছিল। বরং আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, তাওরাত ও ইনজিলের যেসকল বিধান ইসলাম দ্বারা রহিত হয়নি তা প্রতিষ্ঠা করা, যেগুলোর সিদ্ধান্ত হলোÑ আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই এবং উক্ত কিতাবদ্বয়ের ঐ সকল বক্তব্যের ওপর আমল করা, যা নবীজি সা.—এর আগমনের বার্তা দেয় এবং তাঁর সত্যতা প্রমাণ করে। এর দ্বারা সমগ্র মানুষ, বিশেষত আহলে কিতাবের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা নবী সা. এবং তাঁর আনীত পুরো দীনের প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁর শাসনকে মেনে নিয়ে তাঁর পতাকাতলে সমবেত হয়ে যাবে।
আর সূরা নূরের আয়াত :
إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ.
মুমিনদের কথা তো এই, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে এ মর্মে আহ্বান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার—মীমাংসা করবেন, তখন তারা বলেÑ আমরা শ্রবণ করলাম ও আনুগত্য করলাম। আর তারাই তো সফলকাম। (সূরা নূর : ৫১) এর জবাব হলো, উক্ত আয়াতে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে; তাদের প্রত্যেকের অবস্থান, আকিদা, কথা ও কাজ যাই হোক না কেন। এ আয়াতে সকল মানুষের ওপর বর্তায়Ñ এমন সামগ্রিক বিধান বর্ণনা করা হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্যই তাÑই যা আল্লাহ তাআলা বলেছেন। অর্থাৎ, ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যাকে বিবদমান কোনো বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ফয়সালা জানার জন্য আহ্বান করা হলো, কিন্তু সে অহংকার বশত অস্বীকার করলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকে বৈধ মনে করলো এবং “আমরা শ্রবণ করলাম ও আনুগত্য করলাম” এমন কথা বললো না।
পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, যে ব্যক্তি সেচ্ছায় স্বাধীন অবস্থায় আল্লাহর বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং তার কাছে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ পেঁৗছার পর সে তার থেকে বিচার কামনা হতে অস্বীকার করবে, মুখে অথবা অন্তর দ্বারা তার বিরোধিতা করবে সে সর্বসম্মতিক্রমে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি শরিয়াহর সিদ্ধান্তকে অন্তর দ্বারা মেনে নেওয়ার পর কার্যত এর বিরোধিতা করবে, অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের খেলাফ কাজ করবে, কিন্তু সে নিজের কাজটিকে বাতিল বলে বিশ^াস করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. নির্দেশের [যার আনুগত্য ও অনুসরণ করা ওয়াজিব] বিরোধিতার কারণে নিজেকে গোনাহগার মনে করবে, এমন ব্যক্তি ফাসেক ও গোনাহগার হবে; যদিও সে এ কাজের কারণে ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে না এবং ঈমানহারা হবে না।
বিচার ফয়সালা ও দীনের আবশ্যিক জ্ঞান
কেউ কেউ মনে করেন, যে বিচারক বা শাসক আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না যে কাফের। এর সুস্পষ্ট প্রমাণÑ আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট বাণী :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। (সূরা মায়িদা : ৪৪)
তাদের বক্তব্য হলো, এ আয়াতের বিধানটি দীনের আবশ্যিক জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত, আর যে শাসক বা বিচারক আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করে না তার অবস্থাও মানুষের নিকট সুবিদিত। কাজেই তার আবশ্যিক দাবি হলো, ঐ শাসক ও বিচারককে নিশ্চিতরূপে কাফের আখ্যা দিবে। অন্তর দ্বারা তার কাফের হওয়ার বিশ^াস করবে এবং মুখে এ কথা প্রচার করবে।
অতএব, যে ব্যক্তি ঐ শাসকের ওপর বিধান প্রয়োগে পিছপা হলো সে মূলত দীনের একটি আবশ্যিক বিষয়কে অস্বীকার করলো এবং এর দ্বারা সেও কাফের হয়ে গেল। আর যে ব্যক্তি ঐ শাসককে কাফের ঘোষণার সাথে একাত্মতা পোষণ করলো না সে আরও উত্তম রূপে কাফের হয়ে গেল। কারণ, যে ব্যক্তি ঐ শাসককে কাফের আখ্যা দিল না সেও আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার ফয়সালা না করার কারণে কাফের হয়ে গেল। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে। এ কারণে আমরা ‘দীনের আবশ্যিক জ্ঞান’ পরিভাষাটির অর্থ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করা জরুরি মনে করছি।
বস্তুত মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা ও না জানাই হচ্ছে আসল। বিষয়টি কুরআনে কারিমের সুস্পষ্ট বাণী দ্বারাও প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاللَّهُ أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ لَا تَعْلَمُونَ شَيْئًا.
আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে বের করেছেন, যখন তোমরা কিছুই জানতে না। (সূরা নাহল : ৭৮)
এরপর আল্লাহ মানুষের মধ্যে যে অজানার প্রতি আগ্রহ প্রবণতা গচ্ছিত রেখেছেন তা দ্বারা এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয় [যেমনÑ শোনা, দেখা, স্বাদ গ্রহণ, স্পর্শ করা ও ঘ্রাণ নেওয়া] দ্বারা অজানাকে জানতে শুরু করে। আর মানুষ যেসব বিষয় জানে কখনও তা ইচ্ছাকৃত জানে, আবার কখনও মানুষ অনিচ্ছায়, এমনকি না চাইতেও অনেক বিষয় জেনে যায়।
যেমন যখন কোনো বিষয়ের ওপর কারও দৃষ্টি পড়ে তখন সে যে জিনিসের ওপরে দৃষ্টি পড়েছে তার সাথে পরিচিত হয় এবং তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে; এতে সে ঐ জিনিসের দিকে তাকানোর ইচ্ছা করুক বা না করুক। এমনিভাবে কারও কানে কোনো কথার আওয়াজ পেঁৗছলে সে এর দ্বারা ঐ কথার অর্থ ও মর্ম বুঝতে পারে; যদিও আওয়াজটি তার অনিচ্ছায় কানে প্রবেশ করে।
মানব সমাজে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে অনেক অবস্থা অবলোকন করতে হয় এবং অনেক ধরনের কথা ও আওয়াজ শুনতে হয়। এভাবে তার কর্ণকুহরে যে আওয়াজ পেঁৗছে, যে জিনিসের ওপরে তার দৃষ্টি পড়ে এবং তার ইন্দ্রিয় যা অনুধাবন করে সে ঐ সকল জিনিসের জ্ঞান লাভ করে।
মানুষ যেসকল সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে তার বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। যেমনÑ কখনও সে স্বীয় চক্ষু দ্বারা এক বা একাধিক ব্যক্তির অবস্থা প্রত্যক্ষ করে। কখনও এক ব্যক্তি বা একদল লোক থেকে সংবাদ শোনে। আর কোনো সংবাদ বর্ণনার সবচেয়ে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হচ্ছেÑ যা পরিবর্তন—পরিবর্ধন ব্যতিরেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বহু লোকের মাধ্যমে বর্ণিত হয় এবং সেই সংবাদের বিশুদ্ধতা ও সত্যতা সকলের নিকট স্বীকৃত হয়। আর মানুষের স্বভাব—প্রকৃতিতে এ বিষয়টি অসম্ভব যে, নানা মত, পথ, চিন্তা ও রুচির মানুষ কোনো মিথ্যা ঘটনা রচনা কিংবা কোনো ভুল সংবাদ রটনার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সেই মিথ্যা কথা বা ঘটনাটি বর্ণনা করে যাবে; অথচ তাদের কেউ প্রকৃত সত্যটি প্রকাশ করবে না, অথবা সে বিষয়ের বর্ণনায় কোনো দ্বিমত সৃষ্টি হবে না, অথবা সত্যারোপকারী ও মিথ্যারোপকারী কিংবা স্বীকৃতি দানকারী ও সন্দেহ পোষণকারী, এ দুই শ্রেণিতে তারা বিভক্ত হবে না।
মূলত এ কারণে যখন কোনো সংবাদ কোনো মতভিন্নতা ব্যতিরেকে বহু লোকের দ্বারা বর্ণিত হয় এবং সকলে তার সত্যতার ওপর একমত হয় তখন তা অকাট্য জ্ঞানকে আবশ্যক করে এবং উক্ত খবরটি নিশ্চিতরূপে সত্য হওয়া বুঝায়।
কিছু জ্ঞান এমন আছে, নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার জন্য যা জেনে রাখা জরুরি। যদি কোনো ব্যক্তি ঐ বিষয়গুলো না জানে তাহলে সে সেই বৈশিষ্ট্যটি হারিয়ে ফেলে।
উপর্যুক্ত আলোচনা বোঝার পর আমরা বলবো, দীনের আবশ্যিক জ্ঞান দুপ্রকার :
এক. “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া। এ বিষয়টি জানা থাকা মানুষের জন্য জরুরি, তাহলে তার সাথে ইসলামের বৈশিষ্ট্য যুক্ত হবে এবং তখন ঐ ব্যক্তিকে মুসলিম বা মুমিন হিসেবে গণ্য করা হবে। অতএব, কোনো ব্যক্তি যদি এ সাক্ষ্যের বিষয়ে না জানে এবং এ কথার সাক্ষ্য না দেয় তাহলে দুনিয়ার বিধানে সে মুসলিম বলে গণ্য হবে না। এ সম্পর্কিত দলিল পূর্বে আলোচিত হয়েছে।
দুই. শরিয়াহর এমন বিধান, রাসূল সা. বহু লোকের সামনে বারংবার যার আদেশ করেছেন এবং নিজে তা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন, ফলে এ বিষয়ের জ্ঞান মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এবং উক্ত কাজটি ওয়াজিব বা ফরয হওয়া কিংবা নিষিদ্ধ হওয়ার কথা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বহু লোক ঐকমত্যের সাথে বর্ণনা করেছে এবং এ ব্যাপারে মুসলিমদের মধ্যে কোনো দ্বিমত হয়নি।
অর্থাৎ, তা এমন সূত্রে আমাদের পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে যা নিশ্চিত রূপে সত্য হওয়া বুঝায়, ফলে তার বিধানটি ইজতিহাদ ও ভুলের সম্ভাবনা থেকে বেরিয়ে গেছে। এভাবে তার বিশুদ্ধতা ও আমলযোগ্য হওয়ার বিষয়টি মুসলিমদের মধ্যে স্পষ্ট ও প্রসিদ্ধ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। অতএব, যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম সমাজে কিছু সময় অবস্থান করে তাহলে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তাদের কথা শুনে বুঝতে পারবেÑ উক্ত ফরয বিধান বা নিষিদ্ধ কাজ সম্পর্কে জানা থাকা সকলের জন্য আবশ্যক, ফলে তার থেকে এ বিষয়ে অজ্ঞতা বা এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে বিতর্ক কোনো অবস্থায় গৃহীত হবে না।
এর একটি দৃষ্টান্ত হলো, দিনে রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া এবং মুকিম ব্যক্তির জন্য নামাযের রাকাত সংখ্যা। নামাযের আবশ্যিক উপকরণ ও কাজ। যেমনÑ কিবলামুখী হওয়া, কিয়াম করা, রুকু ও সিজদা করা ইত্যাদি। রমযান মাসে রোযা ফরয হওয়া, বায়তুল্লাহয় গিয়ে হজ্জ পালন করা। ধনীদের সম্পদে যাকাত ফরয হওয়া, মুসলিমদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা।
পূর্বে আমরা আলোচনা করেছিÑ শরিয়াহর এসকল বিধানের জ্ঞান অর্জন ফরয হওয়ার ভিত্তি হলো, এ বিষয়গুলো মুসলিমদের মধ্যে স্পষ্ট ও বহুল প্রচলিত এবং কারও কাছে বিষয়গুলো অস্পষ্ট নয়। কেউ যদি মুসলিম সমাজে কিছু দিন অবস্থান করে তাহলে সে অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করবে এবং এসব আবশ্যিক বিষয়ের জ্ঞান তার কানে পেঁৗছে যাবে। কারণ, সকলে এসবের আবশ্যিকতাকে স্বীকার করে এবং এ কথা মানে যে, এগুলো আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের ফরয বিধান। এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করে না।
“দীনের আবশ্যিক জ্ঞান” এ পরিভাষাটির সমর্থনে কিতাবুল্লাহ বা সুন্নাতে রাসূল সা. থেকে কোনো দলিল বর্ণিত হয়নি। বরং এটি হচ্ছেÑ মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবতার নিরিখে কৃত গবেষণার ফলাফল। যেহেতু আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অদৃশ্যের জ্ঞান আর কারও নেই এবং এটি একটি স্বীকৃত মূলনীতি, যার কোনো ব্যতিক্রম নেই, কাজেই এমনটি অসম্ভব নয় যে, কোনো ব্যক্তি মুসলিম সমাজে বসবাস করেছে, যেখান থেকে ঐ সকল আবশ্যিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারতো; কিন্তু তা সত্ত্বেও তার কাছে এ বিষয়ক জ্ঞান ও তথ্য পেঁৗছায়নি।
এ কারণে অধিকাংশ মুসলিম ফকিহগণের সিদ্ধান্ত হলো, যদি কারও কাছে সঠিক জ্ঞান পেঁৗছার ব্যাপারে সন্দেহের উপাদান তৈরি হয় তাহলে আমরা নিশ্চিতরূপে এ সিদ্ধান্ত দিতে পারবো না যে, সে বিষয়টি ভালো করে জানে। আর তখন ঐ ব্যক্তিকে তার কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া যাবে না; বরং তাকে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ (মাজুর) বিবেচনা করতে হবে। অতএব, এ সকল বিধান বা তার আংশিকের ব্যাপারে তার অজ্ঞতা কিংবা অস্বীকারের কারণে সে ঈমানহারা হবে না। বরং তার কাছে সঠিক জ্ঞান পেঁৗছাতে হবে, তাকে তার অজানা জরুরি বিষয়গুলো শিক্ষা দিতে হবে, আর তখন তার প্রতি প্রমাণ পরিপূর্ণ হবে।
যে ব্যক্তির কাছে একটি বিশাল দলের বর্ণনা উপস্থিত হবে এবং এ সম্পর্কিত ইজমার কথাও সে জানতে পারবে তার পক্ষ থেকে বিতর্ক ও অস্বীকার গ্রহণের কোনো সুযোগ থাকবে না। ইতঃপূর্বে আমরা এ সম্পর্কিত একটি ঘটনা বর্ণনা করেছি যে, আবদুর রহমান ইবনে হাতেব এর একজন অনারবী বাঁদি ছিল, যে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল। যখন উসমান রা.—এর অন্তরে সন্দেহ সৃষ্টি হলো যে, বাঁদিটি হয়তো ব্যভিচার হারাম হওয়া সম্পর্কে অজ্ঞ; কারণ তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে, সে কৃতকর্মের কারণে মোটেও দুঃখিত না, বরং তাকে প্রফুল্ল ও হাসি—খুশি দেখাচ্ছে, যেন সে ব্যভিচার হারাম হওয়া সম্পর্কে মোটেও অবগত নয়। এ কারণে তিনি ঐ বাঁদির ওপর হদ্দ প্রয়োগ করেননি। বরং তার অজ্ঞতার কারণে তাকে অপারগ হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং উমর রা.—ও এ ব্যাপারে তার সাথে একাত্মতা পোষণ করেছেন।
কেউ কেউ ধারণা করেছেÑ আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। (সূরা মায়িদা : ৪৪) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ শাসক বা বিচারক। এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, আয়াতটি ব্যাপক অর্থবোধক, যা প্রত্যেক ঐ ব্যক্তিকে শামিল করে যে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করে; হোক সে শাসক, বিচারক, মুফতি বা অন্য কোনো সাধারণ মানুষ। কারণ, শরিয়াহর কোনো বক্তব্যকে দলিল বিহীন সীমিত করা শরিয়াহর দৃষ্টিতে নাজায়েয।
তার কারণ হলো, আয়াতে বর্ণিত হুক্ম (حُكْم) শব্দের অর্থ হচ্ছেÑ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করা। আর দীনের ব্যাপারে সেই সিদ্ধান্ত হতে পারেÑ হারাম, ওয়াজিব, সাধারণভাবে বৈধ কিংবা মাকরূহ (অপছন্দনীয়) কিংবা উত্তম ঘোষণা করা। (আল—ইহকাম ফি উসূলিল আহকাম, ইবনু হাযম : খ. ১, পৃ. ৪৯)
সুতরাং হুকুম শব্দের অর্থ দাঁড়ায়Ñ সিদ্ধান্ত প্রদান করা কিংবা কোনো বিষয় বা কাজের জন্য শরয়ি বৈশিষ্ট্য নিধার্রণ করা। নিম্নে হুক্ম শব্দের আভিধানি অর্থ ও তার ব্যবহার উল্লেখ করা হলো :
আসাসুল বালাগাহ (খ. ১, পৃ. ২০৬) গ্রন্থকার বলেন, أحكم الشيء অর্থ হচ্ছেÑ সে বিষয়টিকে দৃঢ় করলো, ফলে তা দৃঢ় হয়ে গেল। حكم الفرس وأحكمه এর অর্থ হচ্ছেÑ সে ঘোড়াটিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করলো। حكموه অর্থÑ তারা তাকে বিচারক নির্ধারণ করলো। حكمه في ماله অর্থÑ সে তার সম্পদে সিদ্ধান্ত প্রদান করলো এবং এর দ্বারা সে তাতে কতৃর্ত্ব করলো। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে : إن الجنة للمحكمين (নিশ্চয় জান্নাত ঐ সকল লোকদের জন্য যাদের কাছে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়েছে) এরা ঐ সকল লোক যাদেরকে শিরক গ্রহণ অথবা ইসলামের ওপর অটল থেকে নিহত হওয়াÑ এ দুটি বিষয়ের যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার অবকাশ দেওয়া হলে তারা ইসলামের ওপর অটল থেকে নিহত হওয়ার পথকে বেছে নেন। حاكمته إلى القاضي অর্থÑ আমি বিচারকের কাছে মামলা দায়ের করলাম। وهو يتولّى الحكومات অর্থÑ তিনি বিবাদ মীমাংসা করবেন।
মুখতারুস সিহাহ (খ. ১, পৃ. ৭৮( গ্রন্থকার বলেন,
الحكم অর্থÑ ফয়সালা বা সিদ্ধান্ত। যেমন বলা হয় : وقد (حكم) بينهم يحكم بالضم (حكما) و (حكم) له : সে তার পক্ষে বা রায় দিল। وحكم عليه : তার বিপক্ষে রায় দিল। (الحكيم) অর্থ হচ্ছেÑ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী, সুন্দররূপে কাজ সম্পন্নকারী। حَكُمَ অর্থÑ সে প্রজ্ঞার অধিকারী হলো। (حكمه) في ماله تحكيما অর্থÑ সে তাকে স্বীয় সম্পদের ব্যাপারে বিচারক নির্ধারণ করলো, অতঃপর সে তার সম্পদে কতৃর্ত্ব করলো।
আল—কামুসুল মুনজিদ গ্রন্থকার বলেন,
حكم حكما وحكومة : بالأمر وللرجل أو عليه و بينهم এর অর্থ হচ্ছে, ফয়সালা করা, সিদ্ধান্ত দেওয়া। حكمه في الأمر অর্থÑ এ বিষয়ে তার নিকট সিদ্ধান্ত অর্পণ করলো। تحكم في الأمر অর্থÑ স্বেচ্ছাচারী হলো। احتكم في الشيئ : বিষয়টিতে সে নিজের মর্জি মত হস্তক্ষেপ করলো। الحُكم : সিদ্ধান্ত। الحَكَم : সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী। الحاكم : ফয়সালাকারী।
হুক্ম (حُكْم) শব্দের উপর্যুক্ত অর্থ বোঝে থাকলে আমরা বলবো, আল্লাহর দীনের ব্যাপারে বিশ^াসী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ বিশ^াসের জগতে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী। এমনিভাবে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে প্রত্যেক বক্তা স্বীয় বক্তব্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত প্রদানকারী। এমনিভাবে প্রত্যেক কর্মী স্বীয় কর্মের দ্বারা সিদ্ধান্ত প্রদানকারী। শাসক, বিচারক, মুফতি ও অন্য সকল ব্যক্তি, এ ক্ষেত্রে সকলেই এক বরাবর।
পূর্বে আমরা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সা. হতে দলিল পেশ করেছি যে, কোনো মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর আদেশের খেলাফ কাজ করলেই সে এর দ্বারা কাফের হয়ে যায় না; যদি না সে ঐ বিধানকে অস্বীকার করে। তবে ঐ কাজ এর ব্যতিক্রম শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য যার কর্তাকে কালিমার সাক্ষ্যদান সত্ত্বেও ঈমান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এ কারণে কোনো শাসক বা বিচারক আল্লাহর বিধানের খেলাফ রায় দিলেও সে পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াতের ব্যাপকতা থেকে বেরিয়ে যাবে; যদি না সে উক্ত বিধানকে অস্বীকার করে।
যদি কোনো শাসক বা বিচারক আল্লাহর বিধানের বিপরীত কোনো রায় প্রদান করে বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে তাহলে তার বিধান কী এ সম্পর্কে ফকিহগণের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। ইতঃপূর্বে আমরা ‘আল—আকিদাতুত ত্বহাবিয়্যা’—এর ব্যাখ্যাকারকের উদ্ধৃতি দিয়ে এ মতভিন্নতার দিকে ইঙ্গিত করেছি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, কোনো শাসক বা বিচারক যদি আল্লাহর বিধানের বিপরীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে অথবা বাস্তবায়নের আদেশ করে এবং সে শরিয়াহর উক্ত বিধানকে অস্বীকার না করে তাহলে সে ঈমানহারা হবে না। এ মাসআলাটির আরও অধিক ব্যাখ্যার স্বার্থে আল্লাহর কৃপায় আমরা বলবো : ‘ঈমান’ শব্দের অর্থ নিয়ে যারা কথা বলেছেন তাদের মধ্যে চারটি মতের সৃষ্টি হয়েছে :
এক. ঈমান হচ্ছে শুধু অন্তর দ্বারা বিশ^াসের নাম। অর্থাৎ, শুধু অন্তর দ্বারা চেনা ও জানা; যদিও মুখে তার বিপরীত কথা উচ্চারণ করে।
এ মতের প্রবক্তারা শরিয়াহর স্পষ্ট বক্তব্যকে অস্বীকারের কারণে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছে। কেননা শরিয়াহর স্পষ্ট বক্তব্য অনুযায়ী মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করা ওয়াজিব। তাছাড়া যদি শুধু অন্তরে স্বীকার করার দ্বারাই কেউ মুমিন হয়ে যায় তাহলে তার দাবি অনুযায়ী ফিরআউনও মুমিন হয়ে যাবে। কারণ, সে বিশ^াস করতোÑ মূসা আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنْفُسُهُمْ.
তারা নিদর্শনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করলো, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করে নিয়েছিল। (সূরা নামল : ১৪)
لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنْزَلَ هَؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ.
তুমি অবশ্যই অবগত আছ যে, এ সমস্ত স্পষ্ট নিদর্শন আসমানসমূহ ও যমিনের প্রতিপালকই অবতীর্ণ করেছেন। (সূরা বনি ইসরাঈল : ১০২)
তাছাড়া এর আরও দাবি হচ্ছেÑ ইহুদি ও খ্রিষ্টনরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে। কারণ, তারা আল্লাহ সম্পর্কে জানতো এবং মুহাম্মাদ সা.—কে আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্য রাসূল বলে বিশ^াস করতো। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
আর আমি যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে তেমনি জানে যেমন তারা নিজেদের সন্তানদেরকে চিনে। (সূরা বাকারা : ১৪৬)
দুই. ঈমান বলা হয় শুধু মুখের স্বীকারোক্তিকে। অন্তরের বিশ^াস বা অন্তর দ্বারা সত্যায়নের প্রয়োজন নেই। এ মতের প্রবক্তারাও অন্তর দ্বারা সত্যায়ন আবশ্যক, এ সম্পর্কিত শরিয়াহর স্পষ্ট আয়াতসমূহকে অস্বীকারের কারণে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ.
আর তারা তো কেবল আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছিল। (সূরা বায়্যিনা : ৫)
এমনিভাবে তারা শরিয়াহর ঐ সকল স্পষ্ট বক্তব্যকেও অস্বীকার করেছে, যেখানে বলা হয়েছেÑ মুনাফিকরা অন্তরে বিশ^াস না করে শুধু মুখে ঈমানের কথা বলার কারণে মিথ্যাবাদী এবং তারা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।
তিন. ঈমান হলো অন্তরের অন্তরের বিশ^াস ও মুখের স্বীকারোক্তির সমষ্টির নাম। এ ঈমান বাড়েও না কমেও না। আর যে শরিয়াহর বিভিন্ন আদেশ নিষেধ রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ঈমানের অপরিহার্য দাবি, কিন্তু তা ঈমানের অংশ নয়। আর বিভিন্ন আয়াতে আমলসমূহকে যে ঈমান বলে নামকরণ করা হয়েছে, যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ.
আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে নষ্ট করবেন। (সূরা বাকারা : ১৪৩) যেখানে ঈমান দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে হচ্ছেÑ বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে সালাত আদায় করা। এখানে মূলত রূপক অর্থে সালাতকে ঈমান বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। এটি ইমাম আবু হানিফা র.—এর মত।
চার. এটি অধিকাংশ মুসলিম ফকিহ—এর মত এবং সকল অঞ্চলের সকল আহলে রায় ফকিহগণেরও মত; যাদের মধ্যে মালেক ইবনে আনাস, লাইস বিন সা’দ, সুফিয়ান সাওরি, আওযায়ি, আহমদ ইবনে হাম্বল, তাবারি, ইবনে হাযম ও তাঁদের অনুসারীগণ অন্যতম। তাদের সকলের মত হলো, ঈমান একটি শরয়ি পরিভাষা, যার অর্থ হচ্ছেÑ অন্তর দ্বারা বিশ^াস করা, মুখে স্বীকার করা এবং অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা। অর্থাৎ, আদেশ ও নিষেধগুলো পালন করা। এ অন্তরের বিশ^াস বাড়েও না, কমেও না এবং তা ঈমানের একটি অংশ। কিন্তু পুণ্যের কাজ করলে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপ কাজ করলে ঈমান হ্রাস পায়।
ইসলামের অনুসারী তথা তৃতীয় ও চতুর্থ মতের প্রবক্তাগণের নিকট ঈমানের সংজ্ঞা নিয়ে উপর্যুক্ত মতপার্থক্যের ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তির পরিচয় সম্পর্কেও মতপার্থক্য হয়েছে, যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত শাসনকার্য পরিচালনা করে। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে অথবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আদেশ করে।
যারা বলেন, আমল ঈমানের অংশ নয়; বরং তা ঈমানের অপরিহার্য দাবি, আর বিভিন্ন আমলকে যে ঈমান বলে নামকরণ করা হয়েছে, তা রূপক অর্থে ছিল, উক্ত শাসক সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হলো, তাকে কর্মগত কাফের বলে নামকরণ করা হবে। অর্থাৎ, এটি হলো ছোট কুফর, যা তার মধ্যে লিপ্ত ব্যক্তিকে ঈমানের গণ্ডি থেকে বের করে না।
তাদের মধ্য হতে একদলের বক্তব্য হলো, যেহেতু সর্বসম্মত দলিল দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, ঐ শাসক তার উক্ত কাজের দ্বারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে না, অতএব তার দাবি হচ্ছেÑ উপযুর্ক্ত আয়াতের ব্যাপকতাকে সীমিত করা হবে এবং তা ঐ শাসক বা বিচারককে শামিল করবে না। সুতরাং তাকে কাফের বলে নামকরণ করাও বৈধ হবে না। বরং সে ফাসেক ও পাপাচারী বলে গণ্য হবে এবং তার অবস্থা আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্যকারী অন্য সকল লোকের মতই হবে। কিন্তু যে শাসক বা বিচারক আল্লাহর বিধানের বিপরীত রায়কে শরয়ি রূপদানের চেষ্টা করবে সে সর্বসম্মতিক্রমে আল্লাহ এবং তার রাসূলের বিরোধিতাকে বৈধ মনে করলো এবং জেনে শুনে শরিয়াহর বক্তব্যকে অস্বীকার করলো, এ কারণে সে কাফের ও মুশরিক হয়ে যাবে।
যদি আপনি এ আলোচনা বুঝে থাকেন এবং ইতঃপূর্বে আমরা ‘দীনের আবশ্যিক জ্ঞান’—এর যে ব্যাখ্যা করেছি তা জেনে থাকেন তাহলে আপনি সহজে বুঝতে পারবেনÑ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য জরুরি, একজন সাধারণ মুসলিমও এ বিষয়টি ভালো করে জানে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে তার বিধান কী হবে, তা একজন সাধারণ মুসলিম জানতে পারে না; যদি না তার কাছে এ সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ বা শরিয়াহর বিধান পেঁৗছে। আর যখন আপনি এ বিষয়ও জানলেন যে, কোনো ফকিহ এমন কথা বলেননি যে, আল্লাহ তাআলার বাণী :
وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ.
আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফের। (সূরা মায়িদা : ৪৪)
উক্ত আয়াত এবং এতদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আয়াত থেকে আহরিত বিধান দীনের আবশ্যিক জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত। তাছাড়া মানুষের বাস্তব অবস্থা এ কথার সাক্ষী যে, তাদের অধিকাংশই এ আয়াতের মর্ম এবং এ আয়াত ও এ জাতীয় অন্যান্য আয়াত যে শরয়ি বিধানের প্রতি নির্দেশ করে সে সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না।
আপনি আরও জানেন যে, সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ বিখ্যাত সাহাবি ইবনে আব্বাস রা., যাকে নবী সা. নিজের বুকের সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন এবং তার জন্য এ বলে দুআ করেছেনÑ
اللهم علمه الكتاب.
হে আল্লাহ তাকে কিতাবের জ্ঞান দান করুন। (সহিহ বুখারি : খ. ১. পৃ. ২৯) সেই ইবনে আব্বাস রা.—এর মত, এ ছাড়াও বিখ্যাত তাবেয়ি তাউস ইয়েমেনির মত হলো : এ আয়াতের বাহ্যিক ও ব্যাপক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। বরং কাফের ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করে তার বিপরীত ফয়সালা করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধানকে স্বীকার করে, কিন্তু তার বিপরীত বিচার ফয়সালা করে সে হবে জালেম ও ফাসেক। সুদ্দি, আতা—সহ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ফকিহ এ মতই পোষণ করেছেন।
ইমাম আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ি, আহমদ বিন হাম্বল, ইবনে হাযম, ইবনুল কাইয়িম ও ইবনে তাইমিয়াসহ হকপন্থী সকল ইসলামি দলের অভিমতও তাই। তবে খারেজি ও মুতাযিলা সম্প্রদায় এর ব্যতিক্রম, যারা কবিরা গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফের মনে করে। মানুষের হাতে প্রচলিত পবিত্র কুরআনের তাফসির ও ফিকহের কিতাবসমূহে এ কথাই লিপিবদ্ধ আছে।
আপনি যদি আরেকটু আগে বেড়ে চিন্তা করেন তাহলে বুঝবেন যে, অস্বীকারের কিছু প্রকার এমন আছে, যা অতি সূক্ষ্ম এবং তার সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে; বিশেষত ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে নিজের মধ্যে ইসলামের প্রতীকী চিহ্নসমূহ বহন করে। এর মাধ্যমে আপনার সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উপযুর্ক্ত আয়াতসমূহ এবং সেগুলো থেকে যে বিধান আহরিত হয়েছে, তাকে দীনের আবশ্যিক জ্ঞানের অন্তভুর্ক্ত মনে করা, অতঃপর এর ওপর ভিত্তি করে সাধারণ মানুষকে ব্যাপক হারে কাফের ঘোষণা করাÑ এসব কিছুই হলো ভুল।
প্রকৃত কথা হচ্ছেÑ যার কাছে কোনো মাসআলার আসল রূপ স্পষ্ট না হবে অথবা কোনো বিষয়ে সে আল্লাহর বিধান অনুধাবনে অক্ষম হবে কিংবা তার জ্ঞান বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের সমষ্টি থেকে বিধান আহরণের স্তরে উন্নীত না হবে তখন তার দায়িত্ব হচ্ছেÑ এর বিধান সম্পর্কে এমন কথা বলা থেকে সে বিরত থাকবে, যা সঠিক না ভুল এ সম্পর্কে সে জানে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন কথা বলতে নিষেধ করেছেন :
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ.
যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না। (সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৬)
অন্যত্র তিনি বলেন,
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ.
বলুন, নিশ্চয় আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরিক করাÑ যে ব্যাপারে আল্লাহ কোনো প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা, যা তোমরা জান না। (সূরা আরাফ : ৩৩)
তাছাড়া পূর্বে আমরা একটি হাদিস উল্লেখ করেছি যে, হযরত উমর রা. রাসূল সা.—এর নিকট কালালাহ সম্পর্কিত আয়াতটি বোঝার জন্য বারবার প্রশ্ন করেছেন; তা সত্ত্বেও তিনি বুঝতে সক্ষম হননি। এর দ্বারা কিন্তু তার ঈমানে কোনো সমস্যা হয়নি।
নবম অধ্যায়
তাগুতকে অস্বীকার
আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ.
দীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই। নিশ্চয় সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে স্পষ্ট হয়েছে। অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে সে অবশ্যই মজবুত রশি আকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ২৫৬)
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
{أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ.
তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করেÑ তারা ঈমান এনেছে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতিও, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (সূরা নিসা : ৬০)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
{وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى.
যারা তাগুতের পূজা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। (সূরা যুমার : ১৭)
এ জাতীয় আরও অনেক আয়াত রয়েছে। তারা বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন এবং তাগুতকে অস্বীকারের আদেশ করেছেন। তৃতীয় কোনো সুযোগ নেই। হয়তো আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে তাগুতকে অস্বীকার করতে হবে, আর এটাই হচ্ছে ইসলাম, অথবা তাগুতের আনুগত্য করতে হবে, আর তাই হচ্ছে আল্লাহর সাথে কুফরি।
তারা আরও বলেন, তাগুতকে অস্বীকারের দাবি হচ্ছেÑ তার ওপর এ বিধান আরোপ করা যে, সে হলো কাফের। যে ব্যক্তি এ কথা অন্তর দ্বারা বিশ^াস করবে না এবং মুখে ঘোষণা করবে না সে যেন আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করলো না, এ কারণে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এ শেষোক্ত ব্যক্তির প্রতি কুফরের বিধান আরোপ করলো না সেও আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা না করার কারণে কাফের হয়ে গেল। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।
এর জবাবে আমরা বলবো :
তাগুত (الطاغوت) শব্দটি আভিধানিকভাবে طُغْيَان ধাতুমূল থেকে নির্গত। আর طُغْيَانُ বলা হয়Ñ যেকোনো কাজে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়াকে। আরবরা আল্লাহর পরিবর্তে যেসকল দেবতার উপাসনা করতো সেসব কিছুকে তাগুত বলতো। ইমাম কুরতুবি বলেন : তাগুত (الطَّاغُوتُ) শব্দটি স্ত্রী বাচক শব্দ, যা طغى يطغى অথবা طغى يطغو থেকে নির্গত হয়েছে। তার অর্থ হলো, কোনো কাজে বাড়াবাড়ি করে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। কেউ কেউ বলেন, আভিধানিকভাবে الطَّاغُوتُ শব্দটি মূলত الطُّغْيَانِ থেকে গৃহীত হয়েছে, যা কোনো শব্দ থেকে নির্গত হওয়া ব্যতীতই তার অর্থ প্রকাশ করে। জাওহারি বলেন, الطَّاغُوتُ অর্থÑ গণক, শয়তান এবং সকল ভ্রষ্টতার মূল। এর বহুবচন হচ্ছে, الطَّوَاغِيتُ।
উপযুর্ক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হলো যে, তাগুত যেমন মূর্তি, দেবতা বা ব্যক্তি হতে পারে, তেমনি আল্লাহ তাআলা কতৃর্ক নির্ধারিত সীমারেখার অতিরিক্ত শরিয়াহও হতে পারে।
পূর্বোল্লিখিত নসসমূহে স্পষ্টরূপে আমাদেরকে তাগুতের সাথে কুফরি করতে এবং তাকে বর্জন করতে বলা হয়েছে।
আর কোনো জিনিসের সাথে কুফরির অর্থ হলো, তাকে অস্বীকার করা, তার স্বীকৃতি না দেওয়া, তার দাবিকে মিথ্যারোপ করা এবং তা বাতিল ও ভ্রান্ত হওয়ার বিশ^াস পোষণা করা।
তাগুতকে বর্জনের অর্থ হলো, আমরা তার অনুসরণ করবো না, তার আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার বিশ^াস করবো না এবং কাজের মাধ্যমেও তার আনুগত্য করবো না।
আর আমরা জানি যে, তাগুতের সাথে কুফরি করা, তাকে অস্বীকারা করা, তার স্বীকৃতি না দেওয়া, তার দাবিকে মিথ্যারোপ করা এবং তার আনুগত্য ও অনুসরণ না করার মধ্যে এবং তার প্রতি কাফেরের বিধান জারি করার মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে।
এটি একটি বিষয়, আর ওটি স্বতন্ত্র ও ভিন্ন বিষয়। একটিকে অপরটির সাথে মিলিয়ে ফেলা কিছুতেই সঙ্গত হবে না। পূর্বে আমরা যেসকল আয়াত পেশ করেছি এবং এজাতীয় যে অন্যান্য নস রয়েছে সেখানে তাগুতের সাথে কুফরি করতে বলা হয়েছে। আর সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, আমরা জানবোÑ এটি আল্লাহর সীমারেখা বহিভূর্ত বিষয়, অতঃপর আমরা সেই সীমাতিক্রমকে প্রত্যাখ্যান করবো, তাকে অস্বীকার করবো, আল্লাহ তাআলার সীমা বহিভূর্ত তার দাবিকে মিথ্যারোপ করবো এবং তার আনুগত্য ওয়াজিব হওয়ার বিশ^াস করবো না এবং কাজের মাধ্যমেও তার অনুসরণও করবো না।
যেহেতু তাগুত মূর্তি বা প্রতিমা হতে পারে, অতএব আমরা সেই মূর্তি বা প্রতিমা সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র হওয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করবো এবং নিশ্চিতরূপে বিশ^াস করবো যে, তা না কোনো ক্ষতি করতে পারে, না কোনো উপকার করতে পারে।
সেই সাথে আমাদের কর্তব্য হলো, তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা নিবেদন, তার নিদর্শনসমূহ প্রতিষ্ঠা কিংবা তার থেকে বরকত কামনা ইত্যাদি যাবতীয় সবকিছুকে পরিপূর্ণরূপে বর্জন করা। আল্লাহ তাআলা যাকে এ কাজের তাওফিক দান করেছেন সে তো আয়াতে বর্ণিত নির্দেশ পরিপূর্ণরূপে পালন করেছে।
আর এ বিধান প্রদান বা বিশ^াস করা যে, মূর্তি বা প্রতিমা কাফেরÑ আয়াতে এর কোনো উল্লেখ নেই। বরং আয়াতে যে কথা আছে তা হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেনÑ ঐ সকল মূর্তি বা প্রতিমা হচ্ছে জড়বস্তু, যার কোনো বিবেক—জ্ঞান বা বিচার—বুদ্ধি কিছুই নেই। তার প্রতি কোনো দায়িত্ব প্রদান করা যায় না এবং তার প্রতি কুফর বা ইসলামÑ কোনোটিরই বিধান আরোপ করা যায় না।
এমনিভাবে শরিয়াহও তাগুত হতে পারে। এমন কথা বললে কেউ কাফের বা গোনাহগার হবে না। বরং সে হবে সঠিক মতের প্রবক্তা এবং এ কারণে সে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বিনিময়ও পাবে।
অতএব, যদি কখনও আমরা জানতে পারি যে, কোনো মুজতাহিদ ও খোদাভীরু আলেম কোনো ফাতওয়ায় সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি, বরং তার ভুলটি আমাদের সামনে একেবারেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার প্রদত্ত ফাতওয়াটি হবে আমাদের জন্য তাগুতি শরিয়াহ। যে ব্যক্তি তাকে শরিয়াহ হিসেবে মেনে আবশ্যিকরূপে তার অনুসরণ করলো সে তাগুতেরই অনুরসণ করলো, যতক্ষণ এর ভ্রান্তি তার সামনে স্পষ্ট থাকবে। কিন্তু এ ভুলের কারণে এক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য হবে না যে, ঐ ফাতওয়া প্রদানকারী সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার নিয়তে ইজতিহাদের কারণে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নেকি পাবে, যদিও তার সিদ্ধান্তটি কার্যত ভুল ছিল।
“আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর প্রতি ঈমান আনতে এবং তাগুতকে অস্বীকার করতে আদেশ করেছেন” এ কথা পরিপূর্ণ সত্য। আমাদের এ কথা বিশ^াস করতে হবে, তার ওপর আমল করতে হবে এবং কার্যত বাস্তবায়ন করতে হবে।
আর “আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য এবং তাঁর রাসূলের অনুসরণ করতে আদেশ করেছেন” এ কথাও পরিপূর্ণ সত্য, যা বিশ^াস করা, তার ওপর আমল করা এবং তা কার্যত বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব।
“আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাগুতের অনুসরণ না করার আদেশ করেছেন” এ কথাও পরিপূর্ণ যথার্থ। হোক সে অনুসরণ শরয়ি অর্থে তথা সবোর্তভাবে, অথবা আভিধানিক অর্থে তথা কাজের মাধ্যমে আদেশটি বাস্তবায়ন করা, সেই সাথে তা বাতিল হওয়ার বিশ^াস করা। কারণ, আল্লাহ তাআলা কখনও আমাদেরকে তাঁর নাফরমানির আদেশ করেননি।
তবে “যে ব্যক্তি তাগুতের অনুসরণ করবে সে কাফের” এ কথাটি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে; যেমনটি পূর্বে গিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা বলবো, যদি সেই অনুসরণটি হয় এই অর্থে যে, সর্বোতভাবে তার অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহর পরিবর্তে তার আনুগত্যকে ওয়াজিব মনে করতে হবে, এ অর্থে যে তাগুতের অনুসরণ করবে সে কাফের হয়ে যাবে। যাতে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবে সেই অনুসরণ যদি হয় শুধু কাজের মাধ্যমে, সবোর্তভাবে তার অনুসরণ আবশ্যক হওয়ার বিশ^াসের সাথে নয়, অর্থাৎ, এ ব্যক্তি এ কথা স্বীকার করে যে, উক্ত কাজটি আল্লাহ তাআলার আদেশের অবাধ্যতার শামিল এবং আল্লাহর আদেশের বিপরীত আদেশ আল্লাহর আদেশের মধ্যে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধন করতে পারে না, এ অর্থে কেউ তাগুতের আনুগত্য বা অনুসরণ করলে সে গোনাহগার হবে বটে; কিন্তু সে কাফের হবে না। তবে ঐ কাজ এর ব্যতিক্রম যার ব্যাপারে শরিয়ার সুস্পষ্ট বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে যে, সেই কাজটি করলেই তার কর্তা থেকে ঈমান চলে যাবে।
আমরা ইতঃপূর্বে নাফরমানি ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করেছি। আল্লাহ তাআলা জানেন যে, তাঁর বান্দারা তাঁর কিছু আদেশ—নিষেধ অমান্য করবে এবং এক্ষেত্রে তারা কার্যকলাপের মাধ্যমে Ñ আকিদাগতভাবে নয়Ñ শয়তান ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে।
আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহ যে, তিনি আমাদের জন্য দুই প্রকার নাফরমানির মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করে দিয়েছেন, যার একটিকে তিনি কুফর ও শিরক বলে নামকরণ করেছেন এবং অপরটিকে গোনাহ বলে নামকরণ করেছেন, যার কর্তাকে তিনি মাফ করতে পারেন, আবার মাফ না করে শাস্তিও দিতে পারেন। তবে ঐ ব্যক্তি গোনাহের কারণে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। এটি হচ্ছে ঐ প্রকার নাফরমানি যার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত হলো, ঐ নাফরমানিতে লিপ্ত ব্যক্তি থেকে ঈমান চলে যাবে না। আমরা পূর্বে বলেছি যে, আল্লাহ তাআলার নামসমূহ নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنْ هِيَ إِلَّا أَسْمَاءٌ سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ.
এগুলো তো কেবল কিছু নাম, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা রেখেছ। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোনো দলিল—প্রমাণ নাযিল করেননি। (সূরা নাজম : ৫)
আমরা সুস্পষ্ট আলোচনা করেছি যে, এগুলো হচ্ছে এমন সব শরয়ি অর্থ, যে সম্পর্কে আমাদের অবগত হওয়া, তার প্রতি বিশ^াস স্থাপন করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা আমাদের জন্য আবশ্যক। অন্যথায় আমরা বক্তব্যকে তার সঠিক জায়গা থেকে বিকৃত করে ফেলবো এবং এমন সব নাম ও গুণের অবতারণা করবো, আল্লাহ তাআলা যে ব্যাপারে কোনো দলিল প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি।
কারও কারও বক্তব্য হলো, তাগুত হচ্ছে একটি শরয়ি পরিভাষা। কেবল কাফের ও মুশরিককেই এর দ্বারা নামকরণ করা যাবে। আর এ কারণে তাগুতের প্রতি কুফরের বিধান আরোপ করা আবশ্যক। তবে আমাদের জানা মতে শরিয়াহর এমন কোনো বক্তব্য নেই, যা এ মতটিকে সমর্থন করে এবং ঘোষণা করে যে, তাগুত কেবল ঐ মুশরিক ব্যক্তিকেই বলা হবে, যে মানুষকে গুমরাহির দিকে আহ্বান করে। কিন্তু যদি এ সম্পর্কিত শরিয়াহর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় তাহলে আমরা এর দিকে প্রত্যাবর্তন করবো এবং এ কথাই বলবো।
যদি এ কথা সঠিক ধরা হয়, যে কারণে সকল মানুষের জন্য তাগুতের প্রতি কুফর ও শিরকের বিধান আরোপ করা জরুরি হয়ে যায়Ñ তাহলে সে তাগুতকে অবশ্যই তার কুফরের কথা স্পষ্ট রূপে ঘোষণা করতে হবে এবং প্রকাশ্যে ও সামগ্রিকভাবে ইসলাম ধর্ম থেকে এমনভাবে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করতে হবে যে, তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে কোনো মতবিরোধের সুযোগ থাকে না। তবে সমস্যা দেখা দিবে ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যে তার কাজে কর্মে ইসলাম প্রকাশ করে এবং প্রকাশ্যে ইসলামের প্রতীকী বিধানগুলো পালনও করে, আর তার কুফরটি এতটাই প্রচ্ছন্ন হয় যে, তার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার কিছু কথা ও কাজের আসল রূপ অনুসন্ধান এবং সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার প্রকৃত নির্দেশ সম্পর্কে অবগত হতে হয়। আর এ জাতীয় ক্ষেত্রে অনেক মতভিন্নতা দেখা দেয়। এবং অনেক মানুষের কাছেই তা অস্পষ্ট থাকে। বিশেষত সাধারণ মানুষের কাছে।
অতএব, এ কথা বিশুদ্ধ হবে না যে, সাধারণ মানুষ অথবা তার ব্যাপারে ব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ঐ ব্যক্তির প্রতি আবিশ্যক বিধান প্রয়োগে দায়িত্বের অবহেলা করেছে এবং এ কারণে তারা গোনাহগার বা কাফের হয়ে গেছে। ইতঃপূর্বে আমরা সুস্পষ্টরূপে আলোচনা করেছি যে, অজ্ঞ ব্যক্তিকে তার অজ্ঞতার কারণে এবং ভুল স্বীকারকারীকে তার ভুলের কারণে অপারগ (মাজুর) গণ্য করা হবে। এবং আমরা দলিল—প্রমাণের মাধ্যমে আরও আলোচনা করেছি যে, কেউ যদি কোনো বিষয়ে না জানে তাহলে তার দায়িত্ব হচ্ছেÑ সে সম্পর্কে এমন কোনো কথা বলবে না, যার বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়।
দশম পরিচ্ছেদ
সরাসরি কুরআনে কারিমের ওপর আমল
হযরত ইরবায বিন সারিয়া রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন :
أيحسب أحدكم متكئا على أريكته قد يظن أن الله تعالى لم يحرم شيئا إلا ما في القرآن ألا وإني والله قد أمرت ووعظت ونهيت عن أشياء إنها لمثل القرآن.
তোমাদের কেউ কি আসনে হেলান দিয়ে এমনটি ধারণা করে যে, আল্লাহ তাআলা যা হারাম করেছেন সব এ কুরআনে রয়েছে? সাবধান! জেনে রেখোÑ নিশ্চয় আমি আদেশ করেছি, উপদেশ দিয়েছি এবং কিছু বিষয় থেকে নিষেধ করেছি, যেগুলো কুরআনের মতই। (আল—ইহকাম ফি উসুলিল আহকাম : খ. ২, পৃ. ২১)
কেউ কেউ বলেন, আরবরা কুরআনের আয়াত শুনতো, তার দাবির ওপর সরলভাবে আমল করা এবং তৎক্ষণাৎ তার বিধান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। তাই আমাদের ওপরও এমনটি করা আবশ্যক।
আবার কারও কারও মত হলো, ফকিহগণ শরিয়াহর যে বিধান আলোচনা করেছেন তা হয়তো করেছেন তাদেরকে ঘিরে থাকা পরিস্থিতির বিবেচনায়। এবং তাদের মধ্য হতে কেউ কেউ তৎকালীন ক্ষমতাশীল শাসকের নির্দেশনার সামনে নতি স্বীকার করতেন। বর্তমান কালে ইসলামের দাওয়াতের ওপর যে কঠিন পরিস্থিতি বিরাজ করছে অতীতে তা কখনও যায়নি। এ কারণে আমাদের কর্তব্য হচ্ছেÑ সেই প্রাচীন ফিকহকে একদিকে ঝেড়ে ফেলে সরাসরি কুরআনে কারিমের ওপর আমল করা, আমাদের যাপিত জীবনের অনুকূল এবং বর্তমান কালে ইসলামের দাওয়াতের ওপর যে সঙ্গিন অবস্থা বিরাজ করছে তা বিবেচনায় নিয়ে কুরআনে কারিম থেকে বিধান আহরণ করা।
মূল্যায়ন
প্রথম কথা হচ্ছে, আরবদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যে বলা হয়েছেÑ তারা ‘সরলভাবে’ আমল করতো, আমরা জানি না— এ সরলভাবে কথার উদ্দেশ্য কী? যদি তার দ্বারা উদ্দেশ্য হয়Ñ কোনো প্রকার দ্বিধা বা ত্রুটি ও অবহেলা ব্যতীত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা তাহলে আমরা বলবো, এটি আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমরা মনে করি না যে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত আছে। তাছাড়া পূর্বে আমরা যে আলোচনা করেছি তা এ কথার সাথে সাংঘর্ষিক তা—ও মনে করি না।
আর এ ‘সরলভাবে’ কথার দ্বারা যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়Ñ যেকোনো আয়াত বা হাদিস শোনা মাত্রই তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্যন্য আয়াত ও হাদিসের সাথে তুলনা ও সমন্বয় সাধন ব্যতিরেকে আমল করা, তাহলে আমরা বলবোÑ এ কথা সঠিক নয়। বরং এক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হলো, কুরআনে কারিমের অন্যান্য আয়াত ও রাসূল সা.—এর সহিহ হাদিসের সাথে মিলিয়ে দেখা এবং সকল আয়াত ও হাদিস থেকে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য ও কাক্সিক্ষত বিধান জানার জন্য সেগুলোকে পরস্পর তুলনা করা এবং তাদের মধ্যে সমম্বয় সাধন করা।
কারণ, আল্লাহ তাআলা চেয়েছেনÑ তাঁর কিছু আলোচনা বিশেষ পদ্ধতি ও বিষ্ময়কর পন্থায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে তিলাওয়াত করা হবে এবং তার তিলাওয়াতকে ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হবে। আর সেটাই হচ্ছেÑ কুরআনে কারিম। আর কিছু আলোচনা এমন হবেÑ যা প্রথমোক্ত পদ্ধতির ন্যায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে তিলাওয়াত করা হবে না। আর সেটাই হচ্ছেÑ হাদিস—সমগ্র। আল্লাহ তাআলা এ দুপ্রকারের প্রত্যেকটির মধ্যেই তার উদ্দেশ্য ও কাক্সিক্ষত বিধানাবলি নিহিত রেখেছেন এবং একটিকে অপরটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ.
যাতে আপনি তাদের জন্য স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন ঐ বিষয় যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। (সূরা নাহল : ৪৪)
আল্লাহ তাআলা চাইলে সকল বিধান শুধু কুরআনে কারিম অথবা শুধু হাদিস শরিফে নিহিত রাখতে পারতেন। আল্লাহ তাআলা চাইলে প্রত্যেকটি মাসআলার বিধান স্বতন্ত্র আয়াত বা হাদিসে সুস্পষ্ট রূপে নিহিত রাখতে পারতেন। ফলে কুরআন ও হাদিসের উদ্দেশ্য অনুধাবনে কোনো ধরনের মতভিন্নতা তৈরি হতো না। কারণ, আল্লাহ তাআলা সবকিছু করতে সক্ষম। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অভিপ্রায় ছিল এর ব্যতিক্রম।
لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ.
তিনি যা করেন সে সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে না; বরং তাদেরকেই জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা আম্বিয়া : ২৩)
আমরা আরেকটি দৃষ্টান্ত পাই কুরআনে কারিমের সূরা সমূহে। যেমন সূরা বাকারায় তালাক সম্পর্কিত কিছু বিধান আলোচিত হয়েছে। অতঃপর কুরআনে করিমের শেষ দশকে সূরা আহযাবে এ প্রসঙ্গে আলোচনা রয়েছে। এমনকি সূরা তালাক নামে একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে, যেখানে তালাক সম্পর্কিত অনেক বিধান রয়েছে। এছাড়াও আমরা রাসূল সা. থেকে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত অনেক হাদিস পাই, যেখানে এ বিষয়ক আলোচনা স্থান পেয়েছে।
এখন আমাদের জন্য জরুরি হলো, এসবগুলোকে একত্র করে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য ও কাক্সিক্ষত বিধান জানার চেষ্টা করা, যার প্রতি বিশ^াস স্থাপন করা ও তা বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য ওয়াজিব। এর বিপরীতে যদি আমরা কিছু আয়াতকে বাদ দিয়ে বাকি আয়াতের ওপর আমল করি, অথবা কিছু হাদিসকে বাদ দিয়ে বাকি হাদিসের ওপর আমল করি, অথবা হাদিস বাদ দিয়ে আয়াতের ওপর কিংবা আয়াত বাদ দিয়ে হাদিসের ওপর আমল করি তাহলে যে অংশের ওপর আমরা আমল ছেড়ে দিয়েছি তাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য না করার কারণে আমরা পাপী ও গোনাহগার হবো। এবং আমরা ইচ্ছাপূর্বক আল্লাহ হুকুমকে পরিবর্তনকারী, বক্তব্যকে তার সঠিক জায়গা থেকে বিকৃতকারী এবং আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে মিথ্যারোপকারী হিসেবে গণ্য হবো। কারণ, যে ব্যক্তি পুরো বক্তব্যের কিছু অংশ বাদ দিয়ে বাকি অংশ বর্ণনা করলো সে মূলত সেই বক্তব্যকে বিকৃত করলো।
অথচ রাসূলুল্লাহ সা. আমাদেরকে বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের মধ্যে তুলনা করে সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন, নির্দিষ্ট ও ব্যাপক বক্তব্য জানা এবং সেখান থেকে এমন শরয়ি বিধান আহরণের পদ্ধতি শিখিয়েছেন, যার ওপর আমল করা আবশ্যক।
যেমনÑ একটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সা. এক ব্যক্তিকে ডাকলেন, যখন সে নামাযে রত ছিল। কিন্তু সে ব্যাপাক বিধান إن في الصلاة لشغلا (নিশ্চয় নামাযের মধ্যে রয়েছে লিপ্ততা) এর ওপর আমল করে নবীজি সা.—এর আহ্বানে সাড়া দেয়নি। অতঃপর যখন সে নামায শেষ করলো তখন রাসূল সা. তাকে আহ্বান করা সত্ত্বেও তার সাড়া না দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। সে কারণ হিসেবে নামাযে লিপ্ততার কথা বললো। তখন রাসূল সা. আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা তার বিপক্ষে দলিল পেশ করলেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ.
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দাও, যখন তিনি তোমাদের এমন জিনিসের দিকে আহ্বান করেন যা তোমাদেরকে জীবন দান করে। (সূরা আনফাল : ২৪)
রাসূল সা. ও সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারা হতে এর আরও অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। পূর্বে আমরা একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছি যে, হযরত উসমান রা. এক নারীকে ছয়মাসে সন্তান প্রসবের কারণে প্রস্তারাঘাতে হত্যার আদেশ করেছিলেন। তখন আলী রা. তাকে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণীর কথা স্মরণ করিয়ে দেন :
وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا.
তাকে গর্ভে ধারণ ও তার স্তন্য ছাড়ানেরা মেয়াদ ত্রিশ মাস। (সূরা আহকাফ : ১৫)
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ.
জননীগণ তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দুই বছর দুধপান করাবে। (এ বিধান) ঐ ব্যক্তির জন্য যে দুগ্ধপানের মেয়াদ পূর্ণ করতে চায়। (সূরা বাকারা : ২৩৩)
উপর্যুক্ত দুটি আয়াতের সমন্বয়ে যে শরয়ি বিধান আহরিত হয় তা হলো, গর্ভধারণের মেয়াদ কখনও ছয় মাসও হতে পারে। অতঃপর উসমান রা. প্রস্তারাঘাতে হত্যার নির্দেশ প্রত্যাহার করেন। অতএব, বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি নব উদ্ভাবিত কোনো বিষয় নয়।
আর সরাসরি কুরআনে কারিমের ওপর আমলের আবশ্যিকতার বিষয়ে আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা বলবোÑ আল্লাহ তাআলা কাউকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আদেশের বিপরীত কারও অনুসরণের আদেশ করেননি। এ কারণে মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে, যথাসম্ভব কিতাবুল্লাহ এবং রাসূল সা.—এর সহিহ হাদিসের স্মরণাপন্ন হওয়া এবং তার থেকে এমন দলিলের অনুসরণ করা যা শরিয়াহর বিধান জানতে সহায়ক হয়। যদি সে এটি করতে অক্ষম হয় এবং অন্যের থেকে শরিয়াহর বিধান গ্রহণ করে তাহলে তার জন্য এ দৃঢ় বিশ^াস রাখতে হবে যে, সে কেবলই আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের বিধান বাস্তবায়ন করছে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্য কারও নির্দেশ বাস্তবায়ন করছে না।
আর কোনো ব্যক্তির অন্য কারও ওপরে এ বিষয়ে নিষেধজ্ঞা আরোপের অধিকার নেই যে, সে সরাসরি কুরআনে কারিমের ওপর আমল করবে এবং তাঁর আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা করে এমন বিধানাবলি আহরণ করবে, যা আল্লাহর বিধান হিসেবে প্রমাণিত এবং তার অনুসরণ করা ওয়াজিব। যখন কোনো ব্যক্তি এমনটি করতে যাবে তখন সে নিশ্চিতরূপে এমন কিছু আয়াত পাবে যা অকাট্যরূপে প্রমাণ করে যে, রাসূল সা.—এর অনুসরণ করা ওয়াজিব এবং কুরআনে কারিম বা সুন্নাহ সম্পর্কিত রাসূল সা.—এর এর বক্তব্য পরিপূর্ণ সত্য ও যথার্থ, যার সবটুকুর ওপর আমল করা আবশ্যক। কেউ যদি কুরআনে কারিমকে পূর্ণাঙ্গ মনে করে সুন্নাহকে উপেক্ষা করে তাহলে সে কুরআনে কারিমের সুস্পষ্ট ও অকাট্য বক্তব্যসমূহের বিরোধিতা করলো এবং সে নিশ্চিতরূপে আল্লাহ তাআলার প্রকৃত বিধান জানার পথ থেকে বিচ্যুত হলো। তাছাড়া কেউ যদি সরাসরি কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফ থেকে বিধান আহরণ করে তার ওপর আমল করতে চায় তাহলে তার জন্য শর্ত হলো, তাকে এর উপযুক্ত হতে হবে। সেই উপযুক্ততা হচ্ছেÑ আল্লাহ তাআলা এ জাতীয় কাজের জন্য যেসব বিষয়ের শর্তারোপ করেছেক, সেগুলো পূরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে তার জন্য আবশ্যক হচ্ছেÑ তাকে যথাসম্ভব পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফে বর্ণিত বিধানাবলি আয়ত্ব করতে হবে। বিভিন্ন প্রকার বর্ণনার স্তর, বর্ণনাকারীদের গুণবৈশিষ্ট্য এবং মুরসাল ও যঈফ হাদিস থেকে সহিহ হাদিসের সনদকে পৃথক করার পদ্ধতি জানতে হবে। আরও কর্তব্য হচ্ছেÑ হককে বাতিল থেকে পৃথক করার ক্ষেত্রে দলিল প্রদানের কৌশল ও পন্থা কী? দুটি বক্তব্যের মধ্যে বাহ্যিক বিরোধ থাকলে সেক্ষেত্রে কীভাবে আমল করতে হয়? এসবের নীতি ও পদ্ধতি জানা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ.
তাদের প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি অংশ বের হয় না কেন, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। (সূরা তাওবা : ১২২)
আয়াতে বর্ণিত দীনের গভীর জ্ঞানের (তাফাক্কুহ) অর্থ হচ্ছেÑ পবিত্র কুরআনের বিধানাবলি এবং নবীজি সা.—এর আদেশ ও নিষেধসমূহ ভালো করে জানা। কারণ, এ দুটিই হচ্ছে দীনের দুটি মূল স্তম্ভ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا.
হে মুমিনগণ! যদি তোমাদের কাছে কোনো পাপাচারী সংবাদ নিয়ে আসে তাহলে তা যাচাই করো। (সূরা হুজুরাত : ৬)
এ কারণে ন্যায়পরায়ণ ও ফাসেক বর্ণনাকারীদের পরিচয় জানতে হবে। অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ.
তোমরা তোমাদের দলিল পেশ কর যদি সত্যবাদী হও। (সূরা নামল : ৬৪) এ কারণে দলিল প্রদানের পদ্ধতি জানতে হবে। আরও জানতে হবেÑ একটি হাদিসের সাথে আরেকটি হাদিসের বা কুরআনে কারিমের সম্পর্কের ধরন কীরূপ হয়? এবং একটি আয়াত আরেকটি আয়াতের ওপর কীভাবে নির্ভর করে?
আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا.
আমিযখনই কোনো আয়াত রহিত করি বা ভুলিয়ে দেই তখন তার চেয়ে উত্তম বা তার অনুরূপ আনয়ন করি। (সূরা বাকারা: ১০৬) এ কারণে রহিতকারী ও রহিত বক্তব্য সম্পর্কেও জানতে হবে।
এছাড়াও যে ব্যক্তি দীনের ব্যাপারে গভীর জ্ঞান অর্জন এবং নিজেকে দীনের দাঈ হিসেবে প্রস্তুত করতে চায় তার কর্তব্য হচ্ছেÑ আল্লাহ তাআলার বাণী ও রাসূল সা.—এর হাদিসসমূহ অনুধাবনে প্রয়োজনীয় অন্য সকল প্রকার জ্ঞান ও শাস্ত্রের সহযোগিতা নেওয়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ.
আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। (সূরা ইবরাহিম : ৪)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
لِتَكُونَ مِنَ الْمُنْذِرِينَ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ.
যাতে আপনি সতর্ককারী হতে পারেন, সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। (সূরা শুআরা : ১৯৪—১৯৫)
অতএব, ফকিহর জন্য জরুরি হলো, তাকে নাহু শাস্ত্র সম্পর্কে পারদর্শী হতে হবে। কারণ, পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে আরবি ভাষায়। আর নাহু শাস্ত্র দ্বারা আরবি ভাষার বাক্যের বিন্যাস ও হারাকাতসমূহের ভিন্নতার প্রেক্ষিত্রে তার অর্থ জানা যায়। এমনিভাবে তাকে লুগাত বা অভিধানও জানতে হবে। কারণ, শব্দের ভিন্নতার কারণে অনেক সময় বাক্যের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়।
অতএব, কেউ যদি লুগাত বা শব্দার্থ না জানে এবং ইলমে নাহু বা গ্রামরও না জানে, ফলে হারাকাতের ভিন্নতার কারণে যে অথের মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয় এ সম্পর্কে অজ্ঞ হয় তাহলে একথা বলতেই হবে যে, আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল যে ভাষায় আমাদেরকে সম্বোধন করেছেন ঐ ব্যক্তি সেই ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ। আর আরবি ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞ কোনো ব্যক্তির জন্য ফাতওয়া প্রদান করা বৈধ হবে না। কারণ, সে এমন বিষয়ে ফাতওয়া প্রদান করছে যে সম্পর্কে সে নিজেই অজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন কাজ থেকে নিষেধ করেছেন :
وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ.
তুমি ঐ বিষয়ের অনুসরণ করো না, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই। (সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৬)
অন্যত্র তিনি বলেন,
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ.
আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক অজ্ঞতাবশত আল্লাহর ব্যাপারে বিতণ্ডা করে। (সূরা হাজ্জ : ৩ )
এমনিভাবে ফকিহর জন্য নবী সা.—এর সিরাত জানাও জরুরি। কারণ, এর দ্বারা তিনি জানতে পারবেনÑ নবীজি সা.—এর শুরু ও শেষ নির্দেশনা কী ছিল? তিনি কাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং কাদের সাথে সন্ধি করেছেন? তিনি কেনই বা যুদ্ধের বিধান দিয়েছেন এবং রক্তপাত বৈধ হওয়ার পর তিনি কেন তাকে হারাম করেছেন? এছাড়াও তিনি জানতে পারবেনÑ অন্য সকল বিষয়ে নবীজি সা.—এর বিধান ও ফয়সালাসমূহ কী ছিল।”
“অতএব, মুফতিদের মধ্যে তিনটি শ্রেণি হতে পারে :
(এক) বিজ্ঞ আলেম, যিনি শরিয়াহর বক্তব্যসমূহ ভালো করে জেনে ও আয়ত্ত করে চিন্তা—গবেষণার পর ফাতওয়া প্রদান করেন। এ শ্রেণির মুফতি তার প্রচেষ্টার কারণে নেকি লাভ করবেন। এক্ষেত্রে তিনি সঠিক করেন বা ভুল করেন। তবে তার জন্য জরুরি হলো, কোনো বিষয় ভালো করে জেনে তার পরই ফাতওয়া প্রদান করবেন।
(দুই) ফাসেক (পাপাচারী) ব্যক্তি, যে তার জ্ঞান অনুযায়ী ফাতওয়া প্রদান করে; অথচ সে ভালো করেই জানে যে, ফাতওয়া প্রদান করা তার ওপর ওয়াজিব না হওয়া সত্ত্বেও সে ফাতওয়া প্রদান করছে।
(তিন) অজ্ঞ ও দুর্বল বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি, যে নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়াই ফাতওয়া প্রদান করে; কিন্তু তার ধারণা হলো, সে সঠিক করছে। অথচ সে পরিপূর্ণরূপে চিন্তা ও গবেষণা করেনি। বাস্তবে তার যদি বিবেক বুদ্ধি থাকতোই তাহলে সে উপলব্ধি করতো, যেহেতু সে অজ্ঞ এতএব সে কেনই বা এমন বিষয়ে প্রবৃত্ত হবে, যা সে ভালো করে আয়ত্ত করেনি। (আল—ইহকাম ফি উসূলিল আহকাম : খ. ৫, পৃ. ১২৪)”
ইমাম শাহরাস্তানি বলেন, ইজতিহাদের শর্ত পাঁচটি :
১. ভাষা ও অভিধান সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান থাকা, যা দ্বারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আরবি ভাষা বুঝতে পারে এবং শব্দের আসল অর্থ ও রূপক অর্থ, উদ্দিষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ (النص والظاهر), ব্যাপক ও নির্দিষ্ট অর্থ (العام والخاص), শর্তমুক্ত ও শর্তযুক্ত বক্তব্য (المطلق والمقيد), সংক্ষিপ্ত ও বিশদ বর্ণনা (المجمل والمفصل), ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে।
এছাড়াও সে বাক্যের মর্ম ও তাৎপর্য, সামগ্রিক ও আংশিক নির্দেশনা এবং বাক্যের অধীনস্থ বক্তব্যগুলো উদ্ধার করতে পারে। কারণ, এ বিষয়গুলোর জ্ঞান প্রয়োজনীয় মেশিনারি ও যন্ত্রপাতির চালনার ন্যায়। আর যে ব্যক্তি প্রয়োজনীয় মেশিনারি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার জানবে না সে শিল্পে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারবে না।
২. পবিত্র কুরআনের নির্দেশনাসমূহ জানতে হবে; বিশেষত শরিয়াহর বিধানাবলি (أحكام) সংক্রান্ত নির্দেশনা। আরও জানতে হবেÑ কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিস শরিফে কী বলা হয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবিগণ এসব আয়াত ও হাদিসের কী অর্থ বুঝেছেন এবং এ ব্যাপারে তাদের কর্মপদ্ধতি কী ছিল।
৩. হাদিসের মতন (মূলপাঠ) ও সনদ জানতে হবে। বর্ণনাকারীদের বিস্তারিত অবস্থা আয়ত্ত করতে হবে। তাদের মধ্য হতে কে ন্যায়পরায়ণ ও নির্ভরযোগ্য, কে বিতর্কিত ও প্রত্যাখ্যাতÑ ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিপূর্ণরূপে আয়ত্ত করতে হবে। এছাড়াও প্রতিটি হাদিসের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনা ভালো করে জানতে হবে। আরও জানতে হবেÑ কোন হাদিসের বক্তব্য ব্যাপক; যদিও তা একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, অথবা কোন হাদিসের বক্তব্য সীমিত; যদিও তার বিধান প্রত্যেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে।
৪. তাকে আরও জানতে হবেÑ ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, নিষিদ্ধ ও মাকরূহÑ এগুলোর মধ্যে পার্থক্য কী? যাতে করে এসব বিষয়ের কোনো একটি তার থেকে বাদ পড়ে না যায় এবং একটির সাথে অপরটিকে গুলিয়ে না ফেলে।
৫. অতঃপর তাকে জানতে হবেÑ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িগণ ও অনুসৃত পূর্বসূরিদের মধ্যে কোন কোন বিষয় বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য সংঘটিত হয়েছে; যাতে করে সে ইজমার বিপরীত কোনো বিষয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত না হয়।”
আমাদের উপযুর্ক্ত বক্তব্যের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, মুফতি হতে হলে শরিয়াহর সকল বিষয়ের সমগ্র বিধান পরিপূর্ণরূপে আয়ত্ত থাকতে হবে। কারণ, সকল ফকিহর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য যে, তিনি কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত এবং কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত নন। যে ব্যক্তি আমাদের উপযুর্ক্ত আলোচনা ও শর্তাবলি অনুযায়ী দীনের একটি বিষয়ের মাসআলা জানবে তার জন্য সে বিষয়ে ফাতওয়া প্রদান করা বৈধ হবে। অন্য সকল বিষয়ে তার অনবহিত থাকা, এটা আয়ত্তকৃত বিষয়ে ফাতওয়া প্রদানে প্রতিবন্ধক নয়, যেমনিভাবে যেসব বিষয়ে সে ভালো করে জানে তা যেসব বিষয়ে সে জানে না সেসম্পর্কে ফাতওয়া প্রদানে বৈধতাপ্রদানকারী নয়।
যার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান আছে, যা তাকে দলিল—প্রমাণ সম্পর্কে চিন্তা—গবেষণা করে তার থেকে বিধান আহরণ ও ফাতওয়া প্রদান তথা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে স্বাক্ষর প্রদানে সক্ষম করেছে, অতঃপর সে নিজেকে তীক্ষè মেধা, উন্নত রুচি ও স্বভাব এবং তাকওয়া ও পরহেযগারির অধিকারী পূর্বসূরিদের মতামত ও তাদের রেখে যাওয়া জ্ঞানভান্ডার থেকে বঞ্চিত করেছে, যাদের ব্যাপারে এটা স্বীকৃত যে, তারা দীনের ওপর ধৈর্য ও অবিচলতার পরিচয় দিয়েছেন, যারা ছিলেন উঁচু হিম্মত ও দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী, যারা যমিনে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং হকের দাওয়াতের পথে তারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেছেনÑ তাহলে সে নিজেকে প্রভূত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করলো এবং একটি মারাত্মক ভুল দিয়ে তার যাত্রা শুরু করলো।
আল্লাহর মেহেরবানিতে আমরা আরবি ভাষাবিদদের মধ্য হতে নাহুবিদ ও অভিধান শাস্ত্রবিদদের বক্তব্য শ্রবণ করি। আমরা খেয়াল করিÑ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে কী বলেছেন, যাদের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণতা, বিশুদ্ধ জ্ঞান ও আস্থাবান হওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত। আমরা আরও দেখিÑ বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যায় মুসলিম ফকিহ ও ইমামগণ কী বলেছেন, তারা ঐ সকল আয়াত ও হাদিস থেকে কী বিধান উদঘাটন করেছেন। আমরা এসবের কোনোটি থেকে নিজেদেরকে আড়াল করি না। বরং আমরা এ সব কিছু অধ্যয়ন করি, তা নিয়ে চিন্তা—গবেষণা করি এবং কিতাবুল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সা.—এর বিশুদ্ধ হাদিসের বিপরীত সব কিছুকে প্রত্যাখ্যান করি।
সুতরাং যে কথার বিশুদ্ধতার ওপর কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল সা. থেকে দলিল—প্রমাণ থাকবে তাই সত্য ও যথার্থ বলে গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তির বক্তব্য এর বিপরীত হবে সে তার ইজতিহাদের কারণে আল্লাহর নিকট থেকে নেকি পাবে বটে; কিন্তু ধরে নিতে হবে যে, তিনি একজন মানুষ, যিনি কখনও সঠিক করেন, আবার কখনও ভুল করেন। আর আমরা কেবল রাসূল সা. ব্যতীত আর কারও অনুসরণ করতে আদিষ্ট নই। কারণ, একমাত্র রাসূল সা.—ই নিষ্পাপ ও পবিত্র সত্তা, যিনি বিশ^ জগতের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ওহি লাভ করার পরই কথা বলেন।
আমরা পূর্বে যে আলোচনা করেছি তাতে এ নীতিরই অনুসরণ করেছি। যেহেতু আমরা নিজেদের অক্ষমতার বিষয়টি ভালো করেই জানি, এ কারণে আমরা অবাধে ফাতওয়া প্রদান ও ইজতিহাদের দুঃসাহস করি না। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের বোঝা নির্ভরযোগ্য পূর্বসূরিদের ওপর ছেড়ে দিয়েছি। তারা যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন আমরা তাই পালন করি এবং আমাদের পক্ষ থেকে তাতে কোনো সংযোজন করি না। তবে সামান্য কিছু বিষয় এর ব্যতিক্রম, আল্লাহ তাআলা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের আলোকে যার অনুধাবনকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলার নিকট আমাদের কামনাÑ তিনি যেন আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করেন। আমরা সঠিক কাজ করলে তিনি যেন আমাদের জন্য তাতে বরকত দান করেন। সত্যানুসন্ধানীদের জন্য হকের পথকে সহজ করে দেন। আমাদেরকে এবং পৃথিবীর প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে অবস্থানকারী আমাদের সকল ভাইকে হেদায়াত দান করেন। সকলের অন্তরের পবিত্র বন্ধনকে হেফাজত করেন। আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য অনুধাবনের জন্য বোধশক্তি ও দূরদৃষ্টি দান করেন। আমাদেরকে এমন ভালো কাজের তাওফিক দান করেন, যা তাঁর দরবারে কবুল হয়। তাঁর সুদৃঢ় রজ্জুর সাথে আমাদের বন্ধনকে মজবুত করেন। আমাদেরকে তাঁর মজবুত হাতল দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাকার তাওফিক দান করেন। তাঁর মারেফাত লাভ করে সরল সঠিক পথের ওপর আমাদেরকে জীবিত রাখেন। তাঁর সত্য ও সঠিক দীনের ওপর আমাদেরকে মৃত্যু দান করেন। আমাদেরকে জান্নাতবাসী হিসেবে কবুল করেন। আপন দয়া ও অনুগ্রহে আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি দান করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতে তাঁর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করেন।
হে আল্লাহ! আপনি হকের কালিমাকে সমুন্নত করুন, হকের অনুসারীদের সাহায্য করুন, যারা আপনার সন্তুষ্টি কামনায় হককে বিজয়ী করতে নিরলসভাবে কাজ করছে। আপনি কতইনা উত্তম অভিভাবক ও সাহায্যকারী।
হে আল্লাহ! আপনি রহমত ও শান্তি বর্ষিত করুন আমাদের সর্দার হযরত মুহাম্মাদ সা.—এর প্রতি, তাঁর পরিবার—পরিজন, সাহাবি এবং আপনার সকল নবী—রাসূলগণের প্রতি।
আল্লাহর প্রশংসায় এ রচনা সমাপ্ত হয়েছে রোজ রবিবার
৬ জিলহজ্জ ১৩৮৮ হিজরি মোতাবেক
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ খিষ্টাব্দ।
আলোচ্য বিষয় “আমরা দাঈ, বিচারক নই” সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন
এবং
প্রধান উপদেষ্টা উসতায হাসান আল হুদাইবি র. এর জবাব
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
প্রথম প্রশ্ন :
পূর্বে যদি কোনো ব্যক্তি কালিমা পাঠের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণ করতো তাহলে সে একটি ইসলামি শাসন পেত, যা তার ইসলামে প্রবেশের ঘোষণা করতো। আর এভাবে সে আল্লাহর সাথে শিরককারী শাসন থেকে কার্যত আল্লাহর প্রতি সমর্পিত শাসনের দিকে স্থানান্তরিত হতো এবং কেবল মুসলিমদের সাথে পরিপূর্ণ বন্ধুত্ব রাখতো। এর দ্বারা তারা কাছে কালিমা পাঠের কারণে আপতিত দায়িত্বগুলো স্পষ্ট হয়ে যেতো; এর কালিমার অর্থ সে বুঝুক বা না বুঝুক। কিন্তু বর্তমানে কোনো ইসলামি শাসন নেই, কালিমা পাঠের মাধ্যমে যাতে সে প্রবেশ করবে এবং মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব পরিপূর্ণ রক্ষা করবে। এর ওপর ভিত্তি করে কেউ কেউ বলেন, ইসলামি হুকুমাতে প্রবেশ করা তার ব্যাপারে ইসলামের বিধান আরোপের জন্য শর্ত এবং শুধু মুখে কালিমা পাঠ করা তার জন্য যথেষ্ট নয়।
ব্যক্তির প্রতি ইসলামের বিধান আরোপের জন্য ইসলামি হুকুমাত থাকা শর্ত, এ কথার দলিল জিজ্ঞাসা করলে এর জবাবে বলা হয়, বর্তমান কালের বাস্তব অবস্থাই এর দলিল হিসেবে যথেষ্ট। কারণ, আমরা রাসূলুল্লাহ সা.—এর যুগে এমন কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি, যে রাসূল সা.—এর হাতে বায়আত প্রদান করেছে, অতঃপর সে তার সমাজের অন্য সকল লোকদের মত বসবাসের জন্য সেই সমাজে ফিরে গিয়েছে। বরং তখন যে কেউ ইসলাম গ্রহণ করতো সে—ই মুসলিম সমাজে প্রবেশ করতো এবং কেবল মুসলিমদের সাথে পরিপূর্ণ বন্ধুত্বের ঘোষণা করতো; যদিও সে জরুরি পরিস্থিতির কারণে রাসূল সা.—এর নির্দেশে মুসলিম সমাজ থেকে দূরে বসবাস করতো।
আবার কেউ এ দাবির স্বপক্ষে হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা. বর্ণিত হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন। রাসূল সা. তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, যার ভাবার্থ হলোÑ “তুমি অবশ্যই মুসলিমদের জামাআত (বড় দল) ও তাদের ইমামের সাথে যুক্ত থাকবে। তিনি প্রশ্ন করলেন, যদি মুসলিমদের জামাআত ও তাদের ইমাম না থাকে তাহলে? নবীজি সা. বললেন, তাহলে সকল ছোট ছোট দলে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে; যদিও এজন্য তোমাকে গাছের শিকড় কামড়ে থাকতে হয় এবং মৃত্যু অবধি তুমি এভাবে কাটাবে। (সহিহ বুখারি : ৩৬০৬; সহিহ মুসলিম : ১৮৪৭)
উত্তর :
আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, “ইসলামি হুকুমাত” একটি শরয়ি পরিভাষা, যার জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত ও নীতিমালা রয়েছে, যাতে করে এর মৌলিক ধারণা সম্পর্কে কোনো মতপার্থক্য সৃষ্টি না হয়; এ পরিভাষাটিকে যেভাবেই ব্যক্ত করা হোক না কেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূল সা.—এর যুগে কোনো ব্যক্তি ইসলামি হুকুমাতের অধীনে প্রবেশ করতে পারতো না, যে পর্যন্ত না সে ইসলাম গ্রহণ করতো এবং রাসূল সা. তার ইসলাম গ্রহণের স্বীকৃতি প্রদান করতেন। রাসূল সা.—এর পরবর্তী যুগ হতে অদ্যাবধি এ নিয়ম বহাল আছে। অতএব, ইসলামি হুকুমাতে প্রবেশের পূর্বে তাকে অবশ্যই মুসলিম হওয়ার শর্তটি পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম জাতির অন্তভুর্ক্ত হওয়া এবং ইসলামি হুকুমাতে প্রবেশের জন্য তার মধ্যে আবশ্যিকরূপে মুসলিম হওয়ার গুণটি থাকতে হবে।
রাসূল সা.—এর পবিত্র কথা ও কাজের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রমাণিত, যা একটি বিশাল দলের মাধ্যমে আমাদের পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে, যা তাওয়াতুর ও ইজমা (ঐকমত্য)—এর সবচেয়ে মজবুত ও শক্তিশালী প্রকার এবং যে বিষয়ে মুসলিম ফকিহ, আলেম ও জনসাধারণের মধ্যে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এছাড়াও কোনো মতপার্থক্য ব্যতিরেকে চৌদ্দশত বছর ধরে যে বিধান চলমান তা হলো, কোনো ব্যক্তি যদি রাসূল সা. আনীত দীনকে স্বীকার করে এবং অদৃশ্যের বিষয়াবলির ওপর ঈমান এনে কালিমা শাহাদাত পাঠ করে তাহলে সে মুসলিম হয়ে যাবে এবং এ কালিমা পাঠের সাথে সাথেই চোখের পলক পরিমাণ বিলম্ব ব্যতিরেকে এবং অন্য কোনো শর্তের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ ছাড়াই তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে।
অতএব, কোনো ব্যক্তি যদি কালিমা শাহাদাত পাঠ করে এবং এ কারণে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয় তাহলে এর ফলশ্রম্নতিতে সে ইসলামি হুকুমাতের অধীনে প্রবেশ করবে এবং সে মুসলিম উম্মাহর একজন সদস্য হিসেবে অন্য সকল মুসলিমদের ন্যায় অধিকার পাবে। অতএব, ইসলামি হুকুমাত ও মুসলিম উম্মাহতে প্রবেশ করার বিষয়টি ব্যক্তির ইসলামের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলাফল এবং এটি ঐ সকল ফলাফলের একটি, কোনো ব্যক্তির জন্য ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হলে যা আরোপিত হয়।
আর প্রশ্নে যে বলা হয়েছে “আমরা এমন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাইনি যে রাসূল সা.—এর হাতে বায়আত গ্রহণের পর তার সমাজে ফিরে গিয়েছে; বরং প্রত্যেকে ইসলাম গ্রহণের পর মুসলিম সমাজে বসবাস করতে শুরু করেছে এবং কেবল মুসলিমদের সাথে পরিপূর্ণ বন্ধুত্বের ঘোষণা করেছে।” এ কথাটি যদি সঠিক ধরে নেওয়া হয় তাহলেও তা ঐ ফলাফল পর্যন্ত পেঁৗছায় না, এর দ্বারা যার ওপর দলিল প্রদানের ইচ্ছা করা হচ্ছে। কারণ, উক্ত বিষয়টি কিছুতেই এ কথার দলিল হয় না যে, মুসলিম শাসনের অধীনে প্রবেশ করা কালিমা শাহাদাত পাঠকারীর প্রতি ইসলামের বিধান আরোপের জন্য শর্ত। হাঁ, উক্ত বিষয়টি সঠিক ধরে নেওয়ার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হলো, যে ব্যক্তিকে কালিমা শাহাদাত পাঠের কারণে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং কালিমা পাঠের মাধ্যমে যার জন্য ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হয়েছে তাকে মুশরিকদের সঙ্গ ছেড়ে হিজরত করে মুসলিমদের মধ্যে বসবাসের আদেশ করা হবে।
কালিমা পাঠকারী মুসলিমেরর জন্য এ হিজরতের মর্যাদাগত অবস্থান শরিয়াহর অন্য সকল আবশ্যিক বিধানের মতই। যেমনÑ নামায, রোযা ও হজ্জ পালন করা, যাকাত প্রদান করা, সত্য কথা বলা, গীবত, মদপান, ব্যভিচার, চুরি ইত্যাদি অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা, আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণ করা, শরিয়াহর এ জাতীয় অন্য সকল বিধান, যা কালিমা পাঠের মাধ্যমেই ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়; চাই সে কালিমা পাঠকালে এ সম্পর্কে অবহিত হোক অথবা কালিমা পাঠের পর এসব বিষয় অথবা তার আংশিক সম্পর্কে অবহিত হোক। কারণ, কালিমা পাঠের দাবিই হচ্ছে, ইসলামি শরিয়াহর সকল বিধানকে গ্রহণ করা এবং গায়েবের প্রতি বিশ^াসের ঘোষণা করা। সেই সাথে শরিয়াহর সকল বিধান বিন¤্রভাবে মেনে চলাকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নেওয়া। এটিই হচ্ছে রাসূল সা. আনীত গোটা দীন ও গায়েবের প্রতি বিশ^াসের অর্থ।
অতএব, মুসলিম দেশে হিজরত করা বা মুসলিমদের বড় দলের সাথে যুক্ত থাকা শরিয়াহর একটি বিধান, যা কেবল ঐ ব্যক্তির ওপর আবশ্যক হয় যার জন্য ইসলামের বন্ধন কার্যত সাব্যস্ত হয়েছে, আর এ বিষয়টি কেবল ঐ ব্যক্তির থেকেই গৃহীত হয় যাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয়। সুতরাং এ হিজরত ও মুসলিমদের জামাআতের সাথে যুক্ত থাকার বিষয়টি নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জসহ ইসলামের অন্য সকল বিধানের মতই।
রাসূল সা.—এর যুগে যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তাঁর হাতে বায়আত প্রদান করেছে নবীজি সা. তাদের প্রত্যেককে এ বিষয়গুলোর প্রতি বিশ^াস স্থাপন, সে অনুযায়ী আমল করা এবং তা বাস্তবায়নের আদেশ করেছেন। আর এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই যে, যে কেউ নামায আদায় করলেই তা কবুল করা হয় না; বরং কেবল ঐ মুসলিম ব্যক্তির নামাযই কবুল করা হয় যাকে কার্যত মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হয় এবং নামায আদায়, পানাহার বর্জন অথবা বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে গমনের পূর্বে তার জন্য নিশ্চিতরূপে ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হয়।
সুতরাং কোনো ব্যক্তি মুখে কালিমা পাঠ করলেই তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে এবং কালিমা পাঠের সাথে সাথেই সামান্য কাল বিলম্ব না করে বা কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আশ্রয় গ্রহণ ব্যতিরেকে তার জন্য ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হবে; কালিমা পাঠকালে পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। এমনকি যদি সে কালিমা পাঠ করে এমতাবস্থায়, যখন তাকে হত্যার জন্য তার মাথার ওপর তরবারি উঠানো হয়েছে এবং তরবারির আলো তার চোখ ঝলসে দিচ্ছে সে অবস্থায়ও তার ইসলাম গৃহীত হবে। অতঃপর ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হওয়ার পর তাকে আদেশ করা হবেÑ সে যেন ইসলামি শরিয়াহর যাবতীয় বিধান মেনে চলে, কালিমা পাঠের মাধ্যমে সে যে শরিয়াহ মেনে চলা নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছে এবং নিজের জীবনে তা বাস্তবায়নের ঘোষণা করেছে।
পরবর্তীতে যদি সে শরিয়াহর কোনো বিধান পালনে অবহেলা করে তাহলে আমরা দেখবোÑ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সংশ্লিষ্ট বিধান অমান্যকারীর বিষয়ে আমাদেরকে কী আদেশ করেছেন?
যদি আল্লাহ তাআলা এ বিধান দান করেন যে, যে ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের পর ঐ কাজ করবে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুরতাদ হয়ে যাবে তাহলে আমরাও তাকে মুরতাদ ঘোষণা করবো। আর যে কাজের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এ বিধান দিয়েছেন যে, তার কর্তা যদিও আল্লাহর বিধান অমান্য করে পাপ কাজে লিপ্ত হচ্ছে, হত্যা, হস্ত কর্তন, প্রস্তারাঘাতে হত্যা বা বেত্রাঘাতের মত শাস্তির উপযুক্ত হচ্ছে; কিন্তু এ কারণে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে মুরতাদ হয়ে যাবে না; বরং তখনও তার জন্য ইসলামের বন্ধন বাকি থাকবে, তাহলে আমরা তার ওপর আল্লাহর বিধান আরোপ করবো।
সুতরাং কোনো কালিমা পাঠকারীর কাছে যখন এ সংবাদ পেঁৗছবে যে, তার দায়িত্ব হচ্ছেÑ মুশরিকদের মধ্যে বসবাস পরিহার করা এবং মুসলিম উম্মাহ বা মুসলিমদের বড় দল বা তাদের ইমামের সাথে যুক্ত হওয়া তখন তার জন্য সেই বিধানটি পালন করা এবং তা বাস্তবায়ন করা তার ওপর আবশ্যক হয়ে যাবে। এ বিধানের অবস্থান তার কাছে পেঁৗছা অন্য সকল বিধান, যথা নামায, যাকাত ও হজ্জ ইত্যদি বিধান পালন করা এবং চুরি, মদপান, ব্যভিচার ও গিবত থেকে বিরত থাকা, সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা ইত্যাদি বিধানের মতই। কিন্তু যদি তার কাছে এ সকল বিধান বা তার কিছু বিষয়ের সংবাদ না পেঁৗছে তাহলে সে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ (মাজুর) হিসেবে গণ্য হবে।
অতঃপর আমরা ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলবো, যে বলেÑ “আমরা এমন কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাইনি যে রাসূল সা.—এর হাতে বায়আত গ্রহণের পর নিজ সমাজে ফিরে গিয়েছে, যেখানে সে পূর্ব থেকে বসবাস করতো” আমরা তাকে উদ্দেশ্য করে বলবো, রাসূল সা.—এর কাছে এসে উপস্থিত হওয়া, তাঁর মুখোমুখি হয়ে হাতে হাত রেখে সরাসরি বায়আত প্রদান করা ইসলামি ইতিহাসের কোনো সময়ই তা ব্যক্তির ইসলামের বিশুদ্ধতার জন্য শর্ত ছিল না। বরং আমরা দেখিÑ মরুভূমি ও নির্জন প্রান্তরে বসবাসকারী কত লোক এমন আছে, যারা কালিমা শাহাদাত পাঠ করেছেন এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.—কে আল্লাহর রাসূল হিসেবে বিশ^াস করেছেন। তাদের সেই কালিমা পাঠ যথার্থ হয়েছে এবং রাসূল সা.—এর সাথে সাক্ষাৎ ব্যতিরেকেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।
এ মতের প্রবক্তা যেন এ কথাও জেনে রাখেন যে, নাজাশি মৃত্যু অবধি হাবাশা (ইথিওপিয়া)—তেই অবস্থান করেছিল এবং রাসূল সা.—এর সাথে কখনও তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। আল্লাহ তাআলা তাকে ঐ অবস্থাতেই মৃত্যু দিয়েছিলেন, যখন তিনি তার কওমের লোকদের মধ্যে তাদের বাদশাহ হিসেবে অবস্থান করছিলেন। তা সত্ত্বেও সে সকলের থেকে নিজের ইসলাম কবুলের বিষয়টিকে গোপন করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.—এর পবিত্র যবানে যেসকল মুজিযা প্রকাশ করেছিলেন সেগুলোর একটি হলো, তিনি ঘোষণা করেনÑ নাজাশি ইসলামের ওপর মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তিনি কয়েকজন সাহাবিকে একত্র করে Ñআল্লাহ তাআলা যাদেরকে একত্র করার ইচ্ছা করেছেনÑ নাজাশির ওপর গায়েবানা জানাযার নামায আদায় করেন। সুতরাং এ ঘটনার পর কারও জন্য এ কথা বলা কীভাবে বৈধ হবে যে, ইসলামি হুকুমাতে প্রবেশ করা তথা মুসলিম দেশে হিজরত করে চলে যাওয়াটা ইসলামের প্রবেশের জন্য শর্ত এবং যে ব্যক্তি কালিমা শাহাদাত পাঠ করবে তার বিষয়টি মওকুফ থাকবে; সে হিজরত না করা পর্যন্ত মুসলিম বা অমুসলিম নির্দিষ্টরূপে কোনো দলভুক্ত হবে না।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, আর তা হলো :
ঐ ব্যক্তির বিধান কী, যে মুশরিকদের মধ্যে নিজের অবস্থান ছেড়ে মুসলিমদের বড় দলের কাছে হিজরত করে না?
এর জবাবে আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, ঐ মুসলিম যদি শরিয়াহর এ বিধানের আবশ্যিকতা সম্পর্কে অনবহিত হয় তাহলে এতে তার কোনো ক্ষতি হবে না; বরং সে তার অজ্ঞতার কারণে অপারগ হিসেবে গণ্য হবে এবং কালিমা পাঠের কারণে সে মুসলিমদের অন্তভুর্ক্ত হবে। এরপর যদি তার কাছে সঠিক বিধান পেঁৗছে এবং তার নিকট এ সম্পর্কে দলিল—প্রমাণও প্রতিষ্ঠিত হয়, তা সত্ত্বেও যদি সে তা অস্বীকার করে এবং এর বিরোধিতাকে বৈধ মনে করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে এবং ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হওয়ার পরও এখন তাকে অন্য সকল ধর্মত্যাগীদের মত গণ্য করা হবে।
আর কোনো ব্যক্তির ইসলাম শুরু থেকেই বিশুদ্ধ না হওয়া এবং একজনের ইসলাম বিশুদ্ধ হওয়ার পর তার ধর্মত্যাগী হওয়া, এ দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। যেমনÑ কোনো কালিমা পাঠকারী ব্যক্তি যদি মূলত ইহুদি বা খ্রিষ্টান হয়, তাহলে তার ব্যাপারে বিধান হলো, শুধু কালিমা পাঠ করার দ্বারাই সে মুসলিম হবে না। অতঃপর ইসলাম ধর্ম ত্যাগের কারণে সে মুরতাদও হবে না। বরং যদি তার বসবাসকৃত অঞ্চলটি মুসলিম শাসনের অধীন হয় এবং সে মুসলিম শাসককে জিযয়া (ভূমি কর) প্রদান করে তার তার জীবন ও সম্পদ সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু যদি আমরা এমন ব্যক্তিকে শুধু কালিমা পাঠের কারণে মুসলিম বলে ঘোষণা করি তাহলে এরপর সে শরিয়াহর সুস্পষ্ট বিধানকে অস্বীকার এবং তার বিরোধিতাকে বৈধ মনে করার কারণে তাকে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করতে হবে। আর তখন তার জন্য ইসলাম ব্যতীত ইহুদি, খ্রিষ্টান বা অন্য যেকোনো ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। এছাড়াও মুসলিমদের সাথে তার কোনো নিরাপত্তা চুক্তি বহাল থাকবে না।
আর যে ব্যক্তি কালিমা পাঠ করে মুসলিম হলো এবং তার কাছে মুশরিকদের মধ্যে অবস্থানের নিষিদ্ধতা এবং মুসলিম জামাআতের কাছে হিজরতের আবশ্যিকতার সংবাদ পেঁৗছল, তা সত্ত্বেও সে মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করছে, এমন ব্যক্তি যদি সেই বিধানকে অস্বীকার না করে তাহলে দেখতে হবেÑ তার হিজরতের ক্ষেত্রে কোনো ওজর আছে কি না? যদি ওজর থাকে তাহলে সে অপারগ বলে গণ্য হবে। আর যদি কোনো ওজর না থাকে তাহলে তার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কারও কারও মতে ঐ ব্যক্তি মুশরিকদের মধ্যে অবস্থানের কারণে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে এবং মুরতাদ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ, হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে :
أَنَا بَرِيءٌ مِنْ كُلِّ مُسْلِمٍ يُقِيمُ بَيْنَ أَظْهُرِ الْمُشْرِكِينَ.
“আমি প্রত্যেক ঐ মুসলিম থেকে দায়মুক্ত যে মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে।” তাদের বক্তব্য হলো, রাসূল সা. কেবল ঐ ব্যক্তির থেকেই দায়মুক্ত হবেন যে ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে। এ মতের প্রবক্তাদের একজন হলেন, ইমাম ইবনু হাযম।
আবার কেউ কেউ এ মতটি খণ্ডন করে বলেন, রাসূল সা. যাদের থেকে দায়মুক্তির ঘোষণা করেছেন তাদের জন্যই মুসলিম নাম ও বৈশিষ্ট্য বহাল রেখেছেন। হাদিস শরিফে যাদের থেকে দায়মুক্তির কথা বলা হয়েছে তাদের জন্য মুসলিম নাম ও তার বৈশিষ্ট্য বহাল রাখার কথা বর্ণিত আছে। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, এ দায়মুক্তি দীন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে ছিল না; বরং তাদের জন্য দিয়ত (রক্তপণ) প্রদানের আবশ্যিকতাকে নাকচ করার বিষয়ে ছিল। অর্থাৎ, কোনো মুসলিম যদি মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে এবং ঐ মুশরিকদের ওপর আক্রমণকালে যদি সেই মুসলিম নিহত বা আহত হয়, এ ধারণার কারণে যে, সেও অন্যদের মতই মুশরিক তাহলে এতে সে কোনো রক্তপণ পাবে না। এর সমর্থন হয় সূরা আনফালের নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা :
وَالَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَايَتِهِمْ مِنْ شَيْءٍ حَتَّى يُهَاجِرُوا وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ.
আর যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু হিজরত করেনি হিজরত না করা পর্যন্ত তোমাদের ওপর তাদের অভিভাবকত্বের কোনো দায়িত্ব নেই। যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য, তবে সেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় যাদের সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে। (সূরা আনফাল : ৭২)
উক্ত আয়াতে হিজরত না করা সত্ত্বেও মুমিন নাম ও তার বৈশিষ্ট্যকে বহাল রাখা হয়েছে। অথচ হিজরত না করার কারণে তাদের জন্য মুসলিম সা¤্রাজ্য বা মুসলিমদের জামাআতের অভিভাবকত্বের দায়িত্বকে নাকচ করা হয়েছে। এমনিভাবে আয়াতে সকলের দীন এক বলেও ঘোষণা করা হয়েছে : “যদি তারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য।”
সুতরাং যে ব্যক্তির কোনো ওজর নেই, যদিও তার ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে; কিন্তু যার কোনো ওজর আছে তার ব্যাপারে সকলে একমত যে, কালিমা পাঠের মাধ্যমেই তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তার জন্য ইসলামের বন্ধন সাব্যস্ত হবে। অতঃপর এ দুটি বিষয়ের দাবি অনুযায়ী তার ওজরের কারণে তাকে অপারগ বিবেচনা করা হবে। অতএব, হিজরত না করার কারণে সে কাফের, ফাসেক বা গোনাহগার কোনোটিই হবে না।
ওজর বিহীন মুশরিকদের মধ্যে অবস্থানকারী মুসলিম সম্পর্কে পূর্বোল্লিখিত দুটি মতের যেটিই গ্রহণ করা হোক না কেন, এ বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে যে, এ বিধানটি ঐ মুসলিম ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে; ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে নয়, যে পাপাচারী মুসলিমদের মধ্যে অবস্থান করে।
আর ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে হবে, তা হিজরত ব্যতীত ভিন্ন নির্দেশের কারণে। আর এ বন্ধুত্বের বিষয়টি আবেগ ও অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত এবং তা ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে কালিমা পাঠ করেছে এবং এ কালিমা পাঠের ক্ষেত্রে তাকে সত্যবাদী ও নিষ্ঠাবান হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। আর তখন তাকে শরিয়ার বিধান হিসেবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হবে। অর্থাৎ, সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদের সাহায্য করতে পারবে না। কেউ যদি তা করে তাহলে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য কোনো নিরাপত্তা বাকি থাকবে না। অতএব, এর দ্বারা সে মুরতাদ হয়ে যাবে।
আমরা আবারও পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করছি যে, প্রথমত কালিমা পাঠের কারণে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে। অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের সহযোগিতা করার কারণে সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে এবং মুরতাদ হয়ে যাবে।
এরপর আল্লাহর অপার সাহায্যে আমরা আরও বলবো, এ ব্যাপারে রাসূল সা.—এর হাদিসসমূহ একেবারে সুস্পষ্ট ও অকাট্য যে, কেউ কালিমা শাহাদাত পাঠ করলে, কোনোরূপে কাল বিলম্ব ছাড়াই সাথে সাথেই সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। তার জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা পাবে। সেক্ষেত্রে তার কালিমা পাঠের বিষয়ে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়াস চলবে না; কালিমা পাঠের সময় পরিস্থিতি যাই হোক না কেন। পূর্বে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি এবং এ বিষয়ের বিশুদ্ধতা ও প্রামাণিকতার ওপরে অকাট্য প্রমাণসমূহ পেশ করেছি।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, “যেকোনো ব্যক্তি কালিমা পাঠ করলেই যে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে” রাসূল সা.—এর সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহির ভিত্তিতেই ছিল। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى.
তিনি মনগড়া কথা বলেন না। এটা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। (সূরা নাজম : ৩—৪)
এটি ছিল মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহি, যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাত। কাজেই এ দাবি কী করে সঠিক হবে, যখন রাসূল সা. মুসলিমদের ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের ওপর এমন একটি সময় আসবে, যখন তাদের মধ্যে বৃহৎ ঐক্য, ইমাম ও ইসলামি শাসন কিছুই থাকবে না। হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান রা. বর্ণিত এ হাদিসে প্রশ্নকারী সেই অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এবং তার সুস্পষ্ট আলোচনা শুনতে চেয়েছেন। তখন রাসূল সা. যে কার্যপদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন তা থেকে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, মুসলিমদের মধ্যে বৃহৎ ঐক্য ও ইমাম না থাকলেও ব্যক্তি পর্যায়ে ঈমান ও ইসলামের বন্ধন এবং মুসলিমের বৈশিষ্ট্য বাকি থাকবে।
যদি মুসলিমদের মধ্যে বৃহৎ ঐক্য ও ইমাম থাকা অবস্থায় কালিমা পাঠের বিধান ঐ অবস্থা থেকে ভিন্ন হতো যখন মুসলিমদের মধ্যে তা বাকি থাকবে না, তাহলে নিশ্চয় রাসূল সা. এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে আমাদের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করতেন, যার দ্বারা কুফর ও ঈমানের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়ে যেতো। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّ.
আর আপনার প্রতিপালক এমন নন যে, তিনি ভুলে যাবেন। (সূরা মারয়াম : ৬৪)
অতঃপর আমরা ঐ ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলবো, যে কালিমা পাঠকারীর ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলামি শাসনের অধীনে প্রবেশ করাকে শর্ত হিসেবে জরুরি বলে ঘোষণা করে, অতঃপর একই সময় সে বলেÑ ‘বর্তমান কালে সেই ইসলামি শাসনের অস্তিত্ব নেই।’ তার উদ্দেশ্যে আমরা বলবো, আপনি কী সিদ্ধান্ত করছেন, সে সম্পর্কে আপনার কি কোনো খবর নেই? ঐ সিদ্ধান্তের আলোকে তো আপনার নিজের ইসলাম গ্রহণই বিশুদ্ধ হচ্ছে না! অর্থাৎ, আপনি নিজেই নিজের ইসলাম বিশুদ্ধ না হওয়ার ফয়সালা করছেন।
যদি আপনি বলেন যে, আপনি ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন এবং কাজ করছেন, তাহলে স্পষ্টত আপনি একটি শর্তের মাধ্যমে আরেকটি শর্তের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কারণ, প্রথমে আপনি শর্ত করেছেন, ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলামি শাসনের অধীনে প্রবেশ করা শর্ত, এবং আপনিই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেই ইসলামি শাসন বর্তমানে অনুপস্থিত, অতঃপর আরেকটি শর্তের মাধ্যমে নিজের ইসলামকে বিশুদ্ধ গণ্য করেছেন। সেই শর্তটি হচ্ছেÑ আপনি ইসলামি শাসন কায়েমের জন্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করছেন। এর জবাবে আমরা বলবো, ইসলামি শাসন কায়েমের জন্য চেষ্টা ও পরিশ্রম করা একটি ভিন্ন বিষয়, যা প্রথম শর্তের বিপরীত। অতএব, আপনার এ দাবির সমর্থনে কি কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল হতে কোনো দলিল আছে কি?
পূর্বে আমরা এ বিষয়ে অকাট্য দলিল পেশ করেছি যে, আল্লাহ তাআলার বিধান হলো, কোনো ব্যক্তি কালিমা শাহাদাত পাঠের সাথে সাথে মুসলিম হয়ে যাবে এবং সেই কালিমা পাঠের পর পাঠকারী থেকে কালিমার শরিয়াহ ব্যতীত অন্য কোনো শরিয়াহ বা জীবন ব্যবস্থা গৃহীত হবে না। আর কালিমা পাঠের মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে কাউকে ইসলামি শরিয়াহ মানতে বাধ্য করা হবে না এবং কারও কাছ থেকে তা তলব করা হবে না।
এটিই হচ্ছে এ বিষয়ে শরয়ি বিধান। আর যে জামাআতের আপনি সম্পৃক্ত তা এ বিষয়টিকে তার সূচনাকাল থেকে মূল ভিত্তিরূপে গ্রহণ করেছে এবং যখন থেকে তার তৎপরতা শুরু করেছে তখন থেকে এক মুহূর্তের জন্যও এ নীতিকে পরিহার করেনি। সেই জামাআতের প্রকৃত অবস্থা, তার প্রতিষ্ঠাতা এবং এর কর্মীদের অবস্থাÑ কোনোটাই এ বিষয়ে বিতর্কের সুযোগ রাখে না। তা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি এ বিষয়ে বিতর্ক করতে চায় সে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত একটি মৌলিক বাস্তবতাকে অহেতুক অস্বীকারের চেষ্টা করছে। বিষয়টি এমনভাবে প্রমাণিত যাতে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণর সুযোগ নেই। যে ব্যক্তি এমন বিষয়ে প্রবৃত্ত হবে সে হলো বাস্তবতাকে অস্বীকারকারী। অতএব, তার কোনো বক্তব্য, বিতর্ক বা উপদেশ কোনোটাই গৃহীত হবে না এবং ধরে নেওয়া হবেÑ সে জামাআতের নীতি ও আদর্শের ওপর নেই।
ইমাম শহিদ হাসান আল বান্না ‘রিসালুত তাআলিম’ পুস্তিকার বিশতম অনুচ্ছেদে বলেন,
“আমরা কখনও এমন কোনো মুসলিমকে কাফের সাব্যস্ত করবো না, যে আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করে এবং হযরত মুহাম্মাদ সা.—কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে। সেই সাথে এ দুটি বিষয়ের দাবির ওপর আমল করে এবং ফরয বিধানসমূহ পালন করে; তা হোক নিজেদের মন মত অথবা কোনো গোনাহের কারণে। কিন্তু যদি সে কুফরি কালিমা উচ্চারণ করে, অথবা দীনের কোনো আবশ্যিক ও অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করে, অথবা কুরআনের স্পষ্ট বিধানকে মিথ্যারোপ করে, অথবা কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করে, আরবি ভাষার নীতিমালা অনুসারে যার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই, কিংবা এমন কাজ করে কুফরি ছাড়া যার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, সেক্ষত্রে আমরা তাকে কাফের সাব্যস্ত করবো।”
যে ব্যক্তি এ বক্তব্য নিয়ে চিন্তা করবে সে অবশ্যই দেখতে পাবে আমরা ইমাম ত্বহাবি র.—এর বাণী “আমরা কোনো মুসলিমকে গোনাহের কারণে কাফের সাব্যস্ত করবো না এবং আমরা এ কথা বলি না যে, ঈমান থাকলে গোনাহের কারণে কোনো ক্ষতি হবে না।” এর যে ব্যাখ্যা আলোচনা করেছি শহিদ ইমামের বক্তব্যের সাথে এর পূর্ণ মিল রয়েছে।
কেউ কেউ শহিদ ইমামের বক্তব্য “আমরা কখনও এমন কোনো মুসলিমকে কাফের সাব্যস্ত করবো না, যে আল্লাহ তাআলাকে এক বলে স্বীকার করে এবং হযরত মুহাম্মাদ সা. কে আল্লাহর রাসূল বলে স্বীকার করে। সেই সাথে এ দুটি বিষয়ের দাবির ওপর আমল করে”—এর পিছনে পড়ে নিজেদের ক্লান্ত করে ফেলেছেন। অতঃপর তারা দাবি করেছেন, মুসলিম থাকতে হলে গোটা শরিয়াহর ওপর পরিপূর্ণরূপে আমল করতে হবে। অর্থাৎ, শরিয়াহর সকল বিধান পরিপূর্ণরূপে মানতে হবে! জবাবে আমরা বলবো, এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, এ কথাকে যদি সঠিক ধরা হয় তাহলে এর পরে যে বলা হয়েছে ‘কোনো মুসলিমকে নিজের খেয়াল খুশি মত বা কৃত গোনাহের কারণে কাফের সাব্যস্ত করবো না’ এ কথাটি অনর্থক হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, গোনাহ বা নাফরমানি (معصية) বলা ঐ কাজকে যা কালিমা শাহাদাতের দাবির বিপরীত হয়। কাজেই উপযুর্ক্ত বক্তব্যকে যদি প্রচলিত ও পরিচিত ফিকহি পরিভাষাসমূহের সাথে সমন্বয় না করে ঢালাওভাবে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে অনেক জায়গায় বিরোধ সৃষ্টি হবে। শহিদ ইমাম এসকল পরিভাষা, মূলনীতি ও সেগুলোর প্রয়োগক্ষেত্র সম্পর্কে সম্মক অবহিত ছিলেন। এ কারণে তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ঐ সকল অবস্থাকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন যেখানে কোনো মুসলিমের প্রতি কুফরের অভিযোগ আরোপ করা যায়। আর তা হচ্ছেÑ সে দীনের কোনো আবশ্যিক ও অকাট্য বিষয়কে অস্বীকার করে, অথবা কুরআনের স্পষ্ট বিধানকে মিথ্যারোপ করে, অথবা কুরআনের এমন ব্যাখ্যা করে, আরবি ভাষার নীতিমালা অনুসারে যার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই, কিংবা এমন কাজ করে কুফরি ছাড়া যার ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
উক্ত জামাআতের সাথে শহিদ ইমাম র.—এর আচরণ এবং তার জন্য তিনি যে রেখা এঁকে দিয়েছেন তা এমন ছিল যে, তাতে সকলের সাথে সমআচরণ করা হতো, হোক সে জামাআতের বর্তমান সদস্য, অথবা অতীতে জামাআতের সদস্য ছিল; কিন্তু পরে মতবিরোধের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, কিংবা যে কখনও জামাআতের সদস্য ছিল না। ইমামের নীতিতে সকলেই ছিল সমান।
আমি মনে করিÑ শহিদ ইমাম র. যে ‘রিসালাতুত তাআলিম’ পুস্তিকা রচনা করেছেন, তাঁর আচরণ ছিল তারই বাস্তব নমুনা এবং সত্য ও সঠিক প্রয়োগ। তাই আমি আবার বলবো, প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এ বিষয়ে জামাআতের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে স্পষ্ট। এ জামাআতের অবস্থা সম্পর্কে যার ধারণা আছে তিনি বিষয়গুলো ভালো করেই জানেন। বরং যারা জামাতের সাথে সম্পৃক্ত এবং তার সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাদের মনে এ বিষয়টি নিশ্চিতরূপে বদ্ধমূল হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : ২।
কিছু লোক আছে যারা বলে, কেউ কালিমা শাহাদাত পাঠ করলে তাকে কাফের সাব্যস্ত করা হবে না; কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, সকল মানুষকে সামগ্রিকভাবে মুসলিম গণ্য করা হবে। কারণ, এ বিষয়টি নিশ্চিত যে, তাদের মধ্যে অনেক লোক আছে, যারা এমন কথা বলে বা কাজ করে যা তাদেরকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। তাই যেমনিভাবে তাদের সকলকে এক কথায় কাফের বলা যাবে না; অনুরূপ তাদেরকে এক কথায় মুসলিমও বলা যাবে না।
এরপর তারা প্রশ্ন করে, ‘মানুষেরা সকলেই মুসলিম’ এবং ‘মুসলিম সমাজ’ এ দুই কথার মধ্যে পার্থক্য কী? বর্তমানে প্রচলিত মুসলিম সমাজে বসবাস করলেই কি কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে এবং সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারবো যে, সে এমন কথা বলেছে বা এমন কাজ করেছে যা তাকে মিল্লাত থেকে বের করে দেয়? নাকি আমরা কাউকেই মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো না, যে পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারবো যে, সে কালিমা শাহাদাত পাঠ করেছে অথবা এমন কাজ করেছে যা কালিমা পাঠের সাক্ষ্য বহন করে? আর কোনো ব্যক্তি মুসলিম সমাজে অবস্থানের কারণে তার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে না, যার ভিত্তিতে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে?
উত্তর :
‘রিসালাতুত তাআলিম’ পুস্তিকার পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে :
“প্রত্যেক ঐ মাসআলা যার ওপর কোনো আমলের ভিত্তি নেই, তাতে প্রবৃত্ত হওয়া এক ধরনের লৌকিকতা, শরিয়াহ আমাদেরকে যার থেকে নিষেধ করেছে।” এর মূলনীতির আলোকে আমরা উক্ত প্রশ্নের জবাব দিবো এবং আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো,
শরিয়াহর কিছু বিধান এমন, যা সমাজের অধিকাংশ মানুষের অবস্থার ওপর অর্থাৎ, সমাজের লোকদের বাহ্যিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যেমনÑ ইসলামি পদ্ধতিতে সালাম প্রদান, অপরিচিত লোকদেরও আচরণে ধার্মিকতা পরিলক্ষিত হওয়া, যাদের পিতা—মাতার পরিচয় জানা নেই। যেমনÑ আপনি ঐ ব্যক্তিকে ইসলামি পদ্ধতিতে সালাম প্রদান করলেন যাকে আপনি চিনেন না, এ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা মুসলিম, অথচ সেখানে এ সম্ভাবনাও আছে যে, আপনি যাকে সালাম দিয়েছেন সে মুসলিম নয়, অথবা আপনি যাদেরকে সালাম দিয়েছেন তাদের মধ্য হতে কিছু লোক মুসলিম নয়।
প্রিয় ভাই! এছাড়া যদি আপনি খেলাফতের রাশেদার যুগেও বসবাস করতেন তাহলে আপনার ওপর বর্তমান কালে যে দায়িত্ব বর্তায় সে যুগেও একই দায়িত্ব অর্পিত হতো। অর্থাৎ, যাদের সাথে আপনি লেনদেন করছেন বা একসাথে মিলে কাজ করছেন তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন। কারণ, আপনি ব্যক্তিগত জীবনের যাবতীয় লেনদেনে যাদের সাথে কাজ করছেন তাদের বাহ্যিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। অতএব, যখন আপনি সেই মূলনীতিকে মেনে চলবেন, অর্থাৎ “যে কেউ কালিমা শাহাদাত পাঠ করবে সেই মুসলিম বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি এমন আমল করবে যা তার ইসলাম ধর্মের প্রমাণ বহন করে সে বাহ্যত মুসলিম, যতক্ষণ না এর বিপরীত দলিল পাওয়া যায়।” এ মূলনীতি মেনে চললে আল্লাহর সাহায্যে আপনি সমস্যায় পড়বেন না এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুতও হবেন না।
আর ‘মানুষেরা সকলেই মুসলিম’ এবং ‘মুসলিম সমাজ’ এ দুই কথার মধ্যে পার্থক্য, কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আপনার এ কথার মতই যে, ‘সে মুসলিম; যদিও সে কিছু গোনাহ ও পাপ কাজে জড়িত।’ এ কথা বলা সহজ। কিন্তু এ কথাটি নিশ্চয় আপনার কাছে একটু কঠিনই মনে হবে যে, ‘লোকটির কাজকর্ম ও আচরণ মূলত ইসলামি, যদিও ধরে নেওয়া হয় যে, সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে কুফরে প্রবেশ করেনি এবং যদিও সে ইসলামি শরিয়া অনুযায়ি সেসব কাজ করে তার সংখ্যা তার কৃত গোনাহের তুলনায় কম।’
আর পূর্বে যে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, বর্তমানে প্রচলিত মুসলিম সমাজে বসবাস করলেই কি কোনো ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে? ঐ ব্যক্তি মুসলিম মিল্লাত থেকে বের হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারবো যে, সে এমন কথা বলেছে বা এমন কাজ করেছে যা তাকে মিল্লাত থেকে বের করে দেয়? নাকি আমরা কাউকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো না, যে পর্যন্ত না আমরা নিশ্চিতরূপে জানতে পারবো যে, সে কালিমা শাহাদাত পাঠ করেছে অথবা এমন কাজ করেছে যা কালিমা পাঠের সাক্ষ্য বহন করে। আর মুসলিম সমাজে অবস্থানের কারণে তার বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য অর্জিত হবে কি, যার ভিত্তিতে তাকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে?
এর জবাবে আমরা বলবো, যে সমাজের অধিকাংশ লোক মুসলিম এবং সেখানে ইসলামের ব্যাপক চর্চা হয়, এমন সমাজের একজন লোককে আমরা মুসলিমই বলবো, যতক্ষণ না এর বিপরীত প্রমাণিত হয়; যদিও ঐ সমাজের অধিকাংশ লোকের মুখে সরাসরি কালিমা শাহাদাত পাঠের বিষয়টি শোনা যায়নি। বরং একজন ব্যক্তি মুসলিম এবং সে কালিমা শাহাদাত পাঠ করেছে, এর প্রমাণ হিসেবে এটাই যথেষ্ট যে, তার থেকে ইসলামি শরিয়া সমর্থিত কাজ প্রকাশ পায়। যেমনÑ আপনি দেখলেন যে, সে আযান দিচ্ছে, অথবা আযানের শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করছে, কিংবা রাসূল সা.—এর ওপর দুরূদ পাঠ করছে বা কুরআন তিলাওয়াত করছে। অথবা মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছে, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার কথা বলছে কিংবা তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করছে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করছে ইত্যাদি…।
অনুরূপ কারও পিতা—মাতা দুজনই মুসলিম হলে কিংবা পিতা মুসলিম ও মা আহলে কিতাব হলে তাকে মুসলিম ধরা হয়, এবং বালেগ হওয়ার পর তার ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম গ্রহণের অধিকার থাকে না। তা সত্ত্বেও যদি সে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে সে মুরতাদ হয়ে যায়।
এর ভিত্তিতে আমরা প্রত্যেকে ঐ ব্যক্তিকে মুসলিম হিসেবে গণ্য করবো যার জন্ম উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী হবে। আর তার এমন জন্মের ওপর প্রমাণ হলো তার পিতা প্রদত্ত নাম, যদি সেই নামটি এমন হয় যা সাধারণত অমুসলিমদের জন্য ব্যবহৃত হয় না। পূর্ববর্তী লোকদের ন্যায় এ ব্যক্তির ওপরও মুসলিম হওয়ার বিধান আরোপ করা হবে। তাকে গোটা শরিয়াহ মানতে বলা হবে এবং শরিয়াহর বিধানসমূহ পালন করা তার জন্য আবশ্যক হবে। কিন্তু যদি সে এমন কাজ করে যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় অথবা সে স্বেচ্ছায় অন্য ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে সেক্ষেত্রে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে এবং মুরতাদ হয়ে যাবে। এমন ব্যক্তিকে শুরু থেকে কাফের বলা হবে না; হোক সে এমন শিশু যে বালেগ হওয়ার সময় ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে।
এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, মুসলিম হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য মুসলিম সমাজে বসবাসের একটি বিশেষ প্রভাব রয়েছে। সেই সাথে আমরা এ বিষয়েও জানি যে, তাদের মধ্যে অনেক লোকও এমন আছে যারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং মুরতাদ হয়ে গেছে। যার ব্যাপারে আমরা নির্দিষ্টরূপে ও নিশ্চিতভাবে এমন জানতে পারবো তাকে কাফের ও মুরতাদ হিসেবে গণ্য করবো।
প্রশ্ন : ৩।
জাহেলিয়াত (الجاهلية) শব্দটি কুরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফে ব্যবহৃত হয়েছে, এবং শেষ যুগেও এ শব্দের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। তবে এর অর্থ ও মর্ম নির্দিষ্ট নয়। নিকট অতীত বা দূর অতীতে এ বিষয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে বলেও জানা নেই এবং এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত বর্ণিত হয়নি। এখান আমার প্রশ্ন হলো, জাহেলি সমাজ কাকে বলে? এ নামকরণ দ্বারা নির্দিষ্ট রূপে কী বুঝায়? বর্তমানে প্রচলিত সমাজকেও কি জাহেলি সমাজ বলা বিশুদ্ধ হবে?
উত্তর :
প্রথমে আমি পূর্বের আলোচনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, আমাদের পূর্বের আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল কেবল, ঐ সকল মতবাদের খণ্ডন, যেগুলো শেষ যুগে প্রকাশ পেয়েছে এবং সেগুলোকে আমাদের দাওয়াতের নীতিপরিপন্থী ও বিপজ্জনক মনে হয়েছে। যেসব চিন্তা ও মতবাদ আমাদের সামনে এসেছে এবং তা দীনের জন্য ক্ষতিকর মনে হয়েছে আমরা তার খণ্ডন করেছি। তবে সেগুলোর আদ্যোপান্ত নিয়ে আলোচনা করা বা খণ্ডন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।
আমরা আবারও বলতে চাই, আমরা দাওয়াতের পূর্ণাঙ্গ উদ্দেশ্য বা তার সকল কার্যক্রম নিয়ে কোনো গবেষণাপত্র লিখিনি এবং আমাদের এ কাজের প্রয়োজনও হয়নি। দাওয়াতের বিষয়ে অনেক পুস্তিকা ও গ্রন্থ রয়েছে। আমরা এখন যে ক্রান্তিকাল ও পরিবেশে বসবাস করছি তা দাওয়াত বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার উপযোগী নয়। এ কারণে আমরা কেবল ঐ বিষয়ে আলোচনা করেছি যে বিষয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছি, এবং কেবল ঐ বিষয়ে কলম ধরেছি এবং ঐ মতবাদকে লিখিত আকারে খণ্ডন করেছি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমাদেরকে বেষ্টনকারী সঙ্কটসমূহ থেকে যে সঙ্কটকে অধিক বিপজ্জনক মনে করেছি।
এরপর মূল প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো, জাহেলিয়াত শব্দটি কুরআনে কারিম ও হাদিস শরিফে বর্ণিত অন্যান্যা শব্দ যেমনÑ الضلال (ভ্রষ্টতা), العصيان (অবাধ্যতা), الفسوق (পাপাচার),الظلم (জুলুম) ইত্যাদির ন্যায় ব্যবহৃত হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, দীনের বিধানাবলি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, সেই বেরিয়ে যাওয়াটা কখনও এমন হবে যা মিল্লাতে ইসলাম থেকে বহিষ্কার করে না, আবার কখনও এমন হবে যা মিল্লাতে ইসলাম থেকে বের করে মুরতাদ বানিয়ে দেয়।
হাদিস শরিফে এর একটি দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই। রাসূল সা. একদিন আবু যর গিফারি রা.—কে উদ্দেশ্য করে বললেন, إنك امرؤ فيك جاهلية : “হে আবু যর! তুমি এমন ব্যক্তি যার মধ্যে জাহেলিয়াত রয়েছে।” ইমাম বুখারি এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন এবং এ অংশ দ্বারা অধ্যায় তৈরি করে বলেন, “পাপ কাজসমূহ জাহেলি স্বভাব। কেউ তাতে জড়িত হলে তাকে কাফের বলা হবে না, যে পর্যন্ত না সে শিরকে লিপ্ত হয়।” (সহিহ বুখারি : খ. ১, পৃ. ১৪)
উপর্যুক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাহেলিয়াত শব্দ বলে বোঝানো হয়েছে, প্রত্যেক ঐ কাজ যার দ্বারা ব্যক্তি দীনের বিধান অমান্য করে। তবে এ অমান্য করাটা ইসলামের সীমা থেকে বের করে দেয় কি না, এর জন্য শরিয়াহর বিধানসমূহ জানতে হবে, যার মাধ্যমে ব্যক্তি বুঝতে পারবেÑ কোনো পাপ কাজ করলে ব্যক্তি ইসলাম থেকে বেরিয়ে মুরতাদ হয়ে যায়, আর কোনো পাপ কাজ করলে ব্যক্তি গোনাহগার হয় বটে, তবে মুরতাদ হয় না।
আর ‘এটি জাহেলি সমাজ’ কথাটি এ কথার মতই যে, এ সমাজ পথভ্রষ্ট, বা এ সমাজ পাপাচারে লিপ্ত। এসকল শব্দ দ্বারা প্রতীয়মান হয়Ñ সেখানে দীনের বিধান লঙ্ঘিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্য সমাজের অধিকাংশের ওপর অথবা তাদের সংগঠন বা ব্যবস্থাপনার ওপর ছেয়ে গেছে। কিন্তু সেই দীনের বিধান লঙ্ঘনটি কি এমন যা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোটা সমাজকে ইসলাম থেকে বের করে মুরতাদ বানিয়ে দেয়, না এমন নয়Ñ এর জন্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসের স্মরণাপন্ন হতে হবে এবং তার থেকে সংশ্লিষ্ট শরিয়াহর বিধান জানতে হবে।
প্রশ্ন : ৪।
মানুষের মধ্যে ইসলাম অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ইখওয়ানুল মুসলিমিন জামাআতের ভূমিকা কী? এ জামাআতের বৈধতার ভিত্তি ও তাৎপর্য কী? শাসকের সম্পর্কে আপনাদের আলোচনায় সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই কেন?
উত্তর :
প্রথমে শাসকের বিষয়ে আমরা বলবো, আমরা সাধারণত আমাদের আলোচনায় শরিয়াহর বিধান ও তার নীতি আলোচনা করি। আর নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর তার প্রয়োগ ঘটানোÑ এটা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমরা পূর্বে বারবার আলোচনা করেছি যে, এ জামাআত তার সূচনাকাল থেকেই একটি নীতিকে অনিবার্যরূপে আকড়ে ধরে আছে। আর তা হচ্ছেÑ জামাআত নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে কখনও কোনো বিধান আরোপ করবে না; বরং তা কেবল কুরআনে কারিমের আয়াত ও হাদিসসমূহ পাঠ করে মানুষের সামনে শরিয়ার বিধান আলোচনা করবে, প্রয়োজনে প্রমাণস্বরূপ ফিকহ, অভিধান ও হাদিস শাস্ত্রের ইমামগণের মতামতও উল্লেখ করবে এবং সেই বিধান প্রয়োগের দায়িত্ব প্রত্যেক শ্রোতার ওপর ছেড়ে দিবে, যেহেতু প্রত্যেকে নিজের ব্যাপারে সবচেয়ে ভালো জানে।
আমরা বারংবার বলেছি যে, আমরা হচ্ছি দাঈ, বিচারক নই। অতএব, শাসকের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই কেন? এ প্রশ্ন করে প্রশ্নকারী যদি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে বিধান জানতে চান তাহলে তার এ কথা আমাদের নিকট প্রত্যাখ্যাত হবে। আর যদি এর দ্বারা ফিকহি মতামত জানতে চান তাহলে জবাবে আমরা বলবো, জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ ইমাম হাসান আল বান্নার পুস্তিকাগুলোতে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে আমরাও আমাদের আলোচনায় এ সম্পর্কে ফকিহগণের মতামত উল্লেখ করেছি এবং ইখওয়ানুল মুসলিমিন তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ফকিহগণের সেই বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছে।
আর জামাআতের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সংক্ষেপে বলবো, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ .
তোমাদের মধ্য থেকে একটি দল যেন এমন থাকে, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান : ১০৪ )
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ.
তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানব জাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎকাজের নির্দেশ প্রদান কর, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহর প্রতি বিশ^াস কর। (সূরা আলে ইমরান : ১১০)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ.
তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করবে না। (সূরা মায়িদা : ২)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ.
যদি মুমিনদের দুই দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে, আর তাদের একদল অপর দলের বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন করলে যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। (সূরা হুজুরাত : ৯)
রাসূল সা. বলেন,
من رأى منكم منكرا فليغيره بيده، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه، وذلك أضعف الإيمان.
তোমাদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় দেখবে সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। তা যদি না পারে তাহলে তার মুখের ভাষা দ্বারা। তাও যদি না পারে তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে, আর এটি হচ্ছে ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। (সহিহ মুসলিম : ৪৯)
অন্যত্র তিনি বলেন,
لتأمرن بِالْمَعْرُوفِ ولتنهون عَن الْمُنكر أَو ليعمنكم الله بِعَذَاب من عِنْده.
তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে, নতুবা আল্লাহ তোমাদের সবাইকে স্বীয় শাস্তি দ্বারা ঢেকে নিবেন।
(আল—ফিসাল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল, ইবনু হাযম : পৃ. ১৭৭)
অন্যত্র নবীজি সা. বলেন,
ما من نبي بعثه الله في أمة قبلي إلا كان له من أمته حواريون وأصحاب يأخذون بسنته ويقتدون بأمره، ثم إنها تخلف من بعدهم خلوف يقولون ما لا يفعلون، ويفعلون ما لا يؤمرون، فمن جاهدهم بيده فهو مؤمن، ومن جاهدهم بلسانه فهو مؤمن، ومن جاهدهم بقلبه، فهو مؤمن، وليس وراء ذلك من الإيمان حبة خردل.
আল্লাহ আমার পূর্বে যত নবীকেই তার উম্মতের কাছে প্রেরণ করেছেন, উম্মতের মধ্য থেকে সেই নবীর কিছু অনুসারী ও সহচর তৈরি হয়েছে। যারা তার সুন্নাতকে আকড়ে ধরতো এবং তার আদেশের অনুসরণ করতো। অতঃপর তাদের পরে এমন এক প্রজন্মের আগমন হতো যারা এমন কথা বলতো, যা তারা করতো না এবং এমন কাজ করতো তাদেরকে যার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং যে ব্যক্তি স্বীয় হাত দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সে মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় জিহ্বা দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তর দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন। এরপর ঈমানের সরিষা পরিমাণ দানাও অবশিষ্ট নেই। (আল—মুহাল্লা : খ. ৬, পৃ. ৩৬০)
অতএব, আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ ও জীবন বিধানকে বাতিল প্রতিপন্ন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশের বিপরীত মানুষকে শাসন করা ও তাদের মধ্যে বিধান বাস্তবায়ন করার চেয়ে বড় জুলুম আর কি হতে পারে?!!
এমনিভাবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশসমূহ ও শরিয়াহকে যমিনে বাস্তবায়ন, তাঁর দীন প্রতিষ্ঠা এবং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য জিহাদ করার চেয়ে বড় নেকির কাজ আর কী হতে পারে, আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে যে কাজে সহযোগিতা করা আবশ্যক! এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ইখওয়ানুল মুসলিমিন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রতিটি মুসলিমের ওপর এটি ওয়াজিব ও আবিশ্যক দায়িত্ব। আর ব্যক্তিগতভাবে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব নয়। এ জন্য এ মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জামাআতবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আর যে ব্যক্তি এ জাতীয় জামাআতের সাথে যুক্ত হওয়া এবং তার সাথে মিলে কাজ করা থেকে নিজেকে পিছিয়ে রাখবে সে ফরয বা শরিয়াহর অন্যান্য আবশ্যিক বিধান বর্জনের মতই গোনাহগার হবে। তবে আমরা এ কথা বলবো না যে, এ গোনাহের কারণে সে মুসলিম মিল্লাত থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ বাস্তবায়ন ও তাঁর বিধান যমিনে প্রতিষ্ঠা করাÑ এ লক্ষ্যকে অস্বীকার করে তাহলে সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : ৫।
বলপ্রয়োগ (الإكراه)—এর মাসআলা সম্পর্কিত একটি পয়েন্ট স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, কেউ কেউ মনে করেনÑ নিরুপায় অবস্থায় রুখসাত (অবকাশ) গ্রহণ করা সঙ্গত নয়, যাতে করে ঐ দলও এর সাথে একাত্ম হয় যারা দাওয়াতের গুরুভার বহন করতে চায়।
উত্তর :
আমরা পূর্বের আলোচনায় বলপ্রয়োগ সম্পর্কিত যাবতীয় নস (পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য) পেশ করেছি। তাছাড়া অনেক ফকিহ—এর মতামতও পেশ করেছি, যাতে করে এর দ্বারা সংশ্লিষ্ট আলোচনা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। যেহেতু আমরা দেখেছিÑ কিছু লোক শরিয়াহর বিধান সম্পর্কে ভালো করে জানে না এবং সামান্য সুযোগ পেয়ে অন্যদেরকে অকপটে কুফরের অভিযোগে অভিযুক্ত করছে। এ কারণে আমরা রুখসাত বা অবকাশ গ্রহণের বিধান প্রমাণ করেছি এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ.
নিশ্চয় আমি যেসব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পরও যারা তা গোপন রাখে আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিশাপকারীগণও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। (সূরা বাকারা : ১৫৯)
তাছাড়া আমরা বিশ^াস করিÑ দীনের মধ্যে এমন কোনো গোপন ভেদ নেই, যা কারও থেকে গোপন করা হয়। বরং শরিয়াহর বিধানাবলি সকলের সামনে বর্ণনা করা আবশ্যক; যাতে করে প্রত্যেক ব্যক্তি বুঝে শুনে আমল করতে পারে।
আমরা আরও বিশ^াস করিÑ সাধারণ অবস্থায় রুখসাত (অবকাশ) গ্রহণ করা সঙ্গত নয়; যাতে করে ঐ সকল লোকেরা এর সাথে একত্মতা পোষণ করে, যারা দাওয়াতের গুরুভার বহন করতে চায়। শহিদ ইমাম ইখওয়ানের উদ্দেশ্যে লিখিত তার পত্রসমূহে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
আমরা আমাদের আলোচনায় বলেছিÑ আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হকের কালিমা সমুন্নত করা, তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়, জুলুম ও সীমালঙ্ঘনের কাজে ধৈর্য ধারণ ও অবিচল থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর এ পথের কর্মীদের জন্য তিনি উত্তম প্রতিদান ও জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদার ঘোষণা করেছেন।
বাস্তবতা হচ্ছে, জগতের নিয়ম হলোÑ যেকোনো দাওয়াত ও উম্মতকে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য করা হয় এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ঐ সকল লোকদের অসিলায় আল্লাহ তাআলা তাঁর সত্যবাদী, ধৈর্যশীল ও অবিচল বান্দাদের মধ্য হতে আপন দয়া ও অনুগ্রহে যাদেরকে নিয়োজিত করেন, যারা ইহকালের বিনিময়ে পরকাল ক্রয় করে এবং প্রত্যেক কথা ও কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, সত্যের পথে কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারের পরোয়া করে না এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সম্পদ ও সম্মান হারানোরও ভয় করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ.
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। (সূরা তাওবা : ১১১)
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন,
الَّذِينَ يُبَلِّغُونَ رِسَالَاتِ اللَّهِ وَيَخْشَوْنَهُ وَلَا يَخْشَوْنَ أَحَدًا إِلَّا اللَّهَ وَكَفَى بِاللَّهِ حَسِيبًا.
তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করতো এবং তাঁকে ভয় করতো, আর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করতো না। আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আহযাব : ৩৯)
আমাদের দলের লোকজন আযিমত (শরিয়াহর দৃঢ়তামূলক বিধান)—এর ওপর একাত্ম হয়েছেন। আল্লাহর সাহায্যে আমরা এ মতই পোষণ করি এবং আমাদের ভাইদেরকে পরামর্শ দেইÑ তারা যেন আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করে এ নীতিকে আবশ্যিক রূপে গ্রহণ করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য :
এ আলোচনা কোনো সাধারণ নীতি নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু চিন্তা ও মতবাদের খণ্ডনের জন্যই তা উল্লেখ করা হয়েছে। কাজেই এর ভিত্তিতে কেউ যেন এ উপসংহারে না পেঁৗছে যে, তিনি তো রুখসাত বা অবকাশ গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
প্রশ্ন : ৬।
জামাআতবদ্ধ থাকা এবং ইমামের হাতে বায়আত গ্রহণ করা, এ বিষয়টি অস্পষ্ট মনে হচ্ছে এবং তা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করছে। যেমনÑ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউস রা. সূত্রে একটি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে : “তিনটি ন্যায়সঙ্গত কারণ ছাড়া কোনো মুসলিমের রক্তপাত ঘটানো কারও জন্য বৈধ হবে না। সে কারণগুলোর একটি হলো, দীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং মুসলিমদের জামাআতকে বর্জন করা।” অপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে :
من مات وليس في عنقه بيعة مات ميتة جاهلية.
“যে ব্যক্তির মৃত্যু এমন অবস্থায় হলো যখন তাঁর কাঁধে বায়আত নেই, তাহলে তার মৃত্যু যেন জাহেলিয়াতের ওপর হলো।” অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে :
من خرج من الجماعة قيد شبر فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه إلا أن يرجع.
যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণও জামাআত থেকে বেরিয়ে গেল সে তাঁর ঘাড় থেকে ইসলামের বন্ধনকে খুলে ফেললো, যদি না সে আবার ফিরে আসে।
এ জাতীয় হাদিসের ভিত্তিতে কেউ কেউ প্রশ্ন করে, কোনো মুসলিমের জন্য কি জামাআত ছাড়া থাকা সহিহ হবে? যে ব্যক্তি জামাআত থেকে বেরিয়ে গেল সে কি মুসলিম মিল্লাত থেকেও বেরিয়ে গেল? আবার অনেকে এমন প্রশ্নও করে যে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন সংস্থা বা সংগঠনের সাথে মিলে কাজ করে, যার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে যে, তা ইসলামের সিদ্ধান্তের বিপরীত কাজ করে অথবা তা মুসলিম জামাআতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কাজ করে তাহলে ঐ ব্যক্তিকে কি মুসলিম হিসেবে গণ্য করা হবে?
উত্তর :
আমরা আমাদের আলোচনায় যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছি তা হলো, যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে যুক্ত থাকা এবং বায়আত প্রদান করার আবশ্যিকতা সম্পর্কে অজ্ঞ তার বিধান কী? যে ব্যক্তি বায়আতের অর্থ ও জামাআতের সাথে যুক্ত থাকার আবশ্যিকতার বিরোধিতা করবে অথবা স্বয়ং জামাআতের অর্থকে অস্বীকার করবে তার বিধান কী? আর আমরা কখনও এটাকে জায়েয মনে করি না যে, আমাদের দলভুলক্ত নয় এমন কাউকে কাফের বলে অভিযুক্ত করবো, যদি না তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ও নিশ্চিতরূপে কাফের হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়।
আমরা পূর্বে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা কতৃর্ক প্রণীত মূলনীতি উল্লেখ করেছি, যা ‘রিসালাতুত তালালিম’ গ্রন্থের বিশতম অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে। এমনিভাবে আমরা আরও স্পষ্ট করেছিÑ ইখওয়ানুল মুসলিমিন এ নীতিকে আবিশ্যকরূপে গ্রহণ করেছে যে, তা শুধু শরয়ি বিধান আলোচনা করবে। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির ওপর বিধান প্রয়োগের জন্য নিজেকে কখনও বিচারকের আসনে বসাবে না।
বিষয়টিকে অধিক স্পষ্ট করার স্বার্থে আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, প্রশ্নে বর্ণিত হাদিসে যে জামাআতের কথা বলা হয়েছে তা নির্দিষ্টকারক ‘আলিফ—লাম’ অব্যয়ের সাথে যুক্ত। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, উল্লেখিত জামাআত দ্বারা নির্দিষ্ট জামাআত উদ্দেশ্য। অতএব, এর দ্বারা যেকোনো মুসলিম জামাআত উদ্দেশ্য নেওয়া সঠিক হবে না। বরং তা দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্দিষ্ট জামাআত, যার জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট শতার্বলি ও বিধান।
তবে এ জামাআতের ব্যাখ্যা, তার শর্তাবলি, বিধান ও বায়আতের অর্থ এবং যে ব্যক্তি বায়আত প্রদান করবে না, এসব বিষয় সম্পর্কে ফকিহগণের মধ্যে অনেক মতভেদ রয়েছে।
এ বিষয়টি স্বীকৃত যে, ইখওয়ানুল মুসলিমিন পরিপূর্ণ বিশ^াসের সাথে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইখওয়ানের দাওয়াত খাঁটি সত্য, আল্লাহ তাআলা এ দাওয়াতের ব্যাপারে ওয়াজিব ও আবশ্যিকরূপে আদেশ করেছেন। আমরা এ বিষয়টিও জোর তাগিদের সাথে বলবো যে, ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা এ জামাআতকে হাদিসে উদ্দিষ্ট মুসলিম জামাআত বলে মনে করতেন না; বরং আল্লাহর অশেষ কৃপায় এ জামাআত তো সেই উদ্দিষ্ট মুসলিম জামাআতকে বাস্তবে রূপদানের জন্য মানুষকে দাওয়াত প্রদান করে।
এর সমর্থন হয় এ কথা দ্বারা যে, ইখওয়ানুল মুসলিমিনের প্রতিষ্ঠাতা এ দলের নেতৃত্বদান কালীন দীর্ঘ সময় জুড়ে এবং যারা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার পাশে জড়ো হয়েছেন এবং তার কাজে সহযোগী হয়েছেন সকলেই অন্যান্য মুসলিম দলগুলোকে স্বীকৃতি দিতেন। যেমনিভাবে কেউ ইখওয়ানুল মুসলিমিনের সাথে যুক্ত না হলে বা যুক্ত হওয়ার পর তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তাকে মুসলিম হিসেবে স্বীকার করতেন।
শহিদ ইমাম এ জামাআতের প্রথম সারির কয়েকজন মুখপাত্র এবং তাদের ছাড়াও দশোধিক ব্যক্তিকে [যাদের অনেকেই ছিলেন উপদেষ্টা কমিটি ও গণপরিষদের সদস্য] বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অথচ তিনি তাদের কারও ব্যাপারে এমন বলেননি যে, সে এমন কথা বলেছে বা এমন কাজ করেছে যার দ্বারা সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে গেছে। এছাড়া তাদের কেউ নিজের ব্যাপারে এমন ধারণা করেননি যে, সে দল থেকে সদস্যপদ হারানোর কারণে ইসলাম থেকেই বেরিয়ে গেছে।
এমনকি শহিদ ইমামের পর উপদেষ্টা কমিটি ও গণপরিষদ—ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জামাআতের সদস্যকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যাদের কেউ কেউ একাধিকবার উপদেষ্টা কমিটি এর সদস্য ছিলেন। এমনকি তাদের কেউ কেউ জামাআতের প্রধান কেন্দ্র ও সংস্থাসমূহের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ বিষয়ে জামাআতের কেন্দ্র থেকে স্পষ্ট বক্তব্য ছিলÑ
“যাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে, তারা মুসলিম এবং তাদের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষিত। জামাআত তাদের ব্যাপারে আশাবাদীÑ তারা তাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্ট ও বিশেষ নীতিতে ইসলামের খিদমত করে যাবেন; যদিও জামাআতের নিয়ম—শৃঙ্খলা, নীতি আদর্শ ও কার্যক্রমের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে গিয়েছিল।”
ইখওয়ানুল মুসলিমিনের উদ্দেশ্যে পঞ্চম সম্মেলনের বার্তায় শহিদ ইমাম বলেন,
“এ আলোচনার পরিপূরক হিসেবে আমরা খিলাফত এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের অবস্থান ব্যক্ত করতে চাই। ইখওয়ান বিশ^াস করেÑ খেলাফত হলো ইসলামি ঐক্যের প্রতীক। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। এটি হচ্ছে ইসলামের অন্যতম নিদর্শন, মুসলিমদের এ বিষয়ে চিন্তা করতে হবে এবং গুরুত্বের সাথে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। ইমাম নিযুক্তকরণ ও ইসলামি হুকুমাতের বিধানাবলির বর্ণনাÑ এ সম্পর্কে যেসকল হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখেনি যে, মুসলিমদের কর্তব্য হচ্ছে, খেলাফতের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা, যখন থেকে তাকে বিকৃত করা হয়েছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত যাকে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এজন্য ইখওয়ানুল মুসলিমিন খেলাফতের বিষয়ে চিন্তা—ভাবনা করা এবং তা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা করাকে তাদের কার্যক্রমের প্রধান অংশ হিসেবে স্থির করেছে। সেই সাথে তারা বিশ^াস করেÑ তার জন্য অনেক পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। এমনকি খেলাফত পুনরুদ্ধারের জন্য যে সরাসরি পদক্ষেপসমূহ রয়েছে তার পূর্বে অনেক প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।”
আর ‘কোনো মুসলিমের জন্য কি জামাআত ছাড়া থাকা সহিহ হবে?’ এ প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো,
পূর্বে আমরা বলেছিÑ হাদিসে জামাআত দ্বারা যেকোনো জামাআত উদ্দেশ্য নয়। বরং তার দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি বিশেষ জামাআত, যার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট শর্তাবলি ও বিধান। অতএব, যদি কোনো জামাআতের মধ্যে ঐ সকল শর্তাবলি ও বিধান পাওয়া যায় এবং ব্যক্তির বিশ^াস হয় যে, এটিই হাদিসে উদ্দিষ্ট জামাআত তাহলে তার জন্য সেই জামাআতে অংশগ্রহণ করা এবং তাদের সাথে মিলে কাজ করা আবশ্যক; যদিও তার ব্যক্তিগত বিশ^াস অন্যদের ব্যাপারে দলিল হবে না, যারা সেই জামাআত সম্পর্কে তার চিন্তা—ভাবনার সাথে একমত নয়।
যাই হোক, মূল কথা হলো, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে তাঁর বিধান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে পুণ্য ও তাকওয়ার কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করার আদেশ করেছেন। কারণ, শরিয়াহর কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জামাআতবদ্ধ হয়ে কাজ করা জরুরি। তাছাড়া এটি আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে পারস্পরিক সহযোগিতার আদেশ করেছেন তার অপরিহার্য দাবি। পূর্বে আমরা আলোচনা করেছি, হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে যে, মুসলিমদের ওপর একটি সময় এমন আসবে যখন তাদের মধ্যে জামাআত বা বৃহৎ ঐক্য থাকবে না, তাদের থাকবে না কোনো ইমাম। কিন্তু এ কারণে তাদের থেকে ইসলামের বৈশিষ্ট্য দূর হবে না; যদিও এ বিষয়টি স্বভাবতই তাদেরকে বৃহৎ মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইমাম নিযুক্ত করার ফরয বিধান থেকে অব্যাহতি দিবে না।
আর যে ব্যক্তি এমন সংগঠন বা সংস্থায় কাজ করে যা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত সেও মূলত কাফেরদের সহযোগী। তার ব্যাপারে আল্লাহর কোনো দায় নেই। এটি একটি সাধারণ মূলনীতি। তবে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর এর প্রয়োগের জন্য বিষয়টি ভালো করে যাচাই—বাছাই ও বিশ্লেষণ করতে হবে, যা শাসন ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের জন্য সহজ নয়। এ বিধান তখন যদি সেই সংগঠনটি ইসলাম থেকে পরিপূর্ণরূপে বিমুখতার ঘোষণা না করে। কিন্তু যদি সংগঠনটি প্রকাশে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে এবং যে কারও কাছেই এ বিষয়ে কোনো অষ্পষ্টতা থাকে না যে, সংগঠনটি ইসলাম থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে তাহলে সেক্ষেত্রে যাচাই—বাছাই ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে না। আমরা আবারও পূর্বের কথার পুনরাবৃত্তি করছি যে, “আমরা দাঈ, বিচারক নই।”
প্রশ্ন : ৭।
বর্তমানে মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত শরিয়াহ থেকে দূরে সরে গেছে। মানুষের বাহ্যিক অবস্থাই এর বাস্তব সাক্ষী। এর অর্থ কি এ নয় যে, তাদের বিশ^াসে ত্রুটি রয়েছে? কারণ, ঈমানের দলিল হলো, তার দাবি অনুযায়ী আমল করা। এ মতের প্রবক্তা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও দলিল পেশ করেন :
وَلَوْ كَانُوا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالنَّبِيِّ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مَا اتَّخَذُوهُمْ أَوْلِيَاءَ.
“যদি তারা আল্লাহ, নবী এবং তাঁর প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান আনতো তাহলে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো না।” (সূরা মায়িদা : ৮১) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করাকে তাদের ঈমান না থাকার দলিল হিসেবে স্থির করেছেন।
উত্তর :
আল্লাহর সাহায্যে আমরা বলবো, যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া হয় যে, শরিয়াহর বিধান অমান্য করা বা তার থেকে দূরে সরে যাওয়া সেই অমান্যকারীর বিশ^াসে ত্রুটি থাকার দলিল, তারপরও আমরা বলবো, আমরা নিজেদের মনমত সেই অমান্যকারীর ওপর বিধান প্রয়োগ করতে পারবো না। বরং আল্লাহ তাআলা যে কাজের ব্যাপারে এ বিধান দিয়েছেন যে, শরিয়াহর এ হুকুম অমান্য করা ব্যক্তির ঈমানের ত্রুটি থাকার দলিল, এবং তা এত ভয়াবহ যে, তা ঐ ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বহিস্কার করে কাফের ও মুশরিক বানিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে আমরাও আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করবো। আর যে কাজের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার বিধান হলো, ঐ কাজের মাধ্যমে ব্যক্তি শরিয়াহর হুকুম অমান্যকারী হয় বটে, তবে সে ইসলাম থেকে বহিস্কার হয়ে কাফের ও মুরতাদ হয় না; বরং সে মুসলিম হিসেবে বহাল থাকে, সেক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করা আমাদের জন্য আবশ্যক।
আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করে আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিধান উদ্ভাবন করা কিছুতেই আমাদের জন্য জায়েয হবে না। তারপরও যদি আমরা তাই করি তাহলে আমরাই হবো আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বিপরীত ফসয়াসলাকারী।
হুবহু একই পার্থক্য হলো দুই প্রকারের গোনাহের মধ্যে। এক প্রকার হলো, যা তার কর্তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কার করে কাফের বানিয়ে দেয় না, আরেক প্রকার হলো, এমন গোনাহ যা তার কর্তাকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বহিস্কার করে কাফের ও মুরতাদ বানিয়ে দেয়। পূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং সেখানে এ কথা স্পষ্টরূপে বিবৃত হয়েছে যে, এ জাতীয় বিধান ব্যক্তি বিশেষের ওপর প্রয়োগ হবে, ব্যাপকভাবে সমগ্র মানুষের ওপর নয়।
***
সমাপ্ত, আলহামদুলিল্লাহ।
